Logo
Logo
×

বাতায়ন

প্রশ্নপত্র প্রণয়ন নিয়ে আরও কথা

Icon

বিমল সরকার

প্রকাশ: ২৪ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

প্রশ্নপত্র প্রণয়ন নিয়ে আরও কথা

যারা দায়িত্বজ্ঞানহীন তাদের শিক্ষকতায় আসা, থাকা কিংবা রাখা উচিত না। ‘রাজশাহী শিক্ষা বোর্ড এইচএসসি পরীক্ষা : পদার্থবিজ্ঞান পরীক্ষায় ৮ প্রশ্নের ৬টিতে ভুল’ শিরোনামের খবরটি দৈনিক যুগান্তরসহ ৩১ আগস্ট বিভিন্ন দৈনিকে ছাপা হয়েছে। পরীক্ষার্থীদের মাঝে ভুল প্রশ্নপত্র বিতরণ-এমন আরও দায়িত্বহীনতা ও খামখেয়ালিপনার খবর রয়েছে চলমান এইচএসসি পরীক্ষাকে ঘিরে। একের পর এক এমন দুর্ভাগ্যজনক ও বিড়ম্বনাময় ঘটনার যেন শেষ নেই।

প্রশ্নপত্র প্রণয়ন ও বিলিবণ্টনে বিপত্তি নিয়ে প্রিয় দৈনিক যুগান্তর পত্রিকায় জুলাই মাসে পরপর আমার দুটি লেখা ছাপা হয়। কিন্তু কথা যেন শেষ হতে চায় না। অতএব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে (স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়) বিভিন্ন পরীক্ষার প্রশ্নপত্র প্রণয়ন নিয়ে আরও কিছু বলার প্রয়োজন বোধ করছি।

‘যারা লেখাপড়া জানে না তারাই শুধু মূর্খ নয়। যারা জানতে-বুঝতে চায় না, যারা প্রশ্ন করতে পারে না, যাদের জ্ঞানতৃষ্ণা নেই, তারাও মূর্খ।’ উদ্ধৃতাংশটির লেখক প্রখ্যাত সাহিত্যিক মহাশ্বেতা দেবী। ওই গুণিজনকে শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করে আমি নিবন্ধটি শুরু করলাম। প্রশ্ন করার ব্যাপারটা সহজ নয়। সহজ তো নয়ই, বরং খুবই কঠিন কাজ এ প্রশ্ন করা। প্রশ্ন সবাই করতে পারে না। প্রশ্ন করতে মেধা, বুদ্ধিমত্তা ও বাস্তব জ্ঞানের দরকার হয়। প্রশ্ন করতে হলে অনেক কিছু জানা এবং এর অবশ্যই একটি মান থাকা চাই। সাধারণভাবে এটাই প্রত্যাশিত। তা নাহলে সবার কাছে হাসির পাত্র কিংবা বিড়ম্বনাময় পরিস্থিতির সৃষ্টি হতে পারে। আর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীর পরীক্ষার জন্য প্রশ্নপত্র প্রণয়ন-সে তো আরও কঠিন কাজ।

প্রথমে সাধারণ প্রশ্নের কথাই ধরা যাক। একটি উদাহরণ দেই। কয়েকজন এনজিওকর্মী জরিপ কাজে কোনো একটা গ্রামে গেলেন। সন্ধান করে ইউপি চেয়ারম্যানের বাড়িতে ঢুকলেন তারা। বাড়িটি বেশ সুপরিসর। ঢুকেই শাড়ি পরিহিত দুজন নারীকে আলাপরত অবস্থায় দেখতে পেলেন। নারীদের একজন বৃদ্ধা, অন্যজন কিশোরী। নিশ্চিত হওয়ার জন্য এনজিওকর্মীদের একজন তাদের কাছে জানতে চান-‘এটা কি চেয়ারম্যান সাহেবের বাড়ি?’ মাথা নাড়িয়ে কম বয়সি নারীটি হ্যাঁ-বাচক উত্তর দিলেন। শোনার পর এনজিওকর্মীর অভিপ্রায়-‘তোমার বাবাকে (চেয়ারম্যান) একটু ডেকে দাও তো।’ এভাবেই বিড়ম্বনার সৃষ্টি। শাড়ি পরিহিতা অল্পবয়সি ওই নারী আসলে কন্যা নয়, চেয়ারম্যান সাহেবের দ্বিতীয় স্ত্রী। প্রশ্নকর্তা এনজিওকর্মী এখানে বড় একটি ধাক্কা খেলেন।

এমনই আর একটি উদাহরণ: কারও কাছে জানতে চাওয়া হলো, বিখ্যাত বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের কথা সে শুনেছে কিনা। জবাব দিল ‘না’, অর্থাৎ বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম সে শোনেনি। একই ব্যক্তিকে এরপর আবারও প্রশ্ন করা হলো-‘বলো তো বিশ্বভারতী পশ্চিমবঙ্গের কোন জেলায় অবস্থিত?’ এমন নির্বুদ্ধিতার জবাব কী!

শত শত, হাজার হাজার, লাখ লাখ শিক্ষার্থীর জন্য প্রশ্নপত্র প্রণয়নে সংশ্লিষ্ট থাকেন মূলত শিক্ষকরাই। শিক্ষার একদম ওপরের স্তর হলো বিশ্ববিদ্যালয়। এখানকার প্রশ্নপত্র প্রণয়ন নিয়ে সাধারণের মধ্যে খুব একটা আলোচনা হয় না। কিন্তু স্কুল ও কলেজ পর্যায়ে শিক্ষকদের প্রশ্নপত্র প্রণয়নের বিষয়টি নিয়ে কেবল আলোচনা নয়, কখনো কখনো তুলকালাম কাণ্ডেরও সৃষ্টি হয়। প্রতিটি পরীক্ষারই প্রশ্নপত্র প্রণয়নের জন্য কিছু নিয়মনীতি থাকে। এসব নিয়মনীতি মেনে তবেই বিষয় বা কোর্সভিত্তিক প্রশ্নপত্র প্রণয়ন করতে হয়। প্রশ্নপত্র প্রণয়নের সময় প্রশ্নকর্তাকে শিক্ষা কারিকুলাম এবং পাঠ্যসূচির পাশাপাশি প্রশ্নের ধরন ও নম্বর বণ্টনের হিসাবটিও জানা থাকা প্রাথমিক শর্ত। কাউকে কটাক্ষ করে কিংবা সামাজিক ও ধর্মীয় সম্প্রীতি বিনষ্ট হতে পারে, এমন কিছু প্রশ্নপত্রে রাখা যাবে না। অথচ কখনো কখনো সাম্প্রদায়িক উসকানিও দৃষ্টিগোচর হয় প্রশ্নপত্রে। যেভাবেই হোক, এমন সব প্রশ্নপত্র প্রণয়ন-বিলিবণ্টনের অনেক উদাহরণ আছে। এমনকি বোর্ডের অধীনে এসএসসি-এইচএসসির মতো গুরুত্বপূর্ণ পরীক্ষাতেও এমনটি লক্ষ করা যায়। কখনো কখনো প্রশ্নপত্র প্রণয়নকারী তথা শিক্ষকের হেন কৃতকর্মের জন্য সরকারের পক্ষ থেকে দুঃখও প্রকাশ করা হয়। এ ছাড়া শাস্তি প্রদানের দৃষ্টান্তও রয়েছে।

উল্লেখ্য, বোর্ড-বিশ্ববিদ্যালয়ের ফাইনাল পরীক্ষায় তো আছেই; হালে বুদ্ধিমান শিক্ষকরা প্রতিষ্ঠানের অভ্যন্তরীণ পরীক্ষার প্রশ্নপত্র প্রণয়নের জন্যও সম্মানি পাওয়ার ব্যবস্থা করে নিয়েছেন।

২.

গুরুত্বপূর্ণ পরীক্ষার প্রশ্নপত্রে বাংলা ছায়াছবির ডায়ালগ-পত্রপত্রিকা ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এ শিরোনামটি হঠাৎ আলোচনার বিষয় হয়ে উঠে। ‘শয়তান দেহ পাবি, মন পাবি না’ এমন একটি ডায়ালগের আলোকেই প্রশ্নটি প্রণয়ন করা। কোনো মাধ্যমিক বিদ্যালয় বা কলেজের নয়, প্রশ্নটি করা হয় একটি খ্যাতনামা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাকাউন্টিং অ্যান্ড ইনফরমেশন সিস্টেম বিভাগের ২০২১-২২ শিক্ষাবর্ষের ‘বাংলাদেশ স্টাডিজ কোর্স’-এর মিডটার্ম পরীক্ষায়। ৮ জুন ২০২৩, ওই কোর্সের পরীক্ষাটি হয়।

এ ডায়ালগের একটি কাহিনি আমি এক বন্ধুর মুখে প্রথম শুনি অন্তত আট-দশ বছর আগে। কিছুটা সম্মতি আর কিছুটা অসম্মতি, কন্যাদায়গ্রস্ত গরিব মা-বাবার অনেকটা অসহায়ত্ব, এমনই পরিস্থিতিতে এক যুবক সামাজিক আচার-অনুষ্ঠান যথারীতি সম্পন্ন করে এক সুন্দরীকে স্ত্রী হিসাবে ঘরে তোলে। দু-চারদিনে বিয়ে উপলক্ষ্যে আগত নিকটাত্মীয়দের কেউ বিদায় নিয়েছেন, কেউ কেউ এখনো রয়ে গেছেন। এরই মধ্যে দেখা দেয় বিপত্তি আর বিড়ম্বনা। আমার বন্ধুর ভাষ্যমতে, প্রায় প্রতিদিন রাত হলেই নবদম্পতির শোবার ঘর থেকে ত্যক্ত-বিরক্ত নানা কথা ভেসে আসে। ত্যক্ত-বিরক্ত হয়ে নববধূটি একসময় বলে বসে-‘শয়তান, তুই আমার দেহ পাবি; মন পাবি না।’ নিকটতম প্রতিবেশী হিসাবে বন্ধু বা বন্ধুপত্নী নিজ কানে হয় তো শুনেছেন এমন ডায়ালগ। এটা যে কোনো ছায়াছবির ডায়ালগ, তা আমার জানা ছিল না। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষার প্রশ্নপত্রে এমনটির সন্নিবেশ ঘটায় বিষয়টি এতদিনে আমার কাছে কিছুটা পরিষ্কার হলো।

৩.

দুই শ্রেণির প্রশ্নপত্রে শুধু শিরোনামে ‘নবম’ ও ‘দশম’ শ্রেণি লেখা, বাকি সব হুবহু। ঘটনাস্থল নাটোরের গুরুদাসপুর উপজেলা। সংবাদমাধ্যমে বিস্তারিত বর্ণনা ছাপা থাকলেও এখানে আমি নতুন করে আর বিদ্যালয়টির নাম উল্লেখ করতে চাই না।চলমান অর্ধবার্ষিক পরীক্ষায় ১৮ জুন ২০২৩, নবম ও দশম শ্রেণির গণিত (বহুনির্বাচনি অভীক্ষা) পরীক্ষা একই প্রশ্নপত্রে নেওয়া হচ্ছিল। সকাল ১০টায় গণিত ও গণিত বহুনির্বাচনী অভীক্ষা পরীক্ষার প্রস্তুতি নিয়ে এসেছিল শিক্ষার্থীরা। প্রশ্নপত্র হাতে পেয়ে তারা ৭০ নম্বরের প্রশ্নপত্রের উত্তর লিখতে শুরু করে। পরে ৩০ নম্বরের বহুনির্বাচনি অভীক্ষার প্রশ্নপত্র পেলে তাদের সন্দেহ হয়। দুই শ্রেণির প্রশ্নপত্র মিলিয়ে দেখে শুধু শিরোনামে নবম ও দশম শ্রেণি লেখা; বাকি সব হুবহু। দুই শ্রেণিতে একই প্রশ্নপত্র হওয়ায় বিষয়টি জানাজানির পর রীতিমতো তোলপাড় সৃষ্টি হয়। শিক্ষার্থী-শিক্ষক, প্রধান শিক্ষক-মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা, এভাবে একে একে সবার নজরে আসে বিষয়টি। শেষপর্যন্ত পরীক্ষাটি স্থগিত করা হয়।

বিমল সরকার : অবসরপ্রাপ্ত সহকারী অধ্যাপক, কলাম লেখক

 

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম