মরুতে প্রাণঘাতী বন্যায় ভুলে যাওয়া কান্না
ড. মো. ফখরুল ইসলাম
প্রকাশ: ২৩ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
লিবিয়ায় সামুদ্রিক ঝড় ড্যানিয়েলের মারাত্মক আঘাতে সৃষ্ট প্রাণঘাতী বন্যার তাণ্ডব দেখে সারা পৃথিবীর মানুষ আশ্চর্যান্বিত হয়েছে। এক সপ্তাহ আগে সৃষ্ট এ সামুদ্রিক ঘূর্ণিঝড়টি ভূমধ্যসাগরের উত্তর দিকের ইউরোপীয় দেশ বুলগেরিয়া, তুরস্ক ও গ্রিসে আঘাত হেনেছিল এবং গ্রিসে ১৫ ব্যক্তির মৃত্যুর কারণ হয়েছিল। গত ১০ সেপ্টেম্বর রাতে সবাই যখন ঘুমিয়ে পড়েছিল, তখন এ হারিকেনটি ভূমধ্যসাগরের দক্ষিণ দিকে লিবিয়া উপকূলে আছড়ে পড়তে থাকে। রাত সাড়ে ৩টায় প্রবল গতিবেগে লিবিয়ার রাজধানী ত্রিপোলি, বেনগাজি, সৌসি, আল-বাঈদা, আলমার্জ, তবরুক, তাকরিক ও ডেরনা শহরে আঘাত হানে। এর আগে ভারি বৃষ্টিপাত হয়। অন্যান্য শহরে বেশি ক্ষয়ক্ষতি না হলেও ডেরনা শহরে প্রচণ্ড বেগে বন্যার তাণ্ডবলীলা শুরু হয়। সেখানে একদিকে সমুদ্রের দিক থেকে হঠাৎ পাহাড়সম জলোচ্ছ্বাসের চাপ, অন্যদিকে ভারি বৃষ্টিপাতের ফলে শহরের মধ্য দিয়ে বয়ে চলা ওয়াদি ডেরনা নদীর দুটি ড্যাম প্রবল শব্দে বিস্ফোরিত হয়ে ভেঙে যায়। ফলে উজানের ঢল নেমে ভাসিয়ে একাকার করে দেয় ধনীদের শহর ডেরনার দুই বর্গকিলোমিটার এলাকা। শুধু ডেরনা শহরেই ২,২১৭টি ভবন ধসে ভেসে গেছে। ড্যামের নিচের দিকে সমুদ্র উপকূলবর্তী একই নদীতে আরও বড় বড় পাঁচটি ব্রিজ ধ্বংস হয়েছে। ডেরনাতেই মারা গেছে সাড়ে ১১ হাজার মানুষ। নিখোঁজ রয়েছে সাড়ে ১০ হাজার।
ডেরনায় পানির স্রোতের গতি ও উচ্চতা এত বেশি ছিল যে, বহুতল আবাসিক ভবনগুলোও ধসে পড়ে। তিনতলা ভবনের ছাদের মধ্যে দামি ভারি মোটরকার আটকে থাকতে দেখা গেছে! সুদৃশ্য বাড়ি, দামি গাড়ি, অফিস, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, তেলক্ষেত্র-সবকিছু ভেসে একাকার হয়ে গেছে। ডেরনা শহরে বেশি ক্ষয়ক্ষতি হওয়ার প্রধান কারণ লিবিয়ার সরকারি কর্তৃপক্ষ বা জনগণের কাছে এ শহরের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত ওয়াদি ডেরনা নদীর ড্যাম ভাঙার আগাম তথ্য বা সতর্কবার্তা না থাকা।
ডেরনা শহরের পাশে প্রবাহিত ওয়াদি ডেরনা নদীতে ১৯৭০ সালে যুগোস্লাভিয়া কর্তৃক নির্মিত দুটি ড্যাম রয়েছে। সেগুলো শহর রক্ষা বাঁধের সঙ্গে সংযুক্ত। প্রথম ড্যামটির নাম আল-বিলাবা ও দ্বিতীয়টির নাম আবু মনসুর। এ ড্যাম দুটি চার ও বারো কিলোমিটার দূরে ওয়াদি ডেরনা নদীতে অবস্থিত। এক স্যাটেলাইট পর্যবেক্ষণে জানা গেছে, ওয়াদি ডেরনা নদীর ওপর নির্মিত দুটি ড্যামই পরপর হঠাৎ ধসে গেলে খুব দ্রুত বেগে শহরের একদিক দিয়ে পানি প্রবেশ করে এবং অন্যদিক দিয়ে ঘূর্ণিঝড় ড্যানিয়েলের প্রভাবে সমুদ্রের ঢেউ আছড়ে পড়ে। ফলে ডেরনা শহরে বেশি ধ্বংসলীলা সাধিত হয়।
ডেরনা লিবিয়ার পূর্বাঞ্চলের সবচেয়ে সুন্দর শহর। সেখানে ১৫ ফুট উঁচু প্রবল ঢেউ আঘাত হানে। সুনামি নয় অথচ সুনামির চেয়ে প্রবল গতিময় স্রোতের তোড়ে গাড়িগুলো ভেসে সমুদ্রের দিকে চলে যায়। কিছু গাড়ি পার্কের গাছে ও উঁচু টিলার মধ্যে ধাক্কা লেগে দুমড়ে-মুচড়ে আটকা পড়ে থাকে। ঘূর্ণিঝড় শুধু গাড়ি নয়, রূপকথার দৈত্যের মতো মানুষসহ গোটা ডেরনা শহরকে যেন সমুদ্রের দিকে টেনে-হিঁচড়ে নিয়ে গেছে। যুদ্ধের মধ্যেও এত ক্ষতি, এত ধ্বংসলীলা দেখেনি সেখানকার মানুষ। চারশজন বিদেশি নাগরিকও এ ঘূর্ণিঝড়ের শিকার হয়ে মৃত্যুবরণ করেছেন। বিদেশিদের মধ্যে সুদান ও মিসরের নাগরিক বেশি। বাংলাদেশি ছয়জন রয়েছেন।
চারদিকে পড়ে থাকা লাশ এক বিভীষিকাময় দৃশ্যের সৃষ্টি করেছিল। শহরটির ১০-২০ মাইলের মধ্যে কবর দেওয়ার কোনো জায়গা খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল না। সমুদ্রে ভাসছিল গলিত লাশ। সেগুলো কোনোরকমে তুলে এনে সারিবদ্ধভাবে রাস্তার পাশে রাখা হয়। কাফনের কাপড় নেই। বডিব্যাগ পাওয়াও কঠিন বলে জানিয়েছেন কিছু উদ্ধারকর্মী। কাঁথা-কম্বল যা পাওয়া গেছে, তাই দিয়ে গণকবর দেওয়ার চেষ্টা করা হয়। রেড ক্রিসেন্টের ক্লান্ত উদ্ধারকর্মীরা পরিচয়হীন লাশগুলোর ছবি তুলে একটি নম্বর দিয়ে হিসাব রাখছিলেন।
মাত্র এক লাখ মানুষের বন্দরনগরী ডেরনা। বিপর্যয়ের আট দিন পর ডেরনার মেয়র বলেছেন, শহরটিতে ২০ শতাংশ মানুষ মারা গেছেন। তিন হাজার মৃতদেহ গণকবর দেওয়া হয়েছে। ধ্বংসস্তূপের নিচে অসংখ্য লাশ চাপা পড়ে আছে। উদ্ধারকাজে বাধা হয়ে দাঁড়ায় যুদ্ধের সময় পুঁতে রাখা ল্যান্ডমাইন। ঠিকমতো উদ্ধারকাজ করা না গেলে ডেরনাতে ডায়রিয়া-কলেরা মহামারি আকারে ছড়িয়ে পড়তে পারে।
ঘূর্ণিঝড় সতর্কতা সংকেত জারি করার পরও কেন এত মৃত্যু ও ক্ষয়ক্ষতি হলো, তা নিয়ে বিশ্লেষকরা বেশ হতাশার কথা জানিয়েছেন। এ জন্য লিবিয়ার জনগণকে দীর্ঘ যন্ত্রণা ভোগ করতে হতে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন কেউ কেউ।
লিবিয়ায় টানা ৪২ বছর ক্ষমতায় থাকা কর্নেল মুয়াম্মার গাদ্দাফীকে ২০১১ সালের ২০ অক্টোবর হত্যা করার পর দেশটিতে তুমুল গৃহবিবাদ শুরু হয়। সেই গৃহবিবাদ থেকে ২০১২ সালে গৃহযুদ্ধের দিকে ধাবিত হয় দেশটি। ২০১২ সালে আলকায়েদা গ্রুপ মার্কিন মিশনে হামলা চালালে সংকট আরও ঘনীভূত হয়ে পড়ে। অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব এতটাই ভয়ংকর হয়ে ওঠে যে দেশটি পূর্ব-পশ্চিম দুটি আলাদা সশস্ত্র গ্রুপের কব্জায় কুক্ষিগত হয়ে পড়ে। পূর্ব লিবিয়ায় স্বঘোষিত সরকার তৈরি হয় এবং রাজধানীর নাম ঘোষিত হয় বেনগাজি। বেনগাজিতে ইসলামিক স্টেটস্ বা আইএস নিয়ন্ত্রিত সরকার ‘ইসলামিক খেলাফত’ প্রতিষ্ঠা করলে লিবিয়া প্রশাসনিকভাবে কার্যত দুভাগে বিভক্ত হয়ে পড়ে। ডেরনায় আইএস সমর্থিত বিদ্রোহী কমান্ডার জরুরি ত্রাণ সহায়তার জন্য গণমাধ্যমে বিশ্বের প্রতি আবেদন জানিয়েছেন।
ত্রিপোলি সরকার এবং স্বঘোষিত বিদ্রোহী বেনগাজী সরকারের নিয়ন্ত্রিত শাসনের কারণে দেশটিতে চরম অশান্তি বিরাজ করছে। এর মধ্যে প্রলয়ংকরী সমুদ্রঝড় ও বন্যার আঘাতে উভয়ের সম্বিত ফিরে এলেও ততক্ষণে মৃত্যু ডেরনা উপত্যকায় এক করুণ পরিস্থিতি সৃষ্টি করে। যুদ্ধবিগ্রহ, অশান্তি ও রেষারেষির মাঝে দেশটিতে রাজনৈতিক সংস্কার সম্ভব হয়নি। ওয়াদি ডেরনার ওপর নির্মিত ড্যাম ও বাঁধগুলো ঝুঁকিপূর্ণ হলেও মেরামত করা হয়নি। গাদ্দাফি সরকারের পতনের পর উপকূল রক্ষায় কোনো সংস্কার কাজ করা হয়নি।
তেলকূপগুলো দখলে রেখে সশস্ত্র গ্রুপগুলো লাভবান হয়ে বিলাসী জীবনযাপন করলেও দেশের পরিবেশ নিয়ে মাথা ঘামায়নি কেউই। ফলে জরুরি পরিস্থিতি মোকাবিলার কোনোরূপ প্রস্তুতি ছিল না লিবিয়ার। প্রলয়ংকরী সমুদ্রঝড় থেকে বাঁচার জন্য ছিল না আশ্রয়শিবিরও। অথবা কোনো ব্যবস্থা থাকলেও সে সময় জনগণকে আগাম সংকেত দিয়ে নিরাপদ স্থানে সরানোর জন্য কেউ এগিয়ে আসেনি। লিবিয়ার আবহাওয়া রক্ষণাবেক্ষণ ব্যবস্থা খুবই দুর্বল এবং উদ্ধার প্রস্তুতি অপ্রতুল। বিশ্ব আবহাওয়া সংস্থার কর্ণধার পেটোরি তালাস এ কথা বলেছেন। আবহাওয়া রক্ষণাবেক্ষণ ব্যবস্থা উন্নত হলে এত মানুষ প্রাণ হারাত না। এমনকি সংস্থাগুলোর সমন্বয়হীনতার অভাবে লিবিয়ার এ ভয়াবহ দুর্যোগের ফলে সৃষ্ট ক্ষয়ক্ষতির সর্বশেষ পরিস্থিতি দ্রুত জানাও খুব কঠিন হবে বলে অনেকে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন।
তবে একটা বিষয়ের উন্নতি হয়েছে এ বিপদের সময়-অতীতের হিংসা হানাহানি ভুলে সবাই এক কাতারে মিলে লাশ খুঁজে দাফনে শরিক হওয়ার চেষ্টা করেছেন। বিভিন্ন দেশ এবং আন্তর্জাতিক সাহায্য সংস্থাগুলো ত্রাণসামগ্রী নিয়ে এগিয়ে এসেছে। ইতোমধ্যে বাংলাদেশ থেকেও ডেরনা ও শাবাব শহরে ওষুধ ও শুকনা খাদ্যসামগ্রীসহ জরুরি মানবিক সাহায্য পাঠানো হয়েছে।
এক রাতে এত মানুষের মৃত্যু এবং ১০ হাজার মানুষের নিখোঁজ হওয়ার বিষয়টি কেউ মেনে নিতে পারছেন না। দূরবর্তী এলাকা থেকে স্বজনরা এসে প্রিয়জনের লাশ খুঁজে না পেয়ে আহাজারি করছিলেন। ‘এটা একটা কেয়ামত, কেয়ামত ছাড়া আর কিছুই নয়’ বলে কাঁদছিলেন একজন বয়স্ক ব্যক্তি। সেখানকার বেঁচে যাওয়া মানুষগুলো খুবই ভীত হয়ে পড়েছেন। ঘটনার আকস্মিকতায় শোকাবিভূত হয়ে তারা মানসিকভাবে এতটাই বিপর্যস্ত হয়েছেন যে কাঁদতেও পারছিলেন না অনেকে।
এই কঠিন বাস্তবতা উপলব্ধি করে সশস্ত্র গ্রুপগুলোর মধ্যকার অভ্যন্তরীণ হিংসা-হানাহানি দূর হোক এবং যে কোনো প্রাকৃতিক বিপর্যয়মূলক জরুরি অবস্থা মোকাবিলায় জনসচেতনতা সৃষ্টি হোক-এ আশাবাদ লিবীয়দের জন্য এবং দেশ-কাল পাত্র ভেদে আমাদের সবার জন্য।
ড. মো. ফখরুল ইসলাম : রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকর্ম বিভাগের অধ্যাপক, সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের সাবেক ডিন
fakrul@ru.ac.bd