স্বদেশ ভাবনা
চালকল মালিকরাই নিয়ন্ত্রণ করছেন বাজার
আবদুল লতিফ মন্ডল
প্রকাশ: ২৪ জানুয়ারি ২০২৪, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
দেশে চালের ক্রেতা-ভোক্তারা আশা করেছিলেন, আমনের ভরা মৌসুমে চালের দাম কমবে। তাদের সে আশা শুধু অপূর্ণই থাকেনি, চালের দাম কমার বদলে বেড়েছে। চালের দামে ঊর্ধ্বগতির খবর পত্রপত্রিকায় গুরুত্বসহকারে প্রকাশিত হয়।
১৩ জানুয়ারি যুগান্তরের প্রতিবেদন অনুযায়ী, বস্তাপ্রতি (৭৫ কেজি) চালের দাম বেড়েছে ২০০ থেকে ২৫০ টাকা। আর প্রকারভেদে কেজিপ্রতি চালের দাম বেড়েছে ৬ থেকে ১০ টাকা। বাজারে ধান-চালের দামে ঊর্ধ্বগতি রোধে ১৭ জানুয়ারি খাদ্য মন্ত্রণালয় আহূত মতবিনিময় সভায় উপস্থিত দেশের চালকল মালিক, আড়তদার, করপোরেট ও চালের পাইকারি ব্যবসায়ীদের উদ্দেশ করে খাদ্যমন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদার বলেছেন, ‘এখন আমনের ভরা মৌসুম। এ সময়ে চালের দাম বাড়বে এটি কোনোভাবেই মেনে নেওয়া যায় না। মিলগেটে ২ টাকা দাম বাড়লে পাইকারি বাজারে ৬ টাকা কেন বাড়বে? অবৈধ মজুতকারী কিংবা অহেতুক দাম বাড়িয়ে দেওয়া ব্যবসায়ী কেউ আইনের ঊর্ধ্বে নয়। সবাইকে জবাবদিহি করতে হবে।
বিনা লাইসেন্সে যারা ধানের স্টক করছেন, তারা কোনোভাবেই ছাড় পাবেন না। আবার যাদের করপোরেট প্রতিষ্ঠান রয়েছে, তারা ২-৩ টাকা খরচে প্যাকেট করে সুপারশপে ৮-৯ টাকা দাম বাড়িয়ে দেন। এটিও কোনোভাবে কাম্য নয়।’ তাদের উদ্দেশে খাদ্যমন্ত্রী আরও বলেছেন, ‘যেভাবে চারদিনের মধ্যে লাফিয়ে লাফিয়ে চালের দাম বাড়ানো হয়েছে, ঠিক সেভাবে চারদিনের মধ্যে দাম কমিয়ে আনতে হবে।’
সভা অনুষ্ঠানের দুদিন পর পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত খবরে জানা যায়, চালের দাম প্রকারভেদে কেজিতে দেড থেকে তিন টাকা কমেছে। এ থেকে যে ধারণাটি বদ্ধমূল হয়ে ওঠে তা হলো, চালের বাজারে অর্থনীতির সাধারণ নিয়ম অকার্যকর।
অর্থনীতির সাধারণ নিয়ম অনুযায়ী, কোনো পণ্যের দাম সেটির চাহিদা ও সরবরাহের মধ্যে বিরাজমান সম্পর্ক দ্বারা নির্ধারিত হয়। চাহিদার তুলনায় পণ্যটির সরবরাহ বেশি থাকলে দাম কম থাকে, আর চাহিদার তুলনায় সরবরাহ কম থাকলে দাম বেশি থাকে। সম্প্রতি চালের দামে ঊর্ধ্বগতি এবং প্রশাসনের চাপে সামান্য নিম্নগতি থেকে স্পষ্ট হয়ে ওঠে, অর্থনীতির নিয়ম অনুযায়ী বাজারে চালের দাম নির্ধারিত হচ্ছে না। চালের দাম নির্ধারণ চালকল মালিক তথা চাল ব্যবসায়ীদের ইচ্ছার ওপর নির্ভরশীল। মূলত চালকল মালিকরা কীভাবে চালের বাজার নিয়ন্ত্রক হয়ে উঠেছেন, তা আলোচনা করাই এ নিবন্ধের উদ্দেশ্য।
এক. দুটি ঘটনা এবারের আমন মৌসুমে ধান-চালের বাজার ঊর্ধ্বমুখী হওয়ার পেছনে প্রাথমিক ভূমিকা রেখেছে। গত ডিসেম্বরের ৭ থেকে ৯ তারিখে রাজধানী ঢাকায় অনুষ্ঠিত সরকারি গবেষণা সংস্থা বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজের (বিআইডিএস) বার্ষিক সম্মেলনে অন্যান্য বিষয়ের মধ্যে বলা হয়, দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন ঘিরে মার্কিন নিষেধাজ্ঞার আশঙ্কা করা হচ্ছে।
এমন নিষেধাজ্ঞা দেশের খাদ্য নিরাপত্তাকে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে। আর ৮ ডিসেম্বর গোপালগঞ্জের কোটালীপাড়ায় এক সভায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আগামী মার্চে দেশে দুর্ভিক্ষের আশঙ্কার কথা বলেন।। খাদ্য নিরাপত্তাহীনতা বা দুর্ভিক্ষের এমন আশঙ্কায় চালকল মালিক ও বড় করপোরেট কোম্পানিগুলো ভবিষ্যতে বেশি লাভের আশায় তাদের ধান-চাল মজুতের পরিমাণ বাড়িয়ে দিতে শুরু করে।
পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত খবরে জানা যায়, চালকল মালিক ও বড় করপোরেট কোম্পানিগুলো প্রতিযোগিতা করে বাড়তি দামে ধান কিনতে থাকে। চাহিদার তুলনায় সরবরাহ কম থাকায় প্রতি মনে ২০০ থেকে ৩০০ টাকা বেশি দামে ধান বিক্রি হতে থাকে। এতে চালের দাম বাড়তে থাকে। উল্লেখ্য, ২০১৯ সালে পরিচালিত এক অনুসন্ধান রিপোর্ট অনুযায়ী, ২০১৯ সালের জুনে ধানের মজুতে বড় ও মাঝারি কৃষকের অংশ ছিল ১৯ দশমিক ৮ শতাংশ। বাকি ৮০ শতাংশের মধ্যে ৬০ শতাংশের কিছুটা বেশি মজুত ছিল চালকল মালিকদের কাছে। অবশিষ্ট কম-বেশি ২০ শতাংশ মজুত ছিল ব্যবসায়ীদের কাছে।
দুই. ধানচাষিরা চাল বিক্রি করেন না, তারা বিক্রি করেন ধান। ধারণা করা হচ্ছিল, চালকল মালিকরা বিপুল পরিমাণে কেনা ধান চালে রূপান্তর করছেন এবং সিন্ডিকেশনের মাধ্যমে অপর্যাপ্ত পরিমাণে চাল বাজারে ছেড়ে কৃত্রিম সংকট সৃষ্টির মাধ্যমে বেশি পরিমাণে লাভ করছেন। যুগান্তরের একটি প্রতিবেদনে এ ধারণার সত্যতা পাওয়া যায়। পাইকারি চাল ব্যবসায়ীদের বরাত দিয়ে ১৪ জানুয়ারি যুগান্তরের প্রতিবেদনে বলা হয়, কয়েকদিন ধরে মিল পর্যায় থেকে চালের সরবরাহ করা হচ্ছে না। পাইকারি চাল ব্যবসায়ীরা যে পরিমাণ চালের অর্ডার দিচ্ছেন, মিল থেকে দেওয়া হচ্ছে তার কম। এক ধরনের কৃত্রিম সংকট তৈরি করে চালের দাম বাড়ানো হচ্ছে। করপোরেট কোম্পানিগুলোরও নিজস্ব মিল ও দোকান আছে। তারাও প্রয়োজনে চাল মজুত করে ও সুযোগ বুঝে বাজারে ছাড়ে বলে মিডিয়ায় খবর প্রকাশিত হয়েছে।
তিন. অভ্যন্তরীণ চাল সংগ্রহে সরকার চালকল মালিকদের ওপর পুরোপুরি নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে। চলমান নীতিমালায় অভ্যন্তরীণভাবে চাল সংগ্রহের জন্য চালকল মালিকরা ছাড়া দ্বিতীয় কোনো উৎস নেই। ২০০৬ সালের জাতীয় খাদ্যনীতিতে উন্মুক্ত প্রতিযোগিতামূলক দরপত্রের মাধ্যমে অভ্যন্তরীণ বাজার থেকে চাল ও অন্যান্য খাদ্যশস্য কেনার নির্দেশ থাকলেও তা বাস্তবায়িত হচ্ছে না। চালকল মালিকরা এ সুযোগের পুরোপুরি সদ্ব্যবহার করছেন। সরকার চাষিদের কাছ থেকে খুব সামান্য পরিমাণ ধান কেনে। এ সুযোগে চালকল মালিকরা ধান কাটা-মাড়াইয়ের মৌসুমে সিন্ডিকেশনের মাধ্যমে স্বল্প দামে প্রচুর পরিমাণে ধান কিনে মজুত করেন। তারা এ ধান চালে রূপান্তর করে সরকারকে চুক্তিবদ্ধ চাল সরবরাহ করেন। অবশিষ্ট থেকে যাওয়া চালের বড় অংশটি সিন্ডিকেশনের মাধ্যমে সময় ও সুযোগ বুঝে চড়া দামে বিক্রি করে লাভবান হন।
চার. চলতি অর্থবছরে দেশে কোনো চাল আমদানি না হওয়ায় এখন কেবল আমন চালের ওপর নির্ভর করতে হচ্ছে। সাধারণভাবে আমন ধান কাটা-মাড়াই শুরুর সময় থেকে বোরো ধান কাটা-মাড়াই শুরুর আগ পর্যন্ত অর্থাৎ ডিসেম্বর-এপ্রিল সময়ে আমন চালের ব্যবহার হয়।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) খানা আয় ও ব্যয় জরিপ ২০১৬ অনুযায়ী, জাতীয় পর্যায়ে মাথাপিছু দৈনিক চাল ভোগের পরিমাণ দাঁড়ায় ৩৭৭.২ গ্রামে, যা ২০১০ সালে ছিল ৪১৬ গ্রাম। সে হিসাবে চলতি অর্থবছরের ডিসেম্বর-এপ্রিল সময়ে দেশের ১৭ কোটি মানুষের জন্য কম-বেশি ১ কোটি ৫০ লাখ টন চাল প্রয়োজন হতে পারে। চলতি মৌসুমে আমনের উৎপাদন নিয়ে এখন পর্যন্ত দুই ধরনের তথ্য পাওয়া গেছে।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর (ডিএই) আশা করছে, চলতি আমন মৌসুমে ১ কোটি ৭১ লাখ টন চাল উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রার বিপরীতে প্রায় ১ কোটি ৭৫ লাখ টন চাল উৎপন্ন হবে। এদিকে মার্কিন কৃষি বিভাগের (ইউএসডিএ) এক সাম্প্রতিক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এবার মৌসুমের শুরুতে প্রয়োজনীয় বৃষ্টির অভাবে একদিকে যেমন আমন রোপা কার্যক্রম দেরিতে শুরু হয়, তেমনি অন্যদিকে আমন চাষের জমির পরিমাণ ২ দশমিক ৫৪ শতাংশ হ্রাস পেয়ে ৫৭ দশমিক ৫০ লাখ হেক্টরে দাঁড়ায়। তাছাড়া নভেম্বরের তৃতীয় সপ্তাহে ঘূর্ণিঝড় মিধিলির কারণে দক্ষিণাঞ্চলের উপকূলীয় জেলাগুলোর দণ্ডায়মান ধান ফসলের ৫ থেকে ১০ শতাংশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এসব কারণে ইউএসডিএর মতে, এ বছর আমনের উৎপাদন ১ কোটি ৩৯ লাখ টনে দাঁড়াতে পারে।
ধরা যাক বিবিএসের হিসাবে এবার আমন চাল উৎপাদনের পরিমাণ দাঁড়াল ১ কোটি ৫০ লাখ টনে। আমনের এ উৎপাদনকে প্রয়োজনের তুলনায় যথেষ্ট মনে করা সংগত নয়। বাফার স্টক প্রয়োজন। আমদানির অবর্তমানে চালের বাফার স্টক তৈরি হচ্ছে না, যা আগামী মার্চ-এপ্রিলে চালের বাজার আরও অস্থিতিশীল করে তুলতে পারে।
পাঁচ. আন্তর্জাতিক বাজারে চালের মূল্যবৃদ্ধি দেশে চালের দামকে উসকে দিয়েছে। প্রাপ্ত তথ্যে দেখা যায়, সদ্য সমাপ্ত বছরের শেষদিকে আন্তর্জাতিক বাজারে চালের দাম বেড়ে ১৫ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছেছে। উচ্চ চাহিদা ও সীমিত সরবরাহ এ মূল্যবৃদ্ধিতে প্রভাবক হিসাবে কাজ করছে। ভারত সাদা ও ভাঙা চাল রপ্তানিতে নিষেধাজ্ঞা বহাল রেখেছে। বিক্রি কম হওয়া সত্ত্বেও ভিয়েতনামি চালের দাম ২০০৮ সালের পর এ যাবৎকালের সর্বোচ্চ পর্যায়ে উঠেছে।
এদিকে এল নিনোর প্রভাব, অনাবৃষ্টি, অতিবৃষ্টি ও বন্যার মতো সমস্যার কারণে বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোয় খাদ্যশস্যের ফলন ব্যাহত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। একদিকে যখন জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে খাদ্যশস্যের উৎপাদন হ্রাস পাওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে, অন্যদিকে তখন চাল আমদানিকারক দেশগুলো থেকে চালের চাহিদা বাড়ছে। দেশে গত ছয় মাসে চাল আমদানি না হলেও আন্তর্জাতিক বাজারে চালের দাম বাড়ার খবরকে চালকল মালিক ও ব্যবসায়ীরা চালের দাম বাড়ার কাজে লাগিয়েছেন মনে করার যথেষ্ট কারণ রয়েছে।
চাল আমাদের প্রধান খাদ্য। খাদ্য নিরাপত্তা মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া বা দুর্ভিক্ষের যে আশঙ্কার কথা বলা হয়েছে, তা মোকাবিলায় সর্বাগ্রে যে পদক্ষেপ দরকার তা হলো বাজারে চালের সরবরাহ যথেষ্ট পরিমাণে বৃদ্ধি করা। চলতি আমন থেকে যে চাল পাওয়া যাবে, তা আগামী বোরো ফসল ওঠা পর্যন্ত দেশের চাহিদা মেটাতে পারবে না বলে ধরে নেওয়া যায়। বোরো ফসল ওঠা পর্যন্ত কী পরিমাণ চাল আমদানি প্রয়োজন হতে পারে, একটি জরুরি সার্ভের মাধ্যমে তা নির্ধারণ এবং সে অনুযায়ী চাল আমদানি করা যেতে পারে। দ্বিতীয় খাদ্যশস্য গমে আমরা প্রায় পুরোপুরি আমদানিনির্ভর। তাই প্রয়োজনীয় গম আমদানির ব্যবস্থাও সম্পন্ন করতে হবে। অন্যথায় চালের ওপর চাপ বেড়ে যাবে।
চালের বাজারের ওপর সরকারের নিয়ন্ত্রণ আরও জোরদার করতে হবে, যাতে চালকল মালিক ও বড় করপোরেট কোম্পানিগুলো সিন্ডিকেশনের মাধ্যমে চালের দাম নিয়ন্ত্রণ করতে না পারে। আর যে বিষয়টিতে দৃষ্টি দিতে হবে তা হলো, নিম্নবিত্তের আয় বৃদ্ধি। কারণ, আর্থিক সামর্থ্য না থাকলে তারা বাজার থেকে চালসহ খাদ্যপণ্য সংগ্রহ করতে পারবেন না। ফলে তারা খাদ্য নিরাপত্তাহীনতার শিকার হবেন।
আবদুল লতিফ মন্ডল : সাবেক খাদ্যসচিব, কলাম লেখক
latifm43@gmail.com