Logo
Logo
×

বাতায়ন

মাধ্যমিকে কোডিং শেখার গুরুত্ব

Icon

মো. হাসান-উল-বারী

প্রকাশ: ২৫ জুলাই ২০২৪, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

মাধ্যমিকে কোডিং শেখার গুরুত্ব

প্রতীকী ছবি

প্রযুক্তির দুনিয়ায় বর্তমানে চর্চার কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠেছে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স। শুধু চর্চা নয়, বেড়েছে ব্যবহারও। মানবসভ্যতার উন্নয়নে এ প্রযুক্তি কীভাবে কাজে লাগানো যায়, তা নিয়ে দিনরাত চলছে গবেষণা। আর সেই কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তারই প্রবেশ ঘটেছে শিক্ষাক্ষেত্রেও। সেটা ভালো কি মন্দ, তা নিয়ে অনেক বিতর্ক হচ্ছে। তবুও এটা নির্দ্বিধায় বলা যায়, তথ্যপ্রযুক্তিনির্ভর একটি বিশ্ব আমাদের তৈরি হবে। আর সেই বিশ্বে পদচারণা করবে আজকের দিনের নতুন প্রজন্মরা-আমার আপনার সন্তান। সে বিশ্বে আমাদের সন্তান কেমন করবে, তা অনেকটাই নির্ভর করবে তার ‘তথ্যপ্রযুক্তি জ্ঞানের’ ওপর। তাই বর্তমান বিশ্বের অভিভাবকরা চাচ্ছেন, তাদের সন্তান যেন ছোট থেকেই তথ্যপ্রযুক্তির ওপর বেসিক কিছু জ্ঞান অর্জন করে। তথ্যপ্রযুক্তি বলতে শুধু ফেসবুককে বুঝলে মারাত্মক ভুল হবে। এটি একটি অ্যাপ মাত্র। ফেসবুক, ইউটিউব, টুইটার, লিংক্ডইন, ইনস্টাগ্রাম, হুয়াট্সঅ্যাপ, গুগল-এসব অ্যাপ ও প্ল্যাটফরমের পেছনে রয়েছে তথ্যপ্রযুক্তির বিশাল কর্মযজ্ঞ। সেখানে কাজ করছেন লক্ষাধিক প্রযুক্তিবিদ। এসব প্ল্যাটফরমে তথ্যকে সহজেই প্রদর্শন করার জন্য ‘কম্পিউটার প্রোগ্রামিং ল্যাঙ্গুয়েজ’ বা কোডিং ব্যবহার করেন প্রযুক্তিবিদরা।

আমরা যদি আমাদের শিশু-কিশোরদের একাডেমিক সাফল্য ও স্মার্ট করতে চাই, তাহলে প্রতিটি শিশুকে কোডিং শেখাতে হবে। বাচ্চাদের জন্য কোডিং শুধু তাদের গণিত এবং লেখার দক্ষতা উন্নত করতে সাহায্য করে না, বরং পরবর্তী সময়ে তাদের কর্মজীবনে দক্ষতার নতুন মাত্রা যোগ করবে। কেন কোডিং শেখা গুরুত্বপূর্ণ এবং কেন ছোটবেলা থেকেই স্কুলে কোডিং শেখানো উচিত, তার বিভিন্ন কারণ রয়েছে। শিশু যত তাড়াতাড়ি কোডিং করতে শিখবে, তাদের সাফল্য অর্জনের সুযোগ তত দ্রুত ধরা দেবে।

আধুনিক বিশ্বে নিজেদের এগিয়ে নিতে গণিত, বিজ্ঞানের পাশাপাশি প্রোগ্রামিং ও কোডিং শিক্ষা গ্রহণ করতে হবে। বঙ্গবন্ধুর বৈষম্যমুক্ত সোনার বাংলা গড়তে হলে সোনার মানুষ দরকার, যা কি না শিক্ষার আলোয় আলোকিত করার মাধ্যমে সম্ভব।

২০৪১ সালের মধ্যে স্মার্ট বাংলাদেশের স্মার্ট সিটিজেন তৈরি করতে শিক্ষার্থীদের সমস্যা সমাধানে দক্ষ করে গড়ে তোলা অপরিহার্য। বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে শিক্ষার্থীদের মধ্যে ডিজিটাল দক্ষতা উন্নয়ন ও সমস্যা সমাধানে আগ্রহী করে গড়ে তুলতে গত ৬-৮ ফেব্রুয়ারি প্রতিদিন এক ঘণ্টার কোডিং ক্যাম্পেইন আওয়ার অব কোড দেশব্যাপী সব মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পরিচালনা করা হয়। ক্যাম্পেইনে অংশগ্রহণ করা শিক্ষার্থীরা অত্যন্ত আনন্দসহকারে কোডিং আওয়ার শেষ করেছে এবং কম্পিউটার জেনারেটেড সনদ গ্রহণ করেছে। ওই ক্যাম্পেইন পরিচালনা করা হয় ‘কিশোর বাতায়ন’ অনলাইন প্ল্যাটফরম থেকে, যেটি সরকার এটুআই-এর সহযোগিতায় বেশ কয়েক বছর আগেই স্কুল শিক্ষার্থীদের উপযোগী করে তৈরি করেছে। ‘ভবিষ্যতের জন্য নিজেকে প্রস্তুত করে তোলো’ স্লোগান সামনে রেখে কিশোর বাতায়নের হাত ধরে আমাদের স্কুল শিক্ষার্থীরা ‘কিশোর বাতায়ন’ প্ল্যাটফরম থেকে আমার স্কুল, বইসমূহ, জীবন দক্ষতা, ক্যারিয়ার দক্ষতা ইত্যাদি বিষয় অনলাইনে শিখতে পারবে। উল্লেখ্য, শুধু জীবন দক্ষতা বিষয়ের ওপর কিশোর বাতায়নে ১৯৩টি কনটেন্ট রয়েছে।

অভিভাবক থেকে শুরু করে সহকর্মী সবার একই প্রশ্ন-শিশু-কিশোরদের কোডিং শিখতে হবে কেন? এ কোডিং শিখে কী লাভ? এটি শিখে কি তারা কম্পিউটার বিজ্ঞানী হবে? নাকি সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার হবে? সেটা যদি না হয়, তাহলে কোডিং শিখবে কেন? যৌক্তিক প্রশ্ন। কোনো কিছু শেখার আগে কেন শিখছি, সেটি জানা খুবই জরুরি। প্রচলিত ধারণায় প্রোগ্রামিং শুধু কম্পিউটারের ভাষা, এটি দিয়ে কম্পিউটারকে নির্দেশ দেওয়া হয়। প্রকৃত অর্থে সেটি প্রোগ্রামিংয়ের প্রথম ধাপ নয়। প্রোগ্রামিং আসলে সমস্যা সমাধান (প্রবলেম সলভিং) এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণ (ডিসিশন মেকিং) করতে শেখায়। প্রতিদিন, প্রতিনিয়ত আমরা সমস্যার সমাধান করে চলেছি। আমরা সেটি সবসময় আসলে খেয়াল করছি না।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তথ্যপ্রযুক্তি ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক ড. বিএম মইনুল হোসেনের উদাহরণ টেনে বলা যাক, অফিসে যাওয়ার জন্য রিকশা নেব নাকি উবার বা পাঠাও থেকে কার বা বাইক নেব, নাকি পাবলিক বাসে যাব, এটি একটি সমস্যা। এ সমস্যা সমাধানের জন্য আমাদের অনেক বিষয় বিবেচনা করে তারপর সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে হয়। উদ্দেশ্য যদি হয় কম খরচে যাওয়া, তাহলে রিকশা নেওয়া যেতে পারে। অন্যদিকে খরচের কথা চিন্তা না করে যদি দ্রুত যাওয়াই হয় প্রধান উদ্দেশ্য, তাহলে পাঠাও নেওয়া যায়। আর যদি উদ্দেশ্য হয় কম খরচে তুলনামূলকভাবে দ্রুত গন্তব্যে পৌঁছানো, তাহলে পাবলিক বাস নেওয়াটা হবে সঠিক সিদ্ধান্ত।

কোডিং মানে শুধু কম্পিউটারের সামনে মাউস, কীবোর্ড নিয়ে বসে থাকা নয়। আগে সমস্যা সমাধানের জন্য সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে হবে। আর এ সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্য উপরের উদাহরণের মতোই প্রয়োজন হয় যৌক্তিক ও বিশ্লেষণধর্মী চিন্তার। এ যৌক্তিক চিন্তার মাধ্যমে সমস্যার সমাধান করা গেলে তারপর প্রশ্ন আসবে সেই সমাধান কম্পিউটারে প্রয়োগ করব নাকি বাস্তব জীবনে প্রয়োগ করব। অর্থাৎ এ সমস্যা সমাধানের দক্ষতা অর্জনের পর সেটি কাজে লাগানোর জন্য তাকে যে ভবিষ্যতে কম্পিউটার বিজ্ঞানী বা সফটওয়্যার প্রকৌশলী হতে হবে, এমন কোনো কথা নেই। জীবনে চলার পথে অসংখ্য সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে সহায়তা করবে এ সমস্যা সমাধানের দক্ষতা ও কৌশল। কাজেই যৌক্তিক চিন্তাভাবনার জন্য প্রোগ্রামিং শিখতে হবে। যদি কেউ প্রোগ্রামিং বা কোডিং জানে, তাহলে তার কাছে পৃথিবীর কোনো কাজই কঠিন হবে না।

কোডিং শেখার অনেক কারণ আছে, যার কয়েকটি হলো-১. কোডিং সমস্যা সমাধানে দক্ষ করে তোলে, ২. কোডিং চিন্তা করতে শেখায়, ৩. একাডেমিক কর্মক্ষমতা উন্নত করে, ৪. কোডিং সৃজনশীলতা বাড়ায়, ৫. ভালো কম্পিউটার প্রোগ্রামার হওয়ার সম্ভাবনা সৃষ্টি করে, ৬. সফটওয়্যার শিল্পে দক্ষতার অভাব দূর করে, ৭. কোডিং শিশুদের গণিত শেখা আনন্দদায়ক করে তোলে, ৮. কোডিং শিক্ষার্থীদের মধ্যে আত্মবিশ্বাস তৈরি করে।

পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে এবার ষষ্ঠ শ্রেণি থেকেই সিবিএসই বোর্ডের সিলেবাসে এসেছে আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স। সিবিএসই বোর্ডের ষষ্ঠ থেকে অষ্টম শ্রেণির সিলেবাসে এবার পড়ানো হবে এআই ও কোডিং। নতুন শিক্ষানীতির আওতায় সিলেবাসে নতুন বেশকিছু বিষয় অন্তর্ভুক্ত করেছে সেন্ট্রাল বোর্ড অফ সেকেন্ডারি এডুকেশন (সিবিএসই)। এর মধ্যে রয়েছে এআই, কোডিংসহ আরও ৩৩টি বিষয়। যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে শিক্ষাব্যবস্থাকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্যই সিলেবাসের পরিবর্তন করেছে সিবিএসই বোর্ড। সেক্ষেত্রে বৃত্তিমূলক পঠন-পাঠনের পাশাপাশি দক্ষতা উন্নয়নের প্রশিক্ষণের দিকে জোর দিতে এআই কিংবা কোডিংয়ের মতো বেশকিছু বিষয় সিলেবাসে জুড়েছে সিবিএসই বোর্ড। আর কী কী বিষয় আসতে চলেছে সিবিএসইর সিলেবাসে? সংশ্লিষ্ট বোর্ড সূত্রের খবর-কোডিং ও এআই ছাড়াও ডেটা সায়েন্স, কাশ্মীরি এমব্রয়ডারি, স্যাটেলাইট অ্যাপ্লিকেশন স্টাডি, অগমেন্টেড রিয়েলিটিসহ (এআর) মোট ৩৩টি নতুন বিষয় পড়ানো হবে সিবিএসই বোর্ডের স্কুলে। যদিও এতদিন এআই ও কোডিং শুধু নবম ও দশম শ্রেণিতেই পড়ানো হতো। কিন্তু নতুন নিয়ম অনুযায়ী, এবার ষষ্ঠ থেকে অষ্টম শ্রেণির পড়ুয়ারাও পড়বে প্রযুক্তির হরেক বিষয়। সিবিএসই বোর্ডের তরফে জানানো হয়েছে, নতুন বিষয়গুলোর ওপর প্র্যাকটিক্যাল ক্লাসও করতে পারবেন ছাত্রছাত্রীরা। সেক্ষেত্রে পড়ুয়ারা খাতা-কলমে শিখবে মাত্র ৩০ শতাংশ এবং বাকি ৭০ শতাংশই তাদের স্কুলের তরফে প্র্যাকটিক্যালে শেখানো হবে। ২০২০ সালে জাতীয় শিক্ষানীতির পরিবর্তন করার সিদ্ধান্ত নেয় ভারতের কেন্দ্রীয় শিক্ষামন্ত্রক। সংশ্লিষ্ট নীতিতে স্কুলের শিক্ষাব্যবস্থায় কারিগরি শিক্ষার ওপর জোর দেওয়ার কথা বলা হয়েছিল। সে পরিপ্রেক্ষিতেই সিলেবাসে আমূল পরিবর্তন আনা হয়েছে। উল্লেখ্য, গত শিক্ষাবর্ষ থেকেই পশ্চিমবঙ্গ সরকারের অধীনস্থ স্কুলগুলোতে উচ্চমাধ্যমিকের সিলেবাসে পড়ানো হচ্ছে আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স এবং ডেটা সায়েন্স।

নতুন কারিকুলাম অনুযায়ী প্রাথমিক শিক্ষায় স্ক্র্যাচ প্রোগ্রামিং তৃতীয় শ্রেণি থেকে পঞ্চম শ্রেণিতে যুক্ত করা হয়েছে। যদিও বাস্তবে এ বছর প্রাথমিকের সিলেবাসে স্ক্র্যাচ প্রোগ্রামিং যুক্ত করা সম্ভব হয়ে ওঠেনি। তবে দেরিতে হলেও বর্তমান সরকার চলতি শিক্ষাবর্ষ থেকে মাধ্যমিকের সিলেবাসে অর্থাৎ অষ্টম ও নবম শ্রেণির ডিজিটাল প্রযুক্তি বিষয়ে পাইথন প্রোগ্রামিং ভাষা অন্তর্ভুক্ত করেছে, যেটি খুবই যুগোপযোগী। ইতোমধ্যে দেশব্যাপী মাধ্যমিকের সব আইসিটি শিক্ষককে কম্পিউটার প্রোগ্রামিং ও নেটওয়ার্কিং বিষয়ে প্রশিক্ষণ প্রদান করা হয়েছে। বিশিষ্ট লেখক ও শিক্ষাবিদ ড. মুহম্মদ জাফর ইকবাল বলেছেন, সবকিছুর মূল সমাধান লুকিয়ে আছে শিক্ষায়। যখনই কোনো সমস্যা হয়, আমি বলি, সর্বক্ষেত্রে শিক্ষা বিস্তার করো। এতেই সমাধান হয়ে যাবে। কাজেই ডিজিটাল বাংলাদেশকে স্মার্ট বাংলাদেশে রূপান্তরের প্রধান ভিত্তি হলো স্মার্ট সিটিজেন। আর স্মার্ট সিটিজেন তৈরির জন্য দরকার ডিজিটাল লিটারেসি ও কোডিং শিক্ষা।

সুতরাং বর্তমান বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে আমাদের শিক্ষকদের সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধিসহ পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণ প্রদান করে এদেশের শিক্ষার্থীদেরও এআই ও কোডিং শিক্ষা দিতে পারলে দেশ দ্রুত স্মার্ট বাংলাদেশে রূপান্তরিত হবে।

মো. হাসান-উল-বারী : শিক্ষক, মিলেনিয়াম স্কলাস্টিক স্কুল অ্যান্ড কলেজ, জাহাঙ্গীরাবাদ সেনানিবাস, বগুড়া

 

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : সাইফুল আলম

প্রকাশক : সালমা ইসলাম