অগ্নিঝরা মার্চ ও এক ‘খলিফা’র কিছু কথা
সাকিব আনোয়ার
প্রকাশ: ২৭ মার্চ ২০২৪, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
সম্ভবত ২০১৯ সালের মার্চে ‘বয়ানতত্ত্ব ও আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাস’ শিরোনামে একটা কলাম লিখেছিলাম। কলামটি যখন লিখছিলাম, তখন শাজাহান সিরাজ জীবিত ছিলেন। ২০১৭-এর শেষ দিকে ব্যক্তিগত আলাপচারিতায় তিনি একবার বলেছিলেন, ‘মাখন (আব্দুল কুদ্দুস মাখন) নেই; সিরাজ ভাই তো কিছু বলেন না; রব ভাই, আমি একদিন সব বলব।’ তার সেই বলা আর হয়নি। তার আগেই তিনি চলে গেলেন। তার সিরাজ ভাইও (সিরাজুল আলম খান) চলে গেছেন।
ইউভাল নোয়া হারারি তার ‘সেপিয়েন্স : অ্যা ব্রিফ হিস্ট্রি অব হিউম্যানকাইন্ড’ বইয়ে মানুষের বয়ান (স্টোরি) তৈরির ক্ষমতার কথা বলেছেন। হারারি বলেন, বিবর্তনের একটা পর্যায়ে এসে মানুষ বয়ান তৈরি করার ক্ষমতা অর্জন করে। কোনো একজন মানুষ যদি একটা গ্রহণযোগ্য বয়ান তৈরি করতে পারে এবং সে যদি সক্ষম হয়, তাহলে আরও অনেক মানুষকে সেই বয়ানের সমর্থনে নিয়ে আসতে পারে। বয়ান বিশ্বাস করিয়ে মানুষকে সংগঠিত করে অসাধারণ সব কাজ করানো যায়। আবার পৃথিবীর যাবতীয় ধ্বংসাত্মক কাজও হয়েছে বয়ান সামনে রেখে। হারারি বলেন, সব রাজনৈতিক ব্যবস্থা (যেমন, গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র), বিভিন্ন রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান, এমনকি রাষ্ট্র নিজেই একটা বয়ান বা গল্প।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসটি মূলত বয়ানতত্ত্বের ওপর প্রতিষ্ঠিত। বাংলাদেশের স্বাধীনতা এসেছে সুদীর্ঘ সংগ্রাম ও একটি সশস্ত্র গণযুদ্ধের মধ্য দিয়ে। সুদীর্ঘ সংগ্রামের মাধ্যমে সৃষ্ট প্রেক্ষাপটে একাত্তরে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মধ্য দিয়ে জন্ম নিয়েছে বাঙালির জাতিরাষ্ট্র-বাংলাদেশ।
একাত্তরের অগ্নিঝরা মার্চ নিয়ে লিখতে বসেছি। মার্চের প্রথম দিন ইয়াহিয়ার পূর্বঘোষিত জাতীয় পরিষদের অধিবেশন বাতিলের সিদ্ধান্তের সঙ্গে সঙ্গেই সেই অগ্নিস্ফুলিঙ্গ আকারে ছড়িয়ে পড়তে শুরু করে। ১ মার্চ সন্ধ্যায় ছাত্রলীগের একক নেতৃত্বে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয়। সেই সন্ধ্যায় সিরাজুল আলম খানের উপস্থিতিতে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেয়। বলা বাহুল্য, ১৯৬৬ সাল থেকেই স্বাধীনতার প্রশ্নে ছাত্রলীগের রেডিক্যাল অংশটি সিরাজুল আলম খানের নেতৃত্বে পরিচালিত হয়ে আসছিল। সেই বৈঠকে পরদিন ২ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলাভবনের বটতলায় এবং ৩ মার্চ পল্টন ময়দানে সমাবেশের সিদ্ধান্ত হয়। পরিকল্পনা অনুযায়ী ২ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবেশে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন এবং ৩ মার্চ স্বাধীনতার ইশতেহার পাঠ করা হয়। সেই বৈঠকে কিংবা পরদিন কলাভবনের সমাবেশের পর সন্ধ্যায় সিরাজুল আলম খান ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের নেতাদের নিয়ে বসেন এবং স্বাধীনতার ইশতেহারের খসড়া তৈরি করে ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক শাজাহান সিরাজকে ৩ মার্চের সমাবেশে পড়ার দায়িত্ব দেন। এ ইশতেহারে স্বাধীন দেশের নাম, মানচিত্র (ভৌগোলিক অবস্থান যা সেসময় খুবই গুরুত্বপূর্ণ ছিল কারণ একটা গোষ্ঠী পূর্ব পাকিস্তানের স্বাধীনতা সংগ্রামকে দুই বাংলার স্বাধীনতা সংগ্রাম হিসাবে প্রচার করে পশ্চিম পাকিস্তান এবং ভারত উভয়কেই প্রতিপক্ষ বানানোর ষড়যন্ত্র করছিল), জাতীয় পতাকা, জাতীয় সংগীত এবং স্বাধীন রাষ্ট্রের শাসন কাঠামো ও মূলনীতি উল্লেখ করা হয়। এটিই বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণার প্রথম লিখিত দলিল।
২ মার্চের পতাকা উত্তোলন প্রসঙ্গে ‘চার খলিফা’র এক ‘খলিফা’ শাজাহান সিরাজের সঙ্গে কথোপকথনে তার বক্তব্য ছিল এরকম : ‘...রব ভাই ওই প্যারেডে সামনে। উনি গিয়া মুজিব ভাইয়ের সামনে একবারে মিলিটারি কায়দায় বইসা সেই পতাকা ওনার হাতে দিল। লিডার খুইলা দ্যাখলেন। দেইখ্যাই ভ্যাবাচ্যাকা খায়া গ্যালেন। তাড়াতাড়ি ভাঁজ কইরা পাশে কেডা জানি আছিল, তার হাতে দিয়া দিল। মনে হয় তাজউদ্দীন ভাই আছিল। হেরপর তো ম্যালা কাহিনি। আওয়ামী লীগ তো কইল এইডা বাড়াবাড়ি হইতাছে। কিন্তু ছাত্রলীগ মানে আমরা আর কি, মনে কর সিরাজ ভাইয়ের ছাত্রলীগ, আমি রব ভাই আমরা ছাড়ি নাই। জাহিদ মানে ওই জগন্নাথের জাহিদ, ওর রুমে পতাকাডা আছিল। হেইডাই সিরাজ ভাই সিস্টেম কইরা ২ তারিখ জাহিদরে দিয়া পাঠায়া দিছে। রব ভাই কার সেডের ডাইন সাইডে আছিল। জাহিদ পতাকাডা দিল। উনি তুইলা দুইবার উড়াইলেন। হেরপর আমি, মাখন, নূরে আলম সিদ্দিকী ভাই....এই তো পতাকা।’ এখানে যে প্যারেডের কথা শাজাহান সিরাজ উল্লেখ করেছেন, সেটা জহুর বাহিনীর কুচকাওয়াজ। এ প্যারেডের আগের রাতে কাজী আরেফ আহমেদের তত্ত্বাবধানে ইকবাল হলের (বর্তমান সার্জেন্ট জহুরুল হক হল) ১১৬ নম্বর কক্ষে আসম আব্দুর রব এবং শাজাহান সিরাজ স্বাধীন বাংলাদেশের জাতীয় পতাকার ডিজাইন করেন (জহুর বাহিনী বা পরবর্তী সময়ে জয় বাংলা বাহিনীর ব্যাটালিয়ন ফ্ল্যাগ হিসাবে)। অনুমোদনের জন্য সিরাজুল আলম খানের কাছে গেলে তিনি লাল বৃত্তের মাঝখানে বাংলাদেশের (তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান) মানচিত্র এঁকে দিতে বলেন। নিউ মার্কেট থেকে সংগ্রহ করা কাপড় দিয়ে বলাকা বিল্ডিংয়ে ছাত্রলীগের অফিসের পাশে এক অবাঙালি দর্জির দোকান থেকে সেলাই করা হয় এ পতাকা। বুয়েট থেকে ট্রেসিং পেপারে মানচিত্র এঁকে আনা হয়। শিবনারায়ণ দাশ আঁকেন মানচিত্র। এ পতাকাই পরবর্তী সময়ে ২ মার্চ ১৯৭১ কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের সমাবেশে আ স ম আব্দুর রব উত্তোলন করেন। ৩ মার্চ পল্টন ময়দানে পঠিত স্বাধীনতার ইশতেহারে এ পতাকাকেই স্বাধীন দেশের পতাকা হিসাবে ঘোষণা করা হয়। ২৩ মার্চ পাকিস্তান দিবসে আনুষ্ঠানিকভাবে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ।
৩ মার্চের পর থেকে সারা দেশ ৭ মার্চে রেসকোর্স ময়দানে শেখ মুজিবুর রহমানের ভাষণের জন্য অপেক্ষা করছিল। কারণ এতদিনে শেখ মুজিব বাঙালির অবিসংবাদিত নেতায় পরিণত হয়েছেন। বাঙালির অবিসংবাদিত নেতা হিসাবে শেখ মুজিবের কাল্ট প্রতিষ্ঠা করতে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা থেকে খালাস পাওয়ার পর ১৯৬৯ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি সিরাজপন্থি ছাত্রলীগের রেডিক্যাল অংশের উদ্যোগে রেসকোর্সে আলাদা সংবর্ধনার আয়োজন করা হয় এবং সিরাজুল আলম খানের নির্দেশে তোফায়েল আহমেদ বঙ্গবন্ধু উপাধি ঘোষণা করেন। ছাত্র ইউনিয়নের উভয় গ্রুপ (মেনন-মতিয়া) এ সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করে। ’৬৯-এর সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ থেকে ’৭১-এ ছাত্রলীগের একক নেতৃত্বে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ গঠনের পটভূমির মধ্যে এ ঘটনাটি ছিল উল্লেখযোগ্য।
৭ মার্চের পর নানা ঘটনা প্রবাহে পরিস্থিতি ক্রমেই উত্তপ্ত হতে থাকে। ২৩ মার্চ প্রজাতন্ত্র দিবসে পাকিস্তানের পতাকা নামিয়ে ২ মার্চ প্রদর্শিত পতাকা উত্তোলন পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকদের নির্দেশে বাঙালির ওপর ক্র্যাকডাউনকে অনিবার্য করে তোলে। অতঃপর ২৫ মার্চের কালো রাতের বিভীষিকা কাটিয়ে বাঙালির প্রতিরোধ যুদ্ধ থেকে স্বাধীনতার চূড়ান্ত লড়াই।
’৬৬-এর ৬ দফার পর শেখ মুজিবসহ আওয়ামী লীগের অনেক নেতা গ্রেফতার এবং বাকিরা আত্মগোপনে চলে যাওয়ার পর সিরাজুল আলম খান আমেনা বেগমকে সঙ্গে নিয়ে অনেকটা একা আওয়ামী লীগ অফিস টিকিয়ে রাখেন। ’৬৯-এ কারামুক্তির পর ক্রমেই শেখ মুজিব সিরাজুল আলম খানের ওপর অনেকাংশে নির্ভরশীল হয়ে ওঠেন। এ সময় স্বাধীনতার প্রশ্নে আপসহীন সিরাজপন্থি ছাত্রলীগের রেডিক্যাল গ্রুপকে পেছন থেকে সমর্থন দিয়ে গেছেন শেখ মুজিব। এ কারণে সিরাজের কর্মকাণ্ডের দিকে আঙুল তুলতে পারেনি ছাত্রলীগ, এমনকি আওয়ামী লীগের কেউ। ফলে ’৬৯-এর পর থেকে মুজিব এবং সিরাজ হয়ে ওঠেন একে অন্যের পরিপূরক। আবার একই সঙ্গে প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসনের দাবিতে রাজনৈতিক লড়াইয়ে থাকা আওয়ামী লীগকেও এ সময় আস্থায় রাখতে পেরেছিলেন শেখ মুজিব। ’৭১-এর অগ্নিঝরা মার্চই বাঙালির স্বাধীন জাতিরাষ্ট্রের মানচিত্র তৈরি করতে শুরু করেছিল, যার পটভূমি তৈরি হচ্ছিল নিভৃতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ৩২ নম্বরে।
সাকিব আনোয়ার : অ্যাক্টিভিস্ট, প্রাবন্ধিক