মিঠে কড়া সংলাপ
মানুষের দুর্ভোগ আজও কেন কমল না?
ড. মুহাম্মদ ইসমাইল হোসেন
প্রকাশ: ০৯ ডিসেম্বর ২০২৩, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
আমাদের স্বাধীনতার বয়স বায়ান্ন বছর পূর্ণ হতে চলেছে; আর ক’দিন পরই বিজয় দিবস উদযাপিত হবে। বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও সংগঠন মহাসমারোহে দিবসটি পালন করবে এবং সেসব ক্ষেত্রে বক্তারা স্বাধীনতার আদ্যোপান্ত উল্লেখ করে স্বভাবতই পাকিস্তানি আমলের দুঃশাসনে পিষ্ট বাঙালি জাতির দুঃখ-কষ্ট, বেদনার কথাও তুলে ধরবেন। কারণ, ১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট ইংরেজদের কাছ থেকে স্বাধীনতা লাভ করে পাকিস্তান নামক একটি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হলেও আমরা পূর্ব পাকিস্তানিরা পশ্চিম পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠী কর্তৃক পুনরায় অন্যায়, অবিচার, নির্যাতনের শিকার হই। আর এসব নিয়ে কিছু বলতে গেলে বা করতে গেলে পাকিস্তানি পুলিশ বাহিনী আমাদের ওপর অমানুষিক অত্যাচার-নির্যাতন করত, মিথ্যা মামলা দিয়ে জেলে আটকে রাখত। সে সময়ের বাঙালি জাতির অবিসংবাদিত নেতা, পরবর্তীকালে যিনি আমাদের স্বাধীনতা এনে দিয়েছিলেন, সেই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নামেও মিথ্যা মামলা দিয়ে বারবার তাকে কারাগারে পাঠানো হয়েছিল এবং সেসব অপকর্মের ধারাবাহিকতায় ‘আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা’ নামে আরও বড় একটি মিথ্যা রাষ্ট্রদ্রোহিতার মামলায় তাকে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত করার জন্য হীন ষড়যন্ত্র করা হয়েছিল। তাছাড়া সে সময়ের মজলুম জননেতা এবং আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীকেও পাকিস্তানিরা বারবার কারাবন্দি করে রাখত। কারণ, মওলানা ভাসানীকেও পাকিস্তানিরা ভীষণ ভয় পেত। কিন্তু বীর বাঙালি পাকিস্তানিদের সেসব ষড়যন্ত্র-চক্রান্তের বিরুদ্ধে দুর্বার গণআন্দোলন গড়ে তুলে সে সময়ে তাদের মুক্ত করে আনে।
অতঃপর ১৯৬৮-৬৯ সালে পাকিস্তানি শাসকদের বিরুদ্ধে অপ্রতিরোধ্য গণআন্দোলন গড়ে ওঠে এবং ১৯৭০ সালের নির্বাচনে বাঙালি জাতি পাকিস্তান রাষ্ট্রটি শাসনের ম্যান্ডেট লাভ করে। কিন্তু পাকিস্তানের তদানীন্তন প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান পিপিপি প্রধান জুলফিকার আলী ভুট্টোর সঙ্গে হাত মিলিয়ে ক্ষমতা হস্তান্তরে ষড়যন্ত্র শুরু করে দেয়। এ অবস্থায় নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাওয়া দল আওয়ামী লীগ প্রধান শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ এক ঐতিহাসিক বক্তৃতায় অত্যন্ত বিচক্ষণতার সঙ্গে স্বাধীনতার ঘোষণা দেন; তিনি তার বক্তব্যের শেষ অংশে বলেন, ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’ আর আমার মতে, এ ঘোষণাটিকেই স্বাধীনতার ঘোষণা বলা উচিত। কারণ, সেদিন থেকেই বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে বীর বাঙালি যার যা আছে তা-ই নিয়ে পাক বাহিনীর মোকাবিলা করতে থাকে এবং সেই যুদ্ধের শেষ পর্যায়ে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর পাক বাহিনীর আত্মসমর্পণের মাধ্যমে আমরা স্বাধীনতা অর্জন করি।
কিন্তু অত্যন্ত দুঃখ ও পরিতাপের বিষয় হলো, স্বাধীনতার এত বছর পরও আমরা প্রকৃতপক্ষে স্বাধীন কিনা সে প্রশ্নটি এখনো বারবার আমাদের সামনে এসে যাচ্ছে। কারণ, আমাদের রাজনৈতিক দলগুলোর আচার-আচরণ, বডি ল্যাংগুয়েজসহ বিভিন্ন কর্মকাণ্ডে প্রমাণিত হয়, আমরা আজও স্বাধীন হতে পারিনি। অন্যথায় স্বাধীনতার বায়ান্ন বছর পূর্ণ হলেও এখনো আমরা আমাদের রাস্তাঘাটে স্বাধীনভাবে চলাফেরা করতে পারি না কেন? রাস্তাঘাটে চলতে, গাড়িতে চড়তে এখনো আমাদের মৃত্যুভয় তাড়া করে কেন? এজন্য দায়ী কারা? দেশের একজন সাধারণ নাগরিক হিসাবে যদি বলা হয়, রাজনৈতিক দলগুলোর ক্ষমতার লোভই এজন্য দায়ী, তাহলে কি ভুল কিছু বলা হবে? আর একজন নাগরিকের এমন প্রশ্ন যদি ভুল না হয়, তাহলে রাজনৈতিক দলগুলো এবং তাদের নেতারা এক্ষেত্রে নিজেদের দায়ই বা কীভাবে এড়াবেন, সেটাও তো দেশের সাধারণ মানুষের কাছে বিরাট একটি প্রশ্ন। নাকি এসব দলীয় নেতা দিনরাত নিজেদের ঢাক নিজেরা পেটাবেন আর দেশের মানুষকে বোকা মনে করবেন? কিন্তু দেশের মানুষ যে বোকা নন, সে কথাটিও তো এসব দল ও নেতার জানা! কারণ, দেশের মানুষ যে বোকা নন, সে বিষয়টি তো সময়ে সময়ে তারা প্রমাণও করে দিয়েছেন। অতীতে একেকটি রাজনৈতিক দল ক্ষমতায় এসে তাদের নেতাকর্মীদের লুটপাটের সুযোগ করে দিয়েছে, তারা দেশের সম্পদ বিদেশে পাচার করে দিয়েছেন; ফলস্বরূপ পরবর্তী নির্বাচনে তারা বৈতরণী পার হতে পারেননি। আর এ বিষয়টি তো দেশের সাধারণ মানুষ, দেশের ভোটাররাই করে দেখিয়েছেন; কিন্তু তারপরও রাজনৈতিক দল এবং তাদের নেতাদের শুভবুদ্ধির উদয় হয়েছে বলে মনে হয় না। এত কিছুর পরও ক্ষমতার দ্বন্দ্বে, ক্ষমতার লড়াইয়ে দেশের মানুষকে তারা জিম্মি করে রেখে নিজ নিজ স্বার্থ উদ্ধারে উঠেপড়ে লেগেছেন! নিরীহ সাধারণ মানুষ স্বভাবতই তাদের কাজকর্ম করে খেতে পারছেন না। প্রায়ই মৃত্যুঝুঁকি মাথায় নিয়ে তাদের রাস্তায় নামতে হচ্ছে, মরতে হচ্ছে। আর রাজনৈতিক দলের নেতারা সমানতালে নিজেদের ঢোল নিজেরা পিটিয়ে একদল আরেক দলের ওপর দোষ চাপাচ্ছেন। তাদের এ ব্লেমগেমের খেসারত যে সাধারণ মানুষকে দিতে হচ্ছে, সে কথাটি তারা বুঝেও না বোঝার ভান করে চলেছেন; কারণ, তাদের ক্ষমতা চাই, ক্ষমতা ছাড়া তারা কিছুই বোঝেন না।
কিন্তু প্রশ্ন হলো, একজন রাজনৈতিক নেতাও তো একজন মানুষ। আর মানুষ হলেন আশরাফুল মাখলুকাত। মহান আল্লাহ তার সৃষ্টির সেরা জীব হিসাবে মানুষ সৃষ্টি করেছেন। আর আমরা সেই মানুষরাই নিজেদের মধ্যে মারামারি, হানাহানিতে লিপ্ত হয়েছি এবং তা কেবলই রাষ্ট্রক্ষমতা দখলের জন্য! যেহেতু রাষ্ট্রক্ষমতা আমাদের ক্ষমতার পাশাপাশি অর্থ, বিত্ত-বৈভবের মালিকও করে দেয়; সে কারণেই এ দেশে আমরা রাষ্ট্রক্ষমতাকে ধ্যান-জ্ঞান মনে করি। আর ক্ষমতার লিপ্সায় কোনো কোনো বিশেষ রাজনৈতিক দলের নমিনেশন প্রাপ্তিকে মনে করি সোনার হরিণ। কারণ, নির্বাচিত হয়ে আসতে পারলেই যেন আকাশের চাঁদটি পর্যন্ত ধরাছোঁয়ার মধ্যে চলে আসে। নির্বাচিত হওয়া মানেই দামিদামি বিলাসবহুল গাড়ি ট্যাক্স ফ্রিতে কম দামে কিনতে পারা, সরকারি উন্নয়ন কাজের টেন্ডারে ভাগ বসানোসহ আরও কত কী! আর সে কারণেই পত্রিকান্তরে প্রকাশিত সংবাদে আমরা দেখতে পাচ্ছি, প্রথম দফায় নির্বাচনের সময় একেকজনের যে সম্পদ ছিল, দ্বিতীয় দফায় বা তৃতীয় দফায় তা ১০, ২০, এমনকি কারও কারও ক্ষেত্রে ৭২ গুণ পর্যন্ত বৃদ্ধি পেয়েছে। সুতরাং, একবার নির্বাচিত হতে পারলেই তো ‘কেল্লা ফতে’!
কিন্তু তাতেও সাধারণ মানুষের হয়তো আপত্তি ছিল না, যদি বিভিন্ন সময়ে তারা রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড তথা সিংহাসনের লড়াইয়ে নিজেদের দানবীয় চেহারা এবং দানবীয় শক্তি প্রদর্শন না করতেন। তা না হলে পাকিস্তান আমলে স্বৈরাচারী সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন-সংগ্রামের সময়, সর্বোপরি স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় বাঙালি জাতিকে যে মূল্য দিতে হয়েছে, আজও কেন একইভাবে দেশের রাজনৈতিক দলগুলোর কারণে আমাদের দুর্ভোগ পোহাতে হবে? আর এসব দুর্ভোগের শেষইবা কোথায়?
ড. মুহাম্মদ ইসমাইল হোসেন : কবি, প্রাবন্ধিক, কলামিস্ট