সাঁওতালরা আর কত নির্যাতিত হবে?
চপল বাশার
প্রকাশ: ২৫ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
উত্তরবঙ্গের বরেন্দ্র অঞ্চলে সাঁওতাল কৃষকদের দুর্ভোগ এখনো কমেনি, বরং বেড়েছে। তারা এখনো সেচের জন্য পানি পান না, ফসল ফলাতে পারেন না। পরিবার নিয়ে থাকেন অনাহারে। গত বছরের মার্চে রাজশাহীর গোদাগাড়ী উপজেলার দুই সাঁওতাল কৃষক সেচের পানি না পেয়ে নিজেদের জমিতে দাঁড়িয়ে বিষপানে আত্মহত্যা করেছিলেন। সেই ঘটনা দেশজুড়ে আলোড়ন তুলেছিল, বিভিন্ন মহল তীব্র প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছিল।
আশা করা হয়েছিল, দুই কৃষকের আত্মহত্যার পর সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের টনক নড়বে, বরেন্দ্র অঞ্চলের সেচব্যবস্থায় দুর্নীতি বন্ধ হবে। দরিদ্র সাঁওতাল কৃষক ফসল ফলাতে সেচের পানি পাবেন। কিন্তু কিছুই হয়নি। সেচের পাম্প অপারেটররা তাদের দুর্নীতি ও সাঁওতালদের ওপর নির্যাতন চালিয়ে যাচ্ছেন আগের মতোই। বরেন্দ্র বহুমুখী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (বিএমডিএ) সাঁওতাল কৃষকের জন্য কিছুই করেনি, তারা দুর্নীতিবাজ পাম্প অপারেটরদের হাতে সেচব্যবস্থা ছেড়ে দিয়েছে। সেচের পানি পেতে আর কত সাঁওতাল কৃষককে আত্মাহুতি দিতে হবে?
সংবাদপত্রে প্রকাশিত খবরে জানা যায়, ৯ সেপ্টেম্বর বিএমডিএ রাজশাহী নগরের সদর দপ্তরে বেসরকারি সংস্থা সিসিবিডি আয়োজিত মতবিনিময় সভা অনুষ্ঠিত হয়। সেই সভায় উপস্থিত কৃষকরা বরেন্দ্র অঞ্চলে সেচব্যবস্থার সঙ্গে যুক্ত পাম্প অপারেটরদের বিরুদ্ধে বহু অভিযোগ উত্থাপন করেন। অভিযোগের মধ্যে রয়েছে, পানি চাইতে গেলে অপারেটররা সাঁওতাল কৃষককে অনর্থক হয়রানি করে। চাওয়ামাত্র পানি দেওয়া সম্ভব; কিন্তু অপারেটররা বিলম্ব করে এবং কৃষকদের ৪/৫ দিন ঘুরিয়ে তারপর পানি দেন। ততক্ষণে পানির অভাবে ধানের চারা শুকিয়ে যায়।
পানি নিতে আগত কৃষককে সিরিয়াল নম্বর দেওয়া হয়। সাঁওতাল কৃষককে পানি নেওয়ার জন্য সময় দেওয়া হয় গভীর রাতে, যেটা তাদের জন্য খুবই অসুবিধার ব্যাপার। অথচ অন্য কৃষককে পানি নেওয়ার সিরিয়াল নম্বর দেওয়া হয় তাদের সুবিধামতো সময়ে, দিনের বেলা। পানি দেওয়ার ক্ষেত্রে সাঁওতাল কৃষককে সব সময় পেছনে রাখা হয়, অগ্রাধিকার পান অন্যরা। সেচের পানির জন্য অপারেটররা দাম নেন। অন্যদের কাছ থেকে ১৫০ টাকা করে নিলেও সাঁওতালদের কাছ থেকে আদায় করা হয় ২০০ টাকা। সাঁওতাল কৃষকের প্রতি এমন বৈষম্যমূলক আচরণ চলে আসছে দীর্ঘকাল ধরে।
সেচ অপারেটরদের দুর্নীতি
অপারেটররা যাতে সুশৃঙ্খলভাবে সেচের পানি সরবরাহ করে, অনিয়ম যেন না করে, এ উদ্দেশ্যে প্রতিটি গভীর নলকূপের জন্য কমিটি থাকার কথা। কিন্তু সব গভীর নলকূপের জন্য কমিটি নেই, পানি সরবরাহের ক্ষেত্রে কোনো তালিকা বা হিসাব-খাতাপত্র রাখা হয় না। কমিটি থাকলেও সেখানে সাঁওতাল কৃষকদের প্রতিনিধিত্ব নেই বলে অভিযোগ রয়েছে। এসব কারণে অপারেটররা অবাধে অনিয়ম-দুর্নীতি করার সুযোগ পাচ্ছে। তদুপরি রয়েছে ক্ষমতাসীন দলের প্রভাব-প্রতিপত্তি। তাদের খবরদারি পানি সরবরাহে অনিয়ম না কমিয়ে আরও বাড়াচ্ছে। দুর্নীতিবাজ অপারেটররা স্বেচ্ছাচারী-বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। তাদের স্বেচ্ছাচারী-বৈষম্যমূলক আচরণে হতদরিদ্র সাঁওতাল কৃষকরা অসহায় অবস্থায় আছে। বিএমডিএ তাদের সাহায্যের জন্য এগিয়ে আসছে না।
বিএমডিএ কী করছে?
বরেন্দ্র বহুমুখী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (বিএমডিএ) গঠিত হয়েছিল মূলত ওই অঞ্চলের কৃষির উন্নয়ন তথা কৃষকদের কল্যাণের লক্ষ্যে। কিন্তু সংস্থাটির কিছু অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারী সেই মহৎ উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য নস্যাৎ করেছে। প্রভাবশালী ও ক্ষমতাসীন মহলও এক্ষেত্রে অবদান রাখছে বলে স্থানীয় জনগণের অভিযোগ রয়েছে। ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ সব ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠী ও ধর্মীয় সংখ্যালঘুর সুরক্ষা প্রদান ও সমান অধিকার নিশ্চিত করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। কিন্তু বাস্তবে দেখা যাচ্ছে বরেন্দ্র অঞ্চলের সাঁওতাল কৃষকরা তাদের ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত। এ পরিস্থিতি দুই সাঁওতাল কৃষককে গত বছর আত্মহননের পথে ঠেলে দিয়েছিল। এমন মর্মান্তিক ঘটনা যাতে আর না ঘটে, সেজন্য সময় থাকতে সরকারের উচ্চতর কর্তৃপক্ষকে সতর্ক হতে হবে।
বরেন্দ্র অঞ্চলের কৃষি ও কৃষক জাতীয় অর্থনীতিতে উল্লেখযোগ্য অবদান রাখেন। কিন্তু ওই অঞ্চলে সেচের জন্য পানির সমস্যা প্রকট। এ কারণে, বিশেষ করে শুষ্ক মৌসুমে, সেচের পানির জন্য কৃষককে গভীর নলকূপের ওপর নির্ভর করতে হয়। এসব নলকূপের ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব বিএমডিএর হাতে। নলকূপের অপারেটররা নিয়ম মেনে সঠিকভাবে কাজ করছেন কি না, তা সঠিকভাবে তদারকি করতে হবে বিএমডিএকে। সঠিক তদারকির মাধ্যমে অপারেটরদের অনিয়ম-দুর্নীতি বন্ধ করা গেলে বরেন্দ্র অঞ্চলের কৃষক প্রাপ্য পানি পাবেন, তাদের কৃষিকাজ ফলপ্রসূ হবে, সাঁওতালসহ সব দরিদ্র কৃষকের জীবনযাত্রা সহজ হবে। সেই সঙ্গে বাংলাদেশের কৃষিও হবে সমৃদ্ধ।
গোদাগাড়ীর সেই মর্মান্তিক ঘটনা
রাজশাহীর গোদাগাড়ী উপজেলার দুই সাঁওতাল কৃষক অভিনাথ মারান্ডি ও রবি মারান্ডি গত বছরের ২৩ মার্চ কীটনাশক পান করে আত্মহত্যা করেন। তারা সেচের পানির জন্য স্থানীয় গভীর নলকূপ অপারেটর সাখাওয়াত হোসেনের কাছে গিয়েছিলেন। সাখাওয়াত তাদের কাছে বিপুল অঙ্কের টাকা দাবি করে পানি দেওয়ার জন্য। অভিনাথ ও রবির পক্ষে এত টাকা দেওয়া সম্ভব ছিল না। ওরা দুজন সাখাওয়াতের কাছে বারবার ধরনা দিয়েও সরকার নির্ধারিত মূল্যে পানি পাননি। একপর্যায়ে সাখাওয়াত তাদের বলেন, ‘তোদের পানি দেব না, তোরা বিষ খা।’ এরপর দুই বিক্ষুব্ধ কৃষক সাখাওয়াতের সামনেই নিজেদের জমিতে দাঁড়িয়ে কীটনাশক পান করেন। অভিনাথ ওই দিনেই এবং তার ভাই রবি দুই দিন পর মারা যান।
অভিনাথের স্ত্রী ও রবির এক ভাই থানায় গিয়ে সাখাওয়াতের বিরুদ্ধে অভিযোগ করেন এবং আত্মহত্যায় প্ররোচনা দেওয়ার মামলা দেন। পুলিশ মামলা লিপিবদ্ধ করলেও তখনই কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। কারণ সাখাওয়াত প্রভাবশালী ও ক্ষমতাশালী লোক, স্থানীয় কৃষক লীগের সভাপতি। তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া বা তাকে গ্রেফতার করা সহজ কাজ নয়।
দুই কৃষকের আত্মহত্যার ঘটনা যখন মিডিয়ায় ব্যাপকভাবে প্রচারিত হয় এবং আন্দোলন শুরু হয়, তখন পুলিশ ঘটনার ১১ দিন পর গোদাগাড়ীতেই সাখাওয়াতকে গ্রেফতার করে। তাকে জেলে পাঠানো হয়। ঘটনার পর দেড় বছর পার হয়ে গেছে, কিন্তু এখনো জানা যায়নি মামলার ফল কী হয়েছে। মামলার চার্জশিট দেওয়া হয়েছে কিনা, সাখাওয়াত অভিযুক্ত হয়েছে কি না, কিছুই জানা যায়নি। সাখাওয়াতের মতো প্রভাবশালী ব্যক্তিদের শাস্তি দেওয়া সহজ কাজ নয়। অভিনাথ ও রবির মতো গরিব কৃষক এত সহজেই বিচার পাবেন?
বাংলাদেশের সাঁওতাল
দেশের পাহাড় ও সমতলে ৪৫টির বেশি ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠী রয়েছে। সমতলের ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীগুলোর মধ্যে সাঁওতাল সম্প্রদায় প্রাচীন ও বৃহত্তম। উত্তরাঞ্চলে রাজশাহী ও রংপুর বিভাগে তাদের অবস্থান সবচেয়ে বেশি-প্রায় দুই লাখ। ময়মনসিংহ, সিলেটসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে সাঁওতালরা ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে।
সাঁওতালদের প্রধান পেশা কৃষিকাজ। সুদুর অতীতে সাঁওতালরাই এদেশে কৃষিকাজের প্রচলন করেছিল বলে নৃতত্ত্ব বিশেষজ্ঞরা মনে করেন। বংশপরম্পরায় সাঁওতালরা এখনো কৃষিকাজেই আছেন এবং কৃষিকাজ তারা অন্যদের চেয়ে ভালোই করেন। দেশের কৃষি উৎপাদনে তাদের উল্লেখযোগ্য অবদান রয়েছে। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, সাঁওতালরা সব ক্ষেত্রেই অবহেলিত এবং বঞ্চনার শিকার। মাঝেমধ্যেই তাদের ওপর নির্যাতনের খবর পাওয়া যায়। এদেশের নাগরিক হলেও রাষ্ট্রের কাছ থেকে উপযুক্ত প্রাপ্য ও সম্মান তারা পাচ্ছে না। অথচ এই সাঁওতালরা মুক্তিযুদ্ধের সময় তির-ধনুক নিয়ে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছে, জীবন দিয়েছে। সাঁওতালরা তীর-ধনুক নিয়ে একাত্তরে রংপুর ক্যান্টনমেন্ট আক্রমণ করেছিল। ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধেও সাঁওতালরা একটানা তিন বছর তির-ধনুক নিয়ে লড়াই করেছিল (সাঁওতাল বিদ্রোহ : ১৮৫৪-৫৬)।
গোবিন্দগঞ্জের ঘটনা
গাইবান্ধা জেলার গোবিন্দগঞ্জ উপজেলায় ২০১৬ সালের ৬ নভেম্বর চিনিকল এলাকা থেকে দুই হাজার সাঁওতাল পরিবারকে উচ্ছেদ করা হয়। উচ্ছেদ অভিযানের সময় পুলিশ সাঁওতালদের ওপর গুলিবর্ষণ করলে তিনজন নিহত ও বহু আহত হয়। সাঁওতালদের বসতভিটা-কুঁড়েঘর পুড়িয়ে দিয়ে তাদের জমি দখল করা হয়। অথচ কয়েক হাজার সাঁওতাল পরিবার ওই এলাকায় স্থায়ীভাবে বসবাস করে আসছিল দীর্ঘকাল থেকে। কখনো কোনো প্রশ্ন ওঠেনি।
চিনিকলের জন্য আখচাষ করা হবে, এ কথা বলে সাঁওতালপল্লি উচ্ছেদ করা হয়। দখল করা সাঁওতালপল্লির জমিতে আখচাষ আর হয়নি। সেই জমি স্থানীয় প্রভাবশালী ক্ষমতাসীন মহল ভোগদখল করছে। উচ্ছেদকৃত সাঁওতাল পরিবারগুলো এখনো গৃহহারা। তারা জমি-বসতভিটা ফেরত পাননি, পুলিশি নির্যাতনের বিচারও পাননি। স্বাধীন বাংলাদেশের মাটিতে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপর এমন নির্যাতনের ঘটনা কাম্য নয়। এটি আমাদের সবার জন্য লজ্জার বিষয়।
চপল বাশার : সাংবাদিক, লেখক
basharbd@gmail.com