ভূমির ওপর ন্যায্য অধিকার নিশ্চিত হোক
ড. কুদরাত-ই-খুদা বাবু
প্রকাশ: ১৩ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
কৃষিপ্রধান বাংলাদেশে কৃষিই হচ্ছে জাতীয় আয়ের অন্যতম প্রধান উৎস। সুতরাং, এদেশে ভূমি সম্পদের গুরুত্ব অপরিসীম এবং গুরুত্বপূর্ণ এ সম্পদের ব্যবহার সঠিক পরিকল্পনার ওপর অনেকাংশে নির্ভরশীল। তাই একটি সুষ্ঠু পরিকল্পনা ও নীতির মাধ্যমে এ প্রাকৃতিক সম্পদের সুষ্ঠু ব্যবহার, তথা সীমিত ভূমির সর্বোত্তম ব্যবহার সুনিশ্চিত করা প্রয়োজন।
এরই ধারাবাহিকতায় এবং দেশে ভূমি আইনের অপরিসীম গুরুত্ব উপলব্ধি করে এবং ভূমি আইনসংক্রান্ত সমস্যা ও জটিলতা নিরসনকল্পে সরকার ‘ভূমি অপরাধ প্রতিরোধ ও প্রতিকার আইন ২০২৩’ পাস করতে যাচ্ছে। ৪ সেপ্টেম্বর সংসদে এ সংক্রান্ত একটি বিল তোলা হয়েছে। বিলটি পরীক্ষা করে সাত দিনের মধ্যে প্রতিবেদন দেওয়ার জন্য ভূমি মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটিতে পাঠানো হয়। মূলত তিনটি কারণে এ আইন করতে যাচ্ছে সরকার-ব্যক্তিমালিকানাধীন বা সরকারি খাসভূমিসহ সরকারি যে কোনো প্রতিষ্ঠান বা সংবিধিবদ্ধ সংস্থার মালিকানাধীন ভূমিতে প্রকৃত মালিকের মালিকানা ও দখল নিশ্চিত করা; জালিয়াতি করে তৈরি দলিল বা দলিল ছাড়া ভূমি দখল ঠেকানো এবং এ ধরনের অপরাধ করতে পেশিশক্তির ব্যবহার রোধ করা।
দেশে প্রচলিত নিয়ম অনুযায়ী দখলে থাকলেই মালিক নয়, বরং এক্ষেত্রে যথাযথভাবে থাকতে হবে জমির দলিলসহ জমির প্রয়োজনীয় দস্তাবেজ। অন্যের জমি নিজের দখলে রাখা, ভুয়া বা মিথ্যা দলিল তৈরি এবং নিজ মালিকানার বাইরে অন্য কোনো জমির অংশবিশেষ উল্লেখ করে দলিল হস্তান্তরের ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ সাত বছরের কারাদণ্ড ও অর্থদণ্ডের বিধান রেখে এ নতুন আইনটি করা হচ্ছে।
প্রস্তাবিত ওই বিলে বলা হয়েছে, ভূমি হস্তান্তর, জরিপ ও রেকর্ড হালনাগাদে অন্যের জমি নিজের নামে প্রচার, তথ্য গোপন করে কোনো ভূমির সম্পূর্ণ বা অংশবিশেষ কারও কাছে হস্তান্তর, ব্যক্তির পরিচয় গোপন করে জমি হস্তান্তর ও মিথ্যা বিবরণসংবলিত কোনো দলিলে সই-স্বাক্ষর করলে সর্বোচ্চ সাজা হবে সাত বছরের কারাদণ্ড ও অর্থদণ্ড। ওই বিলে আরও বলা হয়, কোনো দলিল সম্পাদিত হওয়ার পর আইনানুগ কর্তৃত্ব ছাড়া প্রতারণামূলকভাবে দলিলের কোনো অংশ কাটা বা পরিবর্তন করলে তার সাজাও হবে সর্বোচ্চ সাত বছরের কারাদণ্ড ও অর্থদণ্ড।
তাছাড়া সম্পূর্ণ বা আংশিকভাবে কোনো মিথ্যা দলিল প্রস্তুত করার সাজাও একই হবে। এছাড়া প্রতারণামূলকভাবে কোনো ব্যক্তিকে কোনো দলিলে সই বা পরিবর্তনে বাধ্য করার ক্ষেত্রেও সংশ্লিষ্ট অপরাধীকে একই সাজা ভোগ করতে হবে। সর্বশেষ খতিয়ান মালিক বা তার উত্তরাধিকার সূত্রে বা হস্তান্তর বা দখলের উদ্দেশ্যে আইনানুগভাবে সম্পাদিত দলিল বা আদালতের আদেশের মাধ্যমে কোনো মালিকানা বা দখলের অধিকারপ্রাপ্ত না হলে কোনো ব্যক্তি ওই ভূমি দখলে রাখতে পারবেন না বলেও ওই বিলে উল্লেখ করা হয়েছে। আর অবৈধ দখলের সাজা হবে সর্বোচ্চ দুই বছরের কারাদণ্ড ও অর্থদণ্ড। এছাড়া প্রস্তাবিত আইনে আদালতের বাইরে জমিসংক্রান্ত বিরোধ নিষ্পত্তির সুযোগ রাখা হয়েছে।
প্রস্তাবিত আইনের খসড়ায় বলা হয়েছে, কোনো ব্যক্তির নামে স্টেট অ্যাকুইজিশন অ্যান্ড টেন্যান্সি অ্যাক্টের (রাষ্ট্রীয় অধিগ্রহণ ও প্রজাস্বত্ব আইন-১৯৫০) অধীনে প্রণীত বা হালনাগাদকৃত বলবৎ সর্বশেষ খতিয়ান না থাকলে এবং খতিয়ান ও হালনাগাদ ভূমি উন্নয়ন কর পরিশোধের প্রমাণ দেখাতে ব্যর্থ হলে তিনি ওই জমি বিক্রি, দান বা হেবা বা অন্য কোনোভাবে হস্তান্তর, পাওয়ার অব অ্যাটর্নি (কোনো দায়িত্ব বা ক্ষমতা অর্পণের জন্য পাওয়ার অব অ্যাটর্নি বা আমমোক্তারনামা করতে হয়। তা হতে হবে লিখিত। এটি একটি আইনগত দলিল। যাকে মোক্তার নিয়োগ করা হয়, তিনি মূল মালিকের পক্ষে কোনো সম্পত্তির দান, বিক্রি, হস্তান্তর, রক্ষণাবেক্ষণ, বন্ধক রাখা, খাজনা ইত্যাদি কাজ করে থাকেন) সম্পাদন বা দলিল নিবন্ধন করতে পারবেন না। বিলে আরও বলা হয়েছে, কোনো ব্যক্তি জেলা প্রশাসকের অনুমতি ছাড়া আবাদযোগ্য জমির উপরি স্তর কাটলে তার সাজা হবে সর্বোচ্চ দুই বছরের কারাদণ্ড ও অর্থদণ্ড। বিলে উল্লেখ আছে, কোনো ব্যক্তি এ আইনে বর্ণিত কোনো অপরাধ সংঘটনে সহায়তা ও প্ররোচনা দিলে মূল অপরাধীর সমান দণ্ডে দণ্ডিত হবেন।
নতুন এ ভূমি আইনের মূল উদ্দেশ্য ও কারণ হচ্ছে-ভূমির স্বত্ব সংরক্ষণ ও শান্তিপূর্ণ ভোগদখল বজায় রাখার লক্ষ্যে ভূমিসংক্রান্ত অপরাধ এবং এর দ্রুত প্রতিকার নিশ্চিত করা। তাছাড়া নাগরিকদের নিজ নিজ মালিকানাধীন ভূমিতে নিরবচ্ছিন্ন ভোগদখল অধিকার নিশ্চিত করা, ভূমিবিষয়ক প্রতারণা ও জালিয়াতির ক্ষেত্রগুলো চিহ্নিত ও প্রতিরোধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ, ভূমিসংক্রান্ত কিছু অপরাধের দ্রুত প্রতিকারের ব্যবস্থার লক্ষ্যে এ আইন প্রণয়নের উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়। ভূমি থেকে বেআইনি দখল, স্থাপনা বা প্রতিবন্ধকতা বা প্রযোজ্য ক্ষেত্রে অবৈধভাবে ভরাটকৃত মাটি, বালু, ইত্যাদি অপসারণ করতে এবং ওই ভূমিকে এর আগের শ্রেণি বা প্রকৃতিতে পুনরুদ্ধারের উদ্দেশ্যে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য বিধি প্রণয়নের ক্ষমতা এখানে সন্নিবেশ করা হয়েছে। তাছাড়া ভূমিসংক্রান্ত মামলা নিষ্পত্তিতে দীর্ঘসূত্রতা দূরীকরণ এবং যথাসময়ে জনগণের বিচারপ্রাপ্তি নিশ্চিত করার লক্ষ্যে সংশ্লিষ্ট সব মন্ত্রণালয় ও বিভাগ এবং মাঠ পর্যায়ের মতামত গ্রহণসহ অংশীজনের মতামত গ্রহণ করে প্রয়োজনীয় সংশোধন ও পরিমার্জনক্রমে প্রস্তাবিত আইনটি প্রণয়ন করা হয়েছে। পাশাপাশি ব্যক্তিমালিকানাধীন কৃষিজমি থেকে বালু বা মাটি উত্তোলন করা যাবে না, এমন বিধান রেখে ‘বালু মহাল ও মাটি ব্যবস্থাপনা’ আইনেরও সংশোধন করা হচ্ছে। বিদ্যমান আইনে কৃষিজমি থেকে বালু বা মাটি তোলা সম্পর্কিত কোনো বিধিনিষেধ ছিল না। বিলে বলা হয়েছে, কোনো ব্যক্তিমালিকানাধীন জমি থেকে বালু বা মাটি তোলা যাবে না, যদি তা উর্বর কৃষিজমি হয় বা বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে হয়, বা কৃষিজমির উর্বর উপরিভাগের মাটি হলে বা পরিবেশ-প্রতিবেশ বা জীববৈচিত্র্যের ক্ষতি হয় বা ড্রেজারের মাধ্যমে বা যদি অন্য কোনো কৌশলী প্রক্রিয়ায় বালু বা মাটি উত্তোলন করা হয়, যাতে এ জমিসহ পার্শ্বশ্বর্তী অন্য জমির ক্ষতি, চ্যুতি বা ধসের উদ্ভব হয়। পাশাপাশি ১৯৮৪ সালের ল্যান্ড রিফর্মস অর্ডিন্যান্স রহিত করে ভূমি সংস্কার আইন করা হচ্ছে। আইনে আরও বলা হয়েছে, ৬০ প্রমিত বিঘার বেশি কৃষি ভূমির মালিক বা তার পরিবার হস্তান্তর, উত্তরাধিকার, দান বা অন্য কোনো উপায়ে নতুন কোনো কৃষি ভূমি অর্জন করতে পারবে না। তবে আটটি ক্ষেত্রে এটি শিথিল থাকবে।
ভূমিসংক্রান্ত নতুন এ আইনটি পাশ ও কার্যকর হলে জনগণ যেমন একদিকে জমি নিয়ে দীর্ঘদিনের সমস্যা, হয়রানি ও ঝামেলা থেকে সহজেই পরিত্রাণ পাবে, তেমনি ভূমিবিষয়ক নিত্যনতুন গবেষণা ও উচ্চশিক্ষার দ্বারও উন্মোচন হতে পারে। যেমন-বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভূমি আইনসংক্রান্ত বিভাগ চালু করা হলে অনার্স ও মাস্টার্স ডিগ্রি অর্জন করার পর শিক্ষার্থীরা আদালতে সংশ্লিষ্ট বিষয়ে প্র্যাকটিস করার পাশাপাশি দেশের ভূমি উন্নয়নের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখতে পারবেন। একইসঙ্গে তারা ভূমি রেকর্ড ও জরিপ অধিদপ্তর, ভূমি সংস্কার বোর্ড, ভূমি আপিল বোর্ড, ভূমি প্রশাসন প্রশিক্ষণ কেন্দ্র এবং হিসাব নিয়ন্ত্রক (রাজস্ব) দপ্তরসহ বিভিন্ন জায়গায় দক্ষতার সঙ্গে কাজ করতে সক্ষম হবেন। পাশাপাশি বিভাগীয় পর্যায়ে কমিশনার, জেলা পর্যায়ে কালেক্টর (জেলা প্রশাসক), উপজেলা পর্যায়ে সহকারী কমিশনার (ভূমি), ইউনিয়ন পর্যায়ে ইউনিয়ন ভূমি সহকারী কর্মকর্তা (তহশিলদাররা) ভূমিসংক্রান্ত কার্যাদি সম্পাদনের লক্ষ্যে নিজেদের নিয়োজিত রাখতে পারবেন। ভূমি উন্নয়ন কর ও রাজস্ব আদায়, খাসজমি ব্যবস্থাপনা ও বন্দোবস্ত, জলমহাল ব্যবস্থাপনা, ভূমি অধিগ্রহণ ও হুকুম দখল, ভূমি রেকর্ড ও জরিপকরণ এবং ভূমিসংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা/কর্মচারীদের প্রশিক্ষণ প্রদানেও ওই বিভাগ থেকে পাশ করা শিক্ষার্থীরা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে সক্ষম হবেন। তাছাড়া ব্যাংকের মাধ্যমে ভূমি উন্নয়ন কর আদায়, জনস্বার্থে ভূমি আইন ও বিধি প্রণয়ন ইত্যাদি সংস্কারমূলক কার্যক্রম এবং ভূমিহীন ছিন্নমূল জনগোষ্ঠীর পুনর্বাসন, ভূমি জোনিং কার্যক্রম, চর ডেলেপমেন্ট অ্যান্ড সেটেলমেন্ট প্রকল্পের আওতায় ভূমিহীনদের মধ্যে খাসজমি বন্দোবস্ত প্রদান, উপজেলা ও ইউনিয়ন ভূমি অফিস নির্মাণ ও মেরামত, ভূমি রেকর্ড আধুনিকীকরণ তথা জনসাধারণকে স্বল্পতম সময়ে ভূমিসংক্রান্ত সেবা প্রদান ইত্যাদি উন্নয়নমূলক কার্যাদি পালন করা সম্ভব হবে। সর্বোপরি, প্রস্তাবিত বিলটি আইনে পরিণত হলে ভূমিসংক্রান্ত জটিলতা ও মামলার দ্রুত নিষ্পত্তি হবে এবং এর ফলে জনগণ উপকৃত হবেন বলে আশা করা যায়।
ড. কুদরাত-ই-খুদা বাবু : অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান, আইন বিভাগ, ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি
kekbabu@yahoo.com