আশেপাশে চারপাশে
দুই মেয়রের চার বছর নগরবাসীর প্রাপ্তি কী?
চপল বাশার
প্রকাশ: ২৫ মে ২০২৪, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের দুই মেয়র তাদের পাঁচ বছর মেয়াদের চার বছর পূর্ণ করেছেন সম্প্রতি। একই সঙ্গে দুই করপোরেশনের মোট ১২৯ ওয়ার্ডের কাউন্সিলরদেরও চার বছর মেয়াদ পূর্ণ হয়েছে। আগামী বছর মে মাসের মধ্যে দুই সিটি করপোরেশনের মেয়র ও কাউন্সিলর পদে আবার নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে।
দুই মেয়রের চার বছর মেয়াদপূর্তির পর তাদের সাফল্য ও ব্যর্থতা নিয়ে বিভিন্ন মহলে আলোচনা-পর্যালোচনা চলছে। নগরবাসীও হিসাব করে দেখছেন কী তাদের আকাঙ্ক্ষা ছিল, আর কী তারা পেয়েছেন এ চার বছরে। নগর বিশেষজ্ঞরা পর্যালোচনা করেছেন দুই মেয়রের নির্বাচনি-প্রতিশ্রুতি কী ছিল, তার কতটুকু পূরণ হয়েছে। ইনস্টিটিউট ফর প্ল্যানিং অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (আইপিডি) পরিচালক আদিল মুহাম্মদ খান তার এক নিবন্ধে দুই মেয়রের চার বছরের কার্যকাল পর্যালোচনা করেছেন। নিবন্ধে উল্লেখ করা হয়, ‘নির্বাচনি ইশতেহারে উত্তরের মেয়র মো. আতিকুল ইসলাম একটি সুস্থ, প্রাণবন্ত ও আধুনিক শহর গড়ে তোলার জন্য ৩৮টি প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। অপরদিকে দক্ষিণের মেয়র শেখ ফজলে নূর তাপস তার নির্বাচনি ইশতেহারে ঐতিহ্যবাহী, সুন্দর, প্রাণবন্ত সুশাসিত ও উন্নত ঢাকা গড়ে তুলতে প্রায় ৫০টি প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। উভয় মেয়রই ঢাকার ভয়ানক যানজটের উন্নতি, জলাবদ্ধতা দূরীকরণ ও মশার উপদ্রব নির্মূলসহ সাহসী প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন।’
দুই মাননীয় মেয়র চার বছর আগে নির্বাচনের সময় যেসব সাহসী প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, তার অর্ধেকও যদি বাস্তবায়িত হতো, তাহলে ঢাকা মহানগরীর চেহারা অনেকটাই পালটে যেত। বিশেষজ্ঞরা তাদের মেধা-অভিজ্ঞতা দিয়ে প্রতিশ্রুতি ও বাস্তবায়নের চুলচেরা বিশ্লেষণ করবেন, সেটাই স্বাভাবিক। কিন্তু দুই কোটি নগরবাসী, যারা ভোট দিয়ে দুই মেয়র ও কাউন্সিলরদের নির্বাচিত করেছেন, তাদের প্রাপ্তি কতটুকু, সেটাই প্রধান বিবেচ্য বিষয়।
নগরবাসী দেখতে চান যানজট ও জলাবদ্ধতা পরিস্থিতির কতটা উন্নতি হয়েছে। নগরবাসী জানতে চান মশার উপদ্রব, বর্জ্যদূষণ, বায়ুদূষণ, শব্দদূষণ, ফুটপাত বেদখল সমস্যা দূর হয়েছে কিনা। এসব প্রশ্নের উত্তর মেয়র-কাউন্সিলরদের কাছ থেকে পাওয়ার দরকার নেই। নগরবাসী নিজের চোখেই তো সবকিছু দেখছেন। চার বছর আগে নগরীর পরিস্থিতি-পরিবেশ যা ছিল, তা থেকে উন্নতি হয়নি, বরং পিছিয়ে গেছে। এটাই বাস্তবতা। দুই নগরপিতা চার বছরে তাদের প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়ন করতে পারেননি, বাকি এক বছরে কতটুকু পারবেন?
দুই মেয়র অবশ্য তাদের ব্যর্থতা স্বীকার করবেন না, এটাই স্বাভাবিক। ব্যর্থতা স্বীকারের সংস্কৃতি আমাদের দেশে গড়ে ওঠেনি। উভয় মেয়রই বলেছেন, প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নে তাদের উদ্যোগ ছিল। বাস্তবায়নের কাজও কিছু হয়েছে। কিন্তু এসব উদ্যোগ ও বাস্তবায়ন নগরবাসীর কাছে কতটা দৃশ্যমান, সেটাই প্রশ্ন।
যানজট
নগরবাসী দেখছেন মেট্রোরেল ও এক্সপ্রেসওয়ে চালু হওয়ার পরও ঢাকা শহরে যানজট একটুও কমেনি, বরং বেড়েই চলেছে। ঢাকা নগরবাসীর কাছে যানজটই প্রধান সমস্যা, তাই এ সমস্যা নিয়ে প্রথমে কিছু বলা যাক। যানজট নিয়ে অনেক গবেষণা, আলোচনা-পর্যালোচনা, লেখালেখি অতীতে হয়েছে, এখনো হচ্ছে। উদ্যোগ হয়তো নেওয়া হয়েছিল যানজট কমানোর, কিন্তু তা দৃশ্যমান হয়নি। যানজটের আতঙ্কে নগরবাসী ঘর থেকে বের হতে চান না। কিন্তু প্রয়োজনের তাগিদে বের হতেই হয়, আধঘণ্টার পথ পাড়ি দিতে অনেক সময় ২-৩ ঘণ্টাও লেগে যায়। যানজটে আটকা পড়ে রাস্তায় গরম ও ধুলার মধ্যে বসে থাকা কতটা কষ্টকর তা ভুক্তভোগীরাই বোঝেন।
যানজট কমানো সিটি করপোরেশনের একার পক্ষে সম্ভব নয়। এজন্য পুলিশের ট্রাফিক বিভাগের সক্রিয় সহযোগিতা দরকার। সরকারের সড়ক পরিবহণ কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ) এবং অন্যান্য সংস্থাকেও সম্পৃক্ত করতে হবে। তবে মূল দায়িত্ব সিটি করপোরেশনের এবং তারাই সমন্বয়কের দায়িত্ব নিয়ে যানজট নিরসনের ব্যবস্থা করবেন। এ কথা সিটি করপোরেশন এবং সরকারের উচ্চতর কর্তৃপক্ষ ভালোভাবেই জানে। কিন্তু তা করা হচ্ছে না। কেন হচ্ছে না, তা আমাদের অজানা।
কোনো নগরীর যানজট নিরসন অসম্ভব বা অসাধ্য কাজ নয়। তার প্রমাণ থাইল্যান্ডের রাজধানী শহর ব্যাংকক। তিন-চার দশক আগেও সেখানে যানজট ছিল অসহনীয়, আমাদের বর্তমান অবস্থার চেয়েও খারাপ। সেখানে এক ঘণ্টার পথ অতিক্রম করতে চার ঘণ্টা লাগত। থাই সরকারের আন্তরিক প্রচেষ্টায় ব্যাংককের যানজট দূর হয়েছে। সেখানে প্রয়োজনমতো ফ্লাইওভার, এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণ করা হয়েছে। পুরো ট্রাফিক ব্যবস্থাকে সুশৃঙ্খল করা হয়েছে। আমাদের প্রতিবেশী পশ্চিমবঙ্গের রাজধানী কলকাতাতেও কয়েক দশক আগে যানজট পরিস্থিতি খুব খারাপ অবস্থায় ছিল। সেখানে মাটির তলায় মেট্রোরেল, কয়েকটি ফ্লাইওভার নির্মাণ এবং রাস্তায় যানবাহন চলাচল সুশৃঙ্খল করে যানজট পরিস্থিতিকে সহনীয় পর্যায়ে আনা হয়েছে অনেক আগেই।
ট্রাফিক সিগনাল উধাও
ব্যাংকক পেরেছে, কলকাতা পেরেছে, আমরা কেন পারছি না ঢাকা নগরীর যানজট পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে? কী করে নিয়ন্ত্রণে আসবে, এখানে যে গোড়াতেই গলদ! একটি আধুনিক শহরের যানবাহন চলাচল নিয়ন্ত্রণ করা হয় স্বয়ংক্রিয় ট্রাফিক সিগনাল ব্যবস্থার মাধ্যমে। এ ট্রাফিক সিগনাল এককালে ঢাকা নগরীতে ছিল। এখন নেই। কবে বিলুপ্ত হয়েছে, মনে করতে পারছি না।
এ শহরে লাল-সবুজ-হলুদ বাতির স্বয়ংক্রিয় ট্রাফিক সিগনাল যে ছিল, তার প্রমাণ পাওয়া যায় রাজপথের গুরুত্বপূর্ণ মোড়গুলোতে। সেখানে অচল ট্রাফিক সিগনালের ভগ্নাবশেষ এখনো দেখা যায়। এগুলো এখনই জাদুঘরে নিয়ে রাখা দরকার, যাতে নতুন প্রজন্ম জানতে পারে এ মহানগরীতে এককালে ট্রাফিক সিগনাল ছিল। ট্রাফিক সিগনালের বিকল্প এখন ট্রাফিক পুলিশ। তারা রাস্তার মোড়ে দাঁড়িয়ে হাত উঠিয়ে-নামিয়ে যানবাহন চলাচল নিয়ন্ত্রণ করেন। আমার মনে হয় ঢাকাই বিশ্বের একমাত্র রাজধানী, যেখানে স্বয়ংক্রিয় ট্রাফিক সিগনাল নেই। এটা আমাদের জন্য লজ্জার বিষয় নয় কি?
বেদখল ফুটপাত
ঢাকা মহানগরীর আরেকটি বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, এখানে ব্যবহারযোগ্য ফুটপাত নেই। উত্তর ঢাকায় গুলশানের মতো অভিজাত এলাকার রাস্তায় ফুটপাত আছে। সেখানে হেঁটে চলাচল করা যায়। কিন্তু দক্ষিণ ঢাকায় হাঁটার উপযোগী ফুটপাত খুঁজে পাওয়া কঠিন। প্রায় সব ফুটপাত হকারদের দখলে। হকাররা ফুটপাতের পাশের রাস্তাতেও দোকান বসায়। এ কারণে পথচারীদের দুর্ভোগ ছাড়াও রাস্তায় ট্রাফিক চলাচল বিঘ্নিত হয়। হকারদের দখল থেকে ফুটপাত উদ্ধারের প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিল, কিন্তু কিছুই করা হয়নি।
জলাবদ্ধতা দূর হয়নি
রাজধানীর জলাবদ্ধতা দূর করার লক্ষ্যে হারিয়ে যাওয়া খালগুলো পুনরুদ্ধারের প্রতিশ্রুতিও দেওয়া হয়েছিল। চারটি বড় আকারের খাল ঢাকা ওয়াসা ২০২০ সালে দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের কাছে হস্তান্তর করে। কথা ছিল সিটি করপোরেশন খালগুলো পুনঃখনন ও সংস্কার করে সচল করবে, যাতে নগরীর জলাবদ্ধতা পরিস্থিতির উন্নতি হয়। ২০২২ সালে চারটি খাল পুনঃখনন ও সংস্কারের জন্য প্রায় ৯০০ কোটি টাকার প্রকল্প চূড়ান্ত করে দক্ষিণ সিটি করপোরেশন। কিন্তু এখন পর্যন্ত প্রকল্প বাস্তবায়নের কাজ শুরু হয়নি। নগরীর জলাবদ্ধতা দূর হবে কী করে?
মশা নিয়ন্ত্রণ ও ডেঙ্গু
ঢাকা মহানগরীতে মশার উপদ্রব কমাতে কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া হবে বলে দুই মেয়র প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। কিন্তু মশা নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রম যে সফল হয়নি, তার প্রমাণ ডেঙ্গুর ভয়াবহ বিস্তার। ডেঙ্গুর মারাত্মক প্রাদুর্ভাব দেখা দিয়েছিল গত বছর। ওই বছর সারা দেশে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে ৩,২১,১৭৯ জন হাসপাতালে ভর্তি হন বলে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্যে বলা হয়। এদের মধ্যে মৃত্যু হয় ১,৭০৫ জনের। মৃতদের মধ্যে ৯৮০ জন ঢাকা শহরের, অন্য ৭২৫ জন ঢাকা শহরের বাইরের।
দেশে ডেঙ্গুর প্রকোপ চলছে প্রায় চার দশক ধরে। কিন্তু অতীতে কোনো বছর এত মানুষ মারা যায়নি। প্রাপ্ত তথ্যে দেখা যায়, ২০২৩ সালের আগে ২২ বছরে ডেঙ্গুতে মৃত্যুর মোট সংখ্যা ছিল ৮৬৮। কিন্তু ২০২৩ সালে এক বছরে প্রাণহানি দ্বিগুণ হয়ে ১,৭০৫ হয়। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, চলতি ২০২৪ সালে ডেঙ্গু পরিস্থিতি আরও খারাপ হতে পারে। ইতোমধ্যেই এ বছরের জানুয়ারি থেকে এ পর্যন্ত ২৬৭৬ জন ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। এদের মধ্যে মৃত্যু হয়েছে ৩৩ জনের। আসন্ন বর্ষায় এবং বর্ষা পরবর্তীকালে ডেঙ্গু পরিস্থিতি ভয়াবহ রূপ নিতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। এখনই যদি ডেঙ্গুর বাহক এডিস মশা নিধন ও নিয়ন্ত্রণে কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া যায়, তাহলে ভয়াবহ পরিস্থিতি এড়ানো যেতে পারে।
ঢাকা দক্ষিণের মেয়র অবশ্য ঘোষণা করেছেন, মশা নিয়ন্ত্রণে ব্যাপক কর্মসূচি শুরু হচ্ছে এবং এ কর্মসূচি যাতে সফল হয় সেজন্য সব ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এ কর্মসূচি সফল করে ডেঙ্গুর বিস্তার ঠেকানো গেলে নগরবাসী অবশ্যই খুশি হবেন। দেখা যাক কী হয়।
নগরবাসীর দুর্ভোগ কমেছে কি?
সবকিছু নিয়ে বিস্তারিত আলোচনার সুযোগ স্বল্প পরিসরে নেই। শুধু বলা যায়, উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের দুই মেয়র এবং ১২৯টি ওয়ার্ডের কাউন্সিলররা চার বছর আগে নগরবাসীর ভোটেই নির্বাচিত হয়েছিলেন। নির্বাচনের সময় নগরবাসীকে তারা অনেক প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। চার বছরে প্রতিশ্রুতির বাস্তবায়ন কতটুকু হয়েছে, তারা নিজেরাই মূল্যায়ন করে দেখুন। চার বছর তারা দাপ্তরিক ও দৈনন্দিন রুটিন ওয়ার্ক ঠিকই করে গেছেন। কিন্তু নগরবাসীর দুর্ভোগ দূর করতে না পারলেও কমাতে পেরেছেন কিনা, এটাই আজকের বড় প্রশ্ন।
চপল বাশার : সাংবাদিক, লেখক