Logo
Logo
×

বাতায়ন

আশেপাশে চারপাশে

টাইটানিকের যাত্রী কি আমরা?

Icon

চপল বাশার

প্রকাশ: ০১ জুলাই ২০২৪, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

টাইটানিকের যাত্রী কি আমরা?

ছাগল নামক চতুষ্পদ প্রাণীটিকে সবাই তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করেন। অনেকে বলেন, ছাগল কোনো কাজেই লাগে না, শুধু এর মাংস খাওয়া যায়। কিন্তু এই নিরীহ, গোবেচারা ছাগল কত ভয়ংকর কাণ্ড ঘটাতে পারে, তা হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছেন জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) সদ্য সাবেক উচ্চপদস্থ ডাকসাইটে কর্মকর্তা মতিউর রহমান। একটি ‘উচ্চবংশীয়’ সুদর্শন ছাগল মতিউর সাহেবের বহু কষ্টে গড়ে তোলা সম্পদের পাহাড় গুঁড়িয়ে দেওয়ার উপক্রম করেছে। ভদ্রলোকের চাকরি তো গেছেই বলা যায়। তিনি ক্ষমতাশালী ও প্রভাবশালী আমলা হয়েও পালিয়ে বেড়াচ্ছেন। বোকা ছাগলের কারণে মতিউর সাহেবের দুটি ‘সোনার সংসার’ ছারখার হতে বসেছে।

১৫ লাখ টাকা দামের বহুল আলোচিত ছাগলটিকে কুরবানি করার মহৎ উদ্দেশ্যে মতিউর সাহেবের দ্বিতীয় সংসারের সুযোগ্য পুত্র কলেজছাত্র ইফাত কিনেছিল বা কেনার জন্য অগ্রিম টাকা দিয়েছিল। ছাগলটির সঙ্গে সে সুন্দর একটি ছবি তুলে ফেসবুকে দিয়েছিল এবং প্রচার করা হয়েছিল-এটি যেমন-তেমন ছাগল নয়, উচ্চবংশীয় ছাগল। ১৫ লাখ টাকার উচ্চবংশীয় ছাগল ও তার উচ্চবংশীয় ক্রেতার প্রতি যথাযথ সম্মান জানানোর জন্য ফেসবুকের সদস্যরা ছবিসহ খবরটি ব্যাপকভাবে প্রচার করেন, যাকে বলে ভাইরাল হওয়া। ছাগলবিষয়ক সচিত্র প্রতিবেদনটি ছোট-বড় সব সংবাদপত্রে ফলাও করে ছাপা হয়েছে। টিভির সংবাদেও দেখানো হয়েছে।

এরপরেই যত ‘অনাকাঙ্ক্ষিত’ ঘটনা ঘটতে লাগল একের পর এক। গণমাধ্যমের বেরসিক তরুণ রিপোর্টাররা ছাগলের মালিক ও তার ক্রেতার বংশ-পরিচয় জানার জন্য মাঠে নামলেন। কেঁচো খুঁড়তে সাপ বেরোতে লাগল। ভাইপার, কেউটে, গোখরা তো বের হলোই, বড় আকারের অজগরও পাওয়া যাচ্ছে।

ছাগলটির ক্রেতা ইফাতের পিতা এনবিআর কর্মকর্তা মতিউর রহমান। তিনি রাষ্ট্রীয় সোনালী ব্যাংকের পরিচালকও ছিলেন। সরকারি চাকুরে হয়ে এত বিশাল সম্পদের মালিক কীভাবে হলেন, সেটি নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। এটাই এখন সংবাদপত্রসহ সব গণমাধ্যমের প্রধান খবর। পাঠকরা এখন ছাগলকাণ্ডের খবরটিই আগে পড়েন। সরকারও বিষয়টিকে গুরুত্ব দিয়ে ব্যবস্থা নিচ্ছেন। মতিউর রহমানকে এনবিআর ও সোনালী ব্যাংকের পদ থেকে সরিয়ে মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে। তার ব্যাংক-হিসাব, শেয়ারবাজারের বিও অ্যাকাউন্ট জব্দ করা হয়েছে। তবে তাকে কোথাও পাওয়া যাচ্ছে না, দেখাও যাচ্ছে না। মতিউর রহমান ও তার পরিবারের দেশত্যাগের ওপর নিষেধাজ্ঞা দেওয়ার খবরও গণমাধ্যমে এসেছে। তিনি ও তার পরিবারের সদস্যরা কোথায়, সবাই জানতে আগ্রহী। তার প্রথম স্ত্রী, যিনি রায়পুরা উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান, বেশ কিছুদিন অন্তরালে থাকার পর কয়েকদিন আগে কাজে যোগ দিয়েছেন।

ছাগলকাণ্ড নিয়ে বাজার যখন গরম, তখনই জানা গেল এনবিআরের আরেক উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাও ধরা খেয়েছেন। তারও অবৈধ উপায়ে অর্জিত বিপুল পরিমাণ সম্পদের খবর গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে। দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) এ সম্পর্কে ব্যবস্থা নিয়েছে বা নিচ্ছে।

এর আগে সাবেক পুলিশ প্রধান বেনজীর আহমেদের দুর্নীতির মাধ্যমে অর্জিত বিপুল সম্পদ নিয়ে দেশজুড়ে তোলপাড় হয়েছে। তাকে দুদক কার্যালয়ে ডাকা হয়েছিল। তিনি আসেননি। পরে জানা যায়, তিনি আগেই দেশ ছেড়ে গেছেন। এর পরপরই ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) সাবেক কমিশনার আছাদুজ্জামান মিয়ার বিরুদ্ধে একই ধরনের অভিযোগ উঠেছে। দুদক তার সম্পর্কেও তদন্ত করছে। সাবেক সেনাপ্রধান আজিজ আহমেদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ এনে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তার প্রতি নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে। সম্প্রতি ভারতের মাটিতে ঝিনাইদহ-৪ আসনের এমপি আনোয়ারুল আজিম আনারের খুন হওয়ার পেছনে দুর্নীতি-চোরাচালানের মতো কারণ জানা যাচ্ছে। প্রশাসনের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে এমন দুর্নীতি-অনিয়মের অভিযোগ সরকার ও জনগণের জন্য মোটেই স্বস্তিদায়ক নয়, বরং বিব্রতকর। এসব ঘটনা দেশের ভাবমূর্তি বিনষ্ট করছে।

দুর্নীতিসংক্রান্ত ঘটনাবলি জাতীয় সংসদেও আলোচিত হয়েছে। সংবাদপত্রে লেখালেখি হচ্ছে। সুশীল সমাজ ও বুদ্ধিজীবী মহল তাদের প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে বক্তব্য দিচ্ছেন। দুর্নীতির মূলোৎপাটনে সরকার কী পদক্ষেপ নেয়, সেটাই এখন দেখার বিষয়। তবে শুধু সরকারি কর্মকর্তারা নয়, বেসরকারি খাতের অনেক বড় বড় ব্যবসায়ীও বিদেশে টাকা পাচার, ব্যাংক লুটপাট, নিত্যপণ্যের সিন্ডিকেট তৈরির মতো দুর্নীতিতে জড়িত। এদের বিরুদ্ধেও কঠোর ব্যবস্থা প্রয়োজন।

একটি ছাগলকে কেন্দ্র করে সরকারের উচ্চপর্যায়ের দুর্নীতি-অনিয়মের ঘটনা প্রকাশিত হচ্ছে। দুর্নীতির ঘটনা তো এগুলোই শুধু নয়। সহজেই বোধগম্য, এমন ঘটনা আরও অনেক আছে। যে কটি দুর্নীতির ঘটনা উন্মোচিত হয়েছে, সেগুলোকে Tip of the iceberg (হিমশৈলের অগ্রভাগ) বলা যায়। সমুদ্রে ভাসমান বিশাল হিমশৈল পুরোপুরি দেখা যায় না। উপরিভাগের সামান্য অংশ দৃশ্যমান থাকে। জাহাজের নাবিক যদি তা বুঝতে না পারেন, তাহলে জাহাজটি ডুবে থাকা হিমশৈলের সঙ্গে ধাক্কা খেয়ে দুর্ঘটনা ঘটতে পারে। যেমনটি ঘটেছিল ১৯১২ সালে। যাত্রীবাহী বিরাট জাহাজ টাইটানিক আটলান্টিকের পানিতে ডুবে থাকা বিশাল হিমশৈলের সঙ্গে ধাক্কা খেয়ে ডুবে যায়। মৃত্যু হয় প্রায় ১৫০০ মানুষের।

অতএব, সাবধান। দুর্নীতির বিশাল হিমশৈলের সঙ্গে বাংলাদেশ যেন ধাক্কা না খায়। দুর্নীতি সম্পর্কে সরকারের নীতি ‘জিরো টলারেন্স’। সেই নীতি আন্তরিকতার সঙ্গে অনুসরণ করতে হবে। স্বজনপ্রীতির কারণে দুর্বলতা দেখালে চলবে না। জনগণ চায় না বাংলাদেশ টাইটানিক হোক।

চপল বাশার : সাংবাদিক, লেখক

basharbd@gmail.com

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : সাইফুল আলম

প্রকাশক : সালমা ইসলাম