Logo
Logo
×

বাতায়ন

স্বদেশ ভাবনা

বিএনপিবিহীন নির্বাচন কতটা অংশগ্রহণমূলক হবে

Icon

আবদুল লতিফ মন্ডল

প্রকাশ: ০৬ ডিসেম্বর ২০২৩, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

বিএনপিবিহীন নির্বাচন কতটা অংশগ্রহণমূলক হবে

নির্বাচন কমিশন সচিবালয়ের হিসাব অনুযায়ী, নিবন্ধিত ৪৪টি রাজনৈতিক দলের মধ্যে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও সংসদে বিরোধী দল জাতীয় পার্টিসহ ২৯টি দল দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে প্রার্থী দিয়েছে। এদের মধ্যে ১৯টি দল ৫০টির কম আসনে তাদের দলীয় প্রার্থী দিয়েছে। অপরদিকে নির্বাচনকালীন নির্দলীয় সরকারব্যবস্থার দাবিতে মাঠের বিরোধী দল বিএনপিসহ ১৫টি নিবন্ধিত রাজনৈতিক দল এ নির্বাচন বয়কট করেছে। আর বিএনপির হিসাবে, গণতন্ত্র ও ভোটাধিকার প্রতিষ্ঠার চলমান আন্দোলনে নির্বাচন কমিশনে (ইসি) নিবন্ধিত ও অনিবন্ধিত মোট ৬০টি দল দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন বর্জন করেছে (যুগান্তর, ২ ডিসেম্বর)।

বিএনপির অংশগ্রহণ ছাড়া দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক হবে কিনা তা নিয়ে মতভিন্নতা রয়েছে। বিএনপি ও সমমনা রাজনৈতিক দলগুলো নির্বাচন অনুষ্ঠানের চলমান প্রক্রিয়াকে ‘একতরফা জাতীয় নির্বাচন আয়োজনের অপচেষ্টা’ হিসাবে আখ্যায়িত করেছে। লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টির (এলডিপি) প্রেসিডেন্ট কর্নেল অলি আহমদ বীরবিক্রম (অব.) বলেছেন, বিএনপি ও সমমনা দলগুলোকে বাদ দিয়ে নির্বাচন গ্রহণযোগ্য হবে না। আমার বাংলাদেশ (এবি) পার্টির নেতারা বলেছেন, আওয়ামী লীগ ও বিএনপি অংশ না নিলে সেই নির্বাচন অতীতেও অংশগ্রহণমূলক ও গ্রহণযোগ্য হয়নি, এখনো হবে না। বাংলাদেশ ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির (ন্যাপ) মহাসচিব এম গোলাম মোস্তফা ভূঁইয়া বলেছেন, সব দলের অংশগ্রহণ ছাড়া যেভাবে একতরফা নির্বাচনের দিকে এগোচ্ছে দেশ, তাতে বিরাজমান রাজনৈতিক সংকট আরও তীব্র হবে।

নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক হওয়ার লক্ষণ দেখছে না ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)। ৩০ নভেম্বর টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান এক অনুষ্ঠানে বলেছেন, ‘আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফশিল ঘোষণার আগে ও পরের পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করা হয়েছে। পর্যবেক্ষণে আমাদের ধারণা হয়েছে, অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের পরিবেশ বলতে যা বোঝায়, তা আমরা এবারও দেখতে পাচ্ছি না।’ তিনি আরও বলেছেন, ‘হয়তো এ নির্বাচন সম্পন্ন করা সম্ভব হবে। এর মাধ্যমে ক্ষমতায় কারা অধিষ্ঠিত থাকবেন, সেটিও নির্ধারণ করার সুযোগ হবে; কিন্তু সত্যিকার অর্থে জনগণের ভাটের অধিকারের যে নির্বাচন, সেটি নিশ্চিত করা যাবে না। এ নির্বাচনের ওপর জনগণের আস্থা বা ভোটের ওপর জনগণের আস্থা নিশ্চিত করা অসম্ভব হবে।’

সাবেক নির্বাচন কমিশনার কবিতা খানম বলেছেন, ভোট অংশগ্রহণমূলক হতে হবে। তবে প্রধান বিরোধী দল না এলে নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক হবে না। আরেক সাবেক নির্বাচন কমিশনার এম সাখাওয়াত হোসেন বলেছেন, বড় দল ছাড়া নির্বাচন হলে বিশ্বের কাছে তা গ্রহণযোগ্য হবে না। নির্বাচনি তফশিল ঘোষণার আগে খোদ প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কাজী হাবিবুল আউয়াল একাধিকবার এরূপ মত প্রকাশ করেছেন। ১২ অক্টোবর বিবিসিকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছেন, ‘দুটো দল, পাঁচটা দল, দশটা দল, ছোটখাটো দল, বাংলাদেশের বিভিন্ন দল নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে পারে। তবে এটা অনস্বীকার্য যে, মূল বিরোধী দল যে বিএনপি, তাদের সমকক্ষ ওরা নয়। এটা আমরা অস্বীকার করি না বা কেউ অস্বীকার করবে না। ওই দলটা যদি অংশগ্রহণ না করে, তাহলে একটা অনিশ্চয়তা বা একটা শঙ্কা, একটা অসম্পূর্ণতা থেকে যেতে পারে, এতে কোনো সন্দেহ নেই।’ এর আগে ২০২২ সালের ডিসেম্বরে বরিশাল বিভাগের আঞ্চলিক ও জেলা নির্বাচনি কর্মকর্তাদের সঙ্গে মতবিনিময়ের পর সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে সিইসি বলেছেন, ‘বিএনপি যদি নির্বাচনে অংশগ্রহণ না করে তবে একটি অসম্পূর্ণতা থেকে যাবে।’ এরকম উদাহরণ আরও দেওয়া যেতে পারে।

জাতিসংঘ ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) চায় বাংলাদেশে আগামী সংসদ নির্বাচন হোক শান্তিপূর্ণ ও সবার অংশগ্রহণমূলক। জাতিসংঘ মহাসচিবের মুখপাত্র স্টিফেন ডুজাররিক সম্প্রতি বলেছেন, বাংলাদেশে অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন হতে হবে সবার অংশগ্রহণে। ২৯ নভেম্বর দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে ইসির সঙ্গে বৈঠক শেষে ইইউ রাষ্ট্রদূত চার্লস হোয়াইটলি সাংবাদিকদের কাছে বলেছেন, ইইউ গণতান্ত্রিক, গ্রহণযোগ্য, শান্তিপূর্ণ ও অংশগ্রহণমূলক সংসদ নির্বাচন দেখতে চায়। যুক্তরাজ্যের হাইকমিশনার সারাহ কুক বলেছেন, যুক্তরাজ্য বাংলাদেশে একটি অবাধ, সুষ্ঠু, অংশগ্রহণমূলক ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচনকে উৎসাহিত করে, যাতে বাংলাদেশের জনগণ তাদের গণতান্ত্রিক অধিকার চর্চা করতে পারে।

এদিকে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারকরা বলছেন, বিএনপি না এলেও আগামী সংসদ নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক হবে। দলটির সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহণ ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেছেন, কেউ না এলেও যথাসময়ে নির্বাচন হবে। কৃষিমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য আবদুর রাজ্জাক বলেছেন, কোনো দল নির্বাচনে না এলে নির্বাচন হবে না, এ রকম কোনো বিধান সংবিধানে নেই। বিএনপি না এলেও আরও অনেক দল নির্বাচনে আসবে। কাজেই যথাসময়েই নির্বাচন হবে। কে এলো, না এলো, সেটি বড় কথা নয়। সুন্দর ও শান্তিপূর্ণ পরিবেশে নির্বাচন হবে।

বিএনপিবিহীন সংসদ নির্বাচন কেন অংশগ্রহণমূলক হবে না, তা নিয়ে আলোচনা করা যাক। এক. এ প্রশ্নের উত্তর সিইসির বক্তব্যেই রয়েছে। তিনি বলেছেন, পাঁচ-দশটা ছোটখাটো দল নির্বাচনে অংশগ্রহণ করলেও সেগুলো মূল বিরোধী দল বিএনপির সমকক্ষ নয়। দুই. জোটভুক্ত হয়ে নির্বাচন করার বিষয়ে ইসিতে আবেদন করেছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগসহ ১০টি রাজনৈতিক দল। এর মধ্যে আওয়ামী লীগ ছাড়া আরও ছয়টি দল ১৪ দলীয় জোটের শরিক হিসাবে আওয়ামী লীগের নির্বাচনি প্রতীক ‘নৌকা’ নিয়ে নির্বাচন করবে বলে ইসিকে জানিয়েছে। আমাদের সংবিধানের ১৫২(১) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, রাজনৈতিক দল বলতে বোঝায় এমন একটি অধিসংঘ বা ব্যক্তিসমষ্টি, যা সংসদের ভেতরে বা বাইরে স্বাতন্ত্র্যসূচক কোনো কাজ করে এবং কোনো রাজনৈতিক মত প্রচারের বা কোনো রাজনৈতিক তৎপরতা পরিচালনার উদ্দেশ্যে অন্যান্য অধিসংঘ থেকে পৃথক কোনো অধিসংঘ হিসাবে প্রকাশ করে। নিজের প্রতীক বাদ দিয়ে একটি বড় দলের প্রতীক নিয়ে নির্বাচনে অংশগ্রহণকারী দলগুলোর বাস্তবে স্বাতন্ত্র্যসূচক কোনো কর্মসূচি, কোনো রাজনৈতিক মত বা রাজনৈতিক তৎপরতা নেই। এগুলো ‘ওয়ান ম্যান ওয়ান পার্টি’ হিসাবে পরিচিত। এরা শুধু নির্বাচনে অংশগ্রহণকারী বা নির্বাচন বর্জনকারী দলের সংখ্যা গণনায় ব্যবহৃত হয়। তিন. গত পাঁচ দশকে অনুষ্ঠিত জাতীয় সংসদ নির্বাচনগুলোর মধ্যে হাতেগোনা কয়েকটি নির্বাচন সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক হয়েছে। সেসব নির্বাচনের তথ্যাদি পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, এসব নির্বাচনে মোট যে ভোট পড়েছে তার ৬১ থেকে ৮১ শতাংশের বেশি ভোট পায় যৌথভাবে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি। প্রাপ্ত তথ্য মোতাবেক, ১৯৯১ সালের ফেব্রুয়ারিতে অনুষ্ঠিত পঞ্চম সংসদ নির্বাচনে মোট ৭৫টি দল/জোট এবং ৪২৪ জন স্বতন্ত্র প্রার্থী অংশগ্রহণ করেন। এ নির্বাচনে মোট যে ভোট পড়ে, তার ৩০.৮১ ও ৩০.০৮ শতাংশ পায় যথাক্রমে বিএনপি ও আওয়ামী লীগ। অর্থাৎ মোট ভোটের ৬১ শতাংশ যৌথভাবে পায় এ দুটি দল। অবশিষ্ট ৩৯ শতাংশ ভোট পায় ৭৩টি দল ও ৪২৪ জন স্বতন্ত্র প্রার্থী। জাতীয় পার্টি ১১.৯২ শতাংশ ভোট পেয়ে তৃতীয় স্থানে থাকে। ১৯৯৬ সালের জুনে অনুষ্ঠিত সপ্তম সংসদ নির্বাচনে মোট ৮১টি দল/জোট এবং ২৮১ জন স্বতন্ত্র প্রার্থী অংশগ্রহণ করেন। এ নির্বাচনে মোট যে ভোট পড়ে, তার ৩৭.৪৪ ও ৩৩.৬১ শতাংশ পায় যথাক্রমে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি। অর্থাৎ মোট ভোটের ৭১ শতাংশ যৌথভাবে পায় এ দুটি দল। বাকি ২৯ শতাংশ ভোট পায় ৭৯টি দল ও ২৮১ জন স্বতন্ত্র প্রার্থী। অবশ্য জাতীয় পার্টি ১৬.৪ শতাংশ ভোট পেয়ে তৃতীয় স্থানে থাকে। ২০০১ সালের অক্টোবরে অনুষ্ঠিত অষ্টম সংসদ নির্বাচনে মোট ৫৪টি/জোট এবং ৪৬৪ জন স্বতন্ত্র প্রার্থী অংশগ্রহণ করেন। এ নির্বাচনে মোট যে ভোট পড়ে, তার ৪০.৯৭ ও ৪০.১৩ শতাংশ পায় যথাক্রমে বিএনপি ও আওয়ামী লীগ। অর্থাৎ মোট ভোটের ৮১ শতাংশের বেশি যৌথভাবে পায় এ দুটি দল। বাকি ১৯ শতাংশ ভোট পায় ৫২টি দল ও ৪৮৪ জন স্বতন্ত্র প্রার্থী। দল হিসাবে জামায়াতে ইসলামী ৪.২৮ শতাংশ ভোট পেয়ে তৃতীয় স্থানে চলে আসে। চার. অতীতে আওয়ামী লীগ বা বিএনপির বর্জন করা কোনো জাতীয় সংসদ নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক হয়নি। বিএনপির শাসনামলে ১৯৯৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে অনুষ্ঠিত ষষ্ঠ সংসদ নির্বাচনে প্রধান বিরোধী দল আওয়ামী লীগসহ বেশ কিছুসংখ্যক দল অংশগ্রহণ না করায় ওই নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক হয়নি। অনুরূপভাবে আওয়ামী লীগের শাসনামলে ২০১৪ সালের জানুয়ারিতে অনুষ্ঠিত দশম সংসদ নির্বাচনে প্রধান বিরোধী দল বিএনপির নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোট এবং সমমনা ৮টি দল অংশ না নেওয়ায় ওই নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক হয়নি।

উপরের বর্ণনার মাধ্যমে যা বলতে চাওয়া হয়েছে তা হলো, দেশে বর্তমানে ৪৪টি নিবন্ধিত রাজনৈতিক দল থাকলেও মূলত দুটি দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপিকে ঘিরে সব রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড আবর্তিত হয়। অন্য দলগুলো হয় আওয়ামী লীগ অথবা বিএনপির ওপর নির্ভরশীল। আওয়ামী লীগ ও বিএনপি অংশ না নিলে সেই নির্বাচন অতীতেও অংশগ্রহণমূলক ও গ্রহণযোগ্য হয়নি, এখনো হবে না। এখনো সময় আছে মাঠের বিরোধী দল বিএনপিসহ সব নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলের অংশগ্রহণে দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানে সরকারি দলের উদ্যোগ গ্রহণ করার। যেহেতু এমন উদ্যোগ গ্রহণ ও বাস্তবায়নে সময়ের প্রয়োজন, সেহেতু সংবিধানের ১২৩ অনুচ্ছেদের ৩ দফার খ উপদফার নির্দেশনা অনুযায়ী অবিলম্বে ব্যবস্থা নেওয়া যেতে পারে। সেক্ষেত্রে আগামী বছরের মার্চের মাঝামাঝি সময় পর্যন্ত দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের সময় পাওয়া যাবে। সরকারি ও বিরোধী দলগুলো খোলা মন নিয়ে আলোচনায় বসলে এ সময়ের মধ্যে চলমান রাজনৈতিক সমস্যা সমাধানে একটি উপায় বেরিয়ে আসবে বলে দেশবাসীর বিশ্বাস।

আবদুল লতিফ মন্ডল : সাবেক সচিব, কলাম লেখক

latifm43@gmail.com

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : সাইফুল আলম

প্রকাশক : সালমা ইসলাম