Logo
Logo
×

বাতায়ন

বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ নিয়ে যত কথা

Icon

বিমল সরকার

প্রকাশ: ১৫ জুলাই ২০২৪, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ নিয়ে যত কথা

আমাদের দেশে ‘বিশ্ববিদ্যালয় কলেজে’র ধারণাটি নতুন নয়। স্বাধীনতা লাভের অব্যবহিত পর স্বনামখ্যাত শিক্ষাবিদ ও রাষ্ট্রবিজ্ঞানী অধ্যাপক ড. মোজাফফর আহমদ চৌধুরী কয়েকটি ঐতিহ্যবাহী কলেজকে ‘বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ’ হিসাবে গ্রহণ করে সেগুলোকে ডিগ্রি বা সনদপত্র প্রদানের ক্ষমতা দেওয়ার ওপর গুরুত্বারোপ করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক মোজাফফর আহমদ চৌধুরী (১৯২২-১৯৭৮) ‘ম্যাক’ নামে সমধিক পরিচিত। স্বাধীন দেশে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম উপাচার্য তিনি। ম্যাকের হাত দিয়েই ১৯৭৩ সালে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি) গঠিত হয়; তিনি প্রতিষ্ঠানটির প্রথম চেয়ারম্যান। পরবর্তীতে সরকারের শিক্ষামন্ত্রী।

১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে নয় মাসে পাকিস্তানি হানাদারবাহিনীর নজিরবিহীন তাণ্ডবে জাতির অর্থনৈতিক মেরুদণ্ডটি একেবারে ভেঙে পড়ে। অর্থনৈতিক ও সামাজিক অস্থিরতা বৃদ্ধি পায়। বোর্ড-বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে অনুষ্ঠিত বিভিন্ন পাবলিক পরীক্ষায় ব্যাপক হারে গণটোকাটুকি হয়। এতে পাশের হার অস্বাভাবিক বেড়ে যায়। ফলে স্বাধীনতার পর বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি সমস্যা প্রকট আকার ধারণ করে। সারা দেশে এ সময় বিশ্ববিদ্যালয়ই বা কটি! সাধারণের মধ্যে ৪টি : ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়। আর ছিল বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় ও বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়। এমন পরিস্থিতিতে শিক্ষা পরিবারের একজন দায়িত্বশীল অভিভাবক হিসাবে যেখানেই সুযোগ হয়েছে, মোজাফফর আহমদ চৌধুরী তার ‘বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ’ পরিকল্পনার কথা প্রকাশ, প্রচার ও ব্যাখ্যা করেছেন। ১৯৭২ সালের ১০ আগস্ট ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জগন্নাথ হলে ‘পূর্ব বাড়ি’ নামে পরিচিত নতুন ভবন উদ্বোধনকালে প্রদত্ত বক্তৃতায় উপাচার্য মোজাফফর আহমদ চৌধুরী বলেন, বিরাজমান অর্থনৈতিক পরিস্থিতিতে দেশে নতুন বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের ব্যয়ভার বহন করাটা যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশের সরকারের পক্ষে খুবই দুরূহ। কাজেই এইচএসসি উত্তীর্ণ শিক্ষার্থীদের ভর্তি সমস্যা সমাধান করতে হলে কয়েকটি ঐতিহ্যবাহী কলেজকে ‘বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ’ হিসাবে গ্রহণ করে, সেগুলোকে ডিগ্রি প্রদানের ক্ষমতা দেওয়া উচিত। এ ব্যবস্থা গ্রহণ করলে কালক্রমে অন্তত পাঁচ-সাত বছরের মধ্যে কলেজগুলো একেকটি পূর্ণাঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয় হিসাবে গড়ে উঠতে পারবে বলে অভিমত ব্যক্ত করেন তিনি। ‘বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ’ পরিকল্পনায় ইউরোপ-আমেরিকার মতো দেশে বিখ্যাত বা শিক্ষার মডেল হিসাবে বিবেচিত বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠার ইতিহাস হয়তো ম্যাকের মনে অনুপ্রেরণা জুগিয়েছিল।

এর অল্প দিন আগে শামসুন্নাহার হলের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে (জুলাই ১৯৭২) প্রদত্ত বক্তৃতায়ও তিনি একইভাবে বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ ঘোষণার অনুকূলে নিজের মতামত প্রকাশ করেন। বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ বিষয়টি যেন মোজাফফর আহমদের অনেকটা ধ্যান-জ্ঞান হয়ে ওঠে। এভাবে মূলত তার চেষ্টায় উদ্যোগটি খোদ সরকারের দৃষ্টিতে পড়ে এবং অনেকখানি এগিয়েও যায়। ১৯৭২ সালের ২২ আগস্ট মহান জাতীয় সংসদে অধ্যাপক মোজাফফর আহমদ চৌধুরীর ‘বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ’ প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে প্রদত্ত বক্তৃতায় শিক্ষামন্ত্রী অধ্যাপক ইউসূফ আলী জানান-এ ব্যাপারে ইতিবাচক চিন্তাভাবনা চলছে।

এ সময় বেশ কয়েকটি কলেজকে বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ হিসাবে বাছাই করা হয়। কলেজগুলোর নাম অবশ্য এক্ষণে আমার মনে নেই (অভিজ্ঞ ও বয়স্করা হয়তো বলতে পারবেন)। এরই মধ্যে ১৯৭৩ সালে গঠিত হয় বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি)। অধ্যাপক মোজাফফর আহমদ চৌধুরীকে উপাচার্য থেকে পদোন্নতি দিয়ে করা হয় নবগঠিত বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের চেয়ারম্যান। ইউজিসি চেয়ারম্যান হিসাবে টানা প্রায় ২২ মাস (১৪ এপ্রিল ১৯৭৩-২৫ জানুয়ারি ১৯৭৫) তিনি দায়িত্বে ছিলেন। দায়িত্বভার গ্রহণ করেই বাসস (বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থা)-এর সঙ্গে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি উচ্চশিক্ষার বিভিন্ন প্রসঙ্গ এবং বিশ্ববিদ্যালয় কলেজের প্রয়োজনীয়তার কথা বিশেষভাবে তুলে ধরেন। ম্যাক বলেন, উচ্চশিক্ষার চাহিদা মেটাতে দেশে আরও অন্তত ১৪টি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন দরকার; কিন্তু সে সামর্থ্য এক্ষণে আমাদের সরকারের নেই। তাই ঐতিহ্যবাহী কলেজগুলোতে অনার্স কোর্স চালু করা গেলে কয়েক বছরের মধ্যে সেগুলোর একেকটি বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিণত হবে। তিনি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর ব্রিটেনে এভাবে অন্তত ২২টি বিশ্ববিদ্যালয় গড়ে ওঠার উদাহরণ দেন (সূত্র : দৈনিক গণকণ্ঠ ৬ মে ১৯৭৩)।

এরপর হঠাৎ করেই হলো রাজনৈতিক পটপরিবর্তন। তবে পঁচাত্তরের নৃশংস হত্যাকাণ্ড এবং ক্ষমতার পালাবদল হলেও মোজাফফর আহমদের বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ পরিকল্পনা কিন্তু একেবারে মুখ থুবড়ে পড়েনি। আর তাই সত্তর দশকের দ্বিতীয়ার্ধে সরকার দেশের প্রসিদ্ধ আরও চারটি কলেজকে ক্রমান্বয়ে বিশ্ববিদ্যালয় কলেজে রূপান্তরের সিদ্ধান্ত নেয়। নতুন করে বিশ্ববিদ্যালয় কলেজের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হয় বরিশালের ব্রজমোহন (বিএম) কলেজ, সিলেটের মুরারিচাঁদ (এমসি) কলেজ, খুলনার ব্রজলাল (বিএল) কলেজ ও রংপুরের কারমাইকেল (কেএম) কলেজের নাম। সরকারের বরাত দিয়ে বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থার খবরে বলা হয়-উল্লিখিত কলেজগুলোর (৪টি) অবকাঠামোগত ও একাডেমিক ধরন নিরূপণের জন্য বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের চেয়ারম্যানকে প্রধান করে একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে। সব বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য, সরকারের শিক্ষা উপদেষ্টা ও জনশিক্ষা পরিচালক (ডিপিআই) এ কমিটির সদস্য। কমিটিকে যথাশিগ্গির রিপোর্ট পেশ করতেও বলা হয় (সূত্র : দৈনিক ইত্তেফাক ২১ জুলাই ১৯৭৭)।

বিশ্ববিদ্যালয় কলেজের নামে এই যে উদ্যোগ-আয়োজন, পদক্ষেপ-তৎপরতা; তাতে বাস্তবে কাজের কাজ কী হয়েছে, তা-ই খতিয়ে দেখা বোধকরি আজ জরুরি হয়ে পড়েছে। একমাত্র জগন্নাথ কলেজ (সাবেক) ছাড়া আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায় সন্দেহাতীতভাবে বিখ্যাত ও ঐতিহ্যবাহী এবং মহীরূহ হিসাবে চিহ্নিত কলেজগুলোর মধ্যে গত ৫২ বছরে কয়টিকে আমরা বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপান্তরিত করতে পেরেছি?

সত্তর এবং আশির দশক গেল। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার আগে সরকারি-বেসরকারি ডিগ্রি স্তরের সব কলেজ ছিল ঢাকা, রাজশাহী ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত। ১৯৯২ সালে প্রতিষ্ঠার পর থেকে এখন কলেজগুলো জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন। নতুন ব্যবস্থাপনায় শিক্ষাক্ষেত্রে বেশ কিছু পরিবর্তন আনা হয়। এর ফলে অধ্যাপক ম্যাকের ভাবনাপ্রসূত বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ ধারণাটিই যেন আজ হারিয়ে যাওয়ার পথে। শিক্ষার্থী-শিক্ষকসহ বিভিন্ন মহলে ‘বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ’ ধারণাটি দিনে দিনে অনেকটা পালটে গেছে। অনেকেই মনে করেন, একটি বা কয়েকটি বিষয়ে অনার্স কিংবা মাস্টার্স কোর্স খোলা হলে অথবা চলমান থাকলেই প্রতিষ্ঠানটিকে বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ বলা যায়, এর আর কোনো অন্তর্নিহিত তাৎপর্য নেই! সে অনুযায়ী বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ নিয়ে দেশব্যাপী এক তেলেসমাতি কারবার চলছে। কলেজের প্যাড, সিলমোহর, মূল ফটকের সাইনবোর্ড এবং গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা ও চিঠিপত্র আদান-প্রদান, যেদিকে তাকানো যায় সেদিকেই কেবল ‘বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ’। ব্যাপক ব্যবহার শিক্ষকদের ভিজিটিং কার্ড ও বিভিন্ন প্রকাশনায়। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে ৮৮২টি কলেজে অনার্স কোর্স চলমান। আরও আছে অন্তত ১৭৫টি কলেজে মাস্টার্স পড়ার বন্দোবস্ত। এসব কলেজে স্নাতক (সম্মান) ও স্নাতকোত্তর শিক্ষা কার্যক্রম চালুর পরই কলেজের নামের সঙ্গে ‘বিশ্ববিদ্যালয়’ শব্দটি ব্যবহার করা হচ্ছে। ফলে শব্দবন্ধটির (বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ) মনগড়া ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ, ব্যবহার-অপব্যবহার এবং যথেচ্ছাচার বলতে গেলে সবখানে দৃশ্যমান। ‘হুজুগে বাঙ্গাল’ প্রবাদটি যেন এক্ষেত্রে খুবই যথার্থ প্রমাণিত হয়েছে।

অধ্যাপক মোজাফফর আহমদ চৌধুরী এত তৎপর থাকলেও দেশের শিক্ষিত সমাজ কিংবা সরকারের (যখন যে দল ক্ষমতায় থাকে) নীতিনির্ধারক মহল বোধকরি ‘বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ’ সম্পর্কে সঠিকভাবে উপলব্ধি করতে পারেননি। তা না হলে যেখানে-সেখানে এবং যখন-তখন নামকাওয়াস্তে নতুন নতুন বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা না করে, বিদেশি নমুনা অনুসরণে ঐতিহ্যবাহী কলেজগুলোকে আলাদা করে কালক্রমে বিশ্ববিদ্যালয় হিসাবে গড়ে ওঠার পথই তারা সুগম করতেন। এর ফলে কেবল শিক্ষার্থী-শিক্ষক ও অভিভাবক নয়, গোটা জাতিরই কল্যাণ সাধিত হতো।

বিমল সরকার : কলাম লেখক; অবসরপ্রাপ্ত কলেজ শিক্ষক

 

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : সাইফুল আলম

প্রকাশক : সালমা ইসলাম