সংবিধানের আলোকে শিক্ষাব্যবস্থার প্রচলন জরুরি
এম আর চৌধুরী
প্রকাশ: ১৮ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
প্রতীকী ছবি
গত ১৩ আগস্ট একটি পত্রিকা ‘ঘোড়ার আগে লাগাম’? শিরোনামে সম্পাদকীয়তে লিখেছে, ‘দেশের অবস্থা এমন পর্যায়ে চলে যাচ্ছে যে, অধিকাংশ সেক্টরে লোভী, আত্মকেন্দ্রিক এবং দুর্নীতিগ্রস্ত মানুষের সংখ্যা হু হু করে বাড়ছে। অন্যায় পথে মানুষের চাহিদার এমন জ্যামিতিক বৃদ্ধি সচরাচর কোনো দেশে লক্ষ করা যায় না। শিক্ষা এবং সাংস্কৃতিক বোধহীনতার কারণে এক ধরনের হ্যালুসিনেশনে আক্রান্ত হচ্ছে লোভাতুর মানুষ। তারা যে কোনো উপায়েই হোক, অর্থ আয়ের জন্য উন্মুখ। ন্যায়-অন্যায় বিচারের সময়ও যেন তাদের হাতে নেই। ফলে দেশের কিছু মানুষের নৈতিকতা এবং বিচার-বিশ্লেষণের ক্ষমতাও প্রায় বিলুপ্তির পথে।’ গত ২৩ আগস্ট অন্য একটি পত্রিকা ‘ব্যবসায়ীদের অতি লোভের চড়া মাশুল গুনছে ভোক্তা’ শিরোনামে প্রকাশিত খবরে বলেছে, ‘উৎপাদন ও সরবরাহ স্বাভাবিক থাকার পরও নানা অজুহাতে অযৌক্তিকভাবে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম বাড়াচ্ছে অসাধু ব্যবসায়ী চক্র। আর তাদের এ অতি লোভের চড়া মাশুল গুনছেন ভোক্তারা। উদ্বেগজনক বিষয় এই যে, তাদের এ অতি মুনাফার লোভ সংক্রমিত হচ্ছে সাধারণ ব্যবসায়ীদের মধ্যেও। তাদের অনেকের মধ্যেই বেড়ে গেছে ঝোপ বুঝে কোপ মারার প্রবণতা।’
অথচ বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিকথা, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধান ওইরূপ বাস্তবতার ইঙ্গিত বহন করে না। তবে এ রূপের বাস্তবতার জন্য দায়ী হলো দেশের শিক্ষা ও রাষ্ট্রব্যবস্থা। বাংলাদেশের শিক্ষা ও রাষ্ট্রব্যবস্থা দেশের জনগণকে ব্যক্তি ও পরিবারকেন্দ্রিক তথা আত্মকেন্দ্রিক হিসাবে গড়ে তুলেছে। ফলে জনগণের মধ্য থেকে অল্পসংখ্যক বাদ দিলে বাকি সবাই চাইছেন যেনতেন প্রকারে ধনী হতে; রাষ্ট্রীয় অর্থ-সম্পদ ও অন্যের ব্যক্তিগত সম্পদ দখল করা, ঘুস-দুর্নীতিতে ব্যাপকভাবে জড়িয়ে পড়া, ব্যবসার নামে অতি মুনাফা অর্জন, সেই সঙ্গে নারীসহ মানব পাচার, চোরাচালান ও ভেজালে আসক্তি; লুণ্ঠন ও দখলের লক্ষ্যে হত্যা করায়ও পিছপা হন না। এরই পাশাপাশি অর্থ, পদাধিকার ও রাজনৈতিক ক্ষমতার জোরে ধরাকে সরা জ্ঞান করার মতো যা ইচ্ছা তাই-ই করার প্রবণতাও লক্ষণীয়। চলছে ‘সাইবার-স্মার্ট-ডিজিটাল’ জালিয়াতি। চাঁদাবাজি হয়ে উঠেছে অর্থ আত্মসাতের এক মহাপদ্ধতি। আরও আছে ঋণের মাধ্যমে ব্যাংকের অর্থ আত্মসাতের মহাকৌশল। যার ফলে অকল্পনীয়ভাবে বেড়ে যাচ্ছে একদিকে সামাজিক বিশৃঙ্খলা ও বৈষম্য আর অন্যদিকে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ লুণ্ঠিত; নির্বাচনি ব্যবস্থা ভেঙে পড়েছে; বাকস্বাধীনতা, ভোটের স্বাধীনতা, সংবাদপত্রের স্বাধীনতা লুণ্ঠিত হওয়া, প্রতিবাদ করা বা অনেক সত্য বলার অধিকার থেকে বঞ্চনা, বাড়বাড়ন্ত মামলা-মোকদ্দমা-যা যুদ্ধ করে স্বাধীন হওয়া একটি দেশে কাম্য ছিল না।
গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানের প্রস্তাবনায় মূলনীতি হিসাবে অন্যান্যের মধ্যে সমাজতন্ত্রের কথা বলা হয়েছে। তাতে আরও বলা হয়েছে যে, ‘আমরা আরও অঙ্গীকার করিতেছি যে, আমাদের রাষ্ট্রের অন্যতম মূল লক্ষ্য হইবে গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে এমন এক শোষণমুক্ত সমাজতান্ত্রিক সমাজের প্রতিষ্ঠা-যেখানে সকল নাগরিকের জন্য আইনের শাসন, মৌলিক মানবাধিকার এবং রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক সাম্য, স্বাধীনতা ও সুবিচার নিশ্চিত হইবে।’ রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি অংশের ৮(১)নং ধারায়ও সমাজতন্ত্রের কথা বলা হয়েছে।
সেখানেই শেষ নয়, সংবিধানের রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি অংশের ১০নং ধারায়ও বলা হয়েছে, ‘মানুষের উপর মানুষের শোষণ হইতে মুক্ত ন্যায়ানুগ ও সাম্যবাদী সমাজ লাভ নিশ্চিত করিবার উদ্দেশ্যে সমাজতান্ত্রিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা হইবে।’ রাষ্ট্র পরিচালনার সে মূলনীতির ১৪নং ধারায় বলা হয়েছে, ‘রাষ্ট্রের অন্যতম মৌলিক দায়িত্ব হইবে মেহনতি মানুষকে-কৃষক ও শ্রমিককে এবং জনগণের অনগ্রসর অংশসমূহকে সকল প্রকার শোষণ হইতে মুক্তি দান করা।’
সহজেই অনুমেয়, বাংলাদেশে প্রতিষ্ঠিত হবে একটি শোষণমুক্ত সমাজতান্ত্রিক সমাজ, সাম্যবাদী সমাজ। এরই ধারাবাহিকতায় সংবিধানের ১৭নং ধারায় (ক)-অংশে ‘একই পদ্ধতির গণমুখী ও সর্বজনীন শিক্ষাব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার’ এবং (খ)-অংশে ‘সমাজের প্রয়োজনের সহিত শিক্ষাকে সংগতিপূর্ণ করিবার’ কথা বলা হয়েছে। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য যে, ১১ জুন ২০২৩ একটি পত্রিকায় ‘এক দেশে ১২ রকমের শিক্ষা’ শিরোনামে প্রকাশিত খবর থেকে আমরা জানতে পারি যে, বাংলাদেশে ১২ রকমের শিক্ষাব্যবস্থা চালু আছে। অথচ, সমাজতান্ত্রিক সমাজ-সাম্যবাদী সমাজ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্য অর্জন যে বিনা শিক্ষায় সম্ভব নয়, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। আর এ শিক্ষা অর্জন করতে হলে বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র ও কমিউনিজমের তত্ত্ব কার্ল মার্কস ও ফ্রেডারিক এঙ্গেলসের রচনাবলি পাঠ্যসূচিতে অন্তর্ভুক্তি একান্তভাবেই আবশ্যক। একইসঙ্গে সেই তত্ত্বের ওপর ভিত্তি করে প্রকাশিত সঠিক ব্যাখ্যা ও বক্তব্যসংবলিত বইপুস্তক পাঠ্য তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা অত্যাবশ্যক। সে সঙ্গে বর্তমানে প্রচলিত শ্রেণি-বৈষম্যভিত্তিক শিক্ষাব্যবস্থার অবসান ঘটিয়ে ৫০ বছর আগে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানে গৃহীত একই পদ্ধতির শিক্ষাব্যবস্থা চালু করতে হবে, অন্যথায় বর্তমানের মতো বৈষম্যমূলক শিক্ষাব্যবস্থা চালু থাকবে। ফলে শিক্ষার্থীদের মধ্যে তথা সমাজে বৈষম্য বাড়তে থাকবে এবং সামাজিক বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হতে থাকবে। আর সে পরিপ্রেক্ষিতে সংবিধানের ১৯নং ধারার (১)-অংশে ‘সকল নাগরিকের জন্য সুযোগের সমতা নিশ্চিত করিতে রাষ্ট্র সচেষ্ট হইবেন’ এবং (২)-অংশে ‘মানুষে মানুষে সামাজিক ও অর্থনৈতিক অসাম্য বিলোপ করিবার জন্য, নাগরিকদের মধ্যে সম্পদের সুষম বণ্টন নিশ্চিত করিবার জন্য এবং প্রজাতন্ত্রের সর্বত্র অর্থনৈতিক উন্নয়নের সমান স্তর অর্জনের উদ্দেশ্যে সুষম সুযোগ-সুবিধাদান নিশ্চিত করিবার জন্য রাষ্ট্র কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করিবে’, বর্ণিত বিষয়াবলি অকার্যকর হয়েই থাকবে।
সে কারণে শিক্ষাব্যবস্থায় শিশুশিক্ষাসহ প্রাথমিক পর্যায় থেকে সর্বোচ্চ পর্যায় অর্থাৎ, বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায় পর্যন্ত সমাজতান্ত্রিক তথা সাম্যবাদী মনোভাবে নাগরিকদের শিক্ষিত করে গড়ে তোলার লক্ষ্যে ‘শোষণমুক্ত সমাজতান্ত্রিক সমাজ’ তথা ‘সাম্যবাদী সমাজে’র অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সামাজিক শিক্ষা অনতিবিলম্বে চালু করার ব্যবস্থা রাষ্ট্রকে গ্রহণ করতে হবে। এরই সঙ্গে রাষ্ট্রকে একরোখা ব্যক্তিমালিকানার শিক্ষার স্থলে সামাজিক মালিকানার শিক্ষা প্রদানের লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় পুস্তক প্রকাশনার ব্যবস্থা করতে হবে।
সেই সঙ্গে দেশের সব সংবাদপত্র, রেডিও ও টেলিভিশনে সমাজতান্ত্রিক সমাজ তথা শোষণমুক্ত সমাজের শিক্ষাসংক্রান্ত রূপরেখা যথাযোগ্যভাবে প্রচারের ব্যবস্থা করবে রাষ্ট্রশক্তি।
এম আর চৌধুরী : সদস্য, বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি
গঠন-প্রক্রিয়া