একাত্তরের রাজহাঁস আর তেইশের বাঘডাশা
ড. এম এ মাননান
প্রকাশ: ১৮ ডিসেম্বর ২০২৩, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
বাংলাদেশের ইতিহাসে ১৯৭১ আর ২০২৩ বিশেষ কারণে গুরুত্বপূর্ণ দুটি বছর। এ দুটি বছর ভিন্নরূপে ভিন্নমাত্রায় দেখা দিয়েছে আমরা একাত্তরের যারা এখনো বেঁচে আছি তাদের কাছে। তখনকার তরুণ নেতা শেখ মুজিব, সাড়ে সাত কোটি বাঙালির প্রিয় মুজিব ভাইয়ের নেতৃত্বে ষাটের পুরো দশক উত্তাল ছিল বাংলার মাটি। বাংলার উত্তর থেকে দক্ষিণে, পূর্ব থেকে পশ্চিমে, মাঠে-প্রান্তরে জনগণের কাছাকাছি ঘুরে ঘুরে ধীরে ধীরে তিনি বাঙালির মনোজগতে ‘বাঙালি জাতিসত্তার’ বিকাশ ঘটিয়েছিলেন। পাকিস্তানি সামরিক শাসকদের দুরাচার, অন্যায়-অত্যাচার, নিপীড়ন-বঞ্চনা, রাষ্ট্রীয় শোষণসহ সব ধরনের অনিয়ম তুলে ধরেছিলেন জনসম্মুখে। সত্তরের নির্বাচনে সবচেয়ে শক্তিশালী এবং বিপুল জনসমর্থিত রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ বিপুল ভোটে জয়লাভ করার পরও বাঙালির হাতে নিয়মতান্ত্রিক পন্থায় ক্ষমতা হস্তান্তর না করে পাকিস্তানি সামরিক জান্তা উলটো বাঙালি নিপীড়নে-নিধনে মেতে ওঠে। এসবের পরিপ্রেক্ষিতে একাত্তরের ৭ মার্চ তৎকালীন রেসকোর্স ময়দানে বঙ্গবন্ধু তার কালজয়ী ভাষণের মাধ্যমে দশ লক্ষাধিক উপস্থিত বাঙালির হৃদয়ে স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষা তীব্র করে তোলেন। আর এরাই ফিরে গিয়ে দেশব্যাপী ছড়িয়ে দেয় ভাষণের আলোকচ্ছটা। ৭ মার্চের সেই আগুনঝরা দিকনির্দেশনামূলক ভাষণের প্রতিটি শব্দ-বাক্য চেতনায় ধারণ করে সব বাঙালি নারী-পুরুষ (কিছু দিগ্ভ্রান্ত লুটেরা ধর্ষকামী মনোবৃত্তির ব্যক্তি ছাড়া) ধর্মগোত্রনির্বিশেষে ঝাঁপিয়ে পড়ে মহান মুক্তিযুদ্ধে-পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী কর্তৃক চাপিয়ে দেওয়া এক অসম যুদ্ধে। বাঙালিদের হাতে না ছিল গোলাবারুদ-অস্ত্র, না ছিল তাদের যুদ্ধের প্রশিক্ষণ। সম্বল ছিল মূলত বাঁশের লাঠি, নৌকার লগি-বৈঠা, শাবল-বঁটি। ওষ্ঠের মাঝে আর বুকের মধ্যখানে ছিল ‘জয় বাংলা’। নারী-পুরুষ সবাই হয়ে উঠল একেকজন মুক্তিযোদ্ধা। তারা যেভাবে পেরেছে সেভাবেই মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছে। আর হায়েনারা ঝাঁপিয়ে পড়ল বাংলাদেশের গ্রামে-গঞ্জে, শহরে-বন্দরে সর্বত্র; জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে বাড়িঘর-শস্যখেতসহ মাটিতে মিশিয়ে দেওয়ার উন্মত্ত খেলায় উঠল মেতে। দীর্ঘ নয় মাস বাংলার মাটিতে ছিল হায়েনাদের বর্বর উল্লাস। তাদের সঙ্গে যুক্ত হলো মুখচোরা-বর্ণচোরা বেইমান রাজাকারগোষ্ঠী। হানাদার পাকিস্তানি বাহিনীর পোড়ামাটি নীতির বাস্তবায়নে এ রাজাকাররা কম যায়নি। এ রাজাকারগোষ্ঠী না থাকলে হয়তো এত ধ্বংসযজ্ঞ, এত সম্ভ্রমহানি, এত অত্যাচার সংঘটিত হতো না।
রাজাকাররা ছিল পাকিস্তানি হানাদারদের সোর্স, তাদের নীলনকশা বাস্তবায়নকারী।
অজস্র প্রাণ, সাগরসম রক্তের বিনিময়ে আমরা পেয়েছি স্বপ্নের স্বাধীনতা। আর জীবনবাজি রাখা মহান বীর মুক্তিযোদ্ধারা এনে দিয়েছেন স্বাধীনতা, একটি নিজস্ব পতাকা; রক্তের আখরে অঙ্কিত করে দিয়েছেন বিশ্বমানচিত্রে একটি নতুন দেশ। বঙ্গবন্ধু বাহাত্তরের ১০ জানুয়ারি পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্ত হয়ে দেশে ফিরেই বিধ্বস্ত দেশের হাল ধরলেন। দেশ একটু একটু করে এগিয়ে হাঁটতে শুরু করল। অনেক সংস্কার, অনেক মেরামত, অনেক নতুন নির্মাণকাজসহ দেশটাকে ফলে-ফসলে-ধনধান্যে ভরে দেওয়ার লক্ষ্যে পুনর্গঠিত করার কাজে নিজকে নিবেদন করলেন। ‘রাজহাঁস ডিম পাড়তে শুরু করল’, আর সে মুহূর্তেই নিঃশেষ করে দেওয়া হলো জাতির আশা-আকাঙ্ক্ষাকে। দেশি-বিদেশি কুচক্রী মহল পরিকল্পিতভাবে জাতির পিতাকে হত্যা করল। তৎকালীন সেনাশাসক ক্ষমতা কুক্ষিগত করলেন। এরপর শুরু হলো ইতিহাস-বিকৃতির মহোৎসব। প্রায় ২০-২২ বছর স্বাধীন বাংলাদেশের যুব সম্প্রদায় শুধু মিথ্যা ইতিহাস শিখেছে; মিথ্যার আবরণে তাদের অন্তর অন্ধকারাচ্ছন্ন হয়েছে; অনেকে এর ফলে পথহারা হয়েছে।
দেশবাসীকে ইতিহাস-বিকৃতি থেকে রক্ষার প্রয়াসে বঙ্গবন্ধুকন্যাই এগিয়ে এলেন সাহসী পদক্ষেপে। ফলে ইতিহাস-বিকৃতি থেমেছে। সঠিক ইতিহাস পাঠ্যপুস্তকে স্থান পেয়েছে। জাতি ইতিহাস-বিকৃতির কলঙ্ক থেকে রক্ষা পেয়েছে। তবে সুফল পাচ্ছে না অন্য অনেক অর্জন থেকে, যা খেয়ে ফেলছে সংঘবদ্ধ বাঘডাশা। প্রশ্ন উঠতে পারে, এসব বাঘডাশা কারা? কোথায় থাকে? কীভাবে কী খায়? প্রশ্ন যেমন আছে, জবাবও তেমনই আছে। এ বাঘডাশাদের কেউ নদীখেকো, কেউ পাহাড়খেকো, কেউ জলাশয়খেকো, কেউবা পাথরখেকো। আবার কেউ জলদস্যু, কেউ বনদস্যু, কেউ ব্যাংকদস্যু, কেউ ঋণদস্যু, কেউবা বুদ্ধিদস্যু। কেউ হন্তারক, কেউ ধর্ষক, কেউ পুকুরচোর, কেউ সাগরচোর, কেউ শুধুই ছ্যাঁচড়। কেউবা আছে লেবাসে-পোশাকে স্বচ্ছ, যাদের ভেতরে বিরাজ করে অস্বচ্ছ কাচের দেওয়াল, ঘুস-দুর্নীতির ঘুনপোকা। এদের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ইদানীং যাদের অপতৎপরতায় জনগণের নাভিশ্বাস, তারা হলো ব্যবসাদস্যু, যারা গড়ে তুলেছে হরেক রকম সিন্ডিকেট, পণ্যের বাজারকে করে তুলেছে অস্থির; রাতারাতি অতিলাভের মোহে কেটে নিচ্ছে সাধারণ মানুষের পকেট। এরাই ভয়ংকর চেহারায় দাবড়ে বেড়াচ্ছে আড়তে, পাইকারি বাজারে, আর ডানা তুলে হানা দিচ্ছে মধ্যবিত্ত-নিম্নবিত্ত-বিত্তহীনদের সংসারে। সম্ভবত একাত্তরে এদের পিতৃপুরুষ ছিল লুটেরার দলে। আর এরা ২০২৩ সালে পঙ্কিল, ভয়ংকর; এরা বাজিকর, এরা চলে ছদ্মছায়ায়; এরা লুটেপুটে দেওয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে দিচ্ছে সরকারের। নির্বাচন সামনে রেখে যারা বাসে, গাড়িতে, ট্রেনে আগুন দিচ্ছে কিংবা রেললাইন কেটে মানুষের জীবন নিয়ে ছিনিমিনি খেলছে, তাদের সঙ্গেও নিশ্চয়ই আছে সব দুর্বৃত্তের যোগসাজশ। এরা রাজহাঁসের পাড়া ডিম খেয়ে সাবাড় করছে, পরিণত হচ্ছে জনশত্রুতে। এদের রুখে দাঁড়ানোর প্রতিজ্ঞা করতে হবে মুক্তিযোদ্ধার সন্তানদেরই, যাদের মা-বাবা রাজহাঁস সৃষ্টিতে অবদান রেখেছেন। নতুবা এসব দুর্বৃত্ত মিলেমিশে পরিকল্পিতভাবে রাজহাঁসের সব ডিম সাবাড় করে শিকেয় তুলবে জাতির অর্জন, বর্তমান সরকারের পনেরো বছরের চেষ্টা-সাধনায় গড়ে তোলা জাতির বৈশ্বিক সুনাম।
২০২৩ সাল যথেষ্ট গুরুত্ব বহন করে আরও একটি কারণে। জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে দুর্বৃত্তরা ২০১৩-২০১৪ সালের মতোই অগ্নিসন্ত্রাস শুরু করেছে; জাতীয় পর্যায়ে বিপর্যয় সৃষ্টির অপপ্রয়াস চালাচ্ছে। মাত্র কয়েকদিন আগে ১২ ডিসেম্বরেও গাজীপুর অঞ্চলে রেললাইন উপড়ে ফেলে একজনকে হত্যা করেছে এবং বহুজনকে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিয়েছে। হয়তো তারা বাঁচলেও পঙ্গু হয়ে দুর্বিষহ জীবন কাটাতে বাধ্য হবে। দিনের পর দিন অবরোধের নামে জনমানুষের দৈনন্দিন জীবন বিপর্যস্ত করে দিচ্ছে। জনজীবনে স্বস্তি জিনিসটিকে উধাও করে দিয়েছে। এরা কি সেই একাত্তরের রাজকারদের দোসর-উত্তরসূরি? হয়তো। না হলে কীভাবে ঠান্ডামাথায় জাতীয় জীবনের অর্জনগুলোকে ধুলায় মিশিয়ে দেওয়ার জন্য দেশের অভ্যন্তরে নাশকতা ঘটায়, পণ্যমূল্য পরিকল্পিতভাবে বৃদ্ধি করে দিনের পর দিন মানুষকে অনাহার-অর্ধাহারে রাখার পাঁয়তারা করতে পারে, আর বিদেশিদের দুয়ারে ধরনা দিয়ে দেশের বদনাম করতে পারে? এরা না শেষ পর্যন্ত ডিম খাওয়া শেষ হওয়ার পর হাঁসটাকেও খেয়ে ফেলে? এদের থামাতে হবেই।
আরও কিছু কাজ নির্মোহচিত্তে করার জন্য প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হতে হবে। বাঘডাশা যেভাবে সুযোগ লুফে নিয়ে ডিমপাড়া হাঁসের ডিমগুলো গলাধঃকরণ করে ঝোপজঙ্গলে লুকিয়ে পড়ে, সেভাবে আমাদের অতিকষ্টের অর্জনগুলোও যেন দুর্বৃত্ত-লুটেরারা লোপাট করে বাঘডাশার মতো লুকিয়ে পড়তে না পারে, সেদিকে সতর্ক দৃষ্টি দিয়ে দৃষ্টান্তমূলক কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে। আমরা যেন ভুলে না যাই, ’৭১-এর উৎপীড়িত-নির্যাতিত মুক্তিপাগল মানুষের বংশধররাই বর্তমান সমাজের কান্ডারি। তারা দুর্বৃত্তায়িত সমাজ সহ্য করবে না। তারাই কৃত্রিম দুর্ভিক্ষ সৃষ্টির মাধ্যমে দেশব্যাপী হাহাকার তৈরির চেষ্টারত খলনায়কদের ঐক্যবদ্ধভাবে রুখে দেবে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় সিক্ত নেতৃত্বকেই যুব সম্প্রদায় সামনে এগিয়ে নিয়ে যাবে এবং উন্নত বাংলাদেশ বিনির্মাণের পথে চলতে চলতে সংশয়-সংকট দুপায়ে ঠেলে দিয়ে সর্বশক্তি নিয়োগ করবে। এদেশের মানুষ পাবে একটি স্মার্ট বাংলাদেশ, যেখানে থাকবে না দুর্বৃত্তমনাদের আনাগোনা, থাকবে না শকুনির ছোবল, থাকবে না কিসিঞ্জারদের প্রেতাত্মার অশুভ ছায়া, মোশতাকদের বিশ্বাসঘাতকতা।
মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম লক্ষ্য অর্থনৈতিক মুক্তি অর্জন নিশ্চিত করার উদ্দেশ্যে আমাদের এখন দরকার সুশাসনের পরিধি বৃদ্ধি, আর্থিক খাতের বিপর্যয় রোধে কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ, আর্থিক খাতসহ অর্থনীতির সঠিক ব্যবস্থাপনা, লাগামহীন পণ্য মূল্যবৃদ্ধির সঙ্গে যুক্ত দুর্বৃত্তদের শেকড় কাটা, শিক্ষাব্যবস্থার সঠিক সংস্কারের মাধ্যমে জীবনমুখী নীতিনৈতিকতাযুক্ত দক্ষ জনশক্তি গড়ে তোলা, সমুদ্র অর্থনীতিকে পরিকল্পিভাবে জাতির উন্নয়নে কাজে লাগানোর ব্যবস্থা গ্রহণ, ডেল্টা প্ল্যানের আলোকে নদী-খাল-বিল-জলাশয়কে দখলদারদের খপ্পর থেকে বাঁচিয়ে টেকসই উন্নয়ন নিশ্চিত করা, গ্রামে-গঞ্জে-শহরে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টিকারীদের দলমতনির্বিশেষে কঠোর হস্তে দমন এবং সর্বোপরি, বাঘডাশার দল নির্মূল করা।
দেশে এখন বহুরূপে চলছে বাঘডাশাদের দুর্বৃত্তপনা। দুর্বৃত্তদের কোনো পরিচয় থাকে না। এরা যখন যে দল ক্ষমতায় আসে, তাদের পদলেহনে লিপ্ত হয় আর জাতীয় সম্পদ লুটপাট শুরু করে। দুর্বৃত্ত দুর্বৃত্তই। তাদের আশকারা-মদদ দেয় যারা, তারাও দুর্বৃত্ত। এ দুই পক্ষের পরিচয় ভিন্ন হলেও এরা লুণ্ঠনের ভাগীদার। তাই আমাদের প্রতিজ্ঞা হোক-এসব বাঘডাশাকে নির্র্মূল করা হবে। একাত্তরের প্রজন্ম অবশ্যই চায় না সবুজ-শ্যামলের গরিমায় বেড়ে ওঠা প্রকৃতির এত সুন্দর দান এদেশের মানুষের সম্পদ চেটেচুটে খেয়ে লুটেরার দল সম্পদের পাহাড় গড়ে তুলুক, আয়বৈষম্য বেড়ে চলুক, বিত্তহীন অতিদরিদ্র ভাসমান লোকের সংখ্যা বেড়ে গিয়ে অর্জিত সুনামের কূল ভাঙুক, যে কোনো মূল্যে অতিধনী হওয়ার প্রবণতাসম্পন্ন লোকের সংখ্যা ফুলেফেঁপে উঠুক, দেশের অর্থনীতির পেট খালি করে অর্থ পাচারের লাগামহীনতার সুতা আরও দীর্ঘ হোক, আর বাঘডাশার কবলে পড়ে রাজহাঁস বিধ্বস্ত হয়ে পড়ুক।
ড. এম এ মাননান : সাবেক উপাচার্য, উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়; অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়