Logo
Logo
×

বাতায়ন

ক্ষুদ্রঋণ, সমবায় ও বিমাসেবা

Icon

তারিক সাইদ হারুন

প্রকাশ: ২০ ডিসেম্বর ২০২৩, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

ক্ষুদ্রঋণ, সমবায় ও বিমাসেবা

এ উপমহাদেশে সমবায়ের ইতিহাস প্রায় শতাব্দীপ্রাচীন। দেশ স্বাধীন হওয়ার আগে থেকেই আমাদের দেশেও সমবায়ের কাজ শুরু হয়। আক্তার হামিদ খাঁন ষাটের দশকে কুমিল্লায় বার্ড (বাংলাদেশ পল্লী উন্নয়ন একাডেমি) স্থাপনের মাধ্যমে দরিদ্র ও সুবিধাবঞ্চিত কৃষকদের এক করে সমবায় আন্দোলন শুরু করেন।

এর আগেও এদেশে কিছু সমবায় সমিতি ছিল, যেগুলোর মধ্যে কক্সবাজারের বদরখালী সমিতি অন্যতম। ১৯৭৭ সালে প্রতিষ্ঠিত বাংলাদেশ দুগ্ধ উৎপাদনকারী সমবায় ইউনিয়ন লিমিটেড (মিল্কভিটা) এদেশের অন্যতম বৃহৎ সমবায় প্রতিষ্ঠান। বার্ডের মূল লক্ষ্য ছিল গ্রামে গ্রামে টেকসই সংগঠন সৃষ্টি, ব্যক্তিগত ও সমষ্টিগত পুঁজি গঠন, উন্নত কৃষিপ্রযুক্তি সম্প্রসারণ। দরিদ্র কৃষক যেন সহজে তার কৃষিপণ্য উৎপাদন করতে পারে। কিন্তু দরিদ্র কৃষকের সমিতিতে ধনী ও প্রভাবশালীরাও ঢুকে পড়লে গরিব কৃষক এলবো আউট হয়ে যায়। তাদের দারিদ্র্য বা ভাগ্যের পরিবর্তন অধরাই থেকে যায়।

দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ড. মুহাম্মদ ইউনূস ক্ষুদ্রঋণ কার্যক্রম শুরু করলে দরিদ্র মানুষ খুব দ্রুত তা লুফে নেয়। কেননা অসহায় গ্রামীণ দরিদ্র মানুষের সহজ অর্থায়নের আর কোনো ব্যবস্থা ছিল না। নব্বইয়ের দশকে এদেশের এনজিওগুলো (ক্ষুদ্রঋণ সংস্থা) খুব দ্রুত ড. ইউনূসের ক্ষুদ্রঋণের সম্প্রসারণ ঘটায়। সঞ্চয় ও ঋণ দিয়ে প্রাথমিকভাবে কার্যক্রম চালু হলেও পরবর্তীকালে সদস্যদের জন্য নানাবিধ সহায়ক কর্মসূচিও পরিচালনা করা হয়। কয়েক প্রজন্মের ঋণ ও উন্নয়ন কার্যক্রম পরিচালনা করে বর্তমানে ক্ষুদ্রঋণ কার্যক্রম তার চতুর্থ প্রজন্মের দ্বারপ্রান্তে।

ঋণ, সঞ্চয়, প্রশিক্ষণ, ঝুঁকি নিরসন, স্বাস্থ্য, শিক্ষাসহ নানাবিধ উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে তৃতীয় প্রজন্ম ব্যস্ত ছিল। পরবর্তী প্রজন্মে এসব উন্নয়ন কর্মকাণ্ডকে ডিজিটালাইজড করার প্রক্রিয়া চলেছে। দেশে বর্তমানে প্রায় সাড়ে সাতশ (এমআরএ সনদপ্রাপ্ত) ক্ষুদ্রঋণ প্রতিষ্ঠান কাজ করছে। প্রায় সাড়ে তিন কোটি পরিবার (মোট জনসংখ্যার প্রায় ৭৯ শতাংশ) ক্ষুদ্রঋণের সেবা গ্রহণ করছে। এ খাতের গড় প্রবৃদ্ধি প্রায় ২০ শতাংশ। জিডিপিতে ক্ষুদ্রঋণের অবদান প্রায় ১৪ শতাংশ (খলীলি, এস আর ওসমানী, ২০১৭)। সদস্যদের মধ্য থেকে প্রতিবছর প্রায় ৫ শতাংশ ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা তৈরি হয়। এতকিছুর পরও কেবল ক্ষুদ্রঋণের মাধ্যমেই যে দারিদ্র্য নির্মূল হবে, এমন ভাবার কোনো কারণ নেই। কারণ দারিদ্র্য বহুমাত্রিক। অর্থায়ন কেবল একটি অনুষঙ্গ, বাকিগুলো আরও অনেক বিষয়ের ওপর নির্ভর করে।

শুরু থেকেই এ খাতে গবেষণা অপ্রতুল হলেও সময়ে সময়ে আলোচনা, পর্যালোচনা এবং তারই পথ ধরে খাতটি আধুনিক ও যুগোপযোগী হয়েছে। গত সাড়ে চার দশকের ক্ষুদ্রঋণের সাফল্য তা-ই নির্দেশ করে। তবে ক্ষুদ্রঋণের এ পথপরিক্রমায় পল্লী কর্ম সহায়ক ফাউন্ডেশন (পিকেএসএফ) এবং নিয়ন্ত্রণকারী প্রতিষ্ঠান মাইক্রোক্রেডিট রেগুলেটরি অথরিটির (এমআরএ) ভূমিকা খুবই প্রশংসনীয়। অ্যাডভোকেসি ও গবেষণাকাজে ক্রেডিট অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট ফোরামের (সিডিএফ) কাজও অনবদ্য।

চতুর্থ প্রজন্মে ক্ষুদ্রঋণকে কেবল ডিজিটালাইজড করলেই চলবে না; এর সঙ্গে ঝুঁকি নিরসনের জন্য বিমাসেবা চালু করতে হবে। জাপানে দরিদ্র কৃষকরা একশ বছর ধরে সমবায় আন্দোলনের মাধ্যমে নিজেদের সংগঠিত ও উন্নত করেছে। যদিও কৃষকরা সরকারি অনুদান, ঋণ, বিপণন ও প্রযুক্তিগত সেবাসহ বিভিন্ন সেবা খুব সহজেই পেয়ে থাকে, তবুও তাদের সমবায় সমিতিগুলো খুব আন্তরিকতা ও পেশাদারির সঙ্গে কর্মকাণ্ড পরিচালনা করছে। একজন কৃষক তার কৃষিকাজের জন্য সমবায় সমিতি থেকে সহজ শর্তে যেমন ঋণ নিতে পারে, তেমনই উৎপাদিত পণ্য সমবায়ের মাধ্যমে বিপণনের ব্যবস্থাও করতে পারে। প্রাকৃতিক দুর্যোগ বা অন্য যে কোনো কারণে ফসলহানি হলে সমবায়গুলো বিমা সুবিধাও প্রদান করে।

কৃষককে পুরোপুরি ঝুঁকিমুক্ত রাখাই সমবায়ের অন্যতম প্রধান উদ্দেশ্য। কৃষকের কাজ শুধু চাষাবাদ করা। পাশাপাশি কৃষিপণ্যের উৎপাদন বাড়ানো ও কৃষকদের জীবনমান বাড়ানোর জন্যও তারা নানাবিধ কাজ করে। বর্তমান জাপানে বয়স্ক মানুষের সংখ্যা বেশি। সমবায় থেকে এই বয়স্ক কৃষকদের বাড়ি বাড়ি নার্সিং সুবিধা দেওয়া হয়। ক্যানসার বা জটিল রোগের চিকিৎসার জন্যও অনুদান দেওয়া হয়। বিপণন ও বাজারব্যবস্থার সঙ্গে কৃষক সরাসরি জড়িত বলে মধ্যস্বত্বভোগী বলে কোনো শ্রেণির উদ্ভব হয়নি। কৃষি, কৃষিজাত পণ্য নিয়ে নিরন্তর গবেষণা, আগাম আবহাওয়ার তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহার জাপানি কৃষিকে বিশ্বে শীর্ষস্থানীয় পর্যায়ে নিতে সাহায্য করেছে। মূল ভূখণ্ডের মাত্র ১৫ শতাংশ জাপানি কৃষকরা কৃষিকাজে ব্যবহার করতে পারে। কিন্তু তারপরও হেক্টরপ্রতি কৃষিপণ্য উৎপাদনে জাপান বিশ্বে অন্যতম। তবে ইদানীং যে বিষয়টি জাপানি কৃষকের জন্য আশীর্বাদ হয়ে এসেছে সেটা হলো মিউচুয়াল ফান্ড। এক্ষেত্রে কৃষকরা বছরব্যাপী স্বল্প পরিমাণ টাকা সমবায়ে জমা করে, বিনিময়ে নানারকম বিমা ও আর্থিক সুবিধা পায়।

সময় এসেছে আমাদের ক্ষুদ্রঋণ কার্যক্রমেও এ ধরনের মিউচুয়াল ফান্ড বা বিমার মতো সুবিধা চালু করার। আমাদের দেশের কৃষক সারা বছর শস্য ফলানোর চেয়ে বিপণন ও ঝুঁকি নিরসনের কৌশল নিয়ে বেশি চিন্তিত থাকেন। এর ফলে কৃষকের উৎপাদনশীলতা কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় কখনো পৌঁছে না। ক্ষুদ্রঋণ প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলো যদিও বিমাসেবা প্রদানের জন্য অনুমতিপ্রাপ্ত নয়, তবুও আমাদের রেগুলেটর বিষয়টি ভেবে দেখবে বলে আশা করি।

বাংলাদেশ কৃষিপ্রধান দেশ। কৃষক বাঁচলেই কৃষি বাঁচবে। যেহেতু ৭৯ শতাংশ মানুষ ক্ষুদ্রঋণ প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সম্পৃক্ত, তাই এ কাজে তাদের যুক্ত করাটাই সমীচীন হবে বলে মনে করি।

তারিক সাইদ হারুন : উন্নয়নকর্মী

Jamuna Electronics
wholesaleclub

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম