জাকাতকেন্দ্রিক অর্থনীতি ও দুস্থ জনগোষ্ঠী
ড. মু. আবদুর রহীম খান ও তাসনীম ইসলাম দ্যুতি
প্রকাশ: ০৮ এপ্রিল ২০২৪, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
আমরা পবিত্র রমজানের একেবারে শেষ প্রান্তে উপনীত হয়েছি। রহমত, মাগফিরাত ও নাজাতের আল্লাহর দেওয়া অশেষ নিয়ামতের প্রথম দুটি ইতোমধ্যে শেষ হয়ে গেছে। এখন চলছে নাজাত পর্ব। নাজাত অর্থ মুক্তি : মুক্তি দেওয়া, মুক্তি পাওয়া, মুক্ত হওয়া ও মুক্ত করা। সব ধরনের কলুষতা, মলিনতা ও পাপ-পঙ্কিলতা থেকে মুক্ত হওয়াই এ মাসে সিয়াম সাধনার মূল উদ্দেশ্য। মুক্ত হওয়ার এ প্রক্রিয়ার সঙ্গে একজন মুসলিমকে মহান আল্লাহতায়ালার সঙ্গে দৃঢ় সম্পর্কের বন্ধনে আবদ্ধ হতে হয় ক্ষমা প্রার্থনা করে, তওবা করে এবং দিনরাত একনিষ্ঠভাবে মহান আল্লাহতায়ালার কাছে প্রার্থনা করে। সমান্তরালভাবে পবিত্র কুরআন মাজিদের মাধ্যমে মহান আল্লাহ এবং শেষ নবী হজরত মুহাম্মদ (সা.) দুটি আর্থিক বিষয়কে প্রত্যেক সক্ষম সামর্থ্যবান মুসলিম নরনারীকে সুনির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে প্রতিপালনের নির্দেশ দিয়েছেন, যার একটি হলো জাকাত এবং অপরটি হলো ফিতরা।
জাকাত ও ফিতরাকেন্দ্রিক অর্থনৈতিক প্রভাব বাংলাদেশের দুস্থ জনগোষ্ঠীর জন্য কতটা ব্যাপক, সেটিই বর্তমান নিবন্ধের মূল প্রতিপাদ্য বিষয়। প্রণিধানযোগ্য যে, জাকাত দারিদ্র্যবিমোচন ও পুনর্বাসনের অন্যতম প্রধান হাতিয়ার। এটি মহান আল্লাহতায়ালা মুসলমানদের ওপর ফরজ করেছেন। তাই এটি বাধ্যতামূলক এবং কোনো অবস্থাতেই স্বেচ্ছামূলক দান নয়। এটি ধনীর সম্পদের ওপর গরিবের ন্যায্য হিস্যা পাওয়ার অধিকার। প্রশ্ন হলো, দুস্থ-গরিব মানুষ সেই অধিকার ভোগ করার সুযোগ বাংলাদেশে পাচ্ছে কি? এক কথায় এর উত্তর হলো, না। তারা সেই অধিকার ভোগ করার সুযোগ তেমনভাবে পাচ্ছে না। এর সমর্থনে কিছু তথ্য-উপাত্ত ও পরিসংখ্যান তুলে ধরা যেতে পারে। ১১ এপ্রিল ২০২৩ বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো খানার আয় ও ব্যয় জরিপ ২০২২ প্রকাশ করেছে। লক্ষণীয় বিষয় হলো, গত ৬ বছরে দেশের দরিদ্র মানুষের সংখ্যা উল্লেখযোগ্য হারে হ্রাস পেয়েছে; ৬ বছর আগে যা ছিল ১২.৯ শতাংশ; এখন ৫.৬ শতাংশ। এক্ষেত্রে আরেকটি বিষয় খেয়াল করা প্রয়োজন। তা হলো, ২০১০ থেকে ২০১৬ সালে প্রতিবছর গড়ে ১.৩ শতাংশ পয়েন্ট হারে অতিদারিদ্র্য কমেছিল। সেই গতি কিন্তু ধরে রাখা যায়নি। এখন অতিদরিদ্র মানুষের সংখ্যা কমার গতি তুলনামূলকভাবে হ্রাস পেয়েছে। বাংলাদেশ ২০৪১ সালে উন্নত দেশের কাতারে শামিল হবে এমন প্রক্ষেপণ করা হচ্ছে। দারিদ্র্য কমার গতি যদি হ্রাস পায়, তাহলে এত দরিদ্র মানুষকে নিয়ে উন্নত দেশের কাতারে শামিল হওয়া কি জাতি হিসাবে আমাদের জন্য মর্যাদার হবে?
আরেকটি বিষয় এড়িয়ে গেলে চলবে না। তা হলো ধনী-দরিদ্রের মধ্যে আয়ের বৈষম্য প্রকট থেকে প্রকটতর হচ্ছে। এ প্রবণতা অর্থাৎ বৈষম্য গ্রামাঞ্চলের চেয়ে শহরাঞ্চলে সংগত কারণেই বেশি। এ ব্যবধানটুকু আমাদের ঘোচাতে হবে। ইতোপূর্বে উল্লেখ করা হয়েছে, জাকাত মহান আল্লাহতায়ালার একটি বিশেষ নির্দেশনা এবং এটি বঞ্চিত মানবতার জন্য দরিদ্রতা থেকে মুক্তির একটি অনন্য অনবদ্য ব্যবস্থা। যদি তাই হয়ে থাকে, একটি মুসলিম-অধ্যুষিত দেশের অধিবাসী হিসাবে এ ব্যবস্থাকে কার্যকরভাবে প্রয়োগ করা যেতে পারে। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানে রাষ্ট্রপরিচালনার মূলনীতিতে মানুষে মানুষে সামাজিক ও অর্থনৈতিক অসাম্য বিলোপের দৃঢ় অঙ্গীকার ব্যক্ত করা হয়েছে। সংবিধানের অঙ্গীকার পরিপূরণে রাষ্ট্রের পক্ষে সরকার ইসলামের বিধির বিধান মোতাবেক জাকাত সংগ্রহ, তহবিল গঠন, তার সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা এবং উপযুক্ত ব্যক্তিকে তা বিতরণের মাধ্যমে দারিদ্র্যবিমোচনের পাশাপাশি মানুষে মানুষে সামাজিক ও অর্থনৈতিক বৈষম্য দূরীকরণের ক্ষেত্রে যুগান্তকারী ভূমিকা পালন করতে পারে।
আশার কথা, ১৯৮২ সালের জাকাত তহবিল অধ্যাদেশ রহিতক্রমে ৩১ জানুয়ারি ২০২৩ জাকাত তহবিল ব্যবস্থাপনা আইন প্রণয়ন করা হয়েছে। এ আইনের ৩নং ধারায় সরকার কর্তৃক গঠিত জাকাত বোর্ডের মাধ্যমে জাকাত সংগ্রহ ও বিতরণের নির্দেশনা রয়েছে। এ আইনের ৭নং ধারায় উল্লেখিত আছে, জাকাত তহবিল নিম্নোক্ত ৩টি উৎস থেকে সংগৃহীত হবে, যার প্রথম দুটি যথাক্রমে (ক) মুসলিম জনগণ কর্তৃক প্রদত্ত ও বোর্ড কর্তৃক সংগৃহীত জাকাত, (খ) প্রবাসী বাংলাদেশি, মুসলিম নাগরিক, কোনো বিদেশি মুসলিম ব্যক্তি বা কোনো সংস্থায় জমাকৃত জাকাতের অর্থ থেকে প্রাপ্ত জাকাত। এখানে আমরা কেবল ‘মুসলিম জনগণ কর্তৃক প্রদত্ত ও বোর্ড কর্তৃক সংগৃহীত জাকাত’ বিষয়ে দৃষ্টি নিবদ্ধ করতে চেষ্টা করব। পবিত্র কুরআন ও হাদিসে জাকাত সম্পর্কে নানা বিশ্লেষণধর্মী আলোচনা রয়েছে। মোদ্দা কথা হলো, সম্পদের যে নির্ধারিত অংশ আল্লাহর পথে ব্যয় করা ফরজ করা হয়েছে, সেটাই হলো জাকাত এবং এ জাকাত একজন স্বাধীন বয়স্ক সামর্থ্যবান মুসলমানের জন্য ফরজ। মোটা দাগে একজন ব্যক্তির ধনসম্পদ আয়ের (জাকাতের বিধিবিধান ও মানদণ্ড অনুযায়ী নির্ধারিত হয়) ২.৫ শতাংশ প্রতিবছর জাকাত হিসাবে প্রদান করতে হয়। ধর্মপ্রাণ মুসলিম জনগোষ্ঠী প্রধানত রমজানের মধ্যে ঈদুল ফিতরের আগে জাকাত প্রদান করে থাকে। সবচেয়ে দুস্থ, অভাবগ্রস্ত, নিকটাত্মীয়কেই জাকাত দেওয়ার ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিতে হবে এবং জাকাত দ্বারা আর্থিক সহায়তার পরিমাণ এমন হবে, তা দিয়ে যেন জাকাত গ্রহণকারী ব্যক্তি নিজের পায়ে দাঁড়াতে পারে।
উল্লেখ করা যেতে পারে, ২০২৪ সালে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের হিসাব অনুযায়ী, বাংলাদেশে আয়কর সনদধারীর সংখ্যা প্রায় ১ কোটি। দেশে কোটিপতি হিসাবধারীর সংখ্যা ১ লাখের ওপর। এ হিসাবধারীর মাঝে ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান দুই-ই রয়েছে। এর মধ্যে যেমন হাজার হাজার কোটি টাকার মালিকও রয়েছেন, আবার ১ কোটি, ২ কোটি টাকার মালিকও রয়েছেন। ব্যাখ্যার স্বার্থে একেবারে সোজাসাপ্টা হিসাব যদি করি এবং ধরে নিই গড়ে একজন ১০ কোটি টাকার মালিককে ২.৫ শতাংশ হিসাবে প্রতিবছর জাকাত দিতে হয় ২৫ লাখ টাকা। সেই হিসাবে কোটিপতিদের কাছ থেকেই বিপুল অঙ্কের জাকাত সংগৃহীত হবে।
২০২৩-২৪ অর্থবছরে বাংলাদেশের সরকারের পক্ষ থেকে সামাজিক নিরাপত্তাবেষ্টনী কর্মসূচিতে দুস্থ, পরিত্যক্ত, বিধবা মহিলা, প্রতিবন্ধী, বিপন্ন জনগোষ্ঠী, মাতৃদুগ্ধ দানকারী মা, বীর মুক্তিযোদ্ধা, শহিদ ও যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা পরিবার, অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মচারী ও তাদের পরিবারের জন্য সর্বসাকুল্যে বরাদ্দ ছিল ১ লাখ ২৬ হাজার ২৭২ কোটি টাকা। তাহলে দেখা যাচ্ছে, যথাযথভাবে জাকাত প্রদান, সংগ্রহ এবং বিতরণ করা গেলে সরকারের বাইরেও আর্তপীড়িত দুস্থ জনগণের জন্য অত্যন্ত কার্যকর কর্মসূচি গ্রহণ করা যেতে পারে। ইসলামিক ফাউন্ডেশনের অধীনে যে জাকাত বোর্ড রয়েছে, সেখানে জাকাত সংগ্রহ ও বণ্টন নীতিমালা পরিষ্কারভাবে উল্লেখিত আছে। কাকে জাকাত দিতে হবে সে ব্যাপারেও সুনির্দিষ্ট নির্দেশনা রয়েছে। জাকাত ব্যবস্থাপনা ও প্রশাসনের সবচেয়ে বলিষ্ঠ দিক হলো, যারা জাকাত সংগ্রহের কাজে নিয়োজিত হবেন, তাদের বেতনভাতাসংক্রান্ত যাবতীয় ব্যয় জাকাত থেকে সংগৃহীত অর্থ থেকেই নির্বাহ করা যায়। বিত্তবান ধর্মপ্রাণ মুসলিম ভাইবোনদের অনুপ্রাণিত করে বাংলাদেশে অতিদরিদ্র যে জনগোষ্ঠী যার সংখ্যা হলো প্রায় ১ কোটি, তাদের জীবনমানের উন্নয়নের জন্য অনেক কিছুই করা যেতে পারে। এদের মধ্য থেকেই জাকাতের অর্থ দিয়ে অসংখ্য ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তার সৃষ্টিযজ্ঞ শুরু হতে পারে। এটা স্বপ্ন কিংবা কল্পনাবিলাসী কোনো পরিকল্পনা নয়। সংশ্লিষ্ট সবাই যদি এক্ষেত্রে এগিয়ে আসেন, তাহলে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক কর্মপ্রবাহে নতুন এক স্রোতধারার সৃষ্টি হতে পারে। তবে এক্ষেত্রে সরকারিভাবে ধর্ম মন্ত্রণালয় ও ইসলামিক ফাউন্ডেশনকেই দেশের জনগণকে সঙ্গে নিয়ে এগিয়ে আসতে হবে।
ড. মু. আবদুর রহীম খান : সহযোগী অধ্যাপক, বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব গভর্ন্যান্স অ্যান্ড ম্যানেজমেন্ট, ঢাকা
তাসনীম ইসলাম দ্যুতি : গবেষণা সহযোগী