Logo
Logo
×

বাতায়ন

মিঠে কড়া সংলাপ

জীবন যেখানে যেমন

Icon

ড. মুহাম্মদ ইসমাইল হোসেন

প্রকাশ: ২০ এপ্রিল ২০২৪, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

জীবন যেখানে যেমন

দেখতে দেখতে আমার আমেরিকার প্রবাস জীবনের সমাপ্তি ঘটতে চলল। প্রায় দুই মাস আমেরিকায় অবস্থান করে আর ক’দিন পরই দেশের উদ্দেশে রওনা করব। এটাই আমার জীবনের দীর্ঘতম প্রবাসজীবন। মেয়ের বাড়ি এসে এখানে দীর্ঘ যে সময়টুকু কাটিয়ে গেলাম, তার ওপর ভিত্তি করেই আমি আজকের লেখাটি লিখতে বসেছি।

এখানকার কথা বলতে গেলে প্রথমেই আমেরিকানদের সমাজজীবনের একটি চিত্র আমাকে তুলে ধরতে হয়। আমি যতটুকু জানতে, দেখতে এবং বুঝতে পারলাম, ব্যক্তি মানুষ হিসাবে আমেরিকানরা অত্যন্ত ভালো। আমি যেখানে যতবার তাদের মুখোমুখি হয়েছি, ততবারই তারা আগ বাড়িয়ে স্মিতহাস্যে আমাকে সম্বোধন করেছেন এবং এক্ষেত্রে তাদের মুখে লেগে থাকা হাসিটুকু আমাকে মুগ্ধ করেছে! নারী, পুরুষ, যুবক-যুবতী, শিশু যার সামনে যখনই পড়েছি, তখনই তারা আমাকে আগে সম্বোধন করেছেন। তাদের কয়েকজনের সঙ্গে মিশে দেখলাম, সারা পৃথিবীতে এই যে দ্বন্দ্ব, রাষ্ট্রে রাষ্ট্রে যুদ্ধ, জাতিতে জাতিতে নিধন যজ্ঞ, এসব কোনো কিছুই আমেরিকানদের সামাজিক জীবনকে স্পর্শ করে না। এসব কিছুই তারা রাষ্ট্রীয় ক্রিয়াকলাপ হিসাবে গণ্য করে এবং রাজনীতি নিয়ে সামাজিক, পারিবারিক এসব জীবনে তারা কোনো আলাপ-আলোচনাও পছন্দ করেন না। কিন্তু তাই বলে তারা যে রাজনৈতিক সচেতন নন, তেমনটি নয়। তারা তাদের রাজনৈতিক সচেতনতার সঠিক প্রয়োগ ঘটিয়েই কংগ্রেসম্যান, তাদের প্রেসিডেন্ট ইত্যাদি পদে নেতা নির্বাচিত করেন। কিন্তু এসব নিয়ে তারা পাড়ায় পাড়ায়, মহল্লায় মহল্লায় দলাদলি করেন না। নিজেদের রাজনৈতিক প্রজ্ঞা কাজে লাগিয়ে ভোটের সময় ভোট প্রয়োগ করেন।

এদেশে স্কুল-কলেজ পর্যায়ে ছাত্রছাত্রীদের বাসায় লেখাপড়া করার জন্য কোনো হোমওয়ার্ক দেওয়া হয় না; ক্লাসের পড়া ক্লাসেই শেষ করতে হয়। এমনকি বাড়িতে কোনো বইপুস্তকও থাকে না বা ক্লাসে আনতে দেওয়া হয় না; কোনো ক্লাস কোনো দিন কেউ মিস করলে প্রয়োজনে লাইব্রেরি থেকে সেই বই আনা যায়। শ্রেণিকক্ষে শিক্ষকের কাছে যে পুস্তক থাকে, সেখান থেকেই নির্ধারিত অংশ পড়ানো হয় এবং শ্রেণিকক্ষেই শিক্ষার্থীকে সেই অংশটুকু পড়তে দিয়ে বা পড়িয়ে সেখানেই তা চূড়ান্ত করা হয়। ফলে শিক্ষার্থীকে বইয়ের বোঝা টানতে হয় না; বিশেষ করে স্কুল পর্যায়ে তো নয়ই।

আমার কাছে আরও ভালো লেগেছে, এদেশের ধর্মীয় আচার পালনের আনুষ্ঠানিকতা। যে যার ধর্ম এত সুন্দরভাবে পালন করে চলেছেন! এক ধর্মের আনুষ্ঠানিকতা অন্য ধর্মের মানুষের জন্য কোনোভাবেই বিরক্তিকর বা একে অপরের চলাফেরা, ওঠাবসা, জীবনযাপনে আদৌ কোনো বিঘ্ন সৃষ্টি করে না। অর্থাৎ ভারতীয় উপমহাদেশে যেমন ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠানে ঢাকঢোল-কাসর-মাইক ইত্যাদি বাজিয়ে উচ্চশব্দ সৃষ্টির মাধ্যমে তা পালন করা হয় এবং পাশের বাড়ির একটি শিশু বা একজন বৃদ্ধের অথবা কোনো রোগীর জন্য তা যন্ত্রণাদায়ক হয়, তাদের ঘুমে বিঘ্ন ঘটে, এদেশে তেমনটি হয় না। কারণ এসব ক্ষেত্রেও আইন আছে এবং আইনের প্রয়োগ আছে।

আমাদের দেশে ঠিক উলটোটাই ঘটে! আমাকে কিছু দিন একটি মন্দিরের পাশে বসবাস করতে হওয়ায়, সে সময়ে শব্দের যন্ত্রণায় আমি কাতর হয়ে পড়তাম। কারণ মন্দিরের পূজারিদের ঢাকঢোল, কাসর বাজানোর শব্দের তীব্রতা এত বেশি, যে কোনো স্বাভাবিক চিন্তা-চেতনা, মন-মানসিকতার মানুষের পক্ষে সেসব শব্দ সহ্য করে জীবনযাপন করা সম্ভব নয়। আবার আমাদের গ্রাম দেশে শীতের আগমনের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত মাইক লাগিয়ে যেভাবে ওয়াজ নসিহত করা হয়, তাতে করেও শব্দদূষণে আশপাশের মানুষের ক্ষতি হয়। অথচ যেসব হুজুর ওয়াজ নসিহত করেন এবং যারা এসব করান, তারা সবাই জানেন, মাইকের এসব উচ্চশব্দ মানুষের স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর। বিশেষ করে আশপাশের শিশু, বৃদ্ধ এবং অসুস্থ মানুষের জন্য এ ধরনের শব্দ যন্ত্রণাদায়ক। কিন্তু কে শোনে কার কথা; ওয়াজ নসিহতের এসব শব্দ এক গ্রাম থেকে অন্য গ্রামে না পৌঁছালে আমাদের দেশের হুজুরদের মনই ভরে না।

শব্দদূষণের ক্ষেত্রে আমাদের দেশের সবচেয়ে ভয়ংকর অপকর্মটি করে থাকে যন্ত্রচালিত যানবাহনের ড্রাইভাররা। তারা যেভাবে উচ্চশব্দে হর্ন বাজিয়ে সড়ক ও জনপথে গাড়ি হাঁকান, তাতে দেশের মানুষের কান, মাথা ভীষণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তাদের নির্বিচারে কর্ণকুহরবিদীর্ণকারী হর্ন বাজানো একটি অপরাধ হিসাবে বিবেচিত হলেও এবং এমন একটি অপরাধের বিরুদ্ধে দেশে আইন থাকলেও, এমনকি সেই আইনের যথাযথ প্রয়োগ ঘটানোর জন্য আইন প্রয়োগকারী সংস্থার প্রতি হাইকোর্টের রুলিং বলবৎ থাকা সত্ত্বেও আমাদের দেশের গাড়িচালকরা মনের হরষে নির্ধারিত ডেসিবেল অপেক্ষা কয়েকগুণ বেশি শব্দে হর্ন বাজিয়ে রাস্তাঘাট পর্যন্ত কাঁপিয়ে তোলে। আর এ শব্দ নিয়ন্ত্রণের দায়িত্বপ্রাপ্ত আমাদের পুলিশ বাহিনীর সদস্যরা রাস্তায় দাঁড়িয়ে তা শ্রবণ করেন।

আমাদের দেশের শব্দদূষণের এ চিত্রটি বিশেষভাবে এখানে তুলে ধরার কারণ হলো, আজ দুই মাস হলো আমাকে কোনো গাড়ির হর্ন শুনতে হয়নি। অথচ দেশে ফিরেই হর্ন বাজানোর প্রতিযোগিতার এক অরাজক পরিস্থিতির মধ্যে আমাকে পড়তে হবে। কথাটি আমি আবারও উল্লেখ করে বলতে চাই, এ দেশে এসে আমি হাইওয়েসহ শহর এলাকায় এ পর্যন্ত কয়েক হাজার মাইল পথ চললেও এ পর্যন্ত একটি গাড়ির হর্নও শুনতে পাইনি। আর কথাটি পুনঃপুনঃ বলার কারণ হলো, আমার কথাটি যদি আইন প্রয়োগকারী সংস্থার লোকদের কানে ঢোকে এবং তাতে যদি কোনো কাজ হয়। যদিও এ বিষয়ে হাইকোর্টের রুলিং পর্যন্ত কোনো কাজে আসেনি; কারণ, পরিবহণ শ্রমিকদের সঙ্গে পুলিশের সখ্য থাকায় এবং সেই সখ্য আর্থিক লেনদেনে পৌঁছানোর ফলে এ ক্ষেত্রে কাজের কাজ কিছু হচ্ছে না।

আমার কথায় অনেকেই হয়তো বলবেন, আমাদের দেশের সঙ্গে আমেরিকা বা উন্নত বিশ্বের জীবনধারণ পদ্ধতির তুলনা করে লাভ নেই। সেক্ষেত্রে আমি তাদের সঙ্গে দ্বিমত পোষণ না করেই বলতে চাই, তাই বলে বিকট শব্দে হর্ন বাজিয়ে জনমানুষের কর্ণকুহরবিদীর্ণ করার মতো অপতৎপরতা, স্ব স্ব ধর্ম পালনের ক্ষেত্রে শব্দদূষণের অপসংস্কৃতি পরিহার করা যাবে না, এমনটিও তো নয়। এ বছরে আমি পবিত্র রমজানের পুরোটা সময়ই এখানে কাটিয়ে এবং প্রতিটি জুমা ইত্যাদিতে এখানকার বৃহৎ একটি ইসলামিক সেন্টারে যাতায়াত করে প্রতিদিন শত শত মুসলমানকে নামাজ আদায় করতে, ধর্ম পালন করতে দেখলাম; অথচ তাদের তো কানফাটা আওয়াজে সেসব করতে দেখলাম না। তাই বলে কি তাদের ধর্ম পালনে কোনো বিঘ্ন ঘটল, নাকি কোনো অনিয়ম হলো? না কোনো অনিয়মই হয়নি। কারণ সিরিয়ার একজন বিখ্যাত আলেম আমাদের নামাজ পড়িয়েছেন; বিভিন্ন আরব দেশ থেকে আগত বহু মুসলমান আমাদের সঙ্গে নামাজ পড়েছেন। সুতরাং, আমাদের নামাজ বা ইবাদতে কোনোই অসুবিধা হয়নি। শব্দদূষণের মতো ক্ষতিকর দিকটি পরিহার করেই আমরা ইবাদত-বন্দেগি করেছি; যা আমাদের দেশেও করা সম্ভব। কারণ, ইসলাম ধর্মের প্রারম্ভেও ধর্ম পালনে শব্দদূষণ বা মাইক লাগিয়ে সারারাত ধরে ওয়াজ নসিহতের বিধিবিধান ছিল না।

তবে শব্দদূষণই হোক আর যে দূষণই হোক, আমাদের দেশের এ সবকিছু মেনে নিয়েই জীবনযাপন করতে হয়েছে, হচ্ছে এবং হবে। কারণ আমাদের যাপিত জীবনে এসব গা সয়া হয়ে গেছে! আর আমাদের দেশের সবচেয়ে বড় দূষণ হলো রাজনৈতিক দূষণ। এ রাজনৈতিক দূষণ থেকে আমরা যদি মুক্ত হতে পারতাম, তাহলে অনেক সমস্যারই সমাধান হয়ে যেত।

লেখাটি আর দীর্ঘায়িত না করে উপসংহারে বলতে চাই, আমাদের দেশে আইনের শাসন থাকলে স্কুলের শিক্ষক থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক শিক্ষক পর্যন্ত কলুষিত হয়ে পড়তেন না। আজ একথা আর অস্বীকার করার সুযোগ নেই, আমাদের দেশের একশ্রেণির শিক্ষক, ডাক্তার, আমলাসহ সব শ্রেণি-পেশার ব্যক্তিদের অনেকেই নিজেরা দূষিত হওয়ার পাশাপাশি নিজ নিজ প্রতিষ্ঠানগুলোকেও নষ্ট করে ফেলায় দিনের পর দিন দেশের মানুষের দুর্ভোগ বেড়েই চলেছে। আর আইনের শাসন না থাকার প্রধান কারণ হলো, দেশের আমলা, ডাক্তার, পুলিশ ইত্যাদি প্রায় সব শ্রেণি-পেশার মানুষই ফায়দা লুটতে রাজনৈতিক ক্ষমতা ভাগাভাগির অংশীদার হয়ে উঠেছেন। ফলে দেশের মানুষের পক্ষে শব্দদূষণ, পরিবেশদূষণ ইত্যাদির হাত থেকে বাঁচা দূরের কথা, রাজনৈতিক দূষণের হাত থেকে বাঁচাই এখন মুশকিল হয়ে পড়েছে। এ অবস্থায় ‘জীবন যেখানে যেমন’ কথাটি মেনে নিয়ে স্বাধীনতার এত বছর পরও আমাদের দূষিত পরিবেশেই জীবনযাপন করতে হচ্ছে।

ড. মুহাম্মদ ইসমাইল হোসেন : কবি, প্রাবন্ধিক, কলামিস্ট

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : সাইফুল আলম

প্রকাশক : সালমা ইসলাম