সব ছাপিয়ে আগামী নির্বাচনের গ্রহণযোগ্যতাই হতে পারে অন্যতম বড় অর্জন
মোনায়েম সরকার
প্রকাশ: ১৮ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
স্বল্প সময়ের ব্যবধানে ব্রিকস শীর্ষ সম্মেলন ও জি-২০ সম্মেলনে অংশগ্রহণ যে বাংলাদেশের জন্য বিশেষ গুরুত্ব ও মর্যাদার, এটি স্বীকার না করে উপায় নেই। এ দুটি আন্তর্জাতিক সংস্থার সদস্য না হলেও বাংলাদেশকে আমন্ত্রণ জানানো হয়। ওই দুই সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উপস্থিতি ও বিশ্বনেতাদের সঙ্গে তার দেখা-সাক্ষাৎ, কথা বলার বিষয়টি জাতীয় ও আন্তর্জাতিক রাজনীতির বর্তমান প্রেক্ষাপটে একেবারে তাৎপর্যহীন নয়।
বিশেষ করে জি-২০ শীর্ষ সম্মেলন উপলক্ষ্যে শেখ হাসিনার নয়াদিল্লি সফরে যে কূটনৈতিক সাফল্য অর্জিত হয়েছে, তাকে খাটো করে দেখার সুযোগ নেই।
নয়াদিল্লিতে গত ৮ সেপ্টেম্বর ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সরকারি বাসভবনে তার সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় বৈঠকে মিলিত হন শেখ হাসিনা। দুই প্রধানমন্ত্রীর মধ্যে একান্ত বৈঠকও অনুষ্ঠিত হয়েছে। বৈঠকের পরই নরেন্দ্র মোদি নিজের টুইটার অ্যাকাউন্টে লিখেন, ‘প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে ফলপ্রসূ আলোচনা হয়েছে। গত ৯ বছরে ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কের অগ্রগতি খুবই সন্তোষজনক। আমাদের আলোচনায় কানেক্টিভিটি, বাণিজ্যিক সংযুক্তি এবং আরও অনেক বিষয় অন্তর্ভুক্ত ছিল।’
ওই রাতেই দিল্লিতে পররাষ্ট্রমন্ত্রী একে আবদুল মোমেন সাংবাদিকদের জানান, দুই প্রধানমন্ত্রীর বৈঠকে ‘আঞ্চলিক শান্তি ও স্থিতিশীলতা’র বিষয়টি খুবই গুরুত্ব পেয়েছে। আমাদের ইস্যু হলো আঞ্চলিক শান্তি ও স্থিতিশীলতা। আমরা বারবার এ কথাটা বলছি, ভারতও একই কথা বলছে। শেখ হাসিনার সঙ্গে বৈঠকের পর যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন ও মরিশাসের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠক করেন নরেন্দ্র মোদি।
পরদিন শনিবার জি-২০ সম্মেলনের এক ফাঁকে বাইডেনের সঙ্গে অনানুষ্ঠানিক সাক্ষাৎ করেন শেখ হাসিনা। এ সময় প্রধানমন্ত্রীর মেয়ে সায়মা ওয়াজেদ পুতুল, যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্থনি ব্লিঙ্কেন ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী একে আবদুল মোমেন উপস্থিত ছিলেন। বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত ছবিতে দেখা যায়, বাইডেনের সঙ্গে পাশাপাশি দাঁড়িয়ে কথা বলছেন প্রধানমন্ত্রী ও পুতুল। একপর্যায়ে বাইডেন নিজেই সেলফি তুলেন শেখ হাসিনা ও পুতুলের সঙ্গে।
একই রাতে ভারতের রাষ্ট্রপতির আমন্ত্রণে দেওয়া নৈশভোজেও বাইডেনের সঙ্গে সাক্ষাৎ হয় শেখ হাসিনার। এ সময় পাশে ছিলেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ও শেখ হাসিনার ছোট বোন শেখ রেহানা। বাইডেনের সঙ্গে এ সাক্ষাৎটিকে ইতিবাচকভাবেই দেখছেন বিশ্লেষকরা। তাদের মতে, শেখ হাসিনার ব্যাপারে দিল্লির ইতিবাচক অবস্থান ওয়াশিংটনকেও অবহিত করা হয়েছে। বাইডেন প্রশাসনকে জানানো হয়েছে, শেখ হাসিনা বাংলাদেশে গণতন্ত্রের স্বার্থে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন আয়োজনেও প্রতিজ্ঞাবদ্ধ।
এটা সবারই জানা, সদস্য না হয়েও ভারতের আমন্ত্রণে জি-২০ শীর্ষ সম্মেলনে অংশ নিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সেই সম্মেলনের মঞ্চ বাংলাদেশকে দিয়েছে বিশেষ গুরুত্ব ও মর্যাদা। সেইসঙ্গে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও বাংলাদেশ সরকারের মধ্যে কিছুদিন ধরে চলা টানাপোড়েন নিরসনেও বিশ্বের সর্ববৃহৎ অর্থনৈতিক জোটের এ সম্মেলন রেখেছে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। পাশাপাশি সাইডলাইনে সৌদি যুবরাজ, দক্ষিণ কোরিয়া, সংযুক্ত আরব আমিরাত ও আর্জেন্টিনার প্রেসিডেন্টের সঙ্গেও বৈঠক করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এ ছাড়া ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির উপস্থিতিতে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের সঙ্গেও কথা হয়েছে তার।
আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষকরা মনে করছেন, সার্বিকভাবে বললে এ সম্মেলনকে বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকারের জন্য ইতিবাচক হিসাবেই দেখা যায়। ব্রিকস ও জি-২০ সম্মেলনে বাংলাদেশকে আমন্ত্রণ জানানো এবং তাতে অংশগ্রহণের মাধ্যমে বিশ্বে বাংলাদেশের ভূ-কৌশলগত গুরুত্ব নতুন করে সামনে এসেছে। বৈশ্বিক নেতৃত্বও এটি অনুধাবন করছে। মানবাধিকার ও গণতন্ত্র নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের যেমন দৃষ্টি আছে; ঠিক তেমনি বাজার ও বাণিজ্যের দিকেও তাদের দৃষ্টি রয়েছে। সবদিক থেকেই বাংলাদেশের উত্থান ঘটেছে। একে বাংলাদেশ কীভাবে কাজে লাগাবে, সেটিই এখন দেখার বিষয়।
জি-২০ সম্মেলনে অংশগ্রহণ এবং সম্মেলনের আগে ভারতের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর দ্বিপক্ষীয় বৈঠক বাংলাদেশের জন্য একটি বড় কূটনৈতিক অর্জন। পাশাপাশি দুই প্রধানমন্ত্রী একান্তে কথা বলেছেন। তারা একান্তে কী কথা বলেছেন তা প্রকাশ্যে বলা হয়নি। তবে সেখানে যে ভূ-রাজনৈতিক ও দ্বিপক্ষীয় দিকগুলো নিয়েই আলোচনা হয়েছে, তা বোঝার জন্য বড় রাজনৈতিক পণ্ডিত হওয়ার দরকার পড়ে না। বর্তমান সময়ে বাংলাদেশসহ উন্নয়নশীল বিশ্বের অনেক দেশই পরাশক্তিগুলোর চাপের মধ্যে রয়েছে। অনেক কৌশলের সঙ্গে সেই চাপগুলোকে মোকাবিলা করতে হচ্ছে। এ জায়গায় বাংলাদেশ আরও বেশি দরকষাকষির সুযোগ পেয়েছে। কারণ, বাংলাদেশ শুধু জি-২০ সম্মেলনে অংশগ্রহণ বা ভারতের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় বৈঠকই করেনি, রাশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী সের্গেই লাভরভ বাংলাদেশ সফরে এসেছেন, ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট বাংলাদেশ সফরে এসেছেন। সব মিলিয়ে কূটনৈতিক এবং ভূ-রাজনৈতিক ক্ষেত্রে বাংলাদেশের ব্যাপক গুরুত্ব দেখা যাচ্ছে। এছাড়া ইন্দো-প্যাসিফিক নিয়ে বাংলাদেশ যা বলেছে, অন্যরাও সেই বিষয়গুলোকে গুরুত্ব দিচ্ছে।
জি-২০তে যোগ দেওয়ায় বাংলাদেশকে তিনটি সুবিধা দিতে পারে বলে মনে করা হচ্ছে। প্রথমত, এ সফর বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক জোরদার করবে। দ্বিতীয়ত, বাংলাদেশ গ্লোবাল সাউথের স্বার্থ প্রচার করবে। তৃতীয়ত, বাংলাদেশ আরও বেশি অংশীদারের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তুলে কূটনৈতিক পরিধিকে আরও প্রসারিত করতে পারে। এছাড়া ভবিষ্যতে বাংলাদেশ এ জোটের সদস্যও হতে পারে। কারণ, ঢাকা এরই মধ্যে গ্লোবাল সাউথ, জলবায়ু পরিবর্তন এবং নারী উন্নয়ন প্রকল্পের সমর্থনের জন্য খ্যাতি অর্জন করেছে। এসব বিষয় দেশটির ভাবমূর্তি বাড়িয়েছে।
এ সফর আগামী নির্বাচনেও ইতিবাচক প্রভাব রাখবে বলে মনে করার যথেষ্ট কারণ আছে। গত দুই বছর বিএনপির রাজপথের আন্দোলনে পরোক্ষভাবে হলেও সহায়তা করেছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা দেশগুলো। বিশেষ করে বাংলাদেশের নির্বাচন, গণতন্ত্র, সুশাসনসহ অভ্যন্তরীণ বিষয়ে সরকারের ওপর নানাভাবে চাপ দিতেও ছাড়েনি তারা। র্যাবের ওপর নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে, সুষ্ঠু নিরপেক্ষ নির্বাচনের পথে বাধা না দেওয়ার হুঁশিয়ারি দিয়ে ‘ভিসানীতি’ ঘোষণা করেছে। তবে নয়াদিল্লিতে শেখ হাসিনার সঙ্গে জো বাইডেনের সঙ্গে হাস্যোজ্জ্বল সেলফি ও আলাপচারিতা, যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী ঋষি সুনাকের হাঁটু গেড়ে আন্তরিক পরিবেশে কথা বলা-এসব ছবি ও খবর প্রকাশের পর ভিন্ন ইঙ্গিত পাচ্ছেন বিশ্লেষকরা। যদিও বিএনপির দাবি-এসব নিছকই আলোচনা। আন্তর্জাতিক মহল বাংলাদেশের সুষ্ঠু নির্বাচনের পক্ষে যে মত দিয়েছে; সেখান থেকে একচুলও নড়েনি। সরকারের উদ্দেশে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল বলেছেন, এত দেউলিয়া হয়ে গেছেন, বাইরের সঙ্গে একটা সেলফি তুলে এখন আপনি ঢোল পেটাচ্ছেন, হ্যাঁ, আমরা জিতে গেছি। জেতাবে তো বাংলাদেশের মানুষ ভোটের মাধ্যমে। সেই ভোট ঠিকমতো হওয়ার ব্যবস্থা করেন। তা না হলে কোনো বাইডেনই আপনাদের রক্ষা করতে পারবে না। সেলফি রক্ষা করতে পারবে না।
জি-২০-এর সদস্য না হওয়া সত্ত্বেও সম্মেলনে অংশ নেওয়া কিংবা দাওয়াত পাওয়া দেশের জন্য একটি বিশেষ কূটনৈতিক অর্জন এবং একে দেশের পররাষ্ট্রনীতির একটি বড় সফলতা বলা যায়। একবার আমেরিকার সঙ্গে বৈঠকে ফ্রান্সের প্রেসিডেন্টের স্ত্রী হ্যান্ডশেক করতে সামান্য দ্বিধা প্রকাশ করেছিলেন, তা নিয়ে আমেরিকার মিডিয়া অনেক হইচই করেছিল।
বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ নিয়ে ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করলে পাওয়া যাবে: ১. ২০৪০ সালের মধ্যে বাংলাদেশ বিশ্বের শীর্ষ ২০টি অর্থনীতির একটি দেশ হিসাবে আবির্ভূত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। এ তালিকায় বাংলাদেশের সঙ্গে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশ ইন্দোনেশিয়াও স্থান পেতে পারে। ফলে চীনের বিনিয়োগকারীদের জন্য বাংলাদেশ আকর্ষণীয় গন্তব্য হতে পারে। বাজারের আকার, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও বিভিন্ন খাতে সম্ভাবনা বিবেচনায় নিয়ে এমনটিই মনে করছে যুক্তরাজ্যের গবেষণা প্রতিষ্ঠান ইকোনমিস্ট ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (ইআইইউ)। এ ছাড়া বাংলাদেশের অর্থনীতির বড় সম্ভাবনার কথা জানিয়েছে যুক্তরাজ্যভিত্তিক সেন্টার ফর ইকোনমিকস অ্যান্ড বিজনেস রিসার্চ (সিইবিআর)। অর্থনৈতিক গবেষণা সংস্থাটি তাদের এক প্রতিবেদনে বলেছে, ২০৩৬ সালের মধ্যে বিশ্বের ২৪তম বড় অর্থনীতিতে পরিণত হবে বাংলাদেশ।
২. চীন যাতে কোনোভাবেই বাংলাদেশকে তাদের বলয়ে নিয়ে যেতে না পারে, সেজন্য হয়তো বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীকে চীনবিরোধী দেশগুলো অনেক বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে।
৩. রাশিয়া এবং ইউক্রেন যুদ্ধ চলছে। এ যুদ্ধকে কেন্দ্র করেও পৃথিবীতে নানান রকমের মেরুকরণ হচ্ছে। সুতরাং, এসব মেরুকরণের হিসাবে বাংলাদেশসহ আরও কিছু দেশকে পৃথিবীর বড় দেশগুলো বেশ গুরুত্বের চোখে দেখছে।
৪. যেহেতু বাংলাদেশের অর্থনীতি খুব দ্রুতগতিতে অগ্রসরমান এবং বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি গত ১০ বছরে ৭ শতাংশের বেশি হয়েছে, সে কারণে বিভিন্ন দেশ এখন বাংলাদেশের সঙ্গে বিভিন্ন রকমের বাণিজ্য চুক্তি করতে চায়। আমার এই কথার প্রমাণ হচ্ছে, ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট বাংলাদেশ সফর করেছেন এবং তিনি দশটি অ্যারোপ্লেন বিক্রির অর্ডার পেয়েছেন (সেলস্ রিপ্রেজেন্টেটিভ)। তার মানে বাংলাদেশের কাছে তারা তাদের জিনিসপত্র বিক্রি করতে চায়। বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-২ উৎক্ষেপণের ব্যাপারে বাংলাদেশ ফ্রান্সের সঙ্গে একটি দ্বিপাক্ষিক চুক্তিও স্বাক্ষর করেছে।
তবে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি আগামীতে কতটা উজ্জ্বল হবে অথবা নিম্নগামী হবে, তা নির্ভর করছে আগামী নির্বাচনের সুষ্ঠুতার ওপর। এই নির্বাচন গ্রহণযোগ্য হতে না পারলে অর্জনগুলো ম্লান হয়ে যাবে বলে ধারণা করা যায়।
মোনায়েম সরকার : রাজনীতিক, লেখক; মহাপরিচালক, বিএফডিআর