Logo
Logo
×

বাতায়ন

খাদ্যে বিষক্রিয়ার কারণ ও প্রতিকার

Icon

মো. লোকমান হেকিম

প্রকাশ: ০৪ মার্চ ২০২৪, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

খাদ্যে বিষক্রিয়ার কারণ ও প্রতিকার

শরীর সুস্থ রাখার জন্য আমরা যা কিছু খাই তা-ই খাদ্য। সহজ করে বলা যায়, আমরা যা খাই তা যদি শরীরে কোনো কাজে লাগে এবং ক্ষুধা নিবারণ করে ও তৃপ্তি দেয়, তবে তা-ই খাদ্য। সুতরাং আমরা যা খাই তা যদি দেহের সঠিক বৃদ্ধি সাধন করে কর্মক্ষম রাখে ও রোগের হাত থেকে বাঁচিয়ে সুস্থ রাখে তাহলে তাকে আমরা খাদ্য বলব। খাদ্য ছাড়া আমরা বাঁচতে পারি না, তাই খাদ্যের কোনো বিকল্প নেই। আমাদের দেশে প্রায়ই খাদ্যে বিষক্রিয়ায় মানুষ মারা যাওয়ার কিংবা অসুস্থ হওয়ার খবর পাওয়া যায়। বিভিন্ন কারণে খাদ্য বিষাক্ত হতে পারে। এর অন্যতম কারণগুলো হলো- কীটনাশক, সার, রাসায়নিক পদার্থ, ওষুধ, ধুতরা, ফানজাই, পটকা মাছ, সোলফিশ, স্ট্রবেরি, স্টেফাইলোকক্কাস, ব্যাসিলাস অরিয়াম, ই-কালাই ০১৫৭, ক্লোস্ট্রিডিয়াম, প্রোটোজোয়া, অ্যামিবা, ক্যাম্পাইলো ব্যাক্টার, সালমনেলা, লিসসেরিয়া ইত্যাদি। তবে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই খালি চোখে দেখা যায় না এমন জীবাণু খাদ্যে বিষক্রিয়ার সৃষ্টি করে। তাই এসব জীবাণু সম্বন্ধে আমাদের জানা দরকার। নিম্নে এগুলো সম্বন্ধে আলোচনা করা হলো।

স্টেফাইলোকক্কাস ব্যাকটেরিয়া : এর বিষ মারাত্মক। তাপে নষ্ট হয় না। ৩-৪ ঘণ্টার মধ্যে খাবারে এর বিষক্রিয়া শুরু হয়। অপরিষ্কার হাতের মাধ্যমে ছড়ায়। এছাড়া যেসব গরু মাসটাইটিস রোগে আক্রান্ত হয়, এদের দুধের মাধ্যমে তা সবচেয়ে বেশি ছড়ায়। এ বিষাক্ততার প্রভাবে ডায়রিয়া এমনকি অনেক সময় রোগীর মৃত্যুও হয়।

বেসিলাস সেরিয়াস ব্যাকটেরিয়া : বাসি-পচা কার্বোহাইড্রেট জাতীয় খাবারে (ভাত, রুটি, সুজি, সেমাই ইত্যাদি) এ জীবাণু বেশি বংশবৃদ্ধি করে। তাপে এ জীবাণু নষ্ট হয় না। ১-৫ ঘণ্টার মধ্যে বিষক্রিয়া ঘটায়।

সালনেলা ব্যাকটেরিয়া : এ জীবাণু খোলা-পচা খাবার, অর্ধসিদ্ধ মাংস কিংবা ডিমে পাওয়া যায়। মাছি, তেলাপোকা, ইঁদুর, বিড়াল, মোরগ-মুরগি, পাখির মাধ্যমে এ জীবাণু ছড়ায়। গরমের সময় সংক্রমণ বেশি হয় এবং বংশবিস্তার বৃদ্ধি পায়। খাওয়ার ১২ থেকে ৩৬ ঘণ্টার মধ্যে এর বিষক্রিয়া শুরু হয়। আমাশয়ের মাধ্যমে লক্ষণ প্রকাশ পায়।

লিসেরিয়া : দুধ, মাছ, ডিম, মাখন, মাংস প্রভৃতিতে এর প্রভাব বেশি। বাতাস, পানি, হাঁস, মোরগ-মুরগি, কুকুর, বিড়াল, গরু, ছাগল, ভেড়া, কবুতর প্রভৃতির মাধ্যমে এ জীবাণু বেশি ছড়ায়। এ বিষক্রিয়ার মাধ্যমে ইনফ্লুয়েঞ্জা জ্বরের লক্ষণ দেখা দেয়।

ক্লোস্টিডিয়াম বুটুলিজম ব্যাকটেরিয়া : এটি সবচেয়ে মারাত্মক বিষক্রিয়া ঘটানো জীবাণু। এ জীবাণুর বিষে আক্রান্ত রোগীর অধিকাংশই মারা যায়। এটা সাধারণত টিনজাত মাছ, মাংস, পনির, সবজি ইত্যাদি কম এসিডযুক্ত খাদ্যে বেশি বংশবৃদ্ধি করে। এর বিষক্রিয়ার মানবদেহ দুর্বল হয়ে পড়ে। দেহের পেশিগুলো কার্যকারিতা হারায়। ফলে শ্বাস-প্রশ্বাস বন্ধ হয়ে অল্প কদিনের মধ্যে রোগী মারা যেতে পারে।

ক্যাম্পাইলো ব্যাক্টর জেজুনি ব্যাকটেরিয়া : এ জীবাণু সবচেয়ে বেশি বিষক্রিয়া ঘটায়। দুগ্ধজাত খাদ্য, মাংস, ডিম ইত্যাদি খাবারে এ জীবাণু পাওয়া যায়। পানি, কুকুর, বিড়াল ইত্যাদি গৃহপালিত পশুর মাধ্যমে ছড়ায়। ৬-৭ দিন পর এ বিষক্রিয়ার লক্ষণ প্রকাশ পায়।

খাদ্যে বিষক্রিয়া হলে করণীয় : ইংল্যান্ডের গ্যাস্ট্রো এন্টরোলজি বিভাগের প্রফেসর ডা. রয় পন্ডারের মতে, বিষক্রিয়া ঘটায় এমন অধিকাংশ জীবাণু প্রথমে তাপে এবং পরে খাবার পর পাকস্থলীর অ্যাসিডে নষ্ট হয়। কিন্তু খাদ্যে বেশি জীবাণু থাকলে অনেক ব্যাকটেরিয়া অন্ত্রে চলে যায়। এখানে অ্যাসিড কম থাকে বলে বংশবিস্তার করতে অসুবিধা হয় না। ফলে বিষক্রিয়ার সৃষ্টি হয়। স্পোর সৃষ্টিতে সক্ষম এমন জীবাণু তাপ ও অ্যাসিডে নষ্ট হয় না এবং বিষ উৎপন্নকারক জীবাণুর বিষ তাপে নষ্ট হয় না। এসব ক্ষেত্রে খাদ্যে বিষক্রিয়া সৃষ্টি হয়। বিষক্রিয়া দেখা দিলে পায়খানা ও বমি করালে বা বেশি পরিমাণ পানি খাওয়ালে প্রায়ই রোগী ভালো হয়। এতে বমি, পায়খানা ও প্রস্রাবের সঙ্গে জীবাণু বের হয়ে যায়। ওষুধ খেলে জীবাণু অন্ত্রে থেকে যায়। ফলে বিষক্রিয়াও থেকে যায়। পরে এ বিষক্রিয়া সারা শরীরে ছড়িয়ে পড়ে। কেরোসিন, অ্যাসিড প্রভৃতি উদ্বায়ী রাসায়নিক পদার্থ খেয়ে কেউ অজ্ঞান হলে রোগীকে বমি করানো যাবে না। তবে বিষক্রিয়া দেখা দিলে ডাক্তারের শরণাপন্ন হওয়াই উত্তম।

খাদ্যে বিষাক্ততা প্রতিরোধ : মাছি, তেলাপোকা, ইঁদুর, বিড়াল, কুকুর, হাঁস-মুরগি, কবুতর ইত্যাদি খাদ্য সংরক্ষণ এবং পরিবেশন স্থান থেকে দূরে রাখতে হবে। ওই স্থান পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন ও জীবাণুমুক্ত হতে হবে। স্থানটি জীবাণুমুক্ত করার জন্য ব্লিচিং পাউডার, সাবান, ডিটারজেন্ট পাউডার, স্যাভলন, ডেটল ইত্যাদি ব্যবহার করা যেতে পারে। খাবার সব সময় তাপে ফুটিয়ে খাওয়া উচিত। ফ্রিজের হিমায়িত খাদ্য গরম করে খেয়ে আবার হিমায়িত করা ঠিক নয়। হিমায়িত খাদ্যকে অবশ্যই স্বাভাবিক তাপে এনে গরম করতে হবে। গরম খাবারকে ঠান্ডা করে ফ্রিজে রাখা উচিত। এসব না করলে স্পোর বহনকারী জীবাণু যেমন- ব্যাসিলাস, ক্লোস্ট্রডিয়াম, স্পোরসারসিনাও স্পোরো ল্যাকটোব্যাসিলাস ধ্বংস হবে না।

যারা খাদ্যসামগ্রী তৈরি ও পরিবেশনে নিয়োজিত থাকেন তাদের হাত-পা, শরীর, কাপড়-চোপড় অবশ্যই পরিষ্কার থাকতে হবে এবং যক্ষ্মা, জন্ডিস, টাইফয়েড, কলেরা প্রভৃতি রোগমুক্ত হতে হবে। সবারই পায়খানা, প্রস্রাব করার পর টয়লেট পেপার ব্যবহার করা ও ছাই, বালু বা মাটি দিয়ে হাত পরিষ্কার করা উচিত। তা না করলে হাতে জীবাণু থেকে যায়। পায়খানা করার পর সাবান দিয়ে হাত পরিষ্কার করলে সাবান পিচ্ছিল বলে হাতের রেখার ভেতর জীবাণু থেকে যায়। এজন্য সাবান ব্যবহার করা ঠিক নয়।

খাদ্য পরিবেশনের তৈজসপত্র জীবাণুমুক্ত রাখার জন্য ডিটারজেন্ট পাউডার দিয়ে পরিষ্কার রাখতে হবে। বাজারের খোলা খাবার খাওয়া যাবে না। ঘরেও কোনো খাবার খোলা রাখা যাবে না। এতে বাতাসে বহনকারী জীবাণু খাদ্যে মিশে দূষিত করতে পারে। কাঁচাবাজার, নালা, নর্দমা, ড্রেন, বাড়ির আঙিনা পরিষ্কার রাখতে হবে। যেসব খাবার বিষাক্ত হওয়ার সম্ভাবনা আছে সেগুলো হচ্ছে- পচনশীল ভেজা খাবার, ২৪ ঘণ্টার আগের তৈরি খাবার, খোলা খাবার, গন্ধযুক্ত খাবার ইত্যাদি। এসব খাবার খাওয়ার পরও অনেক সময় সবার দেহে বিষক্রিয়া দেখা দেয় না। এর কারণ হলো যাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা যত বেশি তাদের দেহে বিষক্রিয়া তত কম বা মোটেও দেখা দেয় না। তাই বাসি, ভেজাল, রং মেশানো ও কীটনাশকযুক্ত খাবার পরিহার করুন। অতিরিক্ত তেল, চর্বি ও মিষ্টিজাতীয় খাবার স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর। সব শেষে এ সত্যটি মনে রাখুন-নিজের যত্ন না নিলে নিজে, অন্যের ওপর ভরসা মিছে।

মো. লোকমান হেকিম : চিকিৎসক ও প্রাবন্ধিক

 

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : সাইফুল আলম

প্রকাশক : সালমা ইসলাম