কোচিং-নির্ভরতায় বৈষম্য বাড়ছে
সালাহউদ্দিন শাহরিয়ার চৌধুরী
প্রকাশ: ২৭ মে ২০২৪, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
সকাল ৭টা থেকে সন্ধ্যা ৭টা, রাস্তায় পিঠে স্কুলব্যাগ নিয়ে শিক্ষার্থীদের ভিড়, এই চিত্রটি রাজধানী ঢাকা শহরসহ অনেক বিভাগীয় শহরের। তাদের গন্তব্য স্কুল বা কলেজ নয়-তাদের গন্তব্য কোচিং সেন্টার। বর্তমানে দেশের শিক্ষাব্যবস্থায় কোচিং সেন্টার-নির্ভরতা দিনে দিনে বাড়ছে। কিন্তু কেন শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের এ কোচিং-নির্ভরতা? এর বড় কারণ হচ্ছে, দেশের শিক্ষাব্যবস্থা এখন অনেকটাই পরীক্ষা ও নম্বরকেন্দ্রিক, তাই পরীক্ষায় ভালো ফলাফলের আশায় এর পেছনে ছুটছে শিক্ষার্থী ও অভিভাবকরা। তাদের জিজ্ঞেস করলে একটিই উত্তর-ভালো ফলাফলের জন্য কোচিংয়ে পড়তে হবে, স্কুল বা কলেজে তো তেমন পড়ালেখা হয় না, স্কুলগুলোতে মানসম্পন্ন পড়াশোনা না হওয়ায় অপারগ হয়েই আমরা কোচিং সেন্টারমুখী হচ্ছি। পরীক্ষায় ভালো নম্বর পাওয়ার জন্য যেতে হবে কোচিং সেন্টারে, স্কুলে গুরুত্ব দিয়ে শেখালে কোচিংয়ে যেতে হতো না। বরং কোচিংয়ে গেলে কিছু শেখা যায়, নিয়মিত পরীক্ষা হয়, কোচিংয়ে বিষয়গুলো প্র্যাকটিস করে যেতে হয়, কোচিংয়ের পরীক্ষার জন্য প্রস্তুতি নিতে হয়। কোচিংয়ের বিশেষত্ব হচ্ছে তারা শিক্ষা বছরের শুরু থেকেই পাঠ্যবইয়ের চ্যাপ্টারগুলো সামারাইজ করে ছোট আকারে তৈরি করে, যাতে পরীক্ষায় ওই শিক্ষার্থী জিপিএ-৫ বা ভালো রেজাল্ট করতে পারে। তাদের মতে, এখন শিক্ষার্থীরা আর শেখার জন্য বা লেখাপড়ার জন্য স্কুল-কলেজে যায় না, তারা স্কুলে যায় শিক্ষার্থী হিসাবে স্কুলের তালিকায় নাম থাকার জন্য। ভালো রেজাল্টের আশায় এভাবে অভিভাবকরা অতিরিক্ত অর্থ ব্যয় করে ছেলেমেয়েদের কোচিংয়ে বা প্রাইভেট শিক্ষকের কাছে পাঠাচ্ছেন।
একজন অভিভাবক, প্রতি মাসেই একজন শিক্ষার্থীর স্কুল-কলেজের বেতন, ফি ও অন্যান্য খরচ ছাড়াও কেবল কোচিং এবং প্রাইভেটের পেছনেই অন্তত ৫ থেকে ২০ হাজার টাকা ব্যয় করছেন। অভিভাবকরা বলছেন, জিপিএ-৫ পাওয়া শিক্ষার্থীর সাফল্যের পেছনে বর্তমানে স্কুল বা কলেজের কোনো কৃতিত্ব নেই। তাদের মতে, ভালো কোচিং সেন্টারে টাকা খরচ করে পড়ালেখা করিয়েছেন বলেই তার সন্তান এ কৃতিত্ব অর্জন করেছে। অর্থাৎ ভালো রেজাল্টের জন্য এ প্রতিযোগিতা, আর এতে তারাই ভালো করছে, যারা আর্থিকভাবে সচ্ছল। অন্যদিকে প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়ছে অসচ্ছল পরিবারের সন্তানরা, ফলে মেধা বিকাশে তৈরি হচ্ছে বৈষম্য। অভিভাবক ও শিক্ষার্থীর এমন মতামত পুরোটা সত্যি না হলেও অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সত্য। কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া সামগ্রিক এ চিত্র পুরো দেশের। চিত্রটি এমন, কোচিংগুলোই এখন আমাদের মূল ব্যবস্থা; স্কুলগুলো সহায়ক ভূমিকা পালন করছে। নানা কারণে শিক্ষকরাও শিক্ষার্থীদের এ ধারণার সঙ্গে নিজেদের মানিয়ে নিয়েছেন। তারাও জানেন শ্রেণিকক্ষে না শেখালেও শিক্ষার্থীরা কোনো না কোনো কোচিং সেন্টারে গিয়ে পড়া শিখবে, পরীক্ষায় ভালো নম্বর পাবে।
নতুন শিক্ষাক্রমে ৭০ শতাংশ পর্যন্ত শিখনকালীন মূল্যায়ন শিক্ষকের হাতে রাখা হয়েছে। শিক্ষার্থীদের পড়ালেখার চাপ কমিয়ে যার যার যোগ্যতা অনুযায়ী আনন্দের সঙ্গে শেখানোই নতুন এ শিক্ষাক্রমের অন্যতম লক্ষ্য। এজন্য নতুন শিক্ষাক্রমে কমানো হয়েছে পরীক্ষানির্ভরতা, বাড়ানো হয়েছে শিখনকালীন মূল্যায়ন, শিক্ষকরাই যার যার শ্রেণির শিক্ষার্থীদের মূল্যায়ন করবে। স্বাভাবিকভাবেই আশা করা হয়েছিল, এতে শিক্ষার্থীদের প্রাইভেট কোচিং-এ পড়ার প্রবণতা কমবে; কিন্তু হয়েছে উলটো। নতুন শিক্ষাক্রম শুরুর পর ভয়াবহভাবে বেড়েছে শিক্ষকদের প্রাইভেট কোচিং বাণিজ্য। অভিভাবকরা বলছেন, আগে শিক্ষার্থীরা সাধারণত ইংরেজি ও গণিত বিষয়ে প্রাইভেট কোচিং করত। কিন্তু নতুন শিক্ষাক্রমে নিজ প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকের হাতে বেশির ভাগ নম্বর থাকায় শিক্ষার্থীদের অন্তত চার-পাঁচটি বিষয়ে প্রাইভেট কোচিং করতে হচ্ছে। অন্যদিকে শিক্ষকরা বলছেন, আমাদের দেশে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে শিক্ষকের চেয়ে শিক্ষার্থীর অনুপাত বেশি। ফলে একটি শ্রেণিকক্ষে ৮০ থেকে একশর বেশি শিক্ষার্থীকে ৩০ থেকে ৪৫ মিনিটে কি শেখানো যাবে-হাজিরা নিতেই তো সময় চলে যায়। সময় কম থাকায় শ্রেণিকক্ষে শিক্ষার্থীদের শেখার চাহিদা মেটানো যায় না। তাই তারা বাধ্য হয়েই কোচিং সেন্টারমুখী হচ্ছেন। তাদের মতে, শিক্ষক-শিক্ষার্থীর অনুপাত কম হলে শিক্ষকরা প্রত্যেক শিক্ষার্থীকে পর্যাপ্ত সময় দিতে পারতেন, তাদের সমস্যা সমাধানে সহযোগিতা করতে পারতেন।
একজন শিক্ষকের পক্ষে কখনোই অনেক শিক্ষার্থীর প্রতি মনোযোগ দেওয়া সম্ভব নয়। এ ধরনের পরিস্থিতিতে শিক্ষককে বাধ্য হয়ে শুধু সিলেবাস শেষ করার দিকে মনোনিবেশ করতে হয়। তাই স্কুলে লেখাপড়া একেবারে হয় না-এমন তথ্য পুরোপুরি সঠিক নয়। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নীতিমালায় বলা হয়েছে, কোনো শিক্ষক তার নিজ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীকে কোচিং করাতে পারবেন না। তবে প্রতিষ্ঠান প্রধানের অনুমতি নিয়ে অন্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীকে পড়াতে পারবেন; কিন্তু এ সংখ্যা দৈনিক ১০ জনের বেশি নয়। দেখা যাচ্ছে, শিক্ষা মন্ত্রণালয় যেন নীতিমালা করেই তাদের সব দায়িত্ব শেষ করেছে, বিষয়গুলো সঠিকভাবে মনিটরিং করছে না। প্রায় ক্ষেত্রেই, প্রতিষ্ঠান প্রধান বা শিক্ষকদের যোগসাজশে সময়ের সমন্বয় করে বিভিন্ন শিক্ষক ও সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা কোচিং সেন্টার পরিচালনা করেন। এমনকি অনেক সময় অনৈতিকভাবে শিক্ষকরা ছাত্রছাত্রীদের প্রাইভেট পড়তে বাধ্য করেন। যারা এ কোচিং ব্যবসায় জড়িত, শ্রেণিকক্ষে এসব শিক্ষক অনেক সময় সঠিক পাঠদান করেন না, তবে কোচিংয়ে খুব ভালো পড়ান। এ কোচিং ব্যবসা এতটাই প্রসার লাভ করেছে যে, তারা রীতিমতো নিশ্চিত জিপিএ-৫, শতভাগ পাশের নিশ্চয়তার মতো নজরকাড়া বিজ্ঞাপন দিয়ে শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের আকৃষ্ট করছে। নানা ধরনের চটকদার বিজ্ঞাপন দেখে মনে হয় শিক্ষা ও শিক্ষার্থী যেন ব্যবসায়িক পণ্য।
এমনিতে আমাদের শিক্ষাক্ষেত্রে বৈষম্য বিদ্যমান, এক্ষেত্রে কোচিং-নির্ভরতা কমাতে না পারলে এ বৈষম্য দিন দিন বৃদ্ধি পাবে। সব অভিভাবকের পক্ষে সন্তানের জন্য হাজার হাজার টাকা কোচিংয়ের খরচ করার সক্ষমতা নেই। সেক্ষেত্রে যাদের আর্থিক সামর্থ্য আছে, শুধু তারাই কোচিং ক্লাসে শিক্ষাগ্রহণের কারণে নিজেদের মেধাবী হিসাব তৈরি করতে পারবে, অন্যরা প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়বে। এ কোচিং-নির্ভরতার ক্ষেত্রে কেউ এককভাবে দায়ী নয়, তাই এ কোচিং-নির্ভরতা কমিয়ে মেধা বিকাশে বৈষম্য দূরীকরণে সবার সমন্বিত প্রচেষ্টা প্রয়োজন। সেই নিরিখে নিম্নোক্ত ব্যবস্থাগুলো সবক্ষেত্রে গ্রহণ করা গেলে হয়তো আমরা তার থেকে কিছু সুফল পেতে পারি-১. শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের কোচিং-নির্ভর হওয়ার মানসিকতার পরিবর্তন করা। ২. শিক্ষকদের ক্লাসরুম ছেড়ে আর্থিক কারণে কোচিং সেন্টারে প্রাইভেট পড়ালেখা করানো মানসিকতা পরিত্যাগ করা, তবে সেক্ষেত্রে শিক্ষকদের আর্থিক নিরাপত্তার বিষয়টিও নিশ্চিত করতে হবে। ৩. ছাত্রছাত্রীদের ক্লাসনির্ভর করে ক্লাসে উপস্থিতি নিশ্চিত করা। ৪. যারা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পরিচালনা করেন, তাদের ব্যবসায়িক মনোবৃত্তি পরিত্যাগ করে শিক্ষার মানোন্নয়নে আরও সচেষ্ট হওয়া। ৫. দেশে ‘জাতীয় শিক্ষানীতি-২০১০’ অনুযায়ী শিক্ষক-শিক্ষার্থী অনুপাত ১:৩০ করার ওপর গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে, এ অনুপাতকে গুরুত্ব দিয়ে সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ছাত্র অনুপাতে শিক্ষক সংখ্যা বৃদ্ধি করা। ৬. প্রতিনিয়ত শিক্ষানীতি বা পদ্ধতি পরিবর্তন হয়, তাই সে অনুযায়ী প্রত্যেক শিক্ষকের যথাযথ প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা। ৭. ছাত্রছাত্রীদের মাধ্যমে শিক্ষকদের প্রতিবছর সার্বিক মূল্যায়নের ব্যবস্থা করা। ৮. প্রতিটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীদের পড়ালেখার অগ্রগতির বিষয়ে ক্লাসভিত্তিক অভিভাবকের সঙ্গে মতবিনিময়ের ব্যবস্থা করা। ৯. কোচিং ব্যবসা বন্ধে সরকারকে কঠোর নেওয়া।
সালাহউদ্দিন শাহরিয়ার চৌধুরী : ডেপুটি রেজিস্ট্রার, বিজিসি ট্রাস্ট ইউনিভার্সিটি, বাংলাদেশ
shahareirbgctub@gmail.com