Logo
Logo
×

বাতায়ন

দ্বিপক্ষীয় ঋণ সহায়তায় জাপানই ভরসা

Icon

মুঈদ রহমান

প্রকাশ: ২৮ জানুয়ারি ২০২৪, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

দ্বিপক্ষীয় ঋণ সহায়তায় জাপানই ভরসা

বর্তমান সময়ে বাংলাদেশের মিত্র বলে যাদের বিবেচনা করা হয়ে থাকে, তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য দেশগুলোর আওতায় আছে চীন, রাশিয়া, ভারত ও জাপান।

কিন্তু চলতি অর্থবছরের (২০২৩-২৪) প্রথম ছয় মাসে (জুলাই-ডিসেম্বর) ঋণ সহায়তার প্রতিশ্রুতি একমাত্র জাপান ছাড়া কারও কাছ থেকেই পাওয়া যায়নি। এ ছয় মাসে জাপান বাংলাদেশকে নতুন করে ২০২ কোটি ডলার ঋণ সহায়তার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। এর বাইরে আগের প্রতিশ্রুত ঋণ সহায়তার ৮১ কোটি ২২ লাখ ডলারও ছাড় করেছে দেশটি। চলতি অর্থবছরের (২০২৩-২৪) প্রথমার্ধে বিভিন্ন দেশের ঋণ প্রতিশ্রুতি ও অর্থছাড় নিয়ে অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের (ইআরডি) ২৩ জানুয়ারি প্রকাশিত প্রতিবেদনে এ তথ্য উঠে এসেছে। ইআরডির প্রতিবেদন বলছে, যদিও চলতি অর্থবছরের প্রথমার্ধে সব মিলে ঋণের প্রতিশ্রুতি পাওয়া গেছে ৬৯৮ কোটি ৯৮ লাখ ডলার; কিন্তু সেগুলো বহুপক্ষীয় আন্তর্জাতিক ঋণদাতা সংস্থার। দ্বিপক্ষীয় ঋণদাতা দেশগুলোর মধ্যে একমাত্র জাপানের কাছ থেকেই প্রতিশ্রুতি পাওয়া গেছে। উল্লিখিত সময়ের মধ্যে সর্বোচ্চ প্রতিশ্রুতি পাওয়া গেছে জাপান নিয়ন্ত্রিত এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের (এডিবি) কাছ থেকে। ব্যাংকটির প্রতিশ্রুত ঋণের পরিমাণ প্রায় ২৪৭ কোটি ডলার। প্রতিশ্রুত ঋণ সহায়তার অর্থছাড়ের দিক থেকেও জাপান শীর্ষে। ইআরডির তথ্য অনুযায়ী, ১৯৭২-৭৩ অর্থবছর থেকে গত ২০২২-২৩ অর্থবছর পর্যন্ত দ্বিপক্ষীয় সহযোগীদের মধ্যে বাংলাদেশের অনুকূলে ঋণ প্রতিশ্রুতি ও প্রতিশ্রুত ঋণছাড়ের দিক থেকে জাপানই রয়েছে সবার উপরে। উল্লিখিত সময়ে জাপান থেকে প্রতিশ্রুত ঋণের পরিমাণ ছিল প্রায় ৩ হাজার ৩৫ কোটি ডলার। এর মধ্যে অর্থছাড় হয়েছে ২ হাজার ৪৫ কোটি ১৮ লাখ ডলার। পাইপলাইনে চুক্তির অপেক্ষায় রয়েছে জাপানের আরও ৭৫৬ কোটি ৯৫ লাখ ডলার। গত পাঁচ দশকে বাংলাদেশের অনুকূলে অর্থছাড় ও দ্বিপক্ষীয় ঋণ সহায়তা প্রতিশ্রুতির দিক থেকে দ্বিতীয় অবস্থান চীনের। দেশটি এ পর্যন্ত অর্থছাড় করেছে ৮১১ কোটি ৫০ লাখ ডলার।

জাপানের ঋণ সহায়তার একটি বড় অংশ রয়েছে যোগাযোগ ও অবকাঠমো নির্মাণের মেগা প্রকল্পগুলোয়। এর মধ্যে মাতারবাড়ী গভীর সমুদ্রবন্দর স্থাপনে আর্থিক ও কারিগরি সহায়তা দিচ্ছে জাপান। প্রকল্পটির প্রাক্কলিত ব্যয় ধরা হয়েছে প্রায় ১৮ হাজার কোটি টাকা। এ প্রকল্পে জাইকা ১৩ হাজার কোটি টাকার অর্থায়ন করছে, যা পুরো প্রকল্পের প্রায় ৭২ শতাংশ। জাপানি বিনিয়োগের ওপর ভরসা করে নেওয়া হয়েছে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের তৃতীয় টার্মিনাল নির্মাণের কাজ। ২১ হাজার ৩৯৮ কোটি টাকার এ মেগা প্রকল্পে জাইকার অর্থায়ন রয়েছে প্রায় ১৬ হাজার কোটি টাকা, যা মোট প্রকল্প ব্যয়ের ৭৫ শতাংশেরও বেশি। আরেকটি উল্লেখযোগ্য প্রকল্প হলো উত্তরা-মতিঝিল মেট্রোরেল প্রকল্প (এমআরটি-৬)। নির্মাণাধীন এ প্রকল্পে ব্যয় ধরা হয়েছে ২১ হাজার ৯৮৫ কোটি টাকা, যার মধ্যে জাইকা অর্থায়ন করবে ১৬ হাজার ৫৯৫ কোটি টাকা। এ প্রকল্পে জাইকার অর্থায়ন ৭৫ শতাংশের বেশি। এমআরটি-৬-এর কাজ প্রায় শেষের পথে। এর পরে আছে এমআরটি-৫। প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করবে হেমায়েতপুর-ভাটারা মেট্রোরেল। প্রকল্পটিতে ব্যয় ধরা হয়েছে ৪২ হাজার ২৩৮ কোটি টাকা। এর মধ্যে জাইকার অর্থায়ন থাকবে ২৯ হাজার ১১৭ কোটি টাকা, যা মোট প্রকল্প ব্যয়ের প্রায় ৭০ শতাংশ। তাছাড়া যমুনা নদীর উপর নির্মাণ করা হচ্ছে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব রেলসেতু। প্রকল্পটির ব্যয় ধরা হয়েছে ১৬ হাজার ৭৮০ কোটি টাকা, যার মধ্যে জাইকার অর্থায়ন থাকবে ১২ হাজার ১৪৯ কোটি টাকা বা ৭২ দশমিক ৪ শতাংশ।

সরকার সারা দেশে ১০০টি অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়ে তোলার পরিকল্পনা হাতে নিয়েছে। এ কর্মপরিকল্পনা বাস্তবায়নে বাংলাদেশের সঙ্গে কাজ করছে কয়েকটি দেশ। তবে বাস্তবায়নের অগ্রগতি বিবেচনা করলে বলা যায়, এক্ষেত্রে জাপানের বিনিয়োগকারীদের জন্য জাপানিজ অর্থনৈতিক অঞ্চলই সবার চেয়ে এগিয়ে আছে। ধারণা করা হচ্ছে, নারায়ণগঞ্জের আড়াইহাজারে নির্মীয়মাণ এ অর্থনৈতিক অঞ্চলে আগামী বছরেই বেশ কয়েকটি শিল্প স্থাপনের কাজ শেষ হবে। জাপান সরকার জাপানিজ অর্থনৈতিক অঞ্চল উন্নয়নের স্বার্থে ফরেন ডিরেক্ট ইনভেস্টমেন্ট প্রমোশন প্রজেক্টের আওতায় ১৩ কোটি ৫৩ লাখ ১০ হাজার ডলার সহায়তা দিয়েছে। আর বাংলাদেশ সরকার এ অর্থনৈতিক অঞ্চল স্থাপনে ব্যয় করবে প্রায় ৩ হাজার ২০০ কোটি টাকা।

এনবিআরের সাবেক চেয়ারম্যান ও বর্তমানে ইন্টারন্যাশনাল বিজনেস ফোরাম অব বাংলাদেশের উপদেষ্টা ড. মোহাম্মদ আবদুল মজিদ জাপানে বাংলাদেশের কমার্শিয়াল কাউন্সিল হিসাবে কাজ করেছেন ছয় বছর। তিনি জাপান-বাংলাদেশ সম্পর্কের বিষয়ে বলেছেন, ‘১৯৭২ সাল থেকে জাপান বাংলাদেশকে সব সময় বছরে গড়ে ৩০০ মিলিয়ন ডলার দিয়ে এসেছে। আগে অনুদান বেশি ছিল। দেশটি থেকে পাওয়া ঋণের সুদহার ১ শতাংশেরও নিচে। শিনজো আবের সময়ে জাপানে পুঁজির উদ্বৃত্ত তৈরি হয়েছিল। আবে ২০১৫ সালে বড় বিনিয়োগকারী প্রতিষ্ঠানগুলোকে নিয়ে এসেছিলেন, তখন বিগ বির আওতায় বড় অঙ্কের বিনিয়োগের রাজনৈতিক প্রতিশ্রুতি দিয়ে গিয়েছিলেন। সেই সময়ের পর থেকে বিনিয়োগ আকারে বছরে ৩০০ মিলিয়নের বেশি অর্থ জাপান দিতে শুরু করে। একপর্যায়ে মাতারবাড়ীসহ বড় প্রকল্পে জাপান সম্পৃক্ত হয়। এদিকে বঙ্গবন্ধু শিল্পনগরে বড় বিনিয়োগ করছে ভারত, এ প্রেক্ষাপটে জাপানও এ এলাকায় ভালো উপস্থিতির তাগিদ অনুভব করে। ফলে মাতারবাড়ীর গভীর সমুদ্রবন্দরের মতো কাজগুলো তারা নিল বা পেল। এছাড়া কিছু প্রকল্পে পরোক্ষভাবে অর্থায়নের সুযোগও তারা গ্রহণ করল।’

তবে জাপানের বিনিয়োগকৃত প্রকল্পগুলো তুলনামূলকভাবে অধিকতর ব্যয়বহুল বলে নানা সময়ে আলোচনায় এসেছে। এর একটি বড় উদাহরণ হিসাবে এসেছে চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়ক চার লেনে উন্নীতকরণ প্রকল্প। ২৩ দশমিক ৫২ কিলোমিটার দীর্ঘ মহাসড়কটি চার লেনে উন্নীত করার জন্য ১২ হাজার ১৩৬ কোটি টাকার একটি প্রস্তাব পরিকল্পনা কমিশনে পাঠিয়েছিল সড়ক ও জনপদ (সওজ) অধিদপ্তর। এ প্রকল্পের সম্ভাব্যতা সমীক্ষা, নকশাসহ আনুষঙ্গিক পরিকল্পনার দায়িত্বে ছিলেন জাইকার বিশেষজ্ঞরা। জাপানের অর্থায়নে প্রকল্পটিতে প্রতি কিলোমিটারে ২৫৬ কোটি টাকা ব্যয়ের প্রস্তাব করা হয়েছিল। প্রস্তাবে ফ্লাইওভার, সেতু নির্মাণ, ভূমি অধিগ্রহণসহ সম্ভাব্য অন্যান্য ব্যয় যুক্ত করে দেখা যায়, প্রতি কিলোমিটার সড়ক নির্মাণে সার্বিক খরচ পড়ে ৫২৬ কোটি টাকা, যা একই ধরনের চলমান অন্যান্য প্রকল্পের বরাদ্দের চেয়ে দুই-তিনগুণ বেশি। ব্যাপক সমালোচনার মুখে পরে প্রকল্পের ব্যয় কমিয়ে দেয় পরিকল্পনা কমিশন। সাড়ে ৩ হাজার কোটি টাকার বেশি কমিয়ে প্রকল্পের ব্যয় নামিয়ে আনা হয় ৮ হাজার ৫৫৬ কোটি ১৩ লাখ টাকায়। যদিও নীতিনির্ধারকদের কেউ কেউ বলেছেন, জাপানিরা কাজ ভালো করে, তাই ব্যয় একটু বেশি হয়। কিন্তু সমালোচকরা বলেন, তাহলে মেগা প্রকল্পেও কাজ খারাপ করার সুযোগ আছে? আমাদের বিদ্যমান অর্থনৈতিক পরিস্থিতিতে দ্বিপক্ষীয় ঋণদাতা দেশগুলো এ সময়ে অনেকটা রক্ষণশীল ও সাবধানী অবস্থানে আছে। বলতে দ্বিধা নেই, সেক্ষেত্রে জাপান তার অবস্থানকে গতিশীলই রেখেছে। বলা যায়, নতুন ঋণের গন্তব্য হিসাবে এখনো বাংলাদেশের ওপর ভরসা রাখতে পেরেছে জাপান।

নতুন সরকার চাপের মুখে থাকা অর্থনীতিকে চ্যালেঞ্জ হিসাবে নিয়ে তাকে চাঙা করতে চায়; একই সঙ্গে উন্নয়ন প্রকল্পগুলোয় গতি আনতে চায়। গত দেড় বছর ধরে আমরা ডলার-সংকটের ভেতর দিয়ে চলেছি। ২০২৪ সাল থেকে বিদেশি ঋণের সুদাসল পরিশোধ করতে হবে প্রায় সাড়ে চার বিলিয়ন ডলার। এ সংকট থেকে উত্তরণ এবং বিদেশি মুদ্রার রিজার্ভ বাড়ানোর অন্যতম উপায় হতে পারে প্রতিশ্রুত বিদেশি ঋণ সহায়তার অর্থ ছাড় করা। প্রতিশ্রুত অর্থ ছাড় করাতে পারলে ডলার-সংকট কমবে এবং রিজার্ভ বাড়বে।

এ বিবেচনা মাথায় রেখে ২৪ জানুয়ারি পরিকল্পনা কমিশন বৈঠকে বসেছে। ৯ বছর পর এটি প্রথম বৈঠক। বিগত ৫২ বছরে কমিশনের বৈঠক হয়েছে মাত্র তিনটি। বৈঠকে বিদেশি ঋণছাড়ের বিষয়ে গুরুত্বারোপ করা হয়। বিদেশি ঋণের প্রকল্প সম্পর্কে বৈঠকে উপস্থাপিত হয়েছে, ২০২২-২৩ অর্থবছরে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে (এডিপি) বিদেশি ঋণ ও অনুদান ব্যবহারের হার ছিল ৭২ দশমিক ৪ শতাংশ। অপরদিকে ২০১৭-১৮ অর্থবছরে বিদেশি ঋণের ব্যবহার ছিল প্রায় ৯২ শতাংশ। বিদেশি ঋণ ব্যবহারের এ উচ্চহারের পরবর্তী বছরে আমাদের জিডিপির প্রবৃদ্ধি ছিল ৭ দশমিক ৮ শতাংশ, যা ছিল বাংলাদেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ। চলতি অর্থবছরে এডিপিতে মোট বরাদ্দ রাখা হয়েছে ২ লাখ ৭৪ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে বিদেশি সহায়তা ধরা হয়েছে ৯৪ হাজার কোটি টাকা। এখন সর্বাত্মক প্রচেষ্টা থাকতে হবে, যাতে করে প্রতিশ্রুত ঋণ সহায়তার অর্থ ছাড় করানো যায়। মনে রাখতে হবে, প্রকল্পগুলোতে অর্থায়নে বিদেশি ঋণ সহায়তা আসে বিদেশি মুদ্রায়, আর প্রকল্পগুলোয় ব্যয় হয় স্থানীয় মুদ্রা টাকায়। তাই রিজার্ভে ডলার থেকে যায়।

মুঈদ রহমান : অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : সাইফুল আলম

প্রকাশক : সালমা ইসলাম