হিংসায় উন্মত্ত পৃথ্বী : পরিবর্তনের প্রত্যাশা
মফিদুল হক
প্রকাশ: ০১ জানুয়ারি ২০২৪, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
বছরের আবর্জনা দূর হয়ে যাক; পুরাতনকে পেছনে ফেলে নতুন আশায় নব-উদ্যমে সামনের দিকে পা বাড়ানো-এই তো বর্ষবরণের স্বাভাবিক রীতি। কিন্তু গোটা বিশ্ব আজ মানবতার যে গভীর সংকটে পতিত হয়েছে, মামুলি সালতামামি ও গৎবাঁধা নতুনের আবাহনের সুযোগ সেখানে নেই। একবিংশ শতকের পৃথিবী বিজ্ঞান-প্রযুক্তিতে উৎপাদনের সম্ভোগে যে শিখর স্পর্শ করেছে, তার পাশাপাশি মানবতা, সভ্যতা, সহমর্মিতা ও মানসসম্পদের বিকাশ যে ক্রমাগত অতল অন্ধকারে তলিয়ে যাচ্ছে, সেই পরিচয় তো নানাভাবে জানান দিচ্ছিল বিশ্ব বাস্তবতা; কিন্তু সেদিকে দৃষ্টিদান কিংবা নতুনতর এসব সংকটের মোকাবিলায় মানবগোষ্ঠী যে ক্রমেই ব্যর্থ হচ্ছে, এমন বার্তা শোনার মতো ফুরসত যেন কারও নেই। ফলে আজ যে নিষ্ঠুর বাস্তবতার মুখোমুখি আমরা হয়েছি, সেখানে বিশ্বসমাজ নিজ ব্যর্থতা ও অসারতাকেই মেলে ধরেছে এবং এমন বাস্তবতা নিয়েই আমরা পা রাখছি নতুন বছরে।
পঞ্চাশ বছরেরও আগে বাংলাদেশ যখন স্বাধীনতা অর্জন করে, তখন ‘জলবায়ু সংকট’ নামীয় কোনো সমস্যার কথা কারও বিবেচনায় ছিল না। পৃথিবীর বুক নিংড়ে যত সম্পদ আহরণ করা যায় এবং যন্ত্রের সাহায্যে যত পণ্য উৎপাদন করা যায়, সেটাই মানুষকে অগ্রগতির পথে এগিয়ে নিয়ে যাবে-এমন আস্থা ছিল প্রবল। আজ আমরা প্রকৃতির প্রতিশোধের চক্রে বাঁধা পড়েছি, মানুষের বিরুদ্ধে ফুঁসে উঠছে প্রকৃতি, যার একাদিক্রম ও অভাবিত আঘাতে বিশ্ববসতি হয়ে উঠছে অসহায় ও বসবাস অযোগ্য। সুনামির আঘাতে হকচকিয়ে গিয়েছিল সমুদ্র উপকূলের নানা অঞ্চল। কোভিডের মৃত্যুদংশন মনে করিয়ে দিল মধ্যযুগে প্লেগে উজাড় হয়ে যাওয়া জনপদের পর জনপদের স্মৃতি। উৎপাদন, বিপণন ও সম্পদের বিপুলতা সত্ত্বেও অগ্রসর-অনগ্রসর সব দেশ মহাস্থবিরতায় আক্রান্ত হলো, অভাবিত এক সংক্রমণ মোকাবিলায় বাঁচার জন্য বিবরবাসী হলো দুনিয়ার মানুষ। সেই সংকটের ঢেউ কেটে গেলেও সভ্যতার সংকট নিয়ে আর কোনো ভাবনা-চিন্তার প্রতিফলনও যেন মিলিয়ে গেল দ্রুত। গত নভেম্বর মাসে দুবাইয়ে আয়োজিত বিশ্ব জলবায়ু পরিবর্তন সম্মেলন ছিল সেদিক দিয়ে তাৎপর্যপূর্ণ, যদিও আপাতদৃষ্টিতে দৈনন্দিন জীবনাযাত্রার সঙ্গে এর প্রত্যক্ষ যোগ বিশেষ ছিল না। তবে মানবসভ্যতার ভবিষ্যতের জন্য গুরুত্ববহ এ সম্মেলনে কোনো কার্যকর সিদ্ধান্ত গ্রহণে বিশ্বের রাষ্ট্রগুলো যে ব্যর্থ হচ্ছে, আরেকবার তা জানান দিল জাতিসংঘের উদ্যোগে আয়োজিত সম্মেলন। ফসিল ফুয়েল বা তেল-গ্যাসের বিকল্প হিসাবে পরিবেশবান্ধব শক্তি উৎপাদনের পথে চলার পথরেখা হাতড়ে ফেরা হচ্ছে, নবায়ন অযোগ্য জ্বালানি ব্যবহারে সীমারেখা আরোপে কোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণ সম্ভব হয়নি। এমন সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্য মুনাফা ও মানবতার মধ্যে সমীকরণ টানার যে প্রয়াস নিতে হবে, তা কোনো সহজ কাজ নয়। সেই পথে অগ্রসর হওয়ার সামর্থ্য বিশ্বসমাজ এখনো অর্জন করেনি, ‘কপ ২৮’ সেটাই আমাদের দেখিয়ে দিল।
তবে সভ্যতার সংকট সবচেয়ে তীব্রভাবে দেখা দিল ৭ অক্টোবর গাজার ফিলিস্তিনি গোষ্ঠী হামাসের যোদ্ধাদের সীমান্তের দেওয়াল, প্রহরা, সার্বক্ষণিক পর্যবেক্ষণের লৌহকপাট ভেঙে ইসরাইলে প্রবেশ এবং সশস্ত্র আক্রমণ অভিযান। অবিশ্বাস্য এ আঘাত হতচকিত করে দিয়েছিল ইসরাইলকে, শোকবিহ্বলও বটে, তিন শতাধিক সৈন্যের সঙ্গে আরও আট শতাধিক সাধারণ নাগরিকও এ অভিযানের শিকার হয়। সবচেয়ে বড় কথা, পায়ের নিচে দাবিয়ে রাখা, মৌলিক মানবাধিকারবঞ্চিত যে বিশ লক্ষাধিক ফিলিস্তিনিকে গাজার ভূখণ্ডে কার্যত খাঁচাবন্দি করে রাখা হয়েছিল, তারা যে এমন সুপরিকল্পিত, সুসমন্বিত আক্রমণ করে ইসরাইলের প্রতিরক্ষা শক্তিকে পরাভূত করতে পারে, সেটা ছিল সবার কল্পনার বাইরে। এখান থেকে শিক্ষা নেওয়ার ছিল, কেন এমন ঘটনা ঘটল তা তলিয়ে দেখার ছিল, যেমনটা বলেছিলেন জাতিসংঘের মহাসচিব অ্যান্তোনিও গুতেরেস, ৭ অক্টোবরের ঘটনা হঠাৎ করে ঘটেনি, এর রয়েছে পটভূমি। কিন্তু বিপরীতে ইসরাইল যে প্রত্যাঘাতের সূচনা করল তা হামাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ছিল না, যুদ্ধের সর্বজনস্বীকৃত রীতিনীতি পদদলিত করে তারা চরম হিংস্রভাবে ঝাঁপ দিল নারী-পুরুষ নির্বিশেষ সব ফিলিস্তিনির ওপর। একদিকে এ সীমাহীন বর্বরতা, প্রতিদিন দুনিয়া যা প্রত্যক্ষ করছে, একবিংশ শতকে এমন হিংস্রতার মুখোমুখি হয়ে যে অবস্থান বিশ্বসমাজ নিয়েছে, তা সভ্যতার অসারতা ও অসহায়ত্ব তীব্রভাবে ফুটিয়ে তুলেছে। গাজায় মাইলের পর মাইল ধ্বংসস্তূপ তৈরি করা হয়েছে, সাধারণ নাগরিকদের বাড়িঘরের ওপর বিমান থেকে ফেলা হচ্ছে বোমা, আর্টিলারির গোলা ধ্বংস করছে গোটা এলাকা, ট্যাংক ও সাঁজোয়া যানে সৈনিকরা চালাচ্ছে নিষ্ঠুর হত্যাকাণ্ড, হন্যে হয়ে খুঁজছে হামাসের হাতে আটক শতাধিক ইসরাইলি জিম্মিকে।
গাজার যৎসামান্য ভূখণ্ডে বিপুলসংখ্যক ফিলিস্তিনিকে কার্যত বন্দি রেখে যে ব্যবস্থা ইসরাইল আরোপ করেছিল, তা দক্ষিণ আফ্রিকায় বর্ণবাদী শ্বেতাঙ্গ শাসকদের প্রবর্তিত ‘অ্যাপার্থেইড’ বা বর্ণবৈষম্য নীতির পরাকাষ্ঠা তৈরি করেছিল। অ্যাপার্থেইডের বিরুদ্ধে নিন্দায় মুখর হয়েছিল বিশ্বসমাজ, আরোপ করেছিল বাণিজ্য নিষেধাজ্ঞা। সেই সঙ্গে নেলসন ম্যান্ডেলার নেতৃত্বে কালো মানুষদের সশস্ত্র প্রতিরোধ আন্দোলন অর্জন করেছিল স্বীকৃতি ও সমর্থন। বর্ণবৈষম্যবাদী শ্বেতাঙ্গ শাসন ভেঙে পড়েছিল এ প্রতিরোধ সংগ্রামে। এর বিপরীতে ইসরাইলি বর্বরতার মুখোমুখি জাতিসংঘ পরিণত হয়েছে নির্জীব নিষ্ক্রিয় সংস্থায়। ইসরাইলের আত্মরক্ষার অধিকারের দোহাই দিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র নিরাপত্তা পরিষদে প্রয়োগ করেছে ভেটো, যুদ্ধবিরতির কোনো প্রস্তাবই পশ্চিমা রাষ্ট্রগুলো মানতে রাজি নয়। ফলে অব্যাহত রয়েছে রোমহর্ষক বেদনাদায়ক হত্যালীলা। গাজায় বিধ্বস্ত দালানকোঠার স্তূপে আটক রক্তাক্ত আহত শিশুরা ঢলে পড়ছে মৃত্যুর কোলে, অসহায় পিতা দু-হাতে সরাতে চাইছে কংক্রিটের পাথর; কিন্তু তিনি নিরুপায়, তেমনি নিরুপায় বিশ্বমানবতা।
গাজার দারিদ্র্যপীড়িত সাধারণ ফিলিস্তিনিদের আবাস যখন গুঁড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে বোমার আঘাতে, তখন ঝুরঝুর করে কেবল বাড়িঘর ভেঙে পড়ছে না, ধূলিসাৎ হচ্ছে পাশ্চাত্য সভ্যতার গর্ব। এনলাইটেনমেন্ট, মানুষের অধিকার, গণতন্ত্র ও সভ্যতার যে ধারণার ওপর অগ্রসর সম্পদবান পাশ্চাত্য নির্মাণ করেছে তাদের সভ্যতা ও জ্ঞানকাঠামোর সৌধ, সেসবও ঝুরঝুর করে ভেঙে পড়ছে ধ্বংসযজ্ঞের আরেক পীঠে। মতপ্রকাশের স্বাধীনতা, নাগরিকের অধিকার রক্ষায় সোচ্চার পশ্চিমা গণমাধ্যম আজ এক সেল্ফ-সেন্সরশিপের বলয় তৈরি করেছে। সিএনএন, বিবিসি হামাসের বর্বরতায় মুখর, ইসরাইলের নৃশংসতা রোধের প্রশ্নে নির্বাক। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুক, ইউটিউব ইসরাইলি বর্বরতার নিন্দাবাদকে মুছে দিচ্ছে ‘বিদ্বেষমূলক বক্তব্য’ হিসাবে। প্রতিদিন গাজায় যে নৃশংসতা ঘটে চলেছে, সেই বাস্তবতা আড়াল করতে তারা ব্যস্ত।
তবে এর বিপরীতে রয়েছে আরেক বাস্তবতা। টিকটক, ইনস্টাগ্রাম, টুইটার ও আরও নানা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভয়ংকর ও নিষ্ঠুর বাস্তবের ছবি মানুষের কাছে পৌঁছে যাচ্ছে তাৎক্ষণিকভাবে গাজা থেকেই। প্রতিবাদে সোচ্চার হচ্ছে দেশে দেশে সাধারণ মানুষ। মার্কিন অভিজাত বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় ছাত্ররা সোচ্চার হচ্ছে ইসরাইলি নিষ্ঠুরতার বিরুদ্ধে। বিশ্বজুড়ে এ মানবিক প্রতিরোধ আশাজাগানিয়াও বটে। আপাতভাবে মনে হতে পারে শক্তিহীন, তবে মানুষের অন্তরে প্রোথিত যে মানবসত্তা, সেটাই তো পরিবর্তনের শক্তি। এ শক্তিরই পরিচয় মিলল যিশুর জন্মস্থান পশ্চিমতীরে ইসরাইল অধিকৃত ফিলিস্তিনি শহর বেথলেহামে ক্রিসমাস উৎসব পালনে। প্রতিবছর দেশ-বিদেশের লাখো মানুষ সমবেত হয় বেথলেহামে, যিশুর জন্মদিনের উৎসবে। শহরবাসীর জন্য এ এক আনন্দময় উৎসব, অর্থনৈতিকভাবেও ফলপ্রদ। এ বছর গাজার দুর্গত ফিলিস্তিনিদের প্রতি সহমর্মিতা প্রকাশ করে বেথলেহামের চার্চ কর্তৃপক্ষ ক্রিসমাস উৎসব বাতিল করেছে। তার বদলে তারা শিশু জেসাসের এক প্রতিরূপ বসিয়েছে নগর চত্বরে, সেখানে ভগ্নস্তূপের মধ্যে শুয়ে আছে বালক যিশু, যেমন প্রতিদিন বিশ্ববাসী দেখছে গাজার ধ্বংসস্তূপে আটক অসহায় ফিলিস্তিনি শিশুকে-যিশুর মতোই অপাপবিদ্ধ পবিত্র, সুন্দর ও আবেদনময়।
মফিদুল হক : লেখক, গবেষক ও প্রকাশক