Logo
Logo
×

বাতায়ন

জিরো টলারেন্সের ফুটো বেলুন

Icon

এ কে এম শাহনাওয়াজ

প্রকাশ: ১৩ মার্চ ২০২৪, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

জিরো টলারেন্সের ফুটো বেলুন

আমার যতটুকু মনে পড়ে, ফখরুদ্দীন আহমদ তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠনের পর ‘জিরো টলারেন্স’ শব্দটির বহুল প্রচার শুরু হয়। ঘুস, দুর্নীতি, মজুতদারি সবকিছুর বিরুদ্ধে সরকারের কঠোর অবস্থান বোঝাতে জিরো টলারেন্স নীতির কথা বলতেন তিনি। কথাটি তার আবিষ্কার নয়, তবে তিনি ব্যবহার করেছেন। অবশ্য তার কথার কিছুটা বাস্তবায়ন দেখেছি, বিশেষ করে বিএনপির বাঘা বাঘা মন্ত্রী-এমপিরা যখন ধরা পড়তে থাকেন। তছরুপ করা রিলিফের দ্রব্যাদি, সরকারি মালামাল উদ্ধার হতে থাকে। ধরা পড়ার ভয়ে অনেক দুর্নীতিবাজের টাকার বস্তা রাস্তায় ফেলে যাওয়ার কথাও সংবাদমাধ্যম থেকে জেনেছি। এসব সম্ভব হয়েছিল, কারণ রাজনৈতিক সরকার ক্ষমতায় ছিল না বলে ব্যবস্থা নিতে দ্বিধা করেনি ফখরুদ্দীন আহমদের তত্ত্বাবধায়ক সরকার। উলটো হয়ে গেছে এখন সব। রাজনৈতিক সরকারের কাছে প্রত্যাশা বেশি থাকলেও এখন নিরাশাই বড় করে দেখা দেয়। রাজনৈতিক সরকারগুলো দলপ্রীতিতে বন্দি থাকে। সরকার পরিচালনাকারীদের নানা কুল রক্ষা করতে হয় বলে তাদের পক্ষে বড় আদর্শ বাস্তবায়ন করা কঠিন হয়ে পড়ে। তবুও রাজনৈতিক সরকারের গুরুত্বপূর্ণ মানুষরা ‘জিরো টলারেন্স’ শব্দাবলি হরহামেশা ব্যবহার করছেন। কিন্তু এর কার্যকর ভূমিকা দেখতে পাই না। চোর-ছ্যাচড় আর দুর্নীতিবাজরা এ শব্দযুগলকে বিশেষ পাত্তা দেয় বলে মনে হয় না। ঘুস-দুর্নীতি, মজুতদারি ইত্যাদির বিরুদ্ধে সরকারের কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণের কথা বলা হয় বটে; তবে বাস্তবায়ন না হওয়ায় তা কাগুজে বাঘ হয়ে পড়েছে।

এখন যে বৈশ্বিক সংকট চলছে, তা সচেতন মানুষ জানে। সারা পৃথিবীই অর্থনৈতিক সংকটে পড়েছে। বাংলাদেশ এ থেকে আলাদা থাকবে কেন! এর মধ্যেও মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর দৃঢ়তায় অনেক সংকট সামাল দেওয়ার চেষ্টা কারও দৃষ্টি এড়ায়নি। এসবে যতটুকু সাফল্য পাওয়ার কথা, তা ঠিক পাওয়া যাচ্ছে না। সুশাসন এবং কার্যক্ষেত্রে গণতন্ত্র না থাকাটা এর পেছনে সক্রিয়। সংকটে সরকার জনমনে হতাশা না আসার জন্য নানাভাবে ভাষ্য দেয়। এখন বোধহয় সেই সীমারেখাটাও থাকছে না। সরকারপক্ষের দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে ‘জিরো টলারেন্স’ দেখানোর হুমকি এতটাই অকার্যকর যে তা এখন আর কোনো তাৎপর্য বহন করে না। মন্ত্রী ও সরকারের নানা গুরুত্বপূর্ণ জায়গা থেকে বাজার কারসাজির সঙ্গে যুক্ত মুনাফাখোরদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণের হুমকি এখন পানসে হয়ে গেছে। নানা চেষ্টার পরও বাজার কার্যত সরকারের নিয়ন্ত্রণে নেই। অন্যায়কারীদের বিরুদ্ধে ‘কঠোর’ ব্যবস্থা গ্রহণের কোনো নজির আজ পর্যন্ত দেখা গেল না। ভোক্তা অধিকার রক্ষার সরকারি প্রতিষ্ঠান মাঝে মাঝে চুনোপুঁটিদের জরিমানার মধ্যে আটকে নিজেদের ক্ষমতা সীমাবদ্ধ রেখেছে। সরকারি দলকে পৃষ্ঠপোষকতা দেওয়া দাম্ভিক শিল্পপতি ও আমদানিকারকরা ব্যস্ত থাকছেন সরকারের কাছ থেকে আরও কিছু শুল্কমুক্ত সুবিধা ও নানা প্রণোদনা আদায় করে মুনাফার পরিমাণ বাড়িয়ে নিতে। সরকারের কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার হুমকি তাদের জন্য কোনোকালেই প্রযোজ্য থাকেনি। তাই বাজারে ক্ষতবিক্ষত মানুষ এসব ‘জিরো টলারেন্স’ ও ‘কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণে’র হুমকির বেলুনকে আর ভরসা করে না। জানে, এসব বেলুন আকাশে ওড়ার আগেই ফুটো হয়ে যাবে।

এর আগের সরকারে থাকা বাণিজ্যমন্ত্রীর প্রতি মানুষ বিরক্ত ছিল। আমদানি ও বাজার নিয়ন্ত্রণের কেবল ফাঁকা বুলিই দিয়েছেন। কাজের কাজ কিছুই দেখা যায়নি। মানুষ মনে করেছে, ব্যবসায়ীর চোখ মানবকল্যাণের দিকে নয়-মুনাফার দিকে। বুঝতে হবে মন্ত্রী হলেও তিনিও তো একজন ব্যবসায়ী। এ সরকারের সময় যিনি বাণিজ্যমন্ত্রী, তার সম্পর্কে খুব একটা জানা নেই আমার। কিন্তু তিনি যখন কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার পর বাজার নিয়ন্ত্রণে ব্যবসায়ীদের অনুনয় করেন আর রমজানে ধর্মের কথা স্মরণ করিয়ে আখেরাতের ভয়ে ব্যবসায়ীদের সংযত হতে বলেন, তখন অসহায়ত্বটি বোঝা যায়। এসব দেখে আগের বাণিজ্যমন্ত্রীকে ক্ষমা করতে ইচ্ছা হয়।

সব পর্যায়ে মন্ত্রীরা বলেন, রমজানে বাজার স্থিতিশীল থাকবে। কথাটা অনেক ক্ষেত্রেই সঠিক দেখা যেত। আসলে যা মূল্যবৃদ্ধি করার, তা রোজার আগেই সম্পন্ন করা হতো। তাই সত্যিই রোজায় তেমন বাড়ত না! এমন শুভঙ্করের ফাঁকিও টিকছে না এখন। মন্ত্রী মহোদয়দের আশ্বাস ভুল প্রমাণ করে রোজার এক সপ্তাহ আগেই সব পণ্য ঊর্ধ্বমুখী হয়ে গেছে; নাকি আরও একটু বেড়ে একই স্টাইলে রোজায় স্থিতিশীল হয়ে যাবে!

বাস্তব অবস্থার অসহায়ত্বও বোধহয় ঢাকা যায় না। কদিন আগে সংসদের অধিবেশনে সংসদ নেত্রীর প্রশ্ন-উত্তর পর্ব চলছিল। জাতীয় পার্টির মুজিবুল হক চুন্নু অসৎ রুইকাতলা ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেবেন কিনা জানতে চেয়েছিলেন। পরিস্থিতির বাস্তবতায় মাননীয় প্রধানমন্ত্রীও যে কতটা অসহায় ছিলেন তা দৃশ্যমান হলো। তিনি উত্তরটি এড়িয়ে গেলেন। ভোক্তা অধিকার অধিদপ্তরের মাঝে মাঝে অভিযান চালানোর কথাই বললেন শুধু। বরঞ্চ মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জনগণকে পরামর্শ দিলেন সংযমের মাসে ভোগ্যপণ্য ব্যবহারে সংযত থাকতে। বিদেশি পণ্যের ওপর নির্ভরতা কমাতে। পরামর্শ অবশ্যই ভালো। মানুষ তেমন অভ্যাসে চলে এলে অনেক সংকট কমে যায়। তাহলে খেজুর-ধরনের কম আবশ্যিক দ্রব্য আমদানি বন্ধ করে দেওয়াই তো ভালো ছিল। উলটো আমদানিকারকদের শুল্ক কমিয়ে দেশের রাজস্ব ক্ষতিগ্রস্ত করে আরও বেশি ফুলেফেঁপে ওঠার ব্যবস্থা করা হচ্ছে কেন, যেখানে শুল্ক কমানোর সুফল সাধারণ ভোক্তা পাচ্ছে না? আসলে সুশাসন না থাকায় ‘কঠোর ব্যবস্থা’ গ্রহণের আগে এদেশের রাজনৈতিক সরকারগুলোকে অগ্র-পশ্চাৎ অনেক কিছু ভাবতে হয়। সাধারণ মানুষের সামনে থেকে অন্ধকারের পর্দা সরবে কেমন করে!

মানবিক বিপর্যয় তো এখন হরহামেশা হচ্ছে এ দেশে। সুশাসনহীন দেশে কারও ওপরই কোনো নিয়ন্ত্রণ আরোপ করা যাচ্ছে না। ফলে লাগামহীন উন্মত্ত ঘোড়া ছুটছে দিগ্বিদিক। এক রাজধানীতেই কয়েক বছরের ব্যবধানে বড় বড় ভয়ানক অগ্নিকাণ্ড ঘটে গেল। অনেক মূল্যবান জীবন গেল। কিন্তু প্রতিবিধান হলো কোথায়? বনানী, তাজরিন, নিমতলী, চুরিহাট্টা হয়ে বেইলি রোড। সর্বত্র একই মর্মান্তিক কাহিনি। দুর্ঘটনা ঘটে গেলে সব সাজ সাজ রব। এ নিয়ম মানা হয়নি, সে নিয়ম মানা হয়নি। এ প্রতিষ্ঠান দোষ দিচ্ছে সেই প্রতিষ্ঠানকে। মনে হচ্ছে, সব সংকট এবার দূরীভূত হবে। দুদিন পরে আবার যে-কী-সেই। অমুক ভবনের মালিক প্রভাবশালী, তমুক সরকারের ঘনিষ্ঠ লোক। সুতরাং কোনো সংস্থাই বেশি দূর এগোতে পারে না। এবার বেইলি রোডে অগ্নিকাণ্ডের শিকার বহুতল ভবন। কাহিনি একই। একটি মাত্র বেরুনোর সিঁড়ি। লিফট আছে বলে সিঁড়ির মুখ বন্ধ হয়ে আছে গ্যাস সিলিন্ডারে। বলা হচ্ছে, নিচতলায় লাগা আগুন সহজেই নিয়ন্ত্রণ করা যেত; কিন্তু গ্যাস সিলিন্ডারগুলোর ক্রমাগত বিস্ফোরণে আগুন ছড়িয়ে যায় পুরো ভবনে। বলা হয়, ভবনের ও অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থার ত্রুটি নিয়ে সংশ্লিষ্ট দপ্তর তিনবার নোটিশ দিয়েছে। এসব তো পুরোনো কথা। নোটিশের পর কী কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছিল, তা কিন্তু বলা হলো না। বলা হয়েছে, অনেক ভীতসন্ত্রস্ত মানুষ যে ঘরে আশ্রয় নিয়েছিল সেটি ছিল আবদ্ধ। ভেন্টিলেশনের কোনো সুযোগ ছিল না। তাহলে এমন স্থাপত্যিক ত্রুটি রাজউক দেখল না কেন? ফায়ার সার্ভিসের অনুমোদন পেয়েছিল কীভাবে? আসলে এদেশে সর্বত্র ম্যানেজ করার সংস্কৃতি চালু রয়েছে। ফেসবুকে একজনের স্ট্যাটাসে যথার্থ চিত্র পেলাম। স্ট্যাটাসটি এমন, ‘দুর্ঘটনার পর জানা যায় গাড়ির ফিটনেস ছিল না, ভুল চিকিৎসার পর জানা যায় ক্লিনিকের লাইসেন্স ছিল না, আগুন লাগার পর জানা যায় ভবনের নকশায় ত্রুটি, ধরা পড়ার পর জানা যায় দুর্নীতির ফিরিস্তি। তাহলে প্রশ্ন একটাই-সংশ্লিষ্টরা আগে কী করে?’ আমরা মনে করি, কঠোর দলপ্রেমিক রাজনৈতিক সরকারগুলো যে শক্ত ভূমিকায় আসতে পারে না, এ ধরনের করুণ বাস্তবতা তা-ই প্রমাণ করে। যেমন এদেশের পুলিশ, ডিবি, র‌্যাব এত চৌকশ হওয়ার পরও বছরের পর বছর পেরিয়ে যায় তবুও সাগর-রুনি হত্যা ও ত্বকি হত্যার চার্জশিট পর্যন্ত তৈরি হয় না! জবাবদিহিতাহীন এমন বাস্তবতায় এ দেশের মানুষকে কি এভাবেই মার খেতে হবে বারবার?

আমাদের সরকার পরিচালনাকারীরা নৈতিক ও মানসিকভাবে দুর্বল হয়ে পড়ছেন বলে জনকল্যাণে নিবেদিত হওয়ার বদলে বিরোধী দল দুর্বল হওয়ার পরও প্রতিদিন তাদের নিয়েই চর্চা করেন-বক্তৃতা-বিবৃতি দিয়ে বেশি সময় ব্যয় করেন। না হলে বর্তমান বাস্তবতায় বারবার হোঁচট খাওয়া বিএনপিকে নিয়ে এত মাথা ঘামাচ্ছেন কেন আওয়ামী লীগ নেতারা? যখন বিএনপির উপেক্ষিত হওয়ার কথা, তখনই দলটিকে জীবনী শক্তি দিয়ে বেড়াচ্ছেন আওয়ামী লীগ নেতারা। বিএনপি নেতাদেরও স্বস্তি পাওয়া উচিত যে, আওয়ামী লীগ নেতারা থাকতে সহজে মানুষের মন থেকে বিএনপি হারিয়ে যাবে না। সরকার ও আওয়ামী লীগ নেতারা বিএনপির সঙ্গে রাজনৈতিক বন্ধুত্ব বজায় রাখুন, এতে জনগণের তেমন মাথাব্যথা নেই। কিন্তু নিবেদন থাকবে মৃত্যু মিছিলে দাঁড়িয়ে রাজনৈতিক ঝগড়ায় সময় যেন নষ্ট না করেন। এবার জনকল্যাণে নজর দিন। আপনারা ‘জিরো টলারেন্স’ আর ‘কঠোর ব্যবস্থা’ গ্রহণের বাকওয়াজ বন্ধ করে প্রকৃত আন্তরিকতায় মানুষের পাশে দাঁড়ান। বেফাঁস শব্দে লোক না হাসিয়ে সিন্ডিকেট তৈরির নায়ক বিশাল ব্যবসায়ী আওয়ামী লীগের বড় পৃষ্ঠপোষক বা দলীয় লোক অথবা অমুকের চাচা-খালু এসব বিবেচনায় না এনে দুর্নীতিবাজদের কণ্ঠ চেপে ধরুন। সবাইকে জবাবদিহিতার আওতায় নিয়ে আসুন। মানুষ বিশ্বাস করুক এদেশে আইনের শাসন বলবৎ হয়েছে। দলীয় বিবেচনায় না থেকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা øাত মুক্তবুদ্ধির সৎ মানুষদের এক ছাতার নিচে জড়ো করুন। ঢেলে সাজান প্রশাসনের নানা ক্ষেত্রকে।

অবশ্য এমন পদক্ষেপ গ্রহণ সহজ নয় বর্তমান রোগাক্রান্ত গণতান্ত্রিক বোধসম্পন্নদের নিয়ে। প্রকৃত অর্থবোধক গণতন্ত্র ও সুশাসন প্রতিষ্ঠা ছাড়া আমাদের মুক্তি সম্ভব নয়। আমরা বিশ্বাস করতে চাই, অভিজ্ঞ শেখ হাসিনা সরকার যদি মুক্ত অঙ্গনে দাঁড়াতে পারে, তাহলে ঘন অন্ধকার সরিয়ে আলো ফিরিয়ে আনতে পারবে।

ড. এ কে এম শাহনাওয়াজ : অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়

shahnawaz7b@gmail.com

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : সাইফুল আলম

প্রকাশক : সালমা ইসলাম