Logo
Logo
×

বাতায়ন

গণহত্যার শেষ ষড়যন্ত্র

Icon

এ কে এম শাহনাওয়াজ

প্রকাশ: ২১ মার্চ ২০২৪, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

গণহত্যার শেষ ষড়যন্ত্র

১৬ মার্চ থেকে চলা মুজিব-ইয়াহিয়া বৈঠক আইওয়াশ ছাড়া কিছুই ছিল না। পাকিস্তানি সামরিক শাসক শুধু সময়ক্ষেপণ করছিলেন গণহত্যা শুরু করার উপযুক্ত সময়ের জন্য। হঠাৎ ২৫ মার্চ বিকালে আলোচনা স্থগিত করে ইয়াহিয়া খান সোজা বিমানবন্দরে চলে যান। গণহত্যার সবুজ সংকেত দিয়ে সোজা চলে যান করাচি। পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালিদের নির্বিচারে হত্যার মধ্য দিয়ে তাদের কণ্ঠরোধ করার জন্য ৬ ডিভিশন সৈন্যকে নির্দেশ দিয়ে গিয়েছিলেন। করাচি বিমানবন্দরে পৌঁছে ইয়াহিয়া খান সাংবাদিকদের মুখোমুখি হন। সেখানে তিনি সাবলীলভাবে বলেন, ‘আল্লাহ পাকিস্তানকে রক্ষা করেছে’। ইয়াহিয়া খানের ঢাকা ত্যাগের খবর ঢাকাসহ সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ে। রাজনৈতিক আন্দোলনে যুক্ত সবাই এ সংবাদে একটি অশনিসংকেত দেখতে পেলেন। আনুমান করলেন সেদিন রাতেই বড় কিছু ঘটতে যাচ্ছে।

আলোচনা থেকে কোনো ফলাফল না আসায় দেশের সাধারণ মানুষের মধ্যে উত্তেজনা বাড়ছিল। গোলোযোগ ও সংঘাতের নতুন নতুন সংবাদ আসতে থাকে। পূর্ব পাকিস্তানের কয়েকটি জেলায় বাঙালিদের প্রতিবাদ মিছিলে পাকবাহিনী গুলি ছুড়তে থাকে। বাড়তে থাকে মৃতের সংখ্যা। পরিস্থিতির অবনতি ঘটলে চট্টগ্রাম ও রংপুরে কারফিউ জারি করা হয়। ইতোমধ্যে পশ্চিম পাকিস্তানি নেতাদের অনেকেই ঢাকা ত্যাগ করেছেন। ২৫ মার্চ দেশের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের আলোচনার কোনো ফলাফল না জানিয়ে ঢাকা ত্যাগ করাটি ছিল অশোভন ও দূরভিসন্ধিমূলক।

২৫ মার্চ গণহত্যার জন্য পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর প্রস্তুতির একটি চিত্র পাওয়া যায় রফিকুল ইসলামের বইতে (রফিকুল ইসলাম, লক্ষ প্রাণের বিনিময়ে, মুক্তধারা, ১৯৯১)। তিনি চট্টগ্রামে তার দপ্তরে বসে পাওয়া তথ্যগুলো একসঙ্গে জড়ো করেছেন। এখানে তা উদ্ধৃত করা হলো, ‘‘ইয়াহিয়ার সঙ্গে মীমাংসায় পৌঁছে গেছে বলে এ সময়ে একটা গুজব ছড়িয়ে পড়ে। তবে নির্ভরযোগ্য কোনো মহল থেকে এ সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া গেল না। সরকারি বেতারে একটা রাজনৈতিক ফয়সালার আভাস দেওয়া হয়। কিন্তু এ খবরের ওপরও নির্ভর করা গেল না।...

এদিন (২৫ মার্চ) বেলা ১১টায় সেনাবাহিনীর একটি হেলিকপ্টারে মেজর জেনারেল জানজুয়া, মেজর জেনারেল মিঠ্ঠা খান, মেজর জেনারেল নজর হোসেন শাহ এবং আরও একজন জেনারেল (সম্ভবত জেনারেল ওমর) রংপুর গেলেন। সেসময় রংপুরে ২৩ ব্রিগেডের কমান্ডে ছিলেন ব্রিগেডিয়ার আবদুল আলী মালিক। তিনি হেলিপ্যাডে জেনারেলদের অভ্যর্থনা জানিয়ে তাদেরকে সরাসরি তার বাসভবনে নিয়ে গেলেন। এ সময় ১৪শ ডিভিশন সদর দফতরের কর্নেল স্টাফের হাতে এতটি সিল করা প্যাকেট ছিল, অন্যরা ছিলেন খালি হাতে। মাত্র কয়েক মিনিট পর তারা হেলিপ্যাডে ফিরে এসে রংপুর ত্যাগ করলেন। ফেরার সময় কারও হাতে আর সিল করা প্যাকেটটি দেখা গেল না। ব্রিগেডিয়ারের বাসভবনে সে প্যাকেটটি তাকে দেওয়া হয়েছিল।

রংপুর থেকে হেলিকপ্টার রাজশাহী, যশোর, চট্টগ্রাম এবং কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্ট ঘুরে বিকালে ঢাকা ফিরে এলো। ততক্ষণে খবর ছড়িয়ে পড়ে যে, পরিকল্পনা কমিশনের চেয়ারম্যান এবং ইয়াহিয়ার প্রধান আলোচনাকারী এম. এম. আহমদ গোপনে ঢাকা ত্যাগ করেছেন।

ইয়াহিয়া খান প্রেসিডেন্ট হাউস ত্যাগ করলেন বিকাল ৫টা ৪৫ মিনিটে। গোপনে তিনি বিমানযোগে ঢাকা থেকে সরাসরি করাচি চলে গেলেন। সন্ধ্যা ৭টা ৪৫ মিনিটে প্রেসিডেন্টের ঢাকা ত্যাগের খবর প্রথম জানা গেল। শহরের বিভিন্ন স্থানে ইপিআর সৈন্যরা ডিউটিতে ছিল। ‘মীমাংসা হয়ে গেছ’ এ অজুহাত দেখিয়ে এক নির্দেশে বলা হলো ইপিআর সেনাদের আর ডিউটি দেওয়ার দরকার নেই। তাদেরকে অস্ত্রাগারে অস্ত্র জমা দিতে বলা হল। এসব নির্দেশে ইপিআর সদস্যদের মনে সন্দেহ দেখা দিলেও তাদের আর কিছু করার ছিল না। ইতোমধ্যে ২২ বালুচ রেজিমেন্টের সৈন্যরা পিলখানার প্রায় সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করতে শুরু করে দিয়েছিল। ওইদিন বেলা ২টার দিকে ২২ বালুচ রেজিমেন্টের একটি কোম্পানি খেলার পোশাকে পিলখানা এলাকার চারদিক ঘুরে দেখল। তারা এমন ভাব দেখাল যেন এটা তাদের নিয়মিত শরীরচর্চারই অংশ। আসলে চারদিক ঘুরে তারা পিলখানার ভেতরে ইপিআর সেনাদের অবস্থান দেখে রাখছিল যাতে রাতে সঠিকভাবে লক্ষ্যস্থলের ওপর আক্রমণ চালাতে পারে।

পূর্বের নির্দেশ অনুযায়ী সন্ধ্যার মধ্যে সব ইপিআর সেনা তাদের অস্ত্র অস্ত্রাগারে জমা দিয়ে দিল। ২২ বালুচ রেজিমেন্ট নীরবে ইপিআর সিগন্যাল যোগাযোগ কেন্দ্রের দায়িত্ব নিয়ে নিল এবং অবাঙালি সিগন্যাল সেনাদের ডিউটিতে নিয়োজিত করল। গেটেও এ রেজিমেন্টের সেনাদের ডিউটি দেওয়া হলো এবং পিলখানার ভেতরে প্রবেশ কিংবা সেখান থেকে বাইরে যাওয়া বন্ধ করে দেওয়া হলো।’’

ঠিক এভাবে পশ্চিম পাকিস্তানি সেনা অফিসার সিদ্দিক সালিকের ভাষ্যেও (অনুবাদ মাসুদুল হক, নিয়াজির আত্মসমর্পণের দলিল, ঢাকা, জাতীয় সাহিত্য প্রকাশ) পাকিস্তানি সৈন্যদের গণহত্যার প্রস্তুতি সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায়। তিনি লিখেছেন, “২৫ মার্চ মেজর জেনারেল খাদিম হোসেন যখন রাজনৈতিক আলোচনার সম্ভাব্য পরিণতি নিয়ে গভীর চিন্তামগ্ন ছিলেন, ঠিক সে সময় সকাল ১১টায় তার সবুজ টেলিফোনটি বেজে উঠল। অপর প্রান্তে ছিলেন লেফটেন্যান্ট জেনারেল টিক্কা খান। তিনি বললেন, ‘খাদিম, আজ রাতেই’।

নির্দেশটি খাদিমের মধ্যে কোনোরূপ উত্তেজনার সৃষ্টি করল না। তিনি হাতুড়ির আঘাত পড়ার অপেক্ষাতেই ছিলেন। প্রেসিডেন্টের সিদ্ধান্ত তার ক্ষমতা গ্রহণের দ্বিতীয় বার্ষিকীর সঙ্গে মিশে গেল। আদেশ কার্যকর করার জন্য জেনারেল খাদিম বার্তাটি তার স্টাফদের মধ্যে ছড়িয়ে দিলেন। বার্তা যতই নিচের দিকে পৌঁছাতে থাকল, উত্তেজনাও ততবেশি বৃদ্ধি পেল। আমি দেখতে পেলাম কয়েকজন জুনিয়র অফিসার অতিরিক্ত কিছু রিকয়েললেস রাইফেল জড়ো করার জন্য টানাটানি করছে। অতিরিক্ত গোলাবারুদ পাওয়ার জন্য অনুমতি গ্রহণ করছে। একটি বিকল মর্টার সারিয়ে ফেলা হলো। কয়েকদিন আগে রংপুর থেকে আনা (২৯ ক্যাভালরি) ট্যাংকে ব্যবহার করার জন্য চালকরা জং ধরা এম-২৪ কামানে তেল দিতে শুরু করেছে। ঢাকা শহরকে শব্দে প্রকম্পিত করার জন্য এগুলোই যথেষ্ট।

১৪ ডিভিশনের প্রধান স্টাফ অফিসাররা ঢাকার বাইরের গ্যারিসনগুলোকে আঘাত হানার চূড়ান্ত সময়টি টেলিফোনের মাধ্যমে জানিয়ে দিল। বার্তা প্রেরণের জন্য তারা একটি ব্যক্তিগত সাংকেতিক বার্তা তৈরি করেছিল। নির্দেশ হলো, সব গ্যারিসনকে একসঙ্গেই অপারেশনে নামতে হবে। ২৬ মার্চ রাত ১টায় নিয়তি নির্দিষ্ট সময়টি নির্ধারিত হলো। হিসাব করা হয়েছিল যে, ততক্ষণে প্রসিডেন্ট নিরাপদে করাচি পৌঁছে যাবেন।

সেনাবাহিনী ছাড়া আরেক শ্রেণির লোক ওই রাতে তৎপর ছিল। তারা ছিল আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দ এবং বাঙালি সৈন্য, পুলিশ, সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত লোকজন, ছাত্র এবং দলের স্বেচ্ছাসেবকরা। তারা মুজিব, কর্নেল ওসমানী ও গুরুত্বপূর্ণ বাঙালি অফিসারদের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করে চলছিল। প্রচণ্ডতম প্রতিরোধ গড়ে তোলার জন্য তারা তৈরি হচ্ছিল। ঢাকায় তারা অসংখ্য ‘পথ প্রতিবন্ধক’ সৃষ্টি করল, যাতে সৈন্যরা শহরে ভেতর প্রবেশ করতে গিয়ে বাধার সম্মুখীন হয়।

জিপে লাগান ওয়্যারলেস সেট রাত ১১-এর দিকে প্রথমবারের মতো গুঙিয়ে উঠল। স্থানীয় কমান্ডার-এইচ (ঢাকা) আওয়ার শুরু করার অনুমতি চাইল, কারণ ‘অপরপক্ষ’ অতি দ্রুত বাধা দেয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিল। সবাই যার যার হাতঘড়ির দিকে তাকাল। প্রেসিডেন্ট তখনো কলম্বো ও করাচির মাঝামাঝি আছেন। জেনারেল টিক্কা সিদ্ধান্ত দিলেন, ববিকে বল (আরবাব), যতক্ষণ পারে অপেক্ষা করতে।

সৈন্যদের তাদের লক্ষ্য কেন্দ্রের এলাকায় রাত একটার আগে উপস্থিত থাকার কথা ছিল, কিন্তু তাদের মধ্যে কিছু দল, রাস্তায় দেরি হতে পারে চিন্তা করে, ক্যান্টনমেন্ট থেকে রাত ১১-এর দিকেই রওয়ানা দেওয়া শুরু করেছিল। যারা বেতার ও টেলিভিশন কেন্দ্র, টেলিফোন এক্সচেঞ্জ, বিদ্যুৎ কেন্দ্র, স্টেট ব্যাংক ইত্যাদি পাহারা দেওয়ার জন্য আগে থেকেই শহরে ছিল, তারাও এইচ-আওয়ারের অনেক আগেই যার যার অবস্থান নিল।

ক্যান্টনমেন্ট থেকে বের হওয়ার প্রথম কলামটি ক্যান্টনমেন্ট থেকে প্রায় এক কিলোমিটার দূরে ফার্মগেট গিয়ে বাধার সম্মুখীন হয়। কলামটি বাধাপ্রাপ্ত হয় এক বিশাল গাছের গুঁড়ির সামনে যেটাকে সদ্য কেটে রাস্তার মাঝখানে ফেলা হয়েছে। পাশের ফাঁকা অংশগুলো পুরোনো গাড়ি আর অকেজো স্টিম রোলার দিয়ে আটকানো ছিল। ব্যারিকেডের অপর পাশে শহরের দিকটায় হাজার হাজার আওয়ামী লীগ কর্মী দাঁড়িয়ে জয়বাংলা স্লোগান দিচ্ছিল। জেনারেল টিক্কার হেডকোয়ার্টারের বারান্দায় দাঁড়িয়ে আমি তাদের উদ্দীপ্ত হুঙ্কার শুনতে পাচ্ছিলাম। দ্রুতই জয়বাংলা স্লোগানের সঙ্গে রাইফেলের গুলির আওয়াজ মিশে গেল। একটু পরে স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র থেকে গোলার বিস্ফোরণ হয়ে বাতাস চিরে গেল। এরপর, এক মিশ্র আওয়াজ আসতে থাকল গুলি আর জ্বালাময়ী স্লোগানের, সময় সময় লাইট মেশিনগানের আওয়াজও আসছিল। পনেরো মিনিট পর শব্দগুলো হালকা হয়ে আসতে শুরু করল আর স্লোগান কমে আসা শুরু হলো। আপাতদৃষ্টিতে, অস্ত্রের জয় হলো। সেনাবাহিনীর কলাম শহরে ঢুকে পরল।”

এভাবে নির্ধারিত সময়ের আগেই অ্যাকশন শুরু হয়ে গেল। এখন আর পূর্বনির্ধারিত এইচ আওয়ারের জন্য বসে থাকার কোনো যুক্তি নেই। যখন প্রথম গুলিটি ছোড়া হলো, তখন সরকারি পাকিস্তান রেডিওর কাছাকাছি তরঙ্গদৈর্ঘ্যে খুব মৃদুভাবে একটা আওয়াজ পাওয়া গেল। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের পূর্বধারণকৃত একটি বার্তা, যেখানে তিনি পূর্ব পাকিস্তানকে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ হিসেবে ঘোষণা দিচ্ছেন (ডেভিড লুসাক, Pakistan Crisis, লন্ডন, পৃ. ৯৮-৯৯)। এ ঘোষণার পূর্ণ লিখিত রূপটি ভারতীয় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় কর্তৃক প্রকাশিত ‘বাংলাদেশ ডকুমেন্টসে’ দেওয়া হয়। এতে বলা হয়, ‘এটা হয়তো আমার শেষ বার্তা। আজ থেকে বাংলাদেশ স্বাধীন। আমি বাংলাদেশের জনগণকে আহ্বান করছি, যে যেখানে আছ ও যার কাছে যা আছে, সবকিছু নিয়ে শেষ পর্যন্ত সেনাবাহিনীর দখলকে বাধা দিয়ে যাও। তোমাদের লড়াই ততক্ষণ পর্যন্ত চলতেই হবে, যতক্ষণ পর্যন্ত না দখলদার পাকিস্তান বাহিনীর শেষ সৈনিক বাংলাদেশের মাটি থেকে বিতাড়িত হয় ও চূড়ান্ত বিজয় অর্জিত হয়’ (Bangladesh Documents, Vol-1, পৃ. ২৮৬)।

ড. এ কে এম শাহনাওয়াজ : অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়

shahnawaz7b@gmail.com

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : সাইফুল আলম

প্রকাশক : সালমা ইসলাম