Logo
Logo
×

বাতায়ন

আশেপাশে চারপাশে

বাঙালি সংস্কৃতির ওপর আক্রমণ কিসের লক্ষণ?

Icon

চপল বাশার

প্রকাশ: ২৮ এপ্রিল ২০২৪, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

বাঙালি সংস্কৃতির ওপর আক্রমণ কিসের লক্ষণ?

ঈদের লম্বা ছুটির পর পহেলা বৈশাখে সারা দেশে উদযাপিত হয় বর্ষবরণ উৎসব। সেদিনও সরকারি ছুটি ছিল। ছুটির আমেজেই দেশবাসী বাংলা নতুন বছর বরণ করেছে নানা উৎসবের মাধ্যমে। দেশের সর্বত্র আয়োজন করা হয় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, মঙ্গল শোভাযাত্রা, বৈশাখী মেলা ও অন্যান্য উৎসব। বাংলা নববর্ষই বাংলাদেশের একমাত্র উৎসব, যা জাতিধর্ম নির্বিশেষে সবাই উদযাপন করে। বাঙালি জাতি পহেলা বৈশাখকে কেন্দ্র করে ঐকবদ্ধ হয়, বাঙালি জাতিসত্তাকে সমুন্নত রাখে।

স্বাধীনতার আগে পাকিস্তানি শাসনামলে মৌলবাদীদের বিরূপ প্রচারণা ছিল পহেলা বৈশাখ উদযাপনের বিরুদ্ধে। তারা বলেছে, এটি ইসলামবিরোধী কার্যকলাপ। বাঙালির সংস্কৃতির বিরুদ্ধে এ ধরনের প্রচারণা সম্প্রতি আবার লক্ষ করা যাচ্ছে। পাকিস্তানপন্থি’ মহল এখন তাদের প্রচারণার মাধ্যম হিসাবে ব্যবহার করছে ফেসবুক ও ইন্টারনেট। পাকিস্তানপন্থিদের এ পুনরুত্থান বাঙালি সংস্কৃতির জন্য অশনিসংকেত। মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় এ অশুভ শক্তিকে সমবেতভাবে দমন করতে হবে। সমুন্নত রাখতে হবে বাঙালির আবহমান সংস্কৃতিকে।

বাংলাদেশের স্বাধীনতার আগে তৎকালীন পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী পহেলা বৈশাখ উদযাপনকে কখনোই ভালো চোখে দেখেনি। তারা বলেছে, এটি মুসলমানদের উৎসব নয়, হিন্দুদের উৎসব, ভারতীয় উৎসব। বাঙালির যে একটি নিজস্ব জাতিসত্তা আছে, নিজস্ব সংস্কৃতি আছে, এটি তারা কখনোই স্বীকার করেনি। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার শুরু থেকেই অর্থাৎ ১৯৪৮ সাল থেকেই বাঙালির সংস্কৃতির ওপর আগ্রাসন শুরু হয়। প্রথম আঘাত আসে বাঙালির মাতৃভাষা বাংলার ওপর। পাকিস্তানের সর্বোচ্চ নেতা জিন্নাহ বাংলার মাটিতে দাঁড়িয়ে ঘোষণা করেন-উর্দুই হবে দেশের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা। তার এ ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গেই বাঙালির ভাষা আন্দোলন শুরু হয়, সূচনা হয় বাঙালির সাংস্কৃতিক বিপ্লবের।

তারপর পদ্মা-মেঘনা-যমুনা দিয়ে অনেক স্রোত বয়ে গেছে, বাঙালির সাংস্কৃতিক বিপ্লবও সব বাধা-প্রতিবন্ধকতা প্রতিহত করে সামনে এগিয়ে গেছে। বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনের পর সমগ্র বাঙালি জাতি ঐক্যবদ্ধ হয়ে ভাষার দাবি প্রতিষ্ঠিত করেছে। পাকিস্তানপন্থিরা শুধু বাংলা ভাষার ওপর আক্রমণ চালিয়ে থেমে থাকেনি, তারা এদেশে রবীন্দ্রচর্চা ও বাংলা নববর্ষ উদযাপনের বিরুদ্ধেও সক্রিয় অবস্থান নিয়েছিল। তৎকালীন মুসলিম লীগ সরকার পাঠ্যপুস্তক থেকে রবীন্দ্রসাহিত্যকে বাদ দিয়েছিল, বেতার-টিভিতে রবীন্দ্রসংগীত নিষিদ্ধ ছিল। বাংলা নববর্ষ উদযাপনের বিরুদ্ধেও তারা কথা বলা শুরু করে পঞ্চাশের দশকেই।

ষাটের দশকের মধ্যভাগে যখন ছায়ানটসহ বিভিন্ন সাংস্কৃতিক সংগঠন পহেলা বৈশাখ উদযাপন শুরু করে, সে সময় এদেশের কিছু পাকিস্তানপন্থি এর বিরুদ্ধে প্রচার-প্রপাগান্ডায় নামে। তারা বেতার-টিভি ও সংবাদপত্রে বলতে থাকে-পহেলা বৈশাখ উদযাপন মুসলমানদের সংস্কৃতি নয়, এটি হিন্দু সংস্কৃতি, ভারত থেকে আমদানি করা। বিশেষ করে তাদের চক্ষশূল ছিল মঙ্গল শোভাযাত্রা, বটতলা বা অন্যত্র নারী-পুরুষের সমবেত সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, নৃত্যানুষ্ঠান, বৈশাখী মেলা ইত্যাদি। পাকিস্তানপন্থিদের এসব প্রচারে কোনো কাজ হয়নি। নববর্ষ উদযাপন সারা দেশে প্রতিবছর হয়েছে ব্যাপক উৎসাহ-উদ্দীপনায়, বিপুলসংখ্যক মানুষের অংশগ্রহণে।

বায়ান্নতে বাঙালির যে সাংস্কৃতিক বিপ্লবের সূচনা হয়েছিল, তা চূড়ান্ত পরিণতি পায় একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে। মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ের মধ্য দিয়ে বাঙালি জাতিগোষ্ঠী বাংলাদেশ নামক একটি স্বাধীন রাষ্ট্র পায়। এ রাষ্ট্রের চার মূলনীতি ছিল-জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা ও সমাজতন্ত্র। জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধিরা ১৯৭২ সালে যে সংবিধান প্রণয়ন করেছিলেন, তাতে উল্লিখিত চার মূলনীতি সমুন্নত রাখা হয়েছিল। বাঙালির সংস্কৃতি, অসাম্প্রদায়িকতা ছিল নবীন রাষ্ট্রের মূলনীতি ও আদর্শ। এ নীতি-আদর্শ অক্ষুণ্ন রেখেই জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি থেকে ১৯৭৫ সালের ১৪ আগস্ট পর্যন্ত সরকার পরিচালনা করে গেছেন। ১৫ আগস্ট ষড়যন্ত্রকারীদের হাতে নিহত হওয়া পর্যন্ত তিনি বাঙালির সংস্কৃতির প্রশ্নে আপস করেননি।

বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর পরপরই জিয়া-মোশতাক চক্র বাঙালির সংস্কৃতি এবং অসাম্প্রদায়িকতার নীতি-আদর্শ নস্যাতের জন্য আদাজল খেয়ে নামে। প্রথমেই সংবিধান থেকে অবৈধভাবে রাষ্ট্রীয় চার মূলনীতি-জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা ও সমাজতন্ত্র বাদ দিয়ে অদ্ভুত কিছু শব্দ সংযোজন করে। সংবিধানকে তারা ব্যাপকভাবে কাটছাঁট করে। বাহাত্তরের সংবিধানের মূল চেতনা ও আদর্শ বাদ দিয়ে পাকিস্তানের মতো ভাবধারা সংযোজন করা হয়। বাঙালির সংস্কৃতিকে সরিয়ে দিয়ে মৌলবাদী সংস্কৃতিকে উৎসাহিত ও পৃষ্ঠপোষকতা করা হয়।

তারপরও প্রতিক্রিয়াশীল সরকারগুলো বাঙালির সাংস্কৃতিক চিন্তা-চেতনাকে দাবিয়ে রাখতে পারেনি। বাধা-প্রতিবন্ধকতা সত্ত্বেও ছায়ানটসহ বহু সাংস্কৃতিক সংগঠন বাঙালির সংস্কৃতি সমুন্নত রাখার লক্ষ্যে বর্ষবরণসহ বিভিন্ন অনুষ্ঠান করতে থাকে নতুন উদ্যমে। প্রকৃতপক্ষে বাংলাদেশে তখন একটি নীরব মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়, যার এক পক্ষে ছিল বাঙালি জাতীয়তাবাদে বিশ্বাসী শক্তি, আর অন্য পক্ষে পাকিস্তানপন্থিরা।

এই নীরব মুক্তিযুদ্ধ চলেছে ২১ বছর। একুশটি বছর পাকিস্তানপন্থিরা এদেশের সংস্কৃতি ছাড়াও রাজনীতি, অর্থনীতি ও সমাজজীবনে ভিত গেড়ে বসতে চেয়েছে, অনেকাংশে সফলও হয়েছে। রাজনীতির অঙ্গনে জামায়াতসহ পাকিস্তানপন্থিরা মাথাচাড়া দিচ্ছে। পাকিস্তানপন্থি ব্যবসায়ী-শিল্পপতিরা অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে সক্রিয়। পাকিস্তানপ্রেমী ব্যবসায়ীরা পাকিস্তান থেকে বিভিন্ন পণ্য আমদানি করছে অবাধে। যেসব পণ্য সেদেশ থেকে আনা হচ্ছে, তা অন্য দেশ থেকে আরও কম দামে আনা যায়। এসব আমদানি তো বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অগোচরে হচ্ছে না। তারা অনুমোদন দেন কেন? শত্রুদেশ পাকিস্তানের সঙ্গে প্রেম করার জন্য কি আমরা মুক্তিযুদ্ধ করেছি, রক্ত দিয়েছি?

সাংস্কৃতিক অঙ্গনে পাকিস্তানপন্থিদের আগ্রাসন সবাই জানেন, বোঝেন। সম্প্রতি বাংলা নববর্ষ উদযাপনের বিরুদ্ধে ফেসবুক, ইন্টারনেটে, কোনো কোনো সংবাদপত্রেও বিষোদগার করা হয়েছে। এরা কারা? পাকিস্তানি শাসনামলে যারা বলেছিল, পহেলা বৈশাখ উদযাপন হিন্দু কালচার, তাদেরই বংশধররা এখন বাঙালির সংস্কৃতির বিরুদ্ধে কথা বলছে। ওরা শুধু কথা বলে না, নববর্ষের অনুষ্ঠানে হামলাও করে। ২০০১ সালে পহেলা বৈশাখে রমনা বটমূলে ছায়ানটের অনুষ্ঠানে বোমা হামলা চালানো হয়। এর আগে ১৯৯৯ সালে যশোর এবং পরে ২০০৫ সালে নেত্রকোনায় উদীচীর অনুষ্ঠানে বোমা হামলা হয়। এ তিনটি ঘটনাতেই বহু মানুষ হতাহত হয়। উগ্র মৌলবাদীরা এসব হামলার পেছনে ছিল, সেকথা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী কর্তৃপক্ষই বলেছে। সংস্কৃতিকর্মীদের ওপর হামলা আরও অনেকবার হয়েছে।

ক্রীড়াঙ্গনেও পাকিস্তানপন্থিদের অনুপ্রবেশ ঘটেছে ব্যাপকভাবে। দু’বছর আগে বিজয়ের মাস ডিসেম্বরে পাকিস্তানি ক্রিকেট টিমকে সাদরে আমন্ত্রণ জানিয়ে বাংলাদেশে এনেছিল আমাদের ক্রিকেট বোর্ড। পাকিস্তানি ক্রিকেটাররা এর ভালোই জবাব দিয়ে গেছে। তারা প্র্যাকটিসের সময় মিরপুর স্টেডিয়ামের মাঠে বিরাট আকারের পাকিস্তানি পতাকা মাটিতে পুঁতে প্র্যাকটিস করেছে। এটি খেলার নিয়মবহির্ভূত শুধু নয়, এটি ছিল বাঙালিদের জন্য অপমানজনক। সংবাদপত্রেও ছবিটি ছাপা হয়েছিল। কিন্তু আমাদের ক্রিকেট বোর্ড ওদের কিছু বলেনি, বরং জামাই আদরে রেখেছিল।

সামাজিক অঙ্গনেও পাকিস্তানি সংস্কৃতির অনুপ্রবেশ দৃশ্যমান। তরুণ প্রজন্মের একাংশের আচার-আচরণ, ব্যবহার, পোশাক-আশাক বাঙালি সংস্কৃতির অংশ নয়। এরা বাংলার চেয়ে হিন্দি-উর্দু সংস্কৃতি বেশি পছন্দ করে। আমি তরুণ প্রজন্মের সবাইকে দায়ী করছি না, দায়ী করছি একটি অংশকে। এরা সমাজ-সাংস্কৃতিক অঙ্গনে যে অবক্ষয় সৃষ্টি করেছে, তা একসময় সমগ্র বাঙালি জাতিকে গ্রাস করবে, যদি এখনই প্রতিরোধ না করা যায়।

শুরুতেই বলেছি, বাঙালির সংস্কৃতির বিরুদ্ধে আবার আগ্রাসন শুরু হয়েছে এবং তার অশনিসংকেত আবার দেখা যায়। এ আগ্রাসন প্রতিরোধ করে বাঙালির সংস্কৃতি সমুন্নত রাখা এখন সময়ের দাবি। এজন্য মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী সব শক্তি, সব দেশপ্রেমিক বাঙালিকে এক হয়ে দাঁড়াতে হবে পাকিস্তানপন্থি অপশক্তির বিরুদ্ধে। বাঙালির সংস্কৃতি সমুন্নত থাকবেই।

চপল বাশার : সিনিয়র সাংবাদিক, বীর মুক্তিযোদ্ধা

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : সাইফুল আলম

প্রকাশক : সালমা ইসলাম