Logo
Logo
×

বাতায়ন

নতুন শিক্ষাক্রমের আলোকে এসএসসি পরীক্ষা

Icon

রুবাইয়াৎ জাহান, সুবর্ণা সরকার, নওরীন ইয়াসমিন, ইফফাত নাওমী

প্রকাশ: ১৫ মে ২০২৪, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

নতুন শিক্ষাক্রমের আলোকে এসএসসি পরীক্ষা

২০২৫ সালে নতুন শিক্ষাক্রমের আলোকে প্রথমবারের মতো এসএসসি পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হবে। নতুন শিক্ষাক্রম অনুসারে ২০২৫ সালের এসএসসি পরীক্ষার ধরনেও পরিবর্তন আসছে, এটা প্রায় নিশ্চিত। দেখার বিষয় হলো, নতুন এসএসসি পরীক্ষার প্রক্রিয়াটি কেমন হতে যাচ্ছে।

আমরা জানি, নতুন শিক্ষাক্রমের আলোকে ষষ্ঠ শ্রেণি থেকে নবম শ্রেণি পর্যন্ত শিখন-শেখানো পদ্ধতিতে যেমন পরিবর্তন এসেছে, ঠিক একইভাবে পরিবর্তন এসেছে মূল্যায়ন পদ্ধতিতেও। বর্তমান মূল্যায়ন ব্যবস্থায় সামষ্টিক মূল্যায়নের পাশাপাশি ধারাবাহিক মূল্যায়নকে প্রাধান্য দিয়ে শিক্ষার্থীদের বিভিন্ন যোগ্যতা অর্জনের ওপর গুরুত্বারোপ করা হয়েছে। শিক্ষার্থীদের অর্জনকে নম্বরের মাধ্যমে যাচাই না করে, গুণগত মূল্যায়নের একটি প্রক্রিয়ার মধ্যে আনা হয়েছে। এ ধারাবাহিকতায় এসএসসি পরীক্ষার মূল্যায়নের পদ্ধতিতেও শিক্ষার্থীদের গুণগতমান যাচাইয়ের একটি প্রক্রিয়া নিশ্চিতকরণ খুবই জরুরি। উল্লেখ্য, গতানুগতিক এসএসসি পরীক্ষা পদ্ধতি ও নম্বরভিত্তিক মূল্যায়ন নতুন শিক্ষাক্রমের মূল লক্ষ্যের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। কেননা, বিদ্যমান পরীক্ষা পদ্ধতিতে জ্ঞান ও দক্ষতা মূল্যায়ন করা সম্ভব হলেও কাঙ্ক্ষিত যোগ্যতা অর্জনের জন্য শিক্ষার্থীর মূল্যবোধ এবং দৃষ্টিভঙ্গি মূল্যায়ন করাও জরুরি। এটি কোনো লিখিত পরীক্ষা বা সংখ্যাতাত্ত্বিক কোনো বিশ্লেষণের মাধ্যমে যাচাই করা সম্ভব নয়। শিক্ষার্থীদের যোগ্যতা অর্জন নিশ্চিত করতে বরং গুণগত মূল্যায়ন পদ্ধতি অনেক যুক্তিযুক্ত হবে। বর্তমানে প্রচলিত শিক্ষাবোর্ডের নিয়ম অক্ষুণ্ন রেখেই গুণগত মূল্যায়নের মাধ্যমে এসএসসি পরীক্ষা সম্পন্ন করা সম্ভব। এক্ষেত্রে মূল্যায়ন ব্যবস্থায় যেমন রাখা যেতে পারে লিখিত অংশ, সেই সঙ্গে রাখা যেতে পারে বিভিন্ন পারদর্শিতা পরিমাপের জন্য ব্যবহারিক নানা কাজ।

দ্বিতীয়ত, মূল্যায়ন শিক্ষাক্রমের একটি অবিচ্ছেদ্য ও শক্তিশালী উপাদান, যা শিক্ষাক্রমের সামগ্রিক বাস্তবায়ন প্রক্রিয়াকে নিয়ন্ত্রণ করে। কাজেই এ প্রক্রিয়াতে কোনো ত্রুটি থাকলে তা শিক্ষাক্রমের প্রধান উদ্দেশ্য অর্জনকে বাধাগ্রস্ত করবে। এ প্রেক্ষাপটে যোগ্যতাভিত্তিক শিক্ষাক্রমে মূল্যায়নের ক্ষেত্রে শুধু নম্বরভিত্তিক যাচাই এ শিক্ষাক্রমের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য বাস্তবায়নকে ব্যাহত করবে। এখানে উল্লেখ করা জরুরি যে, মূল্যায়ন যখন শুধু সংখ্যা বা নম্বর দিয়ে হয় তখন শিক্ষার্থীর যোগ্যতার অর্জনের বিষয়টি সঠিকভাবে যাচাই হয় না। কোনো শিক্ষার্থী গণিতে ১০০ তে ১০০ পাওয়ার অর্থ এই নয় যে, সে সেই শ্রেণির গণিতের সব যোগ্যতা শতভাগ অর্জন করেছে। বরং ১০০ তে ১০০ পাওয়ার অর্থ হলো, শিক্ষার্থী লিখিত পরীক্ষার সব প্রশ্নের সঠিক উত্তর দিতে পেরেছে। বাংলাদেশের এসএসসি পরীক্ষার ধারা পর্যালোচনা করলে দেখা যায় যে, অনেক শিক্ষার্থীই বিগত বছরগুলোর প্রশ্ন পর্যালোচনা করে সেগুলো বাদ দিয়ে পড়েও ৮০ শতাংশের বেশি নম্বর অর্জন করছে। এক্ষেত্রে বিষয়টির পূর্ণাঙ্গ যোগ্যতা কিন্তু শিক্ষার্থী অর্জন করতে পারছে না। নম্বরভিত্তিক পদ্ধতিতে শিক্ষার্থী, অভিভাবক, শিক্ষক-সবাই নম্বর বাড়াতে গিয়ে গাইড বই, কোচিং, প্রাইভেট পড়ানো ইত্যাদির প্রতি ঝুঁকে পড়ে, যার ফলে একদিক দিয়ে শিক্ষা যেমন আরও ব্যয়বহুল হয়ে পড়ে, পাশাপাশি এ নম্বর বৃদ্ধির জন্য নানা প্রকার অসদুপায় অবলম্বনের দিকেও শিক্ষার্থীদের ঝুঁকে পড়তে দেখা যায়। তাই সব দিক বিবেচনায়, এসএসসি পরীক্ষা পদ্ধতিকে যদি নতুন শিক্ষাক্রমের আলোকে নতুনভাবে ঢেলে সাজানো যায়, তবে সবদিক দিয়েই শিক্ষার্থীরা উপকৃত হবে।

যোগ্যতাভিত্তিক শিক্ষাব্যবস্থার ক্ষেত্রে মূল্যায়ন পদ্ধতি অবশ্যই ভবিষ্যৎ কর্মক্ষেত্রের জন্য প্রয়োজনীয় জ্ঞান, দক্ষতা, মূল্যবোধ ও দৃষ্টিভঙ্গি ধারণ করে গঠিত হতে হবে। নতুন শিক্ষাক্রমে শিক্ষার্থীদের অভিজ্ঞতার মাধ্যমে শেখানোর একটি প্রয়াস রয়েছে এবং প্রণীত বইগুলোতে শিখন শেখানো কার্যক্রমগুলো এমনভাবে সাজান হয়েছে যে, শিক্ষার্থীরা বাস্তব পরিপ্রেক্ষিতে তাদের অর্জনগুলো পর্যাপ্তভাবে চর্চা করতে পারে। কাজেই নতুন এসএসসি পরীক্ষা পদ্ধতিতে শিক্ষার্থীরা যেন বাস্তবিক পরিপ্রেক্ষিতে তাদের অর্জনগুলো পর্যাপ্তভাবে চর্চা করে তাদের পারদর্শিতা দেখানোর সুযোগ পায়, সেই ব্যবস্থা রাখতে হবে।

বিভিন্ন দেশে যোগ্যতাভিত্তিক শিক্ষাব্যবস্থায় কাঙ্ক্ষিত যোগ্যতা মূল্যায়নের জন্য লিখিত পরীক্ষার পাশাপাশি আরও নানা ধরনের মূল্যায়ন পদ্ধতি (অল্টারনেটিভ মূল্যায়ন পদ্ধতি) ব্যবহৃত হয়ে থাকে। এ ধরনের মূল্যায়নের বিশেষত্ব হলো, এখানে একজন শিক্ষার্থীকে অন্য শিক্ষার্থীদের সঙ্গে তুলনা না করে শুধু তার নিজের অর্জনকে বিভিন্ন ধরনের পরিমাপক দিয়ে নির্দিষ্ট করা হয়। এবং প্রতিটি শিক্ষার্থীকে পর্যাপ্ত পরিমাণ সময় দিয়ে তার সক্ষমতা প্রমাণের সুযোগ করে দেওয়া হয়, যেটি গতানুগতিক একটি নির্দিষ্ট সময়ের পরীক্ষা পদ্ধতিতে সম্ভব নয়। এর আলোকে, ২০২৫ সালের এসএসসি পরীক্ষা পদ্ধতিতে গতানুগতিকতার বাইরে গিয়ে প্রতিটি শিক্ষার্থী যেন পর্যাপ্ত সময়ে নিজের সক্ষমতা প্রমাণের সুযোগ পায়, সেই ব্যবস্থা রাখতে হবে।

আবার পাবলিক পরীক্ষার ব্যবস্থা পর্যালোচনা করে একটি বৈশ্বিক ট্রেন্ড আমরা দেখতে পাই। প্রথমত, বিভিন্ন দেশে যে পাবলিক পরীক্ষা হয়, সেখানে সব বিষয় বাধ্যতামূলক নয়। মূলত ‘ভাষা’ ও গণিতকে বাধ্যতামূলক রাখা হয়, বাকি বিষয়গুলোকে শিক্ষার্থীরা তাদের ভবিষ্যৎ উচ্চশিক্ষার পরিকল্পনা অনুযায়ী পছন্দ করতে পারে। অন্যদিকে, অধিকাংশ দেশেই দশম শ্রেণির পরে পাবলিক পরীক্ষার প্রচলন নেই। পর্যালোচনায় দেখা যায়, শুধু দক্ষিণ এশিয়া এবং আফ্রিকার কিছু স্বল্পোন্নত দেশে দশম শ্রেণির পরে পাবলিক পরীক্ষার প্রচলন রয়েছে। পূর্ব ও মধ্য এশিয়া এবং আফ্রিকার বেশিরভাগ উন্নয়নশীল ও উন্নত দেশগুলোতে দ্বাদশ শ্রেণির পরে পাবলিক পরীক্ষার প্রচলন রয়েছে। আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতেও বর্তমানে নতুন একটি শিক্ষাক্রম চালু করা হয়েছে, যার আলোকে তাদের মূল্যায়ন পদ্ধতিতেও ব্যাপক পরিবর্তন আনা হয়েছে।

বিভিন্ন দেশের পাবলিক পরীক্ষা পদ্ধতি পর্যালোচনা করে দ্বাদশ শ্রেণির পরে পাবলিক পরীক্ষার ফলাফল ব্যবহারের ক্ষেত্রেও বৈচিত্র্য দেখা যাচ্ছে। কিছু দেশ উচ্চশিক্ষায় ভর্তির ক্ষেত্রে প্রবণতা যাচাইয়ের জন্য সরাসরি এ ফলাফল ব্যবহার করছে। কিছু দেশ আলাদা আদর্শায়িত অভীক্ষা (Standardized Test) প্রয়োগ করছে। আবার কিছু দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো আরেকটি ভর্তি পরীক্ষার আয়োজন করছে। আবার কোনো কোনো দেশের উচ্চশিক্ষা সম্পর্কিত প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের নিজেদের মতো ব্যবস্থা গ্রহণ করছে। অবশ্য বিভিন্ন দেশে প্রথম দুটির চর্চা অধিক পরিলক্ষিত হচ্ছে। সুতরাং সার্বিকভাবে দেখা যাচ্ছে যে, পৃথিবীর অধিকাংশ দেশে পরীক্ষা বাধ্যতামূলক নয়, বরং অনেক ক্ষেত্রে বিশেষায়িত ও ঐচ্ছিক হিসাবে পরিচালিত হচ্ছে। বৈশ্বিক এ ধারার সঙ্গে তাল মেলাতে তাই আমাদের মূল্যায়ন ব্যবস্থায়ও পরিবর্তন আনা এখন সময়ের দাবি।

প্রচলিত মূল্যায়ন পদ্ধতিতে বর্তমানে শিক্ষার্থীদের যে ফলাফল প্রকাশিত হয়, তার ভিত্তিতে আমাদের শিক্ষার্থীরা যখন বিদেশে উচ্চশিক্ষার জন্য যাচ্ছে, তখন তাদের নানা ধরনের Aptitude Test in Standardized Test-এর মাধ্যমে নিজেদের যোগ্যতা প্রমাণ করতে হচ্ছে। বর্তমানে চাকরির ক্ষেত্রেও তাদের এ মূল্যায়নের ফলাফল গ্রহণযোগ্যতা হারাচ্ছে, তাদের নিজেদের যোগ্যতা আলাদাভাবে প্রমাণ করতে হচ্ছে। তাই বলা যায়, নতুনরূপে এসএসসি পরীক্ষা পদ্ধতি চালু হলে তা আমাদের ভবিষ্যতের জন্যই সহায়ক হবে। ভবিষ্যতে স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণেও এ গুণগত মূল্যায়ন ব্যবস্থার কোনো বিকল্প নেই।

রুবাইয়াৎ জাহান : অধ্যাপক, শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউট, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়

সুবর্ণা সরকার : সহকারী অধ্যাপক, শিক্ষা ডিসিপ্লিন, শিক্ষা স্কুল, খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়

নওরীন ইয়াসমিন : সহকারী অধ্যাপক, শিক্ষা বিভাগ, নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়

ইফফাত নাওমী : সহকারী অধ্যাপক, শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউট, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম