Logo
Logo
×

বাতায়ন

ঘূর্ণিঝড় রিমাল-পরবর্তী করণীয়

Icon

এম এ হালিম

প্রকাশ: ২৯ মে ২০২৪, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

ঘূর্ণিঝড় রিমাল-পরবর্তী করণীয়

দুর্যোগ মোকাবিলায় আমাদের সক্ষমতা আবারও প্রমাণিত হলো। আমাদের প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো, মাঠপর্যায়ে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের তৎপরতা এবং সমন্বিত প্রয়াসের কারণেই মাত্র ১০ জনের প্রাণহানির মধ্য দিয়ে রবি ও সোমবার ১৯ জেলার ১০৭ উপজেলার উপর দিয়ে বয়ে যাওয়া ঘূর্ণিঝড় রিমাল দক্ষভাবে মোকাবিলা করা সম্ভব হয়েছে। অথচ অতীতে এর চেয়ে কম মাত্রার ঘূর্ণিঝড়ে অনেক প্রাণহানির রেকর্ড রয়েছে। এবারও প্রাণহানি আরও বেশি হতে পারত, যদি না সরকারি হিসাবমতেই ৮ লক্ষাধিক বিপদাপন্ন মানুষকে ঘূর্ণিঝড়ের আগে আশ্রয়কেন্দ্রে আনা সম্ভব হতো। এসব মানুষকে আশ্রয়কেন্দ্রে নিতে সিপিপি, রেড ক্রিসেন্ট ও অন্যান্য সংস্থার স্বেচ্ছাসেবক এবং স্থানীয় কর্তৃপক্ষের উদ্যোগ ছিল প্রশংসাযোগ্য। সরকারের দুর্যোগবিষয়ক স্থায়ী আদেশাবলির (Standing Orders on Disaster-SOD) নির্দেশনা অনুসারে ঘূর্ণিঝড়ের অনেক আগে থেকেই বিভিন্ন উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। বিপদাপন্ন মানুষকে আশ্রয়কেন্দ্রে নেওয়া ছিল বড় প্রতিবন্ধকতা, কারণ এখনো মানুষ আশ্রয়কেন্দ্রে যাওয়ার জন্য শেষ মূহূর্ত পর্যন্ত অপেক্ষা করে। এর কারণ দুটি : ১. অপর্যাপ্ত আশ্রয়কেন্দ্র, ২. আশ্রয়কেন্দ্রে পর্যাপ্ত নিরাপত্তা ও সুযোগ-সুবিধার অভাব। তবুও প্রশাসনিক উদ্যোগ, স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের অংশগ্রহণ এবং স্বেচ্ছাসেবকদের প্রচেষ্টায় ৮ লক্ষাধিক মানুষকে আশ্রয়কেন্দ্রে নেওয়া সম্ভব হয়েছে। উল্লেখ্য, একই সময়ে যুক্তরাষ্ট্রের দুটি অঙ্গরাজ্যে টর্নেডো ও ঝড়ে অন্তত ১৮ জনের প্রাণহানি হয়েছে। সম্প্রতি ইউএনডিপির উদ্যোগে একটি প্রকল্পের আওতায় জেলা ও উপজেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মকর্তাদের (ডিআরআরও, পিআইও) জন্য পরিচালিত যুক্তরাষ্ট্রের দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা সম্পর্কিত একটি কোর্সের সঙ্গে সম্পৃক্ত থেকে সেদেশের স্থানীয়, প্রাদেশিক ও জাতীয় পর্যায়ের প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো সম্পর্কে জানার সুযোগ হয়েছে। আর দেশটির উন্নত প্রযুক্তি ও সম্পদের প্রাচুর্য তো রয়েছেই। তথাপি তাদের উদ্যোগের সঙ্গে জনসম্পৃক্ততা ও স্থানীয় পর্যায়ে আমাদের ঘূর্ণিঝড় প্রস্তুতি কর্মসূচির (সিপিপি) মতো নিবেদিত স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী না থাকার ফলেই সেদেশে প্রাণহানি ও ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে বলে আমার ধারণা।

যা হোক, ঘূর্ণিঝড় রিমালে প্রাণহানির সংখ্যা ন্যূনতম হলেও সম্পদ ও অন্যান্য ক্ষতি ব্যাপক। প্রাথমিক সরকারি তথ্যমতে, ৩৭ লক্ষাধিক মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এছাড়া দেড় লক্ষাধিক ঘরবাড়ি সম্পূর্ণ বা আংশিক বিনষ্ট হয়েছে। উপকূলীয় মানুষের ঘরের দুর্বল অবকাঠামো ও বাতাসের গতিবেগ ক্ষয়ক্ষতি বৃদ্ধিতে ভূমিকা রেখেছে। ঘূর্ণিঝড় রিমালের তাৎক্ষণিক ফলাফল আরও অনেক। অনেক স্থানেই গাছপালা পড়ে রাস্তাঘাট তথা যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়েছে আর বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন হওয়ায় ক্ষতিগ্রস্ত মানুষ ও জনপদ একরকম অবরুদ্ধ হয়ে আছে। এদিকে চট্টগ্রামের পাহাড়ি এলাকায় প্রতিমুহূর্তে শঙ্কা রয়েছে ভূমিধসের। অভিজ্ঞতায় দেখা গেছে, এ ধরনের দুর্যোগে, বিশেষত মুষলধারে বৃষ্টির পর পাহাড় ধস হয় এবং পাহাড়ে বসবাসকারী মানুষের ঘরবাড়ি ধ্বংসসহ প্রাণহানি ঘটে। এবারও তাই প্রশাসনের পক্ষ থেকে পাহাড়ে বসবাসকারীদের নিরাপদ স্থানে সরে যেতে উদ্বুদ্ধ করা হচ্ছে।

ঘূর্ণিঝড়ের আগে ও চলমান অবস্থা দক্ষভাবেই মোকাবিলা করা গেছে বলতে হবে। এখন আমাদের দৃষ্টি দিতে হবে স্বল্পতম সময়ে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের দুর্ভোগ কমিয়ে আনা ও তাদের জরুরি চাহিদা মেটানোর ওপর। সোমবার ইউনিসেফ এক বিবৃতিতে আশঙ্কা প্রকাশ করেছে, ঘূর্ণিঝড়ের ফলে ৮৪ লাখ মানুষ পুষ্টি, স্বাস্থ্য, স্যানিটেশন ও নিরাপত্তা ঝুঁকিতে রয়েছে; এর মধ্যে ৩২ লাখ শিশু। অভিজ্ঞতায় দেখা গেছে, ঘূর্ণিঝড়ের পর খাদ্য সমস্যার চেয়ে বেশি সংকট হয় বিশুদ্ধ পানির, কারণ ঘূর্ণিঝড়ে পানির উৎস নষ্ট অথবা ব্যবহার-অযোগ্য হয়ে যায়। বিশেষত সমুদ্রের লবণাক্ত পানি পুকুর ও নলকূপের পানিতে মিশে তা দূষিত করে। ফলে বিশুদ্ধ খাবার পানির অভাবে নানা পানিবাহিত রোগ ছড়িয়ে পড়ে। তাই সময়মতো ব্যবস্থা না নিলে এর ফলাফল ভয়াবহ হতে পারে। আমাদের মনে রাখতে হবে, খুলনা ও সাতক্ষীরার কিছু উপজেলায় যেমন-কয়রা, দাকোপ, শ্যামনগর, আশাশুনিতে সারা বছর, বিশেষত শুষ্ক মৌসুমে বিশুদ্ধ খাবার পানি সংকট বিরাজমান।

অতীতের মতো এবারও অনেক জায়গায় বেড়িবাঁধ ভেঙে গিয়ে অনেক গ্রাম তলিয়ে গেছে এবং মানুষ পানিবন্দি হয়ে আছে। উঠতি ফসল নষ্ট হয়েছে এবং মাছচাষিদের ক্ষতি হয়েছে ব্যাপক। আবারও দেখা গেল বাঁধ নির্মাণে কর্তৃপক্ষের গাফিলতি আর তা রক্ষায় নজরদারির অভাব। ক্ষতিগ্রস্ত বাঁধ দ্রুত মেরামত করা সম্ভব না হলে মানুষের দুর্ভোগ ও ক্ষতি কমানো সম্ভব হবে না, বরং বাড়বে ক্রমাগত। ঘূর্ণিঝড়ের সামগ্রিক ক্ষয়ক্ষতির আর্থিক পরিসংখ্যান এখনই পাওয়া না গেলেও তা অনেক হবে, যা সহজেই অনুমেয়।

যে কোনো দুর্যোগ মোকাবিলায় সরকারের পাশাপাশি রেড ক্রিসেন্টসহ এখন অনেক প্রতিষ্ঠানই সক্রিয়। ঘূর্ণিঝড় রিমাল-পরবর্তী ত্রাণ ও পুনরুদ্ধার (রিকভারি) উদ্যোগেও সবারই অংশগ্রহণ থাকবে আশা করা যায়। কিন্তু অভিজ্ঞতা রয়েছে, দুর্যোগ-পরবর্তী ত্রাণ ও পুনরুদ্ধার কাজে বড় প্রতিবন্ধকতা হচ্ছে সমন্বয়হীনতা। প্রত্যেক প্রতিষ্ঠানই তাদের সম্পদ বিবেচনায় নিজ নিজ অগ্রাধিকারকে প্রাধান্য দেয়। ফলে কোথাও অধিক আবার কোথাও অপর্যাপ্ত অথবা চাহিদার সঙ্গে সম্পর্কহীন সাহায্য-সহযোগিতা বিতরণ করা হয়। এছাড়া প্রত্যেক প্রতিষ্ঠানই স্ব স্ব দাতাগোষ্ঠীকে টার্গেট করে বিচ্ছিন্নভাবে ক্ষয়ক্ষতি ও চাহিদা জরিপ করে থাকে; যা সময় ও অর্থের অপচয় ঘটায়। অথচ সমন্বিত জরিপ করা গেলে সময় ও অর্থ সাশ্রয় করে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের মধ্যে দ্রুত ও তাদের চাহিদানুসারে সহযোগিতা পৌঁছে দেওয়া সম্ভব। তবে এক্ষেত্রে আদর্শ জরিপ ফরম ব্যবহারে সবার ঐকমত্য থাকতে হবে; কারণ, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান নিজস্ব ফরম ব্যবহার করে। আবার সরকারি ক্ষয়ক্ষতি ও চাহিদা নিরূপণ ফরম (ডি ফরম) বেশ জটিল বলতে হবে। তাই সরকারের সংশ্লিষ্ট অধিদপ্তর তথা ডিডিএমের উদ্যোগে অংশগ্রহণমূলকভাবে এ ফরমকে আরও সহজ বা বাস্তবসম্মত করা গেলে সব প্রতিষ্ঠানই তা ব্যবহারে উৎসাহী হবে; যা সময় ও অর্থের সাশ্রয় করবে এবং সমন্বিত কার্যক্রম বাস্তবায়নে ভূমিকা রাখবে।

সমকালীন জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে দুর্যোগ-পরবর্তী সেবা কার্যক্রমে ক্ষতিগ্রস্তদের সম্পৃক্ত করার বিষয়টিকে গুরুত্ব দেওয়া হয়। এছাড়া দুর্যোগে অধিক বিপদাপন্ন তথা নারী, শিশু, প্রতিবন্ধী এসব জনগোষ্ঠীর প্রতি বিশেষ দৃষ্টি দিতে উৎসাহ দেওয়া হয়, কারণ ভিন্ন ভিন্ন ব্যক্তির দুর্যোগে ক্ষয়ক্ষতি ও চাহিদা ভিন্ন ভিন্ন হয়। ঘূর্ণিঝড় রিমাল-পরবর্তী আমাদের সব উদ্যোগেই যেন আমরা এদিকটাকে গুরুত্ব দিই। এছাড়া সব উদ্যোগেই জনসম্পৃক্ততা নিশ্চিত করতে হবে, যাতে তারা তা বাস্তবায়নে উৎসাহী হয়ে অংশগ্রহণ করে; যা তাদের সক্ষমতা বৃদ্ধিসহ ভবিষ্যৎ ঝুঁকি হ্রাসে ভূমিকা রাখবে।

এদিকে ঘূর্ণিঝড় রিমালের প্রভাবে উপকূলীয় অঞ্চলের জনগোষ্ঠীর ক্ষতি ও দুর্ভোগের পাশাপাশি শহর-শহরতলির দুর্ভোগও কম নয়। একদিনে ঢাকায় ১৫১ মিলিমিটার ও চট্টগ্রামে ২৩৫ মিলিমিটার বৃষ্টিপাতের ফলে সৃষ্ট জলাবদ্ধতায় জনদুর্ভোগ হয়েছে কল্পনাতীত। এ ধরনের দুর্ভোগ এবারই প্রথম নয়। অতীতে সামান্য বৃষ্টিতেই দুই বড় শহরে জলাবদ্ধতাজনিত জনদুর্ভোগ দেখা গেছে, আর প্রতিবারই কর্তৃপক্ষকে বলতে শুনেছি, সামনে আর জলাবদ্ধতা থাকবে না। কিন্তু অবস্থার পরিবর্তন বা উন্নতির দেখা মেলেনি। এবারও তা-ই হলো। অথচ শোনা যায়, জলাবদ্ধতা দূর করতে শত নয়, হাজার হাজার কোটি টাকা খরচ করা হয়। ঘূর্ণিঝড়ের কারণে হঠাৎ অস্বাভাবিক বৃষ্টি হয়েছে, তাই এ দুর্ভোগ-একথা তর্কের খাতিরে মেনে নিলেও আসন্ন বর্ষাকালকে সামনে রেখে এখনই কার্যকর ব্যবস্থা না নিলে এ ধরনের জনদুর্ভোগ চলতেই থাকবে।

প্রযুক্তির উৎকর্ষের ধারায় এখন ঘূর্ণিঝড়ের সংকেত বা পূর্বাভাস অনেক আগে থেকেই পাওয়া সম্ভব হচ্ছে। তথাপি জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণে প্রতিনিয়তই ঘূর্ণিঝড়ের ধরন ও গতিপথ পরিবর্তন হচ্ছে। অর্থাৎ নতুন নতুন জনপথ বিপদাপন্ন হচ্ছে। উদাহরণ হিসাবে বলা যায়, ২০২৩ সালে বাগেরহাটের মোরেলগঞ্জকে সিপিপির আওতাভুক্ত করা হয়েছে। এভাবে বিপদাপন্ন সব জনগোষ্ঠীকে সতর্ক সংকেতের আওতায় আনতে হবে। এ লক্ষ্যেই জাতিসংঘ ‘সবার জন্য পূর্ব সংকেত’ (Early Warning for All-EW4ALL) বাস্তবায়নের উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। জাতিসংঘ বলছে, বিশ্বে এখনো অর্ধেক জনগোষ্ঠীর কাছে দুর্যোগের সতর্কবার্তা পৌঁছে না। আশার কথা, বাংলাদেশ অন্তত ঘূর্ণিঝড়ের আগাম সতর্কবার্তা প্রচারে এগিয়ে আছে। তবুও ভবিষ্যৎ দুর্যোগের কথা বিবেচনায় ব্যক্তি, পরিবার, জনগোষ্ঠীর মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে এবং এ ব্যাপারে প্রাতিষ্ঠানিক উদ্যোগ প্রয়োজন। মনে রাখতে হবে, দুর্যোগ প্রস্তুতিতে যত বেশি বিনিয়োগ করা যাবে, ক্ষয়ক্ষতি ততই কম হবে। জাতিসংঘ বলছে, দুর্যোগের আগে ১ ডলার বিনিয়োগ করলে দুর্যোগের পর ১০ ডলারের সমপরিমাণ ক্ষয়ক্ষতি কমানো সম্ভব।

দুর্যোগ প্রস্তুতিতে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের নিজস্ব বাজেট থাকে। কিন্তু বিশ্বের অনেক দেশের তুলনায় আমাদের জাতীয় বাজেটে এ খাতে বরাদ্দ উল্লেখযোগ্য নয়। আসন্ন বাজেটে তাই দুর্যোগ প্রস্তুতিতে অধিক বরাদ্দের প্রস্তাব রইল। কারণ সরকারি-বেসরকারি-করপোরেট সেক্টর ও উন্নয়ন সংস্থার সম্মিলিত প্রচেষ্টার মাধ্যমেই সম্ভব ঘূর্ণিঝড় রিমালের মতো অনাকাঙ্ক্ষিত দুর্যোগ আরও দক্ষভাবে মোকাবিলা করা।

এম এ হালিম : সাবেক পরিচালক, বাংলাদেশ রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটি; দুর্যোগ, জলবায়ু ও মানবিক বিষয়ে কলাম লেখক

halim_64@hotmail.com

 

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : সাইফুল আলম

প্রকাশক : সালমা ইসলাম