Logo
Logo
×

বাতায়ন

মুক্তচিন্তার আলোকিত মানুষ চাই

Icon

এ কে এম শাহনাওয়াজ

প্রকাশ: ০৩ জানুয়ারি ২০২৪, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

মুক্তচিন্তার আলোকিত মানুষ চাই

বর্তমান পৃথিবীর সব দেশের মানুষ এমন কি না আমি জানি না। একসময় রাজনীতি করা মানুষ সমাজে সম্মানিত ছিলেন। রাজনীতিকরা ছিলেন সাধারণ মানুষের কাছে আরাধ্য ও ভরসার স্থল। কিন্তু সময় পালটে গেছে। রাজনীতির নীতি-আদর্শও এখন ধোঁয়াটে। এখন অনেক ক্ষেত্রেই রাজনৈতিক দলসংশ্লিষ্ট মানুষদের অভিব্যক্তি দেখে বিস্মিত ও বিমর্ষ হতে হয়।

কোনো রাজনৈতিক দলের সমর্থক হলে শুধু নেতা নন, কর্মী-সমর্থকরাও মুক্তচিন্তাবিবর্জিত হয়ে যান। নিজ দলের ভুল সাধারণত চোখে পড়ে না। পড়লেও তা অন্যদের কাছে প্রকাশ করতে চান না। কেউ তার দলের ভুল দেখিয়ে দিলে, গঠনমূলক সমালোচনা করলেও দুঃখ পান, ক্ষুব্ধ হন। সমালোচকের কথায় যতই যুক্তি থাকুক, তারা সাধারণত এসব সুবচনকে আস্তাকুঁড়ে ফেলেন এবং সমালোচকদের প্রতিপক্ষ দলের অনুসারী বিবেচনায় মানসিকভাবে বয়কট করেন।

আওয়ামী লীগ যত কথাই বলুক, তারাও জানেন, ভোটাররাও জানেন, আর প্রতি কেন্দ্রে ভোটগ্রহণের দায়িত্বে যারা ছিলেন তারা তো জানেনই ২০১৮ সালে নির্বাচনকে কীভাবে গড়াপেটা করা হয়েছিল। বিএনপির নেতৃত্ব ও রাজনীতির দুর্বলতায় জাতীয় ও আন্তর্জাতিক অঙ্গনে সেই নির্বাচন আওয়ামী লীগ একরকম বৈধ করে ফেলতে পেরেছিল। চ্যালেঞ্জমুক্ত থাকলে এভাবে বিজয়ীরই শেষে জিত হয়। বিজয়ীকেই বেশির ভাগ মানুষ জিন্দাবাদ দেয়। এখন সেই নির্বাচনের অন্যায় সম্পর্কে লিখে একজন মুক্তচিন্তার মানুষ সরকারি দলের রোষানলে পড়বেন; আর এমন বিবেচনা হতে থাকবে যে, এ ভদ্রলোক বিএনপি-জামায়াত সমর্থক। অথচ মুক্তিযুদ্ধের চেতনা নিয়ে বেড়ে ওঠা এই মানুষটি হয়তো আদর্শিক কারণে বিএনপি ও জামায়াতের ছায়া থেকে যোজন যোজন দূরে থাকেন। আবার একই মানুষই যখন বিএনপির জন্ম নিয়ে প্রশ্ন তোলেন, জিয়াউর রহমান কেন রাজাকার শাহ আজিজকে স্বাধীন দেশের প্রধানমন্ত্রী বানালেন, গোপন বিচারে কেন মুক্তিযোদ্ধা সেনা অফিসারদের হত্যা করলেন, খালেদা জিয়ার শাসনামলে একাত্তরের ঘাতক পাকিস্তানি হানাদার সৈন্যদের সহচর ও বুদ্ধিজীবী হত্যাকারীদের দেশের মন্ত্রী বানালেন, সব জেনেবুঝে নতুন প্রজন্মকে বিভ্রান্ত করার জন্য জিয়াউর রহমানকে স্বাধীনতার ঘোষক বলে প্রচার করতে থাকলেন। কেন জাতির শোকাবহ দিন ১৫ আগস্ট সব মানবিকবোধ বিসর্জন দিয়ে খালেদা জিয়ার জন্মদিন ঘোষণা করতে হয়েছিল? আবার এমন দিনেই সহচর পরিবেষ্টিত হয়ে সহাস্য বদনে কেক কাটছিলেন বিএনপি নেত্রী। আর কেক কাটার এ প্রতিযোগিতায় নেমেছিলেন বিএনপি রাজনীতিসংশ্লিষ্ট নেতা, কর্মী, স্বল্পশিক্ষিত, শিক্ষিত সবাই।

একবার বিশ্ববিদ্যালয়ে বিএনপি রাজনীতি করা শিক্ষক দলের এক স্নেহভাজন অধ্যাপককে বলেছিলাম, ১৫ আগস্টের মতো দিনে ‘ফেক’ জন্মদিনের উৎসব করতে তোমার বিবেক সায় দেয়? তিনি অধোবদন হয়ে বলেছিলেন, ‘কী করব স্যার, যেহেতু রাজনীতি করি, তাই এ উৎসবে শামিল না হলে পিছিয়ে পড়তে হবে!’ বুঝলাম রাজনীতির আফিম এবং চাওয়াপাওয়ার হিসাবে বিবেক নির্বাসিত হয়ে যায়। স্বস্তির বিষয়, কয়েক বছর হয় এ কেক-উৎসব থেকে নিজেদের গুটিয়ে নিয়েছে বিএনপি। এখন এসব কথা মুক্তচিন্তার কোনো সচেতন মানুষ লিখলে তৎক্ষণাৎ তিনি আওয়ামী লীগের লোক হয়ে যাবেন এবং বিএনপি নেতাকর্মীর চোখে নিন্দিত হবেন।

আওয়ামী লীগ কি জন্মলগ্নের আদর্শ ধারণ করা অবস্থায় এখন আছে? বঙ্গবন্ধুর আদর্শে চলা আওয়ামী লীগকে কি এখন খুঁজে পাওয়া যাবে? মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্ব দেওয়া আওয়ামী লীগ নেতারা কি নিজ দলের ভেতর বর্ণচোরা জামায়াত-বিএনপি মতাদর্শীদের জায়গা করে দেননি? গুরুত্বপূর্ণ পদে নিয়ে আসেননি? এখন এসব বললে তো মুহূর্তে ‘বিএনপি’ হয়ে যেতে হবে।

আওয়ামী লীগের টানা চৌদ্দ বছরের শাসনামলে অসহনীয় দুর্নীতি সমাজকে অনেক বেশি কলুষিত করেছে। নির্বাচনে প্রার্থীদের হলফনামায় দেখা গেল, এমপি-মন্ত্রীদের অনেকেই পাঁচ বছরে অগাধ অর্থশালী হয়েছেন। তারাই আবার অধিকারী হয়েছেন নির্বাচন করার। কিন্তু এ নিয়ে কোনো প্রশ্ন রাখার সুযোগ নেই।

দলতন্ত্র আর প্রভাবশালীদের দাপটে দলীয় রাজনীতি বিযুক্ত যোগ্য নাগরিকরা এখন কোণঠাসা দশায়। অসংখ্য উদাহরণ থেকে একটি উদাহরণ দেই। বেশ কয়েক বছর ধরে সরকার একটি মহৎ প্রকল্প কার্যকর করছে। একটি বড় বাজেট বরাদ্দ রাখছে লেখক প্রকাশকদের প্রণোদনা ও জ্ঞান বিকাশের স্বার্থে। এটি বইকেনা প্রকল্প। প্রকাশক-লেখকরা বই জমা দেবেন। নির্দিষ্ট কমিটি বাছাই করে বই কিনবে। এসব বই সরকার স্কুল, কলেজ ও বিভিন্ন লাইব্রেরিতে বিতরণ করবে। প্রকাশনা শিল্পের জন্য একটি বড় প্রণোদনা ছিল এটি। কিন্তু অচিরেই এখানে রাহুর দৃষ্টি পড়ে। তদবির, ক্ষমতার প্রভাব, দলীয় বিবেচনা, অর্থ লেনদেন ইত্যাদির কুপ্রভাবে বই নির্বাচনে নিরপেক্ষতা হারিয়ে গেল। ক্ষমতাবান লেখক, বিশেষ করে দলীয় লেখকদের বই নির্বাচিত হতে লাগল। সুপরিচিত যোগ্য লেখকদের মূল্যবান গ্রন্থও দাপুটেদের কারণে বিবেচনায় এলো না। এ সুযোগে বুদ্ধিমান অনেক প্রকাশক প্রভাবশালী রাজনীতিক আর আমলাদের লেখক বানাতে থাকলেন। তাদের বই কিনতে কিনতেই প্রকল্পের বড় অংশের অর্থ খরচ হয়ে যেতে লাগল। এ নিয়ে কাগজে সমালোচনা কম হয়নি। শেষ পর্যায়ে শুভচিন্তায় এক বছর শ্রদ্ধেয় আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ স্যারের নেতৃত্বে গ্রন্থ নির্বাচন কমিটি গঠন করা হয়। সে বছর অনেকটা নিরপেক্ষভাবে গুণবিচারে বই কেনা হয়েছিল। বিষয়টি বিশ্বাস করতে পারি, কারণ সে বছরই আমাদের মতো অভাজনদের বইও ক্রয় তালিকার অন্তর্ভুক্ত হয়।

বিষয়টি হয়তো ভালো লাগেনি ক্ষমতাবানদের। পরের বছরই এ নিরপেক্ষ কমিটি বাতিল হয়ে গেল। ২০২২ সাল থেকে লেখক-প্রকাশকদের মধ্যে সাজসাজ রব পড়েছিল। প্রধানমন্ত্রী বই কেনার প্রকল্পে প্রায় পঞ্চাশ কোটি টাকা বরাদ্দ করেছেন। ফলে নির্বাচিত কোনো বই ত্রিশ হাজার থেকে ষাট হাজার কপি কেনা হবে। বাংলাবাজারের প্রকাশকদের অনেকে বলাবলি করছিলেন, যে ধরনের বই কেনার বৈশিষ্ট্যের কথা বলা হয়েছে তাতে নাকি গুণবিচারে আমার অন্তত তিনটি বই ক্রয় তালিকায় যাবে। তবে আমি এবং আমার প্রথিতযশা প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানের প্রকাশক উভয়েই উল্লসিত হতে পারিনি। কারণ উভয়েই তদবির করতে পারি না এবং অন্য কোনো প্রভাবও নেই। এবার অন্য এক প্রতিষ্ঠানের প্রধান বিশিষ্টজনের নেতৃত্বে বই নির্বাচনের জন্য শেক্যায়েব নামের প্রজেক্টের দায়িত্ব দেওয়া হয়। যথারীতি পুস্তক প্রকাশকদের চিহ্নিত প্রভাবশালী এবং সরকারি দলভুক্ত প্রকাশকদের সিন্ডিকেট সক্রিয় হয়ে পড়ল। অতি প্রভাবশালী লেখকরা দাঁড়িয়ে গেলেন। এ অবস্থায় সংক্ষুব্ধ অনেক প্রকাশক আদালতে রিট করেন। আদালতের রায়ে বই কেনা স্থগিত হয়ে যায়। অতি প্রভাবশালীরা কিছুদিনের মধ্যেই স্থগিত আদেশ অবমুক্ত করে ফেলেন। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বাছাই কমিটি করায় যেখানে আস্থা রাখলেন, জনরব হলো সেই বেড়াই নাকি খেত খেয়ে ফেলল। বিশাল অর্থের নাকি ছড়াছড়ি হতে থাকল। শেষ পর্যন্ত অতি প্রভাবশালীদের কবজায় চলে গেল সিংহভাগ অর্থের বই কেনা। মাঝখানে কোটি কোটি টাকার বাণিজ্য হয়ে গেল।

এখন এমন সত্য কাগজে প্রকাশ করার পর আওয়ামী লীগের ভক্তরা বলবেন, এ লেখক সরকারের নিন্দা করছেন, নিশ্চয়ই তিনি ‘বিএনপি’ হবেন! এমন বাস্তবতায় আর কী করা যাবে? এমনটি দেখতে পাচ্ছি দলবাজ বদ্ধচিন্তার মানুষদের প্রতিক্রিয়ায়। নির্বাচন সামনে রেখে বিএনপির ভুল পথে হাঁটা দেখে কলাম লেখকের দায়িত্ব থেকে সমালোচনা করে যখন পথনির্দেশনা দিই, তখন বিএনপিমনা পরিচিত শিক্ষিতজন অনেকে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আমাদের তুলোধুনো করেন। তারা আওয়ামী লীগের নানা অন্যায় সামনে নিয়ে আসেন। সেসব কথা বলছি না কেন-বলে অনুযোগ দেন। আমি বুঝে পাই না এখানে আওয়ামী লীগ আসে কেন! এখানে তো কারও সঙ্গে তুলনামূলক বিচার করা হচ্ছে না। আওয়ামী লীগ হয়তো আরও অনেক খারাপ কাজ করেছে। সে প্রসঙ্গ এলে আলোচনা করা যাবে। এখানে অন্য কোনো দলের চেয়ে আপনি কতটা ভালো বা মন্দ, সে কথা আসছে না। আপনার কতটা শুদ্ধ হওয়া প্রয়োজন তা নিয়ে ভাবার কথা।

স্পষ্ট হচ্ছে, এখন যেন মুক্তচিন্তার কোনো জায়গা নেই। বিএনপি আমলে যেমন দেখেছি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক হতে গেলে খোঁজ নেওয়া হতো প্রার্থী ছাত্রকালে ছাত্রদল করত কি না, পরিবারটি বিএনপিভুক্ত কি না, তেমনই আওয়ামী লীগ আমলে আরও বাড়াবাড়িভাবে ছাত্রলীগ আর আওয়ামী লীগের সিল প্রার্থীর গায়ে ভালোভাবে মারা আছে কি না-এসব বিবেচনা আগে চলে আসে। প্রার্থীর মেধার প্রশ্নটি আসে অনেক পরে।

সম্ভবত আশির দশকে আবদুল্লাহ আল মামুন মঞ্চ নাটক করেছিলেন ‘সুবচন নির্বাসনে’। এখন মুক্তবুদ্ধির চর্চাও যেন নির্বাসনে যাচ্ছে। সবকিছুই এখন রাজনৈতিক পক্ষ-বিপক্ষ দিয়ে বিচার করা হচ্ছে। কিশোর বয়সে মুক্তিযুদ্ধ কাছে থেকে দেখেছি। মানুষের আর্তনাদ শুনেছি। পাকবাহিনী, বিহারি আর আলবদরদের হাতে অনেক নিকটজনের নিহত হওয়ার কথা জেনেছি। আমাদের তিন পুরুষের সম্পত্তি-বাড়িঘর পাকিস্তানি বাহিনীর আগুনে ভস্মীভূত হতে দেখেছি। মুন্সীগঞ্জ লঞ্চঘাটের পন্টুনে বসে অসহায় বাঙালির মৃতদেহের মিছিল স্রোতে ভেসে যেতে দেখেছি। অতঃপর ক্ষমতায় এসে বিএনপি নেতাদের হাতে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা লাঞ্ছিত হতে দেখেছি। ফলে আমার পক্ষে বিএনপি-জামায়াতকে বন্ধু ভাবার কারণ নেই। তাই বলে মুক্তচিন্তায় বিএনপিকে আলোচনা-সমালোচনায় কি আনা যাবে না! মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব দিয়েছে বলেই কি এ সময়ের আওয়ামী লীগের ‘সাত খুন মাপ’ হয়ে যাবে! এ শাসক দলের বিরুদ্ধে কি মতপ্রকাশ করা যাবে না? তেমনটি হলেই কি আমি আওয়ামী লীগবিরোধী আর বিএনপির মুখপাত্র হয়ে গেলাম?

এখন এদেশে আমাদের সংকটটি এখানেই অবস্থান করছে। দলবাজি করতে গিয়ে আমরা বদ্ধচিন্তার বন্দিত্বে পড়ে বিবেক হারিয়ে ফেলছি। এ অবস্থা থেকে বেরোতে হবে আমাদের। মুক্তচিন্তার আলোকিত মানুষ হওয়া এখন খুবই প্রয়োজন।

ড. এ কে এম শাহনাওয়াজ : অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়

shahnawaz7b@gmail.com

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : সাইফুল আলম

প্রকাশক : সালমা ইসলাম