চিত্রশিল্পী শাহাবুদ্দিনের নির্বাচন ভাবনা
আলমগীর স্বপন
প্রকাশ: ২১ ডিসেম্বর ২০২৩, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
বিশ্বখ্যাত বাঙালি চিত্রশিল্পী শাহাবুদ্দিন আহমেদ-যার তুলির ছোঁয়ায় জীবন্ত হয়েছে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ, স্বাধীনতার আন্দোলন ও বিজয়। তার ছবিতে সংগ্রামী মানুষের দুর্দমনীয় শক্তি ও অপ্রতিরোধ্য গতির অভিব্যক্তি দুনিয়াব্যাপী সুপরিচিত। আধুনিক ঘরানার এ শিল্পীর শিল্পসত্তা ব্যাপকভাবে সমাদৃত ইউরোপে। পেয়েছেন ফ্রান্সের সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মাননা ‘নাইট’ উপাধি। মাস্টার পেইন্টার্স অব কনটেম্পোরারি আর্টসের পঞ্চাশজনের একজন হিসাবে ১৯৯২ সালে বার্সেলোনায় ‘অলিম্পিয়াড অব আটর্স’ পদকেও ভূষিত হয়েছেন তিনি। পেয়েছেন বাংলাদেশের সর্বোচ্চ সম্মাননা স্বাধীনতা পদক। সম্প্রতি ফ্রান্স সফরকালে মুক্তিযোদ্ধা এ শিল্পীর সঙ্গে চিত্রকলা, শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতির পাশাপাশি কথা হয় রাজনীতি নিয়েও। সেই দীর্ঘ আলাপচারিতার একটি অংশ এখানে তুলে ধরার চেষ্টা করছি।
যদিও শিল্পী শাহাবুদ্দিন রাজনীতি প্রসঙ্গে কিছু বলতে আগ্রহী নন, তবুও তার কাছে জানতে চাই বাংলাদেশের আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচন ও গণতন্ত্র প্রসঙ্গে। তিনি বলেন, একজন শিল্পী হিসাবে আমি দীর্ঘদিন প্যারিসে বসবাস করছি। সেই দেখার জায়গা থেকে বলতে পারি, পৃথিবীতে যদি গণতন্ত্র থাকে, একমাত্র ইউরোপেই আছে। অন্য কোথাও নেই। এর পালটা যুক্তি অনেক কিছু হয়তো দেওয়া যাবে। তবে এটা হলো আমার পর্যবেক্ষণ। আগামী বছর আমার ইউরোপে বসবাসের ৫০ বছর পূর্ণ হবে। আমি এই প্রবাসজীবনে কখনো শুনিনি ইউরোপে কোনো প্রধানমন্ত্রী বা রাষ্ট্রপতিকে হত্যা করা হয়েছে। কিন্তু অন্যান্য মহাদেশে হয়েছে। এটাই গণতন্ত্র। এখানে যারা হারে, তারা ফলাফল জানার পরপরই তা মেনে নেয়, যেটা অন্যান্য দেশে সহজে মেনে নেয় না। যুক্তরাষ্ট্রে কী হয়েছে? এখনো ডোনাল্ড ট্রাম্প নির্বাচনের ফলাফল মেনে নেননি। ওরা বলে গণতন্ত্রের কথা! কোনোদিন ইউরোপে এমনটা দেখা যায়নি। এরকম এখানে ঘটেনি। এজন্যই বলছি, গণতন্ত্র এখনো ইউরোপে টিকে আছে।
তিনি বলন, বাংলাদেশে একমাত্র বঙ্গবন্ধুর সময়েই নির্বাচন হয়েছে কোনো সমস্যা ছাড়া। এরপর আজঅবধি শুনিনি যে সমস্যা নেই। নির্বাচনে হারলে কেউ মেনে নেয় না। কারণ বাংলাদেশে বাইরের দেশের হস্তক্ষেপ আছে। এর মূলে আছে ১৯৭৫ সালের মর্মান্তিক ঘটনা। পরিবারসহ জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ড এবং যে ধ্বংসযজ্ঞ হয়েছিল, এর মাধ্যমে বাইরের শক্তি বাংলাদেশের ক্ষমতাকে হাতে নিয়ে নেয়। এর মাধ্যমে পরিবর্তন ঘটে গেছে নির্বাচনি ব্যবস্থায়ও। যার টাকা আছে, তার সম্ভাবনা বেশি। যার ক্ষমতা আছে, সে সামনে চলে আসছে। তবে এটা শুধু যে বাংলাদেশে ঘটছে তা নয়, পৃথিবীর অনেক দেশেই এমন অবস্থা। দেড়-দুমাস আগে আমি বাংলাদেশ ঘুরে এসেছি। আমার উপলব্ধি হয়েছে, প্রতিটি দলেরই যারা নির্বাচন করে, ওদের চিন্তার মূল চাবিকাঠি হলো টাকা। টাকা নেই তো ওই নীতি-আদর্শ দিয়ে কিচ্ছু হবে না! সবাই জানে লোকটা ভালো, কিন্তু মনোনয়ন পায় না দলের। কারণ, জানে হারবে। এর মানে রাজনীতি, রাজনীতিবিদের আদর্শিক ও চারিত্রিক পরিবর্তন ঘটে গেছে। আগের মতো রাজনীতি আর নেই। এটাই সবাই মেনে নিচ্ছে।
বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে শাহাবুদ্দিন আহমেদ বলেন, বঙ্গবন্ধুর দুর্বলতা ছিল বাংলা ও বাঙালির প্রতি। ‘আমার দেখা নয়াচীন’ বই পড়লে বোঝা যায় সেটা। বঙ্গবন্ধু যখন মন্ত্রী, সেই ’৫৪ সালে, তখনই বিদেশে গিয়ে বাংলায় বক্তৃতা দিয়েছেন। এমন কত কী আমরা জানি না! এত বড় নেতা হুট করে বা দুর্ঘটনাবশত তৈরি হয় না। অনেকে নানাভাবে তাকে তুলনা করে। কিন্তু তিনি আসলে অতুলনীয় ব্যক্তিত্ব ছিলেন। তার মতো এমন রাজনীতির মহানায়কের হত্যাকাণ্ডের পরও যে দেশে গণতন্ত্র এখনো আছে, নির্বাচন হচ্ছে, এটাই অবিশ্বাস্য লাগে আমার কাছে। আমাদের বাংলাদেশে যারা স্বাধীনতার জন্য আত্মত্যাগ করলেন, মুক্তিযুদ্ধ করলেন, যারা স্বাধীনতার মূল চাবিকাঠি ছিলেন, তাদেরই মেরে ফেলা হলো। এরপর আর কী আশা করা যায়? আগেই বলেছি, বাংলাদেশে যে রাজনীতি হচ্ছে, এটাই আমার কাছে অবিশ্বাস্য লাগে।
নির্বাচনে ভোটের অধিকার নিয়ে বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর প্রশ্ন আছে। বিগত দুটি নির্বাচনে ভোটাররা ভোট দিতে পারেনি বলে অভিযোগ আছে। এ প্রসঙ্গ তুলতেই শাহাবুদ্দিন বললেন, সারা জীবনই তো শুনে আসছি ভোটের অধিকার নেই। একমাত্র বঙ্গবন্ধুর সময় শুনিনি। ভোট কে না দিতে চায়, মারামারির মধ্যেও ভোট দেয়। কিন্তু প্রশ্নটা হচ্ছে, কত সংখ্যায় মানুষ ভোট দেবে? মনে হচ্ছে, আগের চেয়ে এবার বেশি ভোটার ভোট দিতে যাবে। কেন? এর দুটি কারণ আছে। একটা হলো, আমার মনে হয়, যেহেতু বিরোধী দলের তেমন কোনো নেতা নেই, এ কারণে হুড় হুড় করে সবাই একদিকে যাচ্ছে। ‘ওইটাই খাই যেটা বেস্ট খাবার’-বিষয়টা এমন। তা না হলে তো গণতন্ত্র মূল্যহীন হয়ে যায়, যদি কেউ না আসে। কিন্তু কেউ না এলে কী হবে? এক্ষেত্রে কী কৌশল, তা আমি বুঝি না, এগুলো আমার ব্যাপার নয়।
জানতে চাই, নির্বাচন কতটা সুষ্ঠু হবে বলে আশা করেন? শাহাবুদ্দিন বলেন, আমার মনে হয় এবার আগের মতো বিশৃঙ্খলা হবে না। পৃথিবীতে একেক সময় একেক রাজনৈতিক ফেনোমেনা আসে, এখন ঢেউটা উঠছে গণতন্ত্রের। জো বাইডেন ইসরাইলে গেলেন। সেখানে গণতন্ত্রের কথা বলেছেন। তবে তিনি আবার বলেছেন, হামাসের হামলা নিরাপত্তার জন্য হুমকি, এটা সন্ত্রাসবাদ! এ ধরনের ডেমোক্রেসি কর্তৃত্ব করছে এখন। আমাদের বাংলাদেশেও তাই। ডেমোক্রেসি, ডেমোক্রেসি, ডেমোক্রেসি। তবে এ ফরমুলাটা তো ফেলে দেওয়ার নয়। সবার বলার ক্ষমতা আছে, অধিকার আছে। আমার তো মনে হয় আরও পঞ্চাশ-ষাট বছর পর অন্যকিছুও আসতে পারে। একই জিনিস তো সারা জীবন থাকতে পারে না। আমি একজন মুক্তিযোদ্ধা ও শিল্পী হিসাবে আশা করি, শান্তিপূর্ণ একটা রাজনৈতিক পরিস্থিতি দেশে সৃষ্টি হোক। অনেকটা হয়েছে। যে জাতীয় নির্বাচন হতে যাচ্ছে, এটা সুষ্ঠু হবে এবং উদাহরণ হিসাবে থাকবে। যাতে মানুষ মনে করে, এত বছর পর এই প্রথম একটা নির্বাচন সুষ্ঠু হলো। একই কামনা করি সবার কাছে-বাঙালি, বাংলাদেশের সবার কাছে। এজন্য হাতজোড় করে অনুরোধ করছি।
ভোটারদের মনোভাবে পরিবর্তন সম্পর্কে শাহাবুদ্দিন বলেন, মানুষ এখন আর এত বোকা নয়। এটা গত সেপ্টেম্বরে বাংলাদেশে গিয়ে আমি অনুভব করেছি। ভোট দেওয়ার সময় হয়তো তারা ঠিক জায়গায় দেবে। এটা আমি যতদিন ছিলাম, উপলব্ধি করেছি। তবে তারা কী করবে জানি না। আমার যে উপলব্ধি ও ধারণা, আমি একজন মুক্তিযোদ্ধা ও শিল্পী হিসাবে মনে করি, মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের সমর্থন বাড়ছে। যদিও বাইরের অবস্থা দেখে সেটা বোঝা যায় না। মনে হয় যে অন্য দেশ। কিন্তু ভেতরে ভেতরে পরিবর্তন হয়েছে। ’৭৫-এর পর ভোটারদের সামনে বিকল্প ছিল না। এখন বিকল্প খোঁজার অনেক সুযোগ আছে। যেহেতু অনেক কিছু উন্নত হয়েছে। বলা হয়েছিল পদ্মা সেতু জীবনে হবে না। কিন্তু হয়েছে। এর মানে কী? সাহস, ইচ্ছা, ভালোবাসা থাকলে কি না হয়!
তিনি বলেন, রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতি আমি আহ্বান জানাব-‘বাঙালি-বাংলাদেশ-স্বাধীনতা-মুক্তিযুদ্ধ’ কতগুলো বিষয় আছে; এগুলো আমলে নিয়ে রাজনীতি করতে হবে। ‘জাগো জাগো বাঙালি জাগো’, ‘পিন্ডি না ঢাকা, ঢাকা ঢাকা।’ এই স্রোতের বাইরে গেলে সমস্যা হবে। বাঙালিত্ব, বাংলা আমার মূল চাবিকাঠি। আমাদের স্বতন্ত্র পরিচিতি। আমি বাঙালি, আমি মুসলমান। এগুলো আমার নিজের জিনিস।
বাংলাদেশের রাজনীতিতে বাইরের শক্তির হস্তক্ষেপ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে শাহাবুদ্দিন বলেন, আপনার কী ক্ষমতা আছে সেটা হলো বিষয়। আরেকজন কী করল, কী বলল, এতে কী এসে যায়? আপনার কী দায়িত্ব আছে? আপনিও তো বাঙালি। গণতন্ত্র আমার ভালো লাগল, আমি ভোট দেব। এক্ষেত্রে একটা দায়িত্ব আছে সবার। শুধু একচেটিয়া বলব, এটা হবে না। এজন্য বলছি, মানুষ এখন আর বোকা নয়, যেটা আগে ছিল। একদিক দিয়ে খারাপভাবে বলতে পারি, মানুষ অনেক চালাক হয়েছে, আবার ইতিবাচকভাবে বলা যায়, দূরদর্শী হয়েছে।
আলমগীর স্বপন : সাংবাদিক