সংসদ-সদস্য আনোয়ারুল আজিম ভারতের কলকাতায় খুন হয়েছেন। কোনো হত্যাকাণ্ডকেই স্বাভাবিকভাবে দেখার সুযোগ নেই। এক দেশের নাগরিক অন্য দেশে গিয়ে খুন হওয়া আরও অস্বাভাবিক ঘটনা। আর যদি একটি দেশের সংসদ-সদস্য অন্য দেশে গিয়ে খুন হন, সেটি শুধু অস্বাভাবিকই নয়, বিস্ময়করও বটে। বাংলাদেশের পুলিশের ভাষ্যমতে, এমপি আজিমকে অত্যন্ত মর্মান্তিকভাবে খুন করা হয়েছে। তার খুন হওয়া ও খুন-পরবর্তী দেহাবশেষ নিয়ে বিভিন্ন ঘটনা এখনো গণমাধ্যমে আসছে। তবে শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত তার দেহাবশেষ পাওয়া যায়নি।
নানা কারণেই মানুষ এক দেশে থেকে আরেক দেশে যাতায়াত করে। বিদেশে অবস্থানকালে নানা দুর্ঘটনায় মানুষ আহত-নিহতও হতে পারে। মধ্যপ্রাচ্যে অনেক বাংলাদেশি আছেন। অনেকের স্বাভাবিক মৃত্যু ঘটে, অনেকে আবার বিভিন্ন দুর্ঘটনায় নিহত হন। খুনও হয়েছেন কম নয়। খুনের ঘটনাগুলো আমাদের উদ্বেগের কারণ। ওইসব ঘটনায় রাষ্ট্রীয় পর্যায় থেকে বাংলাদেশের উদ্বেগ জানানো প্রয়োজন। প্রবাসী নাগরিকদের প্রতি এটি একটি দেশের অতি স্বাভাবিক নৈতিক, আইনগত অধিকার ও চাওয়া। যদিও মধ্যপ্রাচ্যের ওইসব দেশ নিজে থেকেই হত্যাকাণ্ডের তদন্ত ও বিচার করে থাকে। সেসব দেশে আইন তার নিজস্ব গতিতে চলে। তদন্তের আগেই কাউকে দায়ী করা বা দায়মুক্তি দেওয়ার রেওয়াজ নেই। নিজ দেশে অন্য দেশের নাগরিক খুন হলে সব দেশই বিষয়টিকে অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে নিয়ে তার তদন্ত ও বিচার করে থাকে। এটি একটি স্বাভাবিক কূটনৈতিক সম্পর্কেরও পরিচায়ক।
ভারতের মাটিতে একজন বাংলাদেশি নাগরিক খুন হলেন, তিনি শুধু একজন সাধারণ নাগরিকই নন, একজন আইনপ্রণেতাও। একজন সাধারণ নাগরিকও যদি কোনো দেশে খুন হন, তাহলেও সংশ্লিষ্ট দেশ কোনোভাবেই সে দায় এড়াতে পারে না। বলা হচ্ছে, অপরাধীরা সবাই বাংলাদেশি। কিন্তু ঘটনাস্থল তো ভারতের। ভারতের মাটিতেই এরকম একটি অপরাধ হয়ে গেল। সেখানে একজন আমেরিকান নাগরিক (যিনি বাংলাদেশিও বটে) একটি ফ্ল্যাট ভাড়া করেছেন। সেই ফ্ল্যাটেই একজন এমপিকে নিয়ে যাওয়া হলো, অতঃপর তাকে খুন করা হলো। খবরে এসেছে, কয়েকদিন ধরে তার মৃতদেহ টুকরা টুকরা করে কেটে, হলুদ বা মসলা মিশিয়ে ব্যাগে বা ট্রলিতে করে সেই ফ্ল্যাট থেকে বের করে অন্য কোথাও নিয়ে ফেলে দেওয়া হয়েছে। কয়েকদিন ধরে এ কাজটি করা হয়েছে। কাজেই, এ ঘটনা ও ঘটনার সঙ্গে জড়িত নিরাপত্তাসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের কি কোনো দায় নেই?
এছাড়া, তদন্ত হওয়ার আগেই আমাদের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেন, হত্যাকাণ্ডে জড়িত সবাই বাংলাদেশি, ভারতের কেউ জড়িত নন। কোনোরকম তদন্তের আগেই সরকারের উচ্চপর্যায় থেকে এমন মন্তব্য কি তদন্ত ও বিচার প্রক্রিয়াকে একটুও বাধাগ্রস্ত করবে না? হতে পারে আসলেই এ ঘটনায় ভারতের কেউ জড়িত নয়; কিন্তু তারপরও কোনোরকম তদন্ত হওয়ার আগেই এ ধরনের মন্তব্য তদন্ত ও বিচার প্রক্রিয়াকে প্রভাবিত করার শামিল।
এ ঘটনায় জড়িত সন্দেহভাজন অনেক আসামিকে ধরা হয়েছে। তদন্ত এখনো চলছে। তদন্ত যে চূড়ান্ত হয়নি, তার প্রমাণ ডিবিপ্রধান মোহাম্মদ হারুন অর রশীদের নেতৃত্বে তিন সদস্যের একটি তদন্ত দল রোববার কলকাতায় গিয়েছেন তদন্ত করতে। একদিকে তদন্তের জন্য আমাদের ডিবিপ্রধান ভারতে গিয়েছেন, আরেকদিকে তদন্ত হওয়ার আগেই আমরা একজনকে দায়মুক্তি দিচ্ছি। তদন্তের আগেই এ ধরনের মন্তব্য অনভিপ্রেত।
এদিকে একই দিন এমপি আজিমের মেয়ে দাবি করছেন, তার বাবাকে যে হত্যা করা হয়েছে, তিনি তার প্রমাণ চান। অত্যন্ত যৌক্তিক দাবি। যেহেতু তার কোনো দেহাবশেষ এখনো পাওয়া যায়নি। কতিপয় সন্দেহভাজন ধৃত আসামির ভাষ্যই প্রমাণ করে না যে তাকে হত্যা করা হয়েছে। হত্যা করা হলে তার লাশ কোথায় কোথায় ফেলা হয়েছে, সেখানে অনুসন্ধান করা হোক। মূল কথা হলো, ঘটনাটির তদন্ত এখনো চলমান এবং খুনের বিষয়টি প্রমাণসাপেক্ষ।
কলকাতা পুলিশও বলেছে, আনার খুন হয়েছেন সঞ্জীবা গার্ডেনের একটি ফ্ল্যাটে। সেখানে আনারের রক্তমাখা কাপড় এবং জমাট রক্ত পাওয়া গেছে। পুলিশ এত নিশ্চিত হলো কীভাবে? এখনো কি ডিএনএ টেস্ট হয়েছে যে এটা আনারেরই জামা ও রক্ত? কার জামা, কার রক্ত-এসব পরীক্ষা-নিরীক্ষার আগেই নিশ্চিত হওয়া যায় না। আইন-আদালতের কাছে এসব তথ্য প্রমাণ করতে হবে।
মুম্বাই থেকে বাংলাদেশি কসাই জিহাদকে ভাড়া করে আমেরিকান এক বাংলাদেশি নাগরিক কলকাতায় গিয়ে একজন বাংলাদেশি এমপিকে হত্যা করে, সেই খুনি আবার বাংলাদেশ হয়ে আমেরিকা চলে গেল-এটি শুধু চাঞ্চল্যকরই নয়, রীতিমতো বিস্ময়কর এবং যে কোনো গোয়েন্দা ও থ্রিলার সিনেমাকেও হার মানায়। স্যার আর্থার কোনান ডয়েলও এমন ঘটনার জাল বিস্তার করতে পারেননি। কারণ, শার্লক হোমসকে দিয়ে তিনি সে ঘটনার রহস্য উন্মোচন করাতে পারতেন না। কিন্তু আমাদের দেশের গোয়েন্দাপ্রধানের আগেই সরকারি তরফে সে ঘটনার জন্য কে দায়ী তা জলবৎ তরল করে প্রকাশ করা হয়েছে। জাতি শুধু এখন এ বিচারের শেষটা দেখার অপেক্ষায়।
এ ঘটনার সঙ্গে শাহীন, শিলাস্তি আরও অনেক নাম জড়িয়েছে। শাহীনের রহস্যঘেরা বাংলোর কথা উঠে এসেছে। আমরা চাই, সব রহস্যের উন্মোচন হোক। খুনিকে দেশে ফিরিয়ে আনা হোক। আমেরিকার সঙ্গে আমাদের কোনো প্রত্যর্পণ চুক্তি নেই। তাই শাহীনকে আমরা ফিরিয়ে আনতে পারব না। ভারতের মাটিতে যেহেতু খুন হয়েছে, তাই ভারত চাইলে খুনি শাহীনকে ফেরত চাইতে পারে। দেখা যাক আমাদের বন্ধুরাষ্ট্র ভারত এদেশের একজন এমপির হত্যাকারীকে আমেরিকা থেকে ফেরত চায় কিনা।
ঘটনার আপাত বর্ণনায় এটা পরিষ্কার যে, এটি একটি পূর্বপরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড। আমাদের গোয়েন্দা বিভাগ বলছে, আখতারুজ্জামান নামের এক যুক্তরাষ্ট্রপ্রবাসী এক মাস আগে থেকেই এ হত্যার পরিকল্পনা করে। ওই ব্যক্তি এমপি আজিমের বন্ধু ও ব্যবসায়িক অংশীদার। ব্যবসার ভাগবাঁটোয়ারা নিয়ে বিরোধের জের ধরেই এ হত্যাকাণ্ড।
এমপি আজিমের বিরুদ্ধে অভিযোগ নতুন নয়। তার বিরুদ্ধে ২১টি মামলা ছিল। অস্ত্র ও বিস্ফোরক, মাদকদ্রব্য ও স্বর্ণ চোরাচালান, হুন্ডি ব্যবসা, চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, দখলবাজি এবং চরমপন্থিদের আশ্রয় দেওয়ার অভিযোগে মামলা ছিল তার বিরুদ্ধে। ২০০৭ সালে ইন্টারপোল রেড নোটিশ জারি করেছিল আজিমের বিরুদ্ধে। এ সরকার ক্ষমতায় আসার পর সেসব ওয়ারেন্ট প্রত্যাহার করা হয়। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর তার বিরুদ্ধে দায়ের করা সব মামলাও প্রত্যাহার করা হয় এবং ২০১৪, ২০১৮ ও ২০২৪ সালে তাকে সংসদ-সদস্য নির্বাচিতও করা হয়।
ইন্টারপোলের পরোয়ানা থাকার পরও এমন একজনের পরপর তিনবার এমপি হওয়া প্রমাণ করে তার ক্ষমতার উৎসমূল অনেক গভীরে। তিনি যে একজন আন্তর্জাতিক চোরাকারবারি, আওয়ামী লীগ সেটা জানত না, তা হতে পারে না। প্রশ্ন হচ্ছে, আওয়ামী লীগে এরকম আনোয়ারুল আজিম কি একজনই ছিল বা আছে? এবং অন্যান্য রাজনৈতিক দলেও কি এমপি আজিমের মতো রাজনীতিক নেই? দেশে কি আর সোনা চোরাচালানকারী নেই? আর কোনো মাদক ব্যবসায়ী নেই? সবাইকে কি মরিয়াই প্রমাণ করিতে হইবে যে, সে চোরাকারবারি ছিলেন?
ডিবিপ্রধান বলেছেন, এর আগেও আরও দুবার আনারকে হত্যার পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছিল। নির্বাচনের আগে এবং জানুয়ারির মাঝামাঝি তাকে হত্যার পরিকল্পনা করা হয়। দুবার ব্যর্থ হওয়ার পর তৃতীয় দফায় তাকে হত্যা করতে সক্ষম হয় পরিকল্পনাকারীরা। যদি তাই হয়ে থাকে, তবে তার নিরাপত্তা কেন জোরদার করা হলো না? আর হত্যার পরিকল্পনাকারীরাই কারা? কেন তাদের এতদিন ধরা হলো না?
এ হত্যাকাণ্ডের মোটিভ কী হতে পারে-সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নের জবাবে ডিবিপ্রধান বলেন, ‘স্পেসিফিক রিজন বলতে পারছি না। অনেক মোটিভ হতে পারে। পূর্বশত্রুতার জেরে হতে পারে, আর্থিক লেনদেন সংক্রান্ত হতে পারে, রাজনৈতিক বিষয়ও থাকতে পারে। এসব বিষয় জানতে তদন্ত চলছে। তদন্ত শেষ না হওয়া পর্যন্ত বলা যাচ্ছে না।’ তিনি যথার্থই বলেছেন। আমরাও চাই সব রহস্য উন্মোচিত হোক, প্রকৃত খুনিরা বের হয়ে আসুক।
দেশের রাজনীতির সঙ্গে অপরাধজগতের সম্পর্ক নতুন কিছু নয়। আনোয়ারুল আজিম তারই দৃষ্টান্ত। একসময় এদেশের অপরাধীরা সীমান্ত পার হয়ে কলকাতায় আশ্রয় নিতেন। এতদিনেও সে অবস্থার পরিবর্তন হয়নি। কলকাতা যেন আজও এদেশের শীর্ষ সন্ত্রাসীদের এক আস্তানা। দুই প্রতিবেশী দেশকেই এ বিষয়ে ভাবতে হবে। দুই দেশের নিরাপত্তার জন্যই বিষয়টি উদ্বেগের।
বাংলাদেশি আমেরিকান প্রবাসী বাংলাদেশ থেকে ভারতে গিয়ে হত্যাকাণ্ড ঘটিয়ে বাংলাদেশে এসে আবার আমেরিকা চলে গেছেন। অথচ দুটি দেশের আইনশৃঙ্খলা বাহিনী, সীমান্তরক্ষী, ইমিগ্রেশন বিভাগ কেউ টেরই পেল না! আসামি পালিয়ে যাওয়ার পর সবকিছু জানা গেল। এটি দুই দেশরই নিরাপত্তাব্যবস্থাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে। অপরাধীরা নির্বিঘ্নে একটি দেশে বহুবার আসা-যাওয়া করতে পারছে, অথচ একজন সাধারণ রোগীকে চিকিৎসা ভিসার জন্য দিনের পর দিন অপেক্ষা করতে হচ্ছে। এ কেমন নিরাপত্তা ও ইমিগ্রেশন ব্যবস্থা? বিষয়টি নিয়ে ভাবার অবকাশ আছে প্রতিবেশী ভারতেরও।
রাজনীতির সঙ্গে অপরাধজগতের যোগসাজশ যতদিন থাকবে, ততদিন এমপি আজিমদের জন্ম হতেই থাকবে, মৃত্যু যেভাবেই হোক না কেন, আমরা চাই রাজনীতিকরা বেঁচে থাকুন আমাদের আইনপ্রণেতা বা সংসদ-সদস্য হয়ে, অপরাধজগতের সদস্য হয়ে নয়। তাদের মৃত্যুও হোক জীবন-মৃত্যুর স্বাভাবিক নিয়মে-আমাদের প্রিয় অভিভাবক হয়ে, চোরাকারবারি, গডফাদার সন্ত্রাসী হয়ে নয়। এ হত্যার সুষ্ঠু তদন্ত ও বিচার হোক। নতুন কোনো আজিমের এভাবে মৃত্যু না হোক, জন্মও না হোক।
এরশাদুল আলম প্রিন্স : আইনজীবী, প্রাবন্ধিক