আশেপাশে চারপাশে
আদম ব্যাপারীদের শক্ত হাতে দমন করুন
চপল বাশার
প্রকাশ: ১৩ জুন ২০২৪, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
লাখ লাখ টাকা খরচ করে চূড়ান্ত ছাড়পত্র নিয়েও মালয়েশিয়ায় যেতে পারেননি বাংলাদেশের ১৭ হাজার কর্মী। এর মধ্যে একটি অংশ উড়োজাহাজের টিকিট সংগ্রহ করতে পারেনি। আরেকটি অংশ মালয়েশিয়া থেকে নিয়োগকর্তার চূড়ান্ত সম্মতি পায়নি। কর্মীদের মালয়েশিয়া যাওয়ার সর্বশেষ সময় নির্ধারিত ছিল ৩১ মে। এর আগেই নির্বাচিত হাজার হাজার কর্মী বিমানবন্দরে ভিড় করেছিলেন কুয়ালালামপুরগামী ফ্লাইট ধরার আশায়। কিন্তু রিক্রুটিং এজেন্সিগুলোর সিন্ডিকেট তাদের টিকিট দিতে পারেনি। অথচ কর্মীদের কাছ থেকে আগেই টিকিটের দাম কয়েকগুণ বাড়িয়ে আদায় করেছে সিন্ডিকেট তথা আদম ব্যাপারীরা।
অসাধু আদম ব্যাপারী ও তাদের পৃষ্ঠপোষকরা দেশের সহজ-সরল হাজার হাজার কর্মীকে ঠকিয়ে ও ভাঁওতা দিয়ে হাজার হাজার কোটি টাকা লুটে নিয়েছে। কত হাজার পরিবার নিঃস্ব ও সর্বস্বান্ত হয়ে গেছে, সে খবর কে রাখে! আদম ব্যাপারীরা কিছু দুর্নীতিবাজ সরকারি কর্মকর্তা ও প্রভাবশালী পৃষ্ঠপোষকের সহায়তায় যে ন্যক্কারজনক কাণ্ডটি এবার ঘটাল, তা বাংলাদেশের ভাবমূর্তির ক্ষতি করেছে ব্যাপকভাবে। যে ক্ষতি হয়ে গেছে, তা পূরণ করতে অনেক মাশুল দিতে হবে। বাংলাদেশের কর্মীদের মালয়েশিয়া যাওয়ার পথও বন্ধ হয়ে গেল। এই পথ কবে খুলবে, বা আদৌ খুলবে কিনা কে জানে।
এবারই প্রথম নয়। এর আগে ২০০৯, ২০১৬ ও ২০১৮ সালেও অসাধু রিক্রুটিং এজেন্সির সিন্ডিকেটের কারণে মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার বাংলাদেশের কর্মীদের জন্য বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। সরকারের উচ্চ মহলের চেষ্টা ও দেন-দরবারে বন্ধ দুয়ার আবার খুলেছে। এ নিয়ে চতুর্থবার মালয়েশিয়া তাদের দুয়ার আমাদের কর্মীদের জন্য বন্ধ করল। এতে বিশ্বের কাছে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি ও মানসম্মান ব্যাপকভাবে ক্ষুণ্ন হয়েছে। এ ঘটনা বিশ্বের অন্যান্য দেশের শ্রমবাজারেও নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে।
দেশের অর্জিত বৈদেশিক মুদ্রার একটি বড় খাত হচ্ছে প্রবাসীদের পাঠানো অর্থ। আমাদের কর্মীরা বিদেশ বিভূঁইয়ে অক্লান্ত পরিশ্রম করে যে অর্থ দেশে পাঠান, তা আমাদের অর্থনীতিতে বিপুল অবদান রাখে। কিন্তু আমাদের কর্মীরা যদি বিপুল পরিমাণ অর্থ ব্যয় করেও বিদেশে তাদের কর্মস্থলে যেতে না পারেন, তাহলে বিদেশ থেকে অর্থ পাঠাবে কে? এ ধরনের ঘটনায় আমাদের কর্মীরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন, বহু পরিবার সর্বস্বান্ত হচ্ছে, বেকারের সংখ্যা বাড়ছে, শ্রমশক্তির অপচয়ের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে জাতীয় অর্থনীতি।
সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও কর্তৃপক্ষের হিসাবে জানা যায়, চূড়ান্ত ছাড়পত্র নিয়েও এবার মালয়েশিয়া যেতে পারেননি ১৬ হাজার ৯৭০ জন কর্মী। এছাড়াও ভিসা ও অনুমোদন জটিলতায় যেতে পারেননি ৩১ হাজার ৩০৪ জন। বিদেশে শ্রমিক পাঠানোর এজেন্সিগুলোর সংগঠন বায়রা বলেছে, এ সংখ্যা ৪০ হাজারের মতো হবে। অন্যান্য সূত্রে জানা যায়, এ সংখ্যা এক লাখ ছাড়িয়ে যেতে পারে। সরকারি-বেসরকারি সূত্রের এসব তথ্য দেখে অনুমান করা যায়, আমাদের বিপুলসংখ্যক কর্মী অসাধু আদম ব্যাপারীদের দ্বারা ব্যাপকভাবে প্রতারিত হয়েছেন।
বিপুল অঙ্কের অর্থ ব্যয় করে চূড়ান্ত ছাড়পত্র পাওয়ার পরও বিমান-টিকিটের অভাবে বিদেশে পাঠাতে না পারা এক ধরনের প্রতারণা। মালয়েশিয়া যাওয়ার শেষ তারিখের যথেষ্ট আগেই বিশেষ ফ্লাইট বা অতিরিক্ত ফ্লাইটের ব্যবস্থা করে ১৭ হাজার কর্মীকে পাঠানো যেত। সরকার ও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ সময়মতো সে উদ্যোগ না নিয়ে শেষ মুহূর্তে মালয়েশিয়া সরকারকে অনুরোধ করল সময়সীমা বাড়ানোর জন্য। মালয়েশিয়া সে অনুরোধ রাখেনি।
আর্থিকভাবে মালয়েশিয়াগামী কর্মীদের যে প্রতারণা করা হয়েছে, সেটা বিস্ময়কর। সরকার যে ব্যয় নির্ধারণ করেছিল, তাতে মালয়েশিয়া যেতে একজন কর্মীর সর্বোচ্চ ৭৯ হাজার টাকা খরচ হতে পারে। কিন্তু রিক্রুটিং এজেন্সিগুলো কর্মীদের কাছ থেকে পাঁচ লাখ থেকে সাত লাখ টাকা আদায় করেছে। মালয়েশিয়ায় গমনেচ্ছু কর্মী বা শ্রমিকরা এই টাকা সংগ্রহ করেছে নিজের বা পরিবারের জমি-বসতভিটা বিক্রি করে অথবা বন্ধক রেখে। অনেকে এনজিও বা সমিতির কাছ থেকে চড়া সুদে টাকা ধার করেছে। এর পরও তারা যেতে পারেনি বৈধ কাগজপত্র অথবা বিমানের টিকিটের অভাবে। এর চেয়ে দুর্ভাগ্যজনক আর কী হতে পারে!
অভিযোগ রয়েছে, বেসরকারি রিক্রুটিং এজেন্সি তথা আদম ব্যাপারীদের অপকর্মে পেছন থেকে সহযোগিতা করেছে একশ্রেণির সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী। মালয়েশিয়ার নিয়োগকর্তা বা সেদেশের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষও ধোয়া তুলসীপাতা নয়। তাদের অনেকে বাংলাদেশের সিন্ডিকেটের অপকর্মে সহযোগিতা করে এবং বিনিময়ে ফায়দা বা লভ্যাংশ পায়। দুই দেশের দুষ্টচক্র মিলে গড়ে তোলা হয় বৃহৎ সিন্ডিকেট; এবং এদের ভিকটিম বাংলাদেশের নিরীহ কর্মী ও শ্রমিক। এসব অভিযোগ নতুন নয়, আগেও অনেকবার উঠেছে। কিন্তু এই দুর্নীতি ও অপকর্ম বন্ধ হয়নি। বিদেশ গমনে ইচ্ছুক কর্মী ও শ্রমিকদের দুর্ভোগ চলছেই।
এত টাকা খরচ করেও আমাদের কর্মীরা কেন মালয়েশিয়া যেতে চান? কারণ জীবিকার তাগিদ। দেশে বেকার জীবন অথবা উপযুক্ত কর্মসংস্থানের অভাবে তরুণ-যুবকরা বিদেশে যেতে চান। বাংলাদেশের কাছাকাছি মালয়েশিয়ায় রয়েছে বিশাল শ্রমবাজার। মালয়েশিয়ার অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে শ্রমশক্তির চাহিদা বহুদিন থেকেই রয়েছে। নিজস্ব শ্রমশক্তি পর্যাপ্ত না হওয়ায় দেশটি বিদেশি শ্রমশক্তির ওপর নির্ভরশীল হয়ে রয়েছে। আধুনিক মালয়েশিয়ার স্থপতি সাবেক প্রধানমন্ত্রী মাহাথির মোহাম্মদের শাসনামলে সেদেশে ব্যাপক উন্নয়ন কর্মকাণ্ড ও শিল্পায়ন শুরু হয়। তখনই বাংলাদেশের শ্রমিকদের সেদেশে যাওয়ার সুযোগ সৃষ্টি হয়।
বাংলাদেশের শ্রমিকরা মালয়েশিয়ার পাম বাগান, পামতেল কারখানা, নির্মাণকাজ, শিল্পপ্রতিষ্ঠান, বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানসহ বিভিন্ন স্থানে দক্ষতার সঙ্গে কাজ করে আসছেন দীর্ঘদিন ধরে। মালয়েশিয়ায় শ্রমিকদের মজুরি অন্যান্য দেশের তুলনায় কম। কিন্তু অন্য দেশে যাওয়ার সুযোগ কম, সেজন্য আমাদের কর্মীরা মালয়েশিয়া যেতে আগ্রহী হন। এরই সুযোগ নেয় আদম ব্যাপারীরা। বেসরকারি রিক্রুটিং এজেন্টরা সরকার নির্ধারিত খরচের চেয়ে বহুগুণ বেশি টাকা আদায় করে শ্রমিকদের কাছ থেকে। তারপরও প্রতারণার শিকার হন শ্রমিকরা। অনেক টাকা খরচ করেও বহু কর্মী মালয়েশিয়া যেতে পারেন না। এ পরিস্থিতির অবসান হওয়া জরুরি শ্রমিকদের ও দেশের স্বার্থে।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গত ৫ জুন জাতীয় সংসদে বলেছেন, মালয়েশিয়ায় কর্মী পাঠানোর ক্ষেত্রে কী সমস্যা হয়েছে, তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে। এ ঘটনায় কেউ দায়ী থাকলে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান প্রতিমন্ত্রী শফিকুর রহমান চৌধুরীও বলেছেন, তদন্ত কমিটির মাধ্যমে সবকিছু তদন্ত হবে। দায়ী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
এবার যে ঘটনা ঘটেছে, তা আগেও ঘটেছে। কারা এসব করে, কীভাবে ঘটায় সবাই তা জানে। তাই আগেই সতর্ক থাকা উচিত ছিল। তদন্ত কমিটির মাধ্যমে সরকার তদন্ত করে দেখতে চায়, সেটা ভালো কথা। কিন্তু একটি বিষয় নিশ্চিত করতে হবে। সেটা হচ্ছে রিক্রুটিং এজেন্সি, যাদের লোকে ‘আদম ব্যাপারী’ বলে, তাদের ওপর কঠোর নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখা। সংশ্লিষ্ট সরকারি কর্মকর্তারাও যেন শ্রমিকদের স্বার্থ রক্ষা করে কাজ করেন, সেটাও সরকারকে দেখতে হবে। শ্রমিকরা যেন সরকার নির্ধারিত খরচের মধ্যেই স্বস্তির সঙ্গে বিদেশে যেতে পারেন এবং সেখানে স্বস্তির মধ্যে কাজ করতে পারেন, সেটা নিশ্চিত করা রাষ্ট্রের দায়িত্ব।
চপল বাশার : সাংবাদিক, লেখক