Logo
Logo
×

বাতায়ন

শুধু ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস জানলেই হবে না

Icon

মো. নূরুল আমিন

প্রকাশ: ২৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

শুধু ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস জানলেই হবে না

ব্রিটিশরা এ অঞ্চলকে ২০০ বছর শাসন-শোষণ করেছে। তাদের কাছ থেকে স্বাধীনতা ছিনিয়ে আনতে হাজার হাজার মানুষ প্রাণ দিয়েছে। ১৯৪০ সালের লাহোর প্রস্তাবে ঠিক করা হয়েছিল, ভারতবর্ষের যে অঞ্চলগুলোর মুসলমান বেশি, সেরকম দুটি অঞ্চলকে নিয়ে দুটি দেশ ও বাকি অঞ্চল নিয়ে আরেকটি দেশ হবে। কিন্তু ১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট যে এলাকা দুটিতে মুসলমান বেশি, সে এলাকা দুটি নিয়ে দুটি ভিন্ন দেশ না হয়ে পাকিস্তান নামক একটি দেশ হয়। ১৫ আগস্ট বাকি অঞ্চল নিয়ে ভারত নামে আরও একটি দেশ হয়। পাকিস্তান নামে যে দেশটি হলো, সে দেশের দুটি অংশ দুই জায়গায়। দুটি অংশের দূরত্ব ২০০০ কিলোমিটার। মাঝে আরেকটি দেশ ভারত।

ব্রিটিশরা চলে গেলেও পশ্চিম পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠী বাঙালিদের শোষণ করতে থাকে। তারা প্রথম আঘাত হানে বাংলা ভাষার বিরুদ্ধে। ১৯৪৭ সালেই করাচিতে জাতীয় শিক্ষা সম্মেলনে উর্দুকে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা হিসাবে ব্যবহারের সুপারিশসহ প্রচার মাধ্যমে ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কেবল উর্দু ব্যবহারের প্রস্তাব করা হয়। ১৯৪৭ সালের ৮ ডিসেম্বর রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ব্যাপক সমাবেশ ও মিছিল হয়।

১৯৪৮ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি করাচিতে পাকিস্তান শাসনতন্ত্র পরিষদে উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করার প্রস্তাব উত্থাপন করা হলে গণপরিষদ সদস্য জনাব ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত এক সংশোধনী আনেন যে, উর্দুর পাশাপাশি বাংলা ভাষাকেও রাষ্ট্রভাষা করা হোক। আর তাতেই তীব্র প্রতিবাদী হয়ে উঠলেন পাকিস্তানের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খাঁন। তিনি তার ভাষণে ধীরেন্দ্রনাথ দত্তকে ভারতীয় চর, বিছিন্নতাবাদী হিসাবে অভিহিত করেন। তিনি রাষ্ট্রভাষা বাংলা করার দাবিকে পাকিস্তানে বিভেদ সৃষ্টির অপচেষ্টা বলে উল্লেখ করেন।

১৯৫১ সালের আদমশুমারি অনুযায়ী, পাকিস্তানের জনসংখ্যার ৫৬.৪০ শতাংশ ছিল বাঙালি। পাকিস্তানের জনসংখ্যার মাত্র ৩.২৭ শতাংশের ভাষা ছিল উর্দু, আর এ উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা হিসাবে চাপিয়ে দেওয়ার হীন প্রচেষ্টা চলে।

২৯ ফেব্রুয়ারি সারা বাংলায় প্রতিবাদ দিবস ও ধর্মঘট পালন করা হয়। ২ মার্চ ১৯৪৮ সালে এ আন্দোলনের সমর্থনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফজলুল হক হলে ছাত্র-বুদ্ধিজীবীর সমাবেশ হয়। সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয় এবং ১১ মার্চ ধর্মঘট পালনের সিদ্ধান্ত হয়।

১১ মার্চ ১৯৪৮ সালে সচিবালয়ের সামনে ধর্মঘটের নেতৃত্ব দিতে গিয়ে শেখ মুজিবুর রহমানসহ কয়েকজন গ্রেফতার হন। ১৯ মার্চ ১৯৪৮ সালে মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ ঢাকা আসবেন, সে কারণে সরকার সহনীয় আচরণ করে ১৫ মার্চ নেতাদের মুক্তি দেন। ২১ মার্চ গণসংবর্ধনা অনুষ্ঠিত হয় রেসকোর্স ময়দানে, সেখানে জিন্নাহ ঘোষণা করেন, ‘উর্দু’ একমাত্র উর্দুই হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা। সভায় প্রতিবাদ হয়। ২৪ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়ে তিনি একই বক্তব্য রাখেন, উপস্থিত ছাত্ররা ‘না’ ‘না’ বলে চিৎকার করতে থাকে।

১৯৫২ সালের ২৫ জানুয়ারি খাজা নাজিম উদ্দিন তখন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী, তিনি রেডিও ভাষণে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হবে উর্দু, এমন ঘোষণা দেন। সে কারণে রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ ২৯, ৩০ জানুয়ারি ও ৪ ফেব্রুয়ারি ঢাকায় ধর্মঘট ও প্রতিবাদ সভা আহ্বান করে। ২১ ফেব্রুয়ারি প্রদেশব্যাপী হরতালের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।

১৯৫২ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি স্থানীয় প্রশাসন ২১ ফেব্রুয়ারি থেকে ঢাকায় ১ মাসের জন্য সভা-সমাবেশ ও মিছিল নিষিদ্ধ করে ১৪৪ ধারা জারি করে। ২১ ফেব্রুয়ারি কলাভবনের আমতলায় ১৪৪ ধারা ভঙ্গের প্রশ্নে ঐতিহাসিক ছাত্রসভা অনুষ্ঠিত হয়। বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা ১৪৪ ধারা জারির বিপক্ষে স্লোগান দিতে দিতে জড়ো হয়। পুলিশ অস্ত্র হাতে সভাস্থল ঘিরে রাখে। দুপুর সোয়া ১২টায় ছাত্ররা প্রতিবন্ধকতা ভেঙে রাস্তায় নামার প্রস্তুতি নিলে পুলিশ কাঁদানে গ্যাস নিক্ষেপ করে ১৪৪ ধারা ভঙ্গের অপরাধে কয়েকজনকে গ্রেফতার করে, তাতে সহিংসতা ছড়িয়ে পড়ে, বিক্ষোভ চলতে থাকে। বেলা ২টার দিকে আইন পরিষদে যোগ দিতে সদস্যরা এলে ছাত্ররা তাদের বাধা দেয়। এ সময় ঘটে ইতিহাসের জঘন্যতম ঘটনা, পুলিশের গুলিবর্ষণ। আবদুল জব্বার, রফিকউদ্দিন আহমেদ, আবুল বরকতসহ অনেকে এ গুলিতে নিহত হন।

১৯৫২ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি সারা দেশে মিছিল ও বিক্ষোভে উত্তাল হয়ে ওঠে। ছাত্র-জনতা ঢাকা মেডিকেলে জড়ো হয়, জানাজা হয়। তারপর হাজার হাজার লোকের মিছিল কার্জন হলের দিকে অগ্রসর হতে থাকে। এ মিছিল ছত্রভঙ্গ করতে পুলিশ গুলি চালায়।

১৯৫২ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি ঢাকা মেডিকেলের ছাত্ররা শহিদ মিনার তৈরি করে। শহিদ মিনার উদ্বোধন করেন শহিদ শফিউরের পিতা। ২৩ ফেব্রুয়ারি পুলিশ শহিদ মিনার ভেঙে ফেলে। অবশেষে ১৯৫৬ সালে পাকিস্তানের সংবিধানে বাংলা ভাষাকে উর্দুর পাশাপাশি রাষ্ট্রভাষা হিসাবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়। ১৯৫৭ সালে কেন্দ্রীয় শহিদ মিনারের কাজ শুরু হয় এবং ১৯৬৩ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি শহিদ বরকতের মা শহিদ মিনারটি উদ্বোধন করেন।

১৯৬৬ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ঐতিহাসিক ৬ দফা পেশ করেন। তারপর ’৬৯-এর গণআন্দোলন, ’৭০-এর নির্বাচন ও ’৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে আমরা বিজয় অর্জন করি। ১৯৯৮ সালে দুই বাঙালি রফিকুল ইসলাম ও আবদুস সালামের যথাযথ পদক্ষেপে ও মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সময়োচিত সিদ্ধান্তে ১৯৯৯ সালের ১৭ নভেম্বর ইউনেস্কোর প্যারিস অধিবেশনে একুশে ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসাবে স্বীকৃতি প্রদান করা হয়।

অনেক ত্যাগ, অনেক রক্তের বিনিময়ে আমরা পেয়েছি রাষ্ট্রভাষা বাংলার মর্যাদা, আমরা পেয়েছি বিজয়। আমাদের সে চেতনা নিয়ে, ত্যাগের মনোভাব নিয়ে এগিয়ে যেতে হবে। একুশের শহিদদের শ্রদ্ধা জানাতে যে পরিমাণ শহিদ মিনার বাংলাদেশে নির্মিত হয়েছে, বিশ্বের কোনো দেশে তা হয়নি, এমনকি একুশের সকালে যে পরিমাণ ফুল দিয়ে জনতা শহিদ মিনারে যায়, তা দেখে বিশ্ববাসী অবাক হয়। সে দেশে ভাষার মর্যাদা ভূলুণ্ঠিত হয়, এমন কিছু করা যাবে না। সন্তানের নাম শুনে বাঙালি মনে হয় না, আবার মা বলে আমার সন্তান ইংরেজিতে ভালো, সে বাংলা বলতে পারে না, এরূপ আমরা শুনতে চাই না। আবার যিনি ইংরেজি একটু জানেন, তা জাহির করার যে প্রবণতা, তা পরিহার করতে হবে। দোকানের সাইনবোর্ডে অহেতুক বিদেশি ভাষার ব্যবহার কমাতে হবে। আশার কথা এই যে, ২০২৩ সালে ভাষার মাসের প্রথম দিনে মাননীয় আপিল ও হাইকোর্ট বিভাগ থেকে ১৪৯ রায় ও আদেশ বাংলায় এসেছে, একজন বিচারপতি এ পর্যন্ত ২০ হাজারেরও বেশি মামলার রায় ও আদেশ বাংলায় লিখেছেন। এমনকি উচ্চ আদালতে এখন বাংলায় আবেদন করা যাচ্ছে। ভাষার মাসে এ আমাদের বিরাট সাফল্য। ভাষার মর্যাদা ও দেশের মর্যাদা রক্ষায় আমাদের সর্বাত্মক চেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে।

মো. নূরুল আমিন : চেয়ারম্যান, বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন, সাবেক সিনিয়র সচিব

 

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : সাইফুল আলম

প্রকাশক : সালমা ইসলাম