পদ্ধতিগত অনিয়ম ও আর্থিক বঞ্চনা
ড. মো. মমিন উদ্দিন
প্রকাশ: ১১ জুলাই ২০২৪, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
গত ১৩ মার্চ জাতীয় পেনশন কর্তৃপক্ষ অন্যান্য স্ব-শাসিত, স্বায়ত্তশাসিত ও রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে দেশের সব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়কে অন্তর্ভুক্ত করে ‘প্রত্যয়’ নামক একটি পেনশন স্কিম ঘোষণা করলে তখন থেকে দেশের সব বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা যুগপৎভাবে ‘প্রত্যয়’ থেকে তাদের অন্তর্ভুক্তি বাতিলের দাবি জানিয়ে আসছে। বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি ফেডারেশেনের নেতৃত্বে দেশের সব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় একযোগে শান্তিপূর্ণভাবে যথাযথ যুক্তি দেখিয়ে সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করার চেষ্টা করেছে। গত ৩ মাস ধরে শিক্ষকরা ধারাবাহিকভাবে বিবৃতি দিয়ে, সিগনেচার ক্যাম্পেইন করে, মানববন্ধন করে, এক ঘণ্টা-দুই ঘণ্টা-অর্ধদিবস-পূর্ণ দিবস কর্মবিরতি পালন করেছেন। দাবি পূরণ তো দূরের কথা, শিক্ষকদের এ দাবিকে সরকারের কোনো পক্ষ গুরুত্বই দেয়নি। শিক্ষকদের এ দাবির প্রতি সংশ্লিষ্টদের কর্ণপাত না করা শিক্ষকদের প্রতি চরম অবমাননার শামিল, এটা অত্যন্ত দুঃখজনক। উপরন্তু, ১ জুলাই থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা সর্বাত্মক কর্মবিরতি শুরু করলে অর্থমন্ত্রী সাংবাদিকদের বলেছেন, শিক্ষকদের এ দাবি অযৌক্তিক। কী সর্বনাশ! দেশের সব বিশ্ববিদ্যালয়ের হাজার হাজার শিক্ষক, যারা দেশের মেধাবী সন্তান, দেশ-বিদেশ থেকে বড় বড় ডিগ্রি নিয়ে এসেছেন, তারা নাকি না-বুঝে অযৌক্তিক আন্দোলন করছেন! বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা কেন ‘প্রত্যয়’ থেকে তাদের অন্তর্ভুক্তি বাতিলের দাবি করছেন? ‘প্রত্যয়’ বিধি অনুযায়ী অবসরের পর একজন চাকরিজীবী এককালীন কোনো আনুতোষিক পাবেন না, মাসে মাসে একটি নির্দিষ্ট অঙ্কের পেনশন পাবেন এবং এ পেনশনের জন্য তাকে চাকরি জীবনের শুরু থেকে তার মূল বেতনের ১০ শতাংশ বা ৫ হাজার (যেটা কম) টাকা পেনশন ফান্ডে জমা দিতে হবে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা বর্তমান প্রচলিত নিয়মে অবসরে গেলে ৮০ লাখ ৭৩ হাজার টাকা আনুতোষিক, প্রভিডেন্ট ফান্ডে জমাকৃত টাকার ১৩ শতাংশ হারে লাভসহ প্রায় ৩০ লাখ টাকা এবং ১৮ মাসের অর্জিত ছুটি নগদায়ন করে ১৪ লাখ ৪ হাজার টাকা অবসরের সময় এককালীন পেয়ে থাকেন। এ ছাড়াও মাসে মাসে বার্ষিক ৫ শতাংশ বৃদ্ধিসহ কমপক্ষে ৩৬,৬৫৫ টাকা পেনশন, বছরে কমপক্ষে ৭৩৩১০ টাকা উৎসব ভাতা, বছরে কমপক্ষে ৭০২০ টাকা বৈশাখী ভাতা এবং প্রতি মাসে ২৫০০ টাকা চিকিৎসা ভাতা পেয়ে থাকেন। একজন অবসরভোগী আজীবন এবং তার মৃত্যুর পরে তার নমিনি আজীবন (তার কোনো প্রতিবন্ধী সন্তান থাকলে সে আজীবন) এ মাসিক পেনশন সুবিধা পেয়ে থাকে। এসব পেনশন সুবিধার জন্য চাকরিকালীন বেতন থেকে কোনো টাকা কর্তন করা হয় না, শুধু প্রভিডেন্ট ফান্ডের টাকার জন্য চাকরিকালীন মূল বেতনের ১০ শতাংশ টাকা কর্তন করা হয়। ‘প্রত্যয়’ পেনশন স্কিমে উপরে উল্লেখিত সব পেনশন সুবিধা বাতিল করা হয়েছে। ‘প্রত্যয়’ বিধি অনুযায়ী একজন শিক্ষক ত্রিশ বছর চাকরি করে অবসর গ্রহণ করলে প্রতি মাসে ফিক্সড (কোন বার্ষিক ইনক্রিমেন্ট নেই) ১ লাখ ২৪ হাজার ৬৬০ টাকা পেনশন পাবেন। এককালীন কোনো টাকা পাবেন না। এমনকি ঈদ বোনাস ও বৈশাখী ভাতাও নেই।
আরও ভয়ংকর কথা, পেনশনভোগীর মৃত্যুর পরে তার নমিনি পেনশনারের ৭৫ বছর বয়স পর্যন্ত পেনশন পাবে। অর্থাৎ, পেনশনভোগী ৭৪ বছর বয়সে মারা গেলে তার নমিনি মাত্র ১ বছর পেনশন পাবে। জাতীয় পেনশন কর্তৃপক্ষের ব্যাখ্যা হলো-অবসরভোগী এককালীন কোনো আনুতোষিক না পেলেও আর্থিকভাবে তার কোনো ক্ষতি হবে না, বরং অনেক বেশি লাভ হবে। পেনশন কর্তৃপক্ষের এ ব্যাখ্যা শুধু ভুলই না, অত্যন্ত বিভ্রান্তিকর এবং প্রতারণামূলক। পেনশন কর্তৃপক্ষের একজন সদস্য, টকশোতে হিসাব করে দেখালেন, চলমান পেনশন নিয়মে একজন শিক্ষক ৩০ বছর চাকরি করে অবসরে গেলে ৩৫১০০ টাকা পেনশন পান, অন্যদিকে ‘প্রত্যয়’ স্কিমে এরূপ একজন অবসরভোগী মাসে পাবেন ১,২৪,৬৬০ টাকা। সুতরাং এককালীন কোনো টাকা না পেলেও তিনি অনেক বেশি লাভবান হবেন। পেনশন কর্তৃপক্ষের এ সদস্য ২০২৪ এবং ২০৫৪ সালকে একাকার করে ফেলেছেন এবং তিনি তার এ ভুল অঙ্কটি ঢাকঢোল পিটিয়ে প্রচার করছেন। ১,২৪,৬৬০ টাকা পাবে ২০২৪ সালে না, এটা কার্যকর হবে ২০৫৪ সালের ১ জুলাই থেকে, যারা অবসরে যাবেন তাদের ক্ষেত্রে। যেহেতু প্রত্যয়ে কোনো বার্ষিক বৃদ্ধি নেই, তাই একজন অবসরভোগী ২০৫৪ সালে যা পাবেন, পরবর্তী সময়ে ওই একই টাকা পাবেন। ২০৫৪ বা ২০৬০ সালে ১,২৪,৬৬০ টাকা দিয়ে ঢাকা শহরে দুই রুমের একটি বাসা ভাড়া নিয়ে এক মাস ডালভাত খেয়ে বেঁচে থাকাটাই কষ্টকর হবে। এখন যে বাসার ভাড়া ৪০ হাজার টাকা, ২০৬০ সালে ওই বাসার ভাড়া নিশ্চয় ৪০ হাজার টাকা থাকবে না। প্রকৃতপক্ষে ২০৬০ সালে ১,২৪,৬৬০ টাকার মান বর্তমান সময়ের ৪০ হাজার টাকারও কম হবে, যা দিয়ে কুরবানি দেওয়ার জন্য একটি ভালো ছাগলও কেনা যাবে না।
বর্তমান ব্যবস্থায় ৩০ বছর চাকরির পর একজন অধ্যাপক অবসরভোগী বার্ষিক ৫ শতাংশ বৃদ্ধিসহ কমপক্ষে ৩৬,৮৫৫ টাকা পেনশন পান। ২০৫৪ বা ২০৬০ সালে বর্তমান ব্যবস্থায় একজন অধ্যাপক অবসরভোগী নিশ্চয় ৩৬,৮৫৫ টাকা পেনশন পাবেন না। ২০৫৪ সাল পর্যন্ত সরকার যদি আর কোনো পে-স্কেল ঘোষণা নাও করে; তাহলেও বার্ষিক ৫ শতাংশ ইনক্রিমেন্ট সমন্বয় করে ২০৫৪ সালে একজন অধ্যাপক পর্যায়ের অবসরভোগীর শুধু মাসিক পেনশন হবে ১,৫১,৭০০ টাকা। আর এককালীন পাবেন ৩ কোটি ৩২ লাখ টাকা। এর জন্য পেনশনভোগীর বেতন থেকে কোনো টাকা কর্তন করা হবে না। অন্যদিকে ‘প্রত্যয়’ স্কিমে এরূপ একজন অবসরভোগী পাবেন মাত্র ১,২৬,৬৬০ টাকা, যার জন্য তার বেতন থেকে প্রতিমাসে পাঁচ হাজার টাকা কর্তন করা হবে। এককালীন কোনো আনুতোষিক তো তিনি পাবেনই না। সরকার যদি আগের মতো পে-স্কেল ঘোষণা করে, তাহলে বর্তমান পেনশন নিয়মে ২০৫৪ সালে একজন অধ্যাপক অবসরভোগীর এককালীন আনুতোষিক এবং মাসিক পেনশন উপরে উল্লেখিত অঙ্কের প্রায় দ্বিগুণ হবে। যেমন-১৯৭৩ সালে প্রথম গ্রেডের স্কেল ছিল ২ হাজার টাকা যা ৪২ বছর পর ২০১৫ সালে হয়েছে ৭৮০০০ টাকা। ১ম থেকে ৮ম পে-স্কেল পর্যন্ত সময় বৃদ্ধির হার বিবেচনায় গড় বৃদ্ধির হার প্রায় ৭ গুণ। পে-স্কেল সরকারকে অবশ্যই ঘোষণা করতে হবে এবং আর্থিক চাপে আগের থেকে কম হারেও যদি বৃদ্ধি করে ২০৫৪ সাল পর্যন্ত গড় বৃদ্ধি ৫ গুণও যদি হয়, তবুও ওই সময় অবসরকালীন স্কেল হবে ৩ লাখ ৯০ হাজার টাকা। সেক্ষেত্রে এককালীন আনুতোষিক হবে ৪ কোটি ৩ লাখ ৬৫ হাজার টাকা, একাকালীন ছুটি নগদায়ন হবে ৭০ লাখ ২০ হাজার টাকা, আর মাসিক পেনশন হবে ১ লাখ ৭৫ হাজার ৫০০ টাকা, বার্ষিক উৎসব ভাতা হবে ৩ লাখ ৫১ হাজার টাকা, বৈশাখী ভাতা হবে ৩৫ হাজার ১০০ টাকা। প্রভিডেন্ট ফান্ড থেকেও ৩০ লাখের বেশি টাকা পাবে। শিক্ষকদের আন্দোলনের মুখে তড়িঘড়ি করে জাতীয় পেনশন কর্তৃপক্ষ একটি প্রেস রিলিজ দিয়ে বলেছে, ‘প্রত্যয়’ স্কিমে অর্জিত ছুটি নগদায়নের সুযোগ থাকবে এবং শিক্ষকদের অবসরের বয়স ৬৫ বছর রাখা হবে। প্রভিডেন্ট ফান্ডও রাখা হবে। তবে প্রভিডেন্ট ফান্ড কীভাবে রাখা হবে, তা বোধগম্য নয়। বর্তমান নিয়মে প্রভিডেন্ট ফান্ডের জন্য মূল বেতন থেকে ১০ শতাংশ টাকা কর্তন করা হয়। তাহলে কি ১০ শতাংশ টাকা পেনশনের জন্য এবং ১০ শতাংশ টাকা প্রভিডেন্ট ফান্ডের জন্য কর্তন করা হবে? প্রভাষক পদের শিক্ষকের বেতন থেকে ২০ শতাংশ (৪৪০০) টাকা কর্তন করলে ওই শিক্ষক কি জল-হাওয়া খেয়ে থাকবে? এছাড়াও আরেকটি বড় সমস্যা হলো-‘প্রত্যয়’ বিধি অনুযায়ী মূল বেতনের ১০ শতাংশ অথবা ৫০০০ টাকা (যেটা কম) পেনশন ফান্ডে জমা রাখা যাবে। এক্ষেত্রে একজন প্রভাষক ১ম বছর মাসে ২২০০-২৬০০ টাকা এবং সহকারী অধ্যাপক পদে ৩৫০০-৪২০০ টাকার মতো জমা রাখতে পারবেন। সুতরাং ৩০ বছর চাকরির পর অবসরে গেলে ১ জুলাই ২০৫৪ থেকে ১ লাখ ২৪ হাজার ৬৬০ টাকা পেনশন পাওয়ার হিসাবটি সঠিক নয়, কারণ প্রতি মাসে একজন চাকরিজীবীর পাঁচ হাজার টাকা পেনশন ফান্ডে জমা রাখার কোনো সুযোগই নেই। অথচ বর্তমান নিয়মে ২৫ বছর চাকরি করে অবসরে গেলে একজন ওপরের সব সুবিধা প্রাপ্য হবেন।
‘প্রত্যয়’ স্কিমের সবচেয়ে অমানবিক দিক ও নিষ্ঠুরতার চূড়ান্ত প্রকাশ হলো, নমিনির পেনশনের সুযোগ বন্ধ করা। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির এ বাজারে একজন শিক্ষককে অনেক কষ্টে দিনাতিপাত করতে হয়। বেতনের ওপর যাদের নির্ভর করতে হয়, তাদের সারাজীবন ভাড়া বাসায় থাকতে হয়। অবসর গ্রহণের ১৫ বছর পর একজন পুরুষ অবসরভোগীর মৃত্যু হলে তার বৃদ্ধ স্ত্রীকে বৃদ্ধাশ্রমে যাওয়া ছাড়া অন্য কোনো উপায় থাকবে না। প্রতিবন্ধী সন্তান থাকলে কী অমানবিক অবস্থা তৈরি হবে, তা সহজে অনুমেয়। সর্বোপরি ‘প্রত্যয়’ পেনশন স্কিমে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের অন্তর্ভুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার প্রতি কর্তৃপক্ষের একটি পদ্ধতিগত উদাসীনতা এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের প্রতি প্রাতিষ্ঠানিকভাবে অমর্যাদা প্রদর্শন। এমন আচরণ বজায় থাকলে ভবিষ্যতে মেধাবীরা এ পেশায় আসতে আগ্রহী হবে না। এতে উচ্চশিক্ষা চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
ড. মো. মমিন উদ্দিন : অধ্যাপক, ইংরেজি বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়; সভাপতি (ভারপ্রাপ্ত), জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি।