Logo
Logo
×

বাতায়ন

কারিকুলাম নিয়ে কিছু কথা

Icon

মিল্লাত হোসেন

প্রকাশ: ০৮ জুলাই ২০২৪, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

কারিকুলাম নিয়ে কিছু কথা

চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের এই সময়ে মানবসম্পদ হচ্ছে একটা দেশের অর্থনীতির মূল চালিকাশক্তি। মানবসম্পদের আবার দুটো ভাগ রয়েছে-একটি হচ্ছে দক্ষ শ্রমিক ও দক্ষ সেবা প্রদানকারী; আরেকটি হচ্ছে মেধাসম্পদ (গবেষক, উদ্ভাবক, বিজ্ঞানী, লেখক ইত্যাদি)। মানবসম্পদ উন্নয়নের ক্ষেত্রে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান তখনই তার শিক্ষার্থীদের মানবসম্পদে রূপান্তরিত করতে পারবে যখন তার একটি বাস্তবসম্মত এবং যুগোপযোগী বিজ্ঞানসম্মত কারিকুলাম থাকবে। সেই সঙ্গে সেই কারিকুলাম বাস্তবায়ন করার জন্য প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত, দক্ষ, অভিজ্ঞ এবং সৃজনশীল শিক্ষক থাকবে। একই সঙ্গে দুটি উপাদানেরই উপস্থিতি প্রয়োজন। শুধু ভালোমানের শিক্ষক অথবা শুধু ভালোমানের কারিকুলাম দিয়ে দক্ষ মানবসম্পদ তৈরি সম্ভব নয়। সেই সঙ্গে ভালো অবকাঠামো এবং প্রয়োজনীয় সব আধুনিক শিক্ষা উপকরণও প্রয়োজন।

শ্রেণিকক্ষে শিক্ষক যদি একটি ভালো পেডাগোজি অবলম্বন করে পাঠদান করেন এবং একটি ইন্টারেক্টিভ শ্রেণি কার্যক্রম পরিচালনা করেন, তাহলে সেখান থেকে শিক্ষার্থীর মাঝে পাঠের আলোচ্য বিষয় সম্বন্ধে কিছু ধারণা লাভ করতে পারে এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো শিক্ষার্থীকে সংশ্লিষ্ট পাঠ সম্পর্কে আগ্রহী করে গড়ে তোলা সম্ভব হয়। একজন ভালো শিক্ষকের কাজ হচ্ছে কাউকে কোনো কিছু মুখস্থ করানো নয় বা সেই বিষয়ে আত্মস্থ করানো নয় বরং সেই বিষয়ে শিক্ষার্থীর মাঝে শেখার আগ্রহ তৈরি করতে পারাই একজন যথার্থ শিক্ষকের প্রধান কাজ। কারণ, জোরপূর্বক তাকে কোনো কিছু যদি গেলানো হয়, সেটা নিশ্চিতভাবেই সে ভমি করে ফেলে দেবে বা সেটা তার জীবনে কখনোই কাজে আসবে না। আমাদের দেশে দীর্ঘকাল চলে আসা শিক্ষাব্যবস্থায় জোর করে গলাধঃকরণের আয়োজনই বেশি ছিল কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া। সেই গলাধঃকরণের ফলাফল তো আমরা দেখতেই পাচ্ছি। বাংলাদেশের এই ৫৪ বছরে আমরা কতটুকু মেধাসম্পদ তৈরি করতে পেরেছি? দক্ষ শ্রমিকই বা কতটা তৈরি করতে পেরেছি? ইন্ডিয়া বা ফিলিপাইনের প্রবাসীরা মাথাপিছু (গড়) যা আয় করে, বাংলাদেশের প্রবাসীরা তার অর্ধেকেরও কম আয় করতে পারে। এর প্রধান কারণ হচ্ছে আমাদের প্রবাসীদের ভালো কোনো স্কিল সেট না থাকা (কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া)। আমাদের স্থানীয় যেসব কোম্পানি বা সংস্থা সেবা দিচ্ছে তারাও বা কতটা দক্ষতার সঙ্গে সেবা দিতে পারছে? দক্ষতা বৃদ্ধির ক্ষেত্রে আমাদের আরও উন্নতি করার প্রয়োজন রয়েছে। আমাদের দেশে কারও যদি সামর্থ্য/সুযোগ থাকে বিদেশে গিয়ে ভালো সেবা নেওয়ার, তাহলে সে আমাদের দেশের কারও কাছ থেকে সেবা নিতে চায় না, এর পেছনের কারণ কী? কারণ হচ্ছে দক্ষ সেবা প্রদানকারী, প্রফেশনালিজম চর্চাকারী এবং নৈতিক প্রফেশনালের খুবই অভাব।

আমাদের শিক্ষা ও জ্ঞানের অবস্থা তুলে ধরার জন্য কিছু আন্তর্জাতিক সংস্থার পরিসংখ্যান তুলে ধরা আবশ্যক :

জাতিসংঘের উন্নয়ন সংস্থা ইউএনডিপির গ্লোবাল নলেজ ইনডেক্স ২০২১-এর তথ্যমতে, ১৫৪টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১২০তম, ভারত ৯৭তম, শ্রীলংকা ৮৬তম, ভুটান ১০৮তম, মালয়েশিয়া ৫১তম এবং আফ্রিকার ঘানা ১০৭তম।

গবেষণা, উদ্ভাবন ও উন্নয়ন র‌্যাংকিংয়ে ১৫৪টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশ ১৩৬তম, আমাদের থেকেও এগিয়ে আছে মিয়ানমার (১৩৩) আফগানিস্তান (১২৯) নেপাল (১১৯) পাকিস্তান (১১৮), আফ্রিকা মহাদেশের উগান্ডা (১০৮), শ্রীলংকা (৮৪) ও ইন্ডিয়া (৪২তম)

ওয়ার্ল্ড ডেটা ডট ইনফো ১২৮টি দেশের IQ (বুদ্ধিমত্তা মূল্যায়ন করতে পরিকল্পিত বিভিন্ন প্রমিত পরীক্ষার একসঙ্গে প্রাপ্ত ফলাফল)-এর ওপর একটি র‌্যাংকিং প্রকাশ করে থাকে। এ র‌্যাংকিংয়ে বাংলাদেশের অবস্থান (৭৫ আইকিউ স্কোর নিয়ে) ৯৯তম। ৯৮ ও ৯৭তম অবস্থানে আছে সিরিয়া এবং আফ্রিকার দেশ সুদান। দুঃখের বিষয়, ৭০ থেকে ৭৯ IQ স্কোরকে ধরা হয় ‘ভেরি লো আইকিউ’ হিসাবে, আর বাংলাদেশ এই ক্যাটাগরির মধ্যেই পরে। ৯০ থেকে ১০৯ আইকিউ স্কোরকে ধরা হয় অ্যাভারেজ, ৮০ থেকে ৮৯ আইকিউ স্কোরকে ধরা হয় মধ্যম মানের অ্যাভারেজ আইকিউ স্কোর হিসাবে। এ অবস্থা যদি চলতেই থাকে, তাহলে আমাদের মানবসম্পদের অবস্থা হবে ভয়াবহ। শুধু কেরানি ছাড়া আর কিছুই আমরা তৈরি করতে পারব না। অবশ্য বর্তমান অবস্থাও কম গুরুতর নয়।

CEOWorld ম্যাগাজিনের তথ্যমতে, বিশ্বের সেরা ১০০টি মেডিকেল স্কুলের মধ্যে ইন্ডিয়ার সাতটি মেডিকেল স্কুল থাকলেও বাংলাদেশের একটিও নেই। বিশ্বের সেরা ১৬৯টি বিজনেস স্কুলের মধ্যে বাংলাদেশের একটিও নেই, যেখানে ইন্ডিয়ার ১৪টি রয়েছে। এছাড়াও ইউনিভার্সিটি ওয়ার্ল্ড র‌্যাংকিংয়ে আমাদের অবস্থান তো সবারই জানা।

গবেষণায় কিছু কিছু বিষয়ে কিছু কিছু বিশ্ববিদ্যালয় ভালো করছে, বিশেষ করে কৃষিসংশ্লিষ্ট গবেষণাগুলো প্রশংসার দাবি রাখে।

এমতাবস্থায় আমাদের শিক্ষার ওপর নজর দেওয়া উচিত এবং খুব দ্রুততার সঙ্গে যুগের চাহিদার সঙ্গে তাল মিলিয়ে বিজ্ঞানসম্মত পদক্ষেপ নেওয়া উচিত। নতুন কারিকুলাম যথেষ্ট আপডেটেড ও বাস্তবসম্মত। তবে এ কারিকুলাম বাস্তবায়নের জন্য শিক্ষকদের যথাযথ প্রশিক্ষণ ও মনিটরিংয়ের ব্যবস্থা না করলে হয়তো খুব শীঘ্রই এই কারিকুলাম মুখ থুবড়ে পড়তে পারে।

অনেকদিন ধরেই নুতন কারিকুলাম নিয়ে বিভিন্ন প্ল্যাটফরমে অনেক কথাবার্তা হচ্ছে। নতুন কারিকুলাম বনাম পুরোনো কারিকুলাম এবং অভিভাবকদের প্রত্যাশার ব্যাপারে নিজস্ব কিছু মতামত ও প্রশ্ন নিম্নে তুলে ধরলাম :

১. আমার কাছে মনে হয়, পড়াশোনা কোনো প্রতিযোগিতা না বা কোনো খেলা না ক্রিকেট বা ফুটবলের মতো, পুরোনো শিক্ষাব্যবস্থায় পড়াশোনাকে একটি প্রতিযোগিতা হিসাবেই প্রতিষ্ঠিত করা হয়েছিল, যেটা নতুন ব্যবস্থায় কিছুটা হলেও দূর করার চেষ্টা করা হয়েছে। নতুন কারিকুলাম ইনক্লুসিভ শিক্ষাব্যবস্থা যেখানে সবার অংশগ্রহণ নিশ্চিত করার চেষ্টা করা হবে, সেটা অবশ্যই ইতিবাচক একটি বিষয়।

২. আমাদের পুরোনো শিক্ষাব্যবস্থা কতটা যুগোপযোগী ছিল? আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা কি বিশ্ব-চাকরির বাজারে যথাযথভাবে প্রস্তুত করতে পেরেছিল? যদি পেরেও থাকি, সেটা মোট জনগোষ্ঠীর কত পারসেন্ট? আমার কাছে মনে হয়, পারসেন্টা খুবই হতাশাজনক।

৩. আমাদের পুরোনো শিক্ষাব্যবস্থায় ইংরেজি ক্লাস ওয়ান থেকেই পড়ানো হয় একটা বাচ্চাকে; কিন্তু মাস্টার্স পাশ করার পরও কজন শিক্ষার্থী ভালো করে ইংলিশ পারেন? একজন শিক্ষার্থীকে ১৭ বছর ধরে ইংরেজি শিখিয়েও কেন আমরা সফল হতে পারছি না? একটা ভাষা শিখতে কি একজন শিক্ষার্থীর ১২ থেকে ১৭ বছর সাধনা করা দরকার?

৪. আমাদের দেশের কিছু কিছু অভিভাবকের চাওয়া একটাই, ক্লাসে ফার্স্ট হওয়া এবং এ প্লাস পাওয়া-আদর্শবান, মানবিক সৃজনশীল মানুষ তৈরি করা নয়। এ কারণেই মেডিকেলের ভর্তি পরীক্ষাসহ বিভিন্ন পরীক্ষার কোশ্চেন যখন আউট হয়ে যায়, সেগুলো কেনার টাকা কিন্তু এই অভিভাবকরাই দেয় (সবাই নন), সুতরাং আমাদের অভিভাবক শ্রেণির মানসিকতা নিয়েও ভাবতে হবে তারা আসলে কী চায়? তাদের দরকার একটি সার্টিফিকেট, একটা চাকরি-জ্ঞান নয়, এক্সিলেন্সিও নয়। সেই সঙ্গে নৈতিকতার প্রশ্ন তো রয়েই যায়।

৫. শিক্ষার উদ্দেশ্য কি শুধু বই মুখস্থ করা? একজন শিক্ষিত মানুষের অবশ্যই কিছু কিছু সফট স্কিল থাকা দরকার যেমন: পর্যবেক্ষণ করার দক্ষতা, সমস্যা সমাধান করার দক্ষতা ও সিদ্ধান্ত নেওয়ার দক্ষতা, যোগাযোগ ও পাবলিকলি স্পিকিংয়ের দক্ষতা, Brainstorming ও ক্রিটিকাল থিংকিং, সৃজনশীল চিন্তা, গ্রুপ ওয়ার্ক এবং লিডারশিপ, আন্তর্জাতিক চাকরিবাজারে এগুলো যদি কারও না থাকে তাহলে আপনার সার্টিফিকেট দিয়ে কোনো কাজে আসবে না, এমনকি বাংলাদেশের কিছু কিছু প্রাইভেট সেক্টরেও না। এসব স্কিল নতুন শিক্ষাক্রমের মাধ্যমে একজন শিক্ষার্থীর অর্জন হওয়ার সম্ভাবনা পুরোনো শিক্ষাক্রমের চেয়ে বেশি।

৬. অনেককে বলতে শুনেছি ইংরেজি এবং বাংলা বিষয়ে ব্যাকরণ রাখেনি, আসলে কথাটি সঠিক নয়। কিছু আলোচনা প্রথম পত্র বইয়ের মধ্যেই করা হয়েছে, আর একটা ভাষা শিখতে ব্যাকরণ শেখার গুরুত্ব কম। কারণ, ভাষা মানুষের মুখ থেকে বইয়ে আসে, বই থেকে মুখে যায় না।

৭. প্রাত্যহিক জীবনে এবং আমাদের কর্মজীবনে আমরা একাডেমিক লাইফে যতটুকু শিখেছি, তার কতটুকু আমাদের কাজে লাগে কিছু ব্যতিক্রম সেক্টর ছাড়া? দীর্ঘ ১২ থেকে ১৭ বছরের পড়াশোনা যদি কর্মজীবনে প্রত্যহিক জীবনে কাজে না লাগে, চাকরির শুরুতে যদি আমাদের কর্মীকে কাজসংশ্লিষ্ট বিষয় এক/দুই বছর মেয়াদি বেসিক প্রশিক্ষণই দেওয়া লাগে, তাহলে এত পড়াশোনা কার্যক্রম চালিয়ে লাভটা কী? এসএসসি পাশের পর দুই-তিন বছর মেয়াদি প্রশিক্ষণ দিয়ে কাজে জয়েন করে দিলেই তো হয়।

৮. বাংলাদেশের প্রাইভেট সেক্টরে বড় বড় পদে কেন বিদেশিদের আধিক্য বেশি, এমনকি গার্মেন্টসহ কিছু কিছু কোম্পানির ছয় সংখ্যার (লাখ টাকার) বেতনের পদগুলোর অধিকাংশই ভারতীয়সহ অন্যান্য বিদেশির দখলে। আমরা কি একবারও নিজেদের প্রশ্নটা করেছি আমরা কেন এ পদের জন্য যোগ্য কর্মী তৈরি করতে পারছি না?

৯. বিশ্বের বিভিন্ন র‌্যাংকিংয়ে আমরা কেন পেছনের দিকে? বাংলাদেশ কেন উদ্ভাবনের বিরান ভূমিতে পরিণত হয়েছে? আমার ধারণা, পুরোনো শিক্ষাব্যবস্থার মুখস্থ ধারা থেকে বের হয়ে নতুন শিক্ষাক্রমে আমরা কিছুটা হলেও নলেজ তৈরি করতে পারব। যেটা আমাদের র‌্যাংকিংয়ে এগিয়ে যেতে সহায়তা করবে।

১০. কেউ কেউ বলছেন, পড়াশোনা তো হয় না, শুধু এই কাজ সেই কাজ, রান্নাবান্না-এগুলো দিয়েই বছর শেষ করে ফেলছে। উন্নত বিশ্বের সেলফ সার্ভিস বলতে একটা নিয়ম প্রচলিত আছে। আমাদের দেশের মতো কাজের লোক সব দেশে পাওয়া যায় না, নিজের বিছানাটা নিজে গোছাতে পারে কি না, নিজের রান্নাটা নিজে করতে পারে কি না, মা-বাবার কাজের সাহায্য করতে পারছে কি না, পরিবারের দায়িত্ব নিতে শিখছি কি না, বাসায় অসুস্থ রোগীর প্রতি কেয়ারফুল হচ্ছে কি না-শিক্ষার ক্ষেত্রে এ জিনিসগুলো আধুনিক বিশ্বে খুব গুরুত্ব বহন করে।

একটি কারিকুলাম যথাযথভাবে বাস্তবায়নের জন্য শিক্ষক, শিক্ষার্থী অভিভাবক, মিডিয়া ও রাষ্ট্র-সবার আন্তরিকতা প্রয়োজন, সবার সমন্বিত সহযোগিতা ছাড়া নতুন কারিকুলাম কোনো অবস্থায়ই বাস্তবায়ন করা সম্ভব নয়। সেই সঙ্গে নতুন কারিকুলামের বিষয় শিক্ষকদের পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণ এবং নতুন কারিকুলামের যাবতীয় উদ্যোগ উদ্রেককারী বিষয়গুলো যথাযথ ব্যাখ্যার মাধ্যমে জনগণকে সচেতন করে তুলতে হবে।

মনে রাখতে হবে, সবচেয়ে ভালোমানের গাড়ি আপনাকে ড্রাইভ করতে দেওয়ার পর অ্যাকসিডেন্ট করলেন, এখানে দোষটা গাড়ির নাকি ড্রাইভারের?

মিল্লাত হোসেন : ফ্রিল্যান্সার ও শিক্ষক

millatentr@gmail.com

 

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : সাইফুল আলম

প্রকাশক : সালমা ইসলাম