Logo
Logo
×

বাতায়ন

স্বদেশ ভাবনা

পাটের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করতে হবে

Icon

আবদুল লতিফ মন্ডল

প্রকাশ: ০৬ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

পাটের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করতে হবে

পাটচাষিরা পাটের ন্যায্যমূল্য পাচ্ছেন না মর্মে সম্প্রতি পত্রপত্রিকায় খবর প্রকাশিত হয়েছে। ২৮ আগস্ট যুগান্তরে প্রকাশিত এক খবরে বলা হয়েছে, পাটের ন্যায্যমূল্য নিয়ে চাষিরা দিশেহারা হয়ে পড়েছেন।

মৌসুমের শুরুতে দামে তেজিভাব থাকলেও অল্পদিনের ব্যবধানে দরপতনে কৃষক হতবাক। পানির দরে পাট বিক্রি করতে তারা বাধ্য হচ্ছেন। তাদের কপালে দুশ্চিন্তার ভাঁজ পড়েছে। অপরদিকে, এমন পরিস্থিতিতে মধ্যস্বত্বভোগী পাইকার ও ব্যবসায়ীদের পোয়াবারো অবস্থা। সুযোগ কাজে লাগিয়ে তারা পাট মজুতের মহোৎসবে মেতেছেন।

অন্য একটি (বণিক বার্তা, ২ সেপ্টেম্বর) পত্রিকার খবরে বলা হয়েছে, গত বছর এক মন পাট বিক্রি হয়েছে ২ হাজার ৮০০ থেকে ৩ হাজার টাকায়, এ বছর তা বিক্রি হচ্ছে ১ হাজার ৮০০ থেকে ১ হাজার ৯০০ টাকায়। অর্থাৎ গতবারের তুলনায় মনপ্রতি দাম কমেছে ১০০০ থেকে ১১০০ টাকা। এতে বাজারে পাট বিক্রি করে চাষিরা আর্থিকভাবে ক্ষতির মুখে পড়েছেন। এমন আর্থিক ক্ষতি কৃষককে পাটচাষে অনাগ্রহী করে তুলতে পারে। পাটচাষিরা তাদের কষ্টার্জিত পণ্য বিক্রি করে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার কারণ এবং এ অবস্থা থেকে উত্তরণের উপায় আলোচনা করাই এ নিবন্ধের উদ্দেশ্য।

বর্তমানে যে ভৌগোলিক এলাকা নিয়ে বাংলাদেশ গঠিত, সেখানে প্রাচীনকাল থেকেই পাটের চাষ হয়ে আসছে। বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা পরিষদ এবং বাংলাদেশ একাডেমি অব অ্যাগ্রিকালচার কর্তৃক যৌথভাবে সম্পাদিত ‘Agricultural Research in Bangladesh in the 20th century’ শীর্ষক গ্রন্থ অনুযায়ী, প্রাচীনকাল থেকে বাংলাদেশে পাটের চাষ হলেও ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রথমদিকে পাটচাষের বিস্তার শুরু হয়। ১৮৪০ সালে শুরু হয় ব্যাপকভাবে পাট উৎপাদন। যেসব অঞ্চলে পাটচাষ দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে সেগুলো হলো-রংপুর, ময়মনসিংহ, পাবনা, বগুড়া, ফরিদপুর, বাকেরগঞ্জ ও নোয়াখালী। বর্তমানে দেশের সব জেলাতেই কমবেশি পাট উৎপাদিত হয়ে থাকে। পাটচাষ, পাটজাতসামগ্রী তৈরি, পাট ও পাটজাত পণ্যাদির ব্যবসা-বাণিজ্য বহুকাল ধরে এ দেশের বিভিন্ন স্তরের মানুষের জীবিকা নির্বাহে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে।

স্থানীয় বাজারে পাট বিক্রি করে পাটচাষিদের উচ্চমূল্য না পাওয়ার জন্য কারণগুলোর মধ্যে রয়েছে-

এক. পাটচাষে ব্যয় বৃদ্ধি : পাটের ভালো ফলন পেতে জমিতে ব্যবহৃত রাসায়নিক সারের দাম এবং কৃষিশ্রমিকের মজুরি বৃদ্ধি পাওয়ায় পাটচাষ ব্যয়বহুল হয়ে পড়েছে। পাটের ভালো ফলন পেতে জমিতে যেসব রাসায়নিক সার ব্যবহার করতে হয় সেগুলো হলো ইউরিয়া, ফসফরাস ও পটাশ। গত অর্থবছরের আগস্টে সরকার ইউরিয়া সারের দাম কৃষক পর্যায়ে কেজিপ্রতি ৬ টাকা বাড়িয়ে ২২ টাকায় এবং পরে এপ্রিলে আরও ৫ টাকা বাড়িয়ে ২৭ টাকায় নির্ধারণ করে দেয়। বৃদ্ধি পায় পটাশ ও ফসফরাসের দাম। অন্যদিকে গ্রামাঞ্চলে সার্ভিস সেক্টরের প্রসারে কৃষিশ্রমিকের সরবরাহ ক্রমান্বয়ে হ্রাস পাচ্ছে। ফলে বাড়ছে তাদের মজুরি। এসব কারণে গত বছরের তুলনায় এ বছর পাটচাষে খরচ প্রায় দেড়গুণ বেড়ে গেছে।

দুই. পাট উৎপাদনে ধারাবাহিকতার অভাব এবং নিম্ন উৎপাদনশীলতা : এটা ঠিক, দেশে পাট উৎপাদনের পরিমাণ বেড়েছে। বাংলাদেশে পাট গবেষণা ইনস্টিটিউটের (বিজেআরআই) তথ্য অনুযায়ী, ২০০৫-০৬ অর্থবছরে ৪.২ লাখ হেক্টর জমিতে পাটচাষ হয় এবং উৎপাদনের পরিমাণ দাঁড়ায় ৮.৩৮ লাখ টনে। ২০১০-১১ ও ২০১৫-১৬ অর্থবছরে যথাক্রমে ৭.০৮ ও ৭.২৫ লাখ হেক্টর জমিতে পাটচাষ হয় এবং উৎপাদিত পাটের পরিমাণ ছিল যথাক্রমে ১৫.২৬ ও ১৩.৭৪ লাখ টন। অন্য এক সূত্রে জানা যায়, ২০২১-২২ অর্থবছরে ৭.৪৫ লাখ হেক্টর জমিতে ১৫.০২ লাখ টন পাট উৎপাদিত হয়। বিজেআরআই’র তথ্য মোতাবেক ২০০৫-০৬, ২০১০-১১ ও ২০১৫-১৬ অর্থবছরে হেক্টরপ্রতি পাট উৎপাদন দাঁড়ায় যথাক্রমে ২.০৮, ২.১৫ ও ১.৯০ টনে। এর অর্থ হলো, পাট উৎপাদনে ধারাবাহিকতার অভাব। আরেক সূত্রে জানা যায়, চীনে ১ একর জমিতে ১.১৫ টন পাটের ফলনের বিপরীতে বাংলাদেশে এক একর জমিতে পাটের ফলন ০.৬৮ টন। ভারতেও একর বা হেক্টরপ্রতি পাট উৎপাদন বাংলাদেশের চেয়ে বেশি। উদাহরণস্বরূপ, বাংলাদেশে ২০২১-২২ অর্থবছরে ৭.৪৫ লাখ হেক্টর জমিতে যখন ১৫.০২ লাখ টন পাট উৎপাদিত হয়, তখন ভারতে ৬.৪০ লাখ হেক্টর জমিতে ১৭.৩৫ লাখ টন পাট উৎপাদিত হয়। পাট উৎপাদনে ধারাবাহিকতার অভাব এবং নিম্ন উৎপাদনশীলতার কারণে কৃষক পর্যায়ে পাটচাষ লাভজনক হচ্ছে না।

তিন. ২৫টি রাষ্ট্রায়ত্ত পাটকল বন্ধ ঘোষণায় দেশে কাঁচাপাটের চাহিদা হ্রাস : মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে পশ্চিম পাকিস্তানি মালিকদের ছেড়ে যাওয়া রাষ্ট্রীয়করণকৃত ৮২টি পাটকল নিয়ে স্বাধীনতার পরপর গঠিত হয় বাংলাদেশ জুট মিলস করপোরেশন (বিজেএমসি)। ব্যবসা-বাণিজ্যে অনভিজ্ঞ সরকারি কর্মকর্তাদের এসব পাটকলের ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব প্রদান, দুর্নীতি, মধ্যস্বত্বভোগী শ্রেণির উদ্ভব এবং শ্রমিক অসন্তোষের কারণে এ খাতে বিপর্যয় দেখা দেয়।

১৯৭৫-পরবর্তী সরকার বিজেএমসির আওতাধীন এসব পাটকলের বিরাষ্ট্রীয়করণ শুরু করে, যা পরবর্তী সময়ে অব্যাহত থাকে। ২০২০ সালের মাঝামাঝি পর্যন্ত বিজেএমসির নিয়ন্ত্রণাধীন রাষ্ট্রায়ত্ত পাটকলের সংখ্যা দাঁড়ায় ২৬-এ, যার মধ্যে চালু ছিল ২৫টি। পাটকলগুলো ক্রমাগত লোকসান দিচ্ছে এই যুক্তিতে ২০২০ সালের ১ জুলাই থেকে সরকার এগুলো বন্ধ ঘোষণা করে। তবে পাটকলগুলো বন্ধ ঘোষণার আগে সরকার পাবলিক প্রাইভেট পার্টনারশিপের (পিপিপির) মাধ্যমে সেগুলো চালু রাখার কথা বলে। পরে সরকার এ অবস্থান থেকে সরে গিয়ে বেসরকারি প্রতিষ্ঠান বা কোম্পানির কাছে লিজ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। প্রাপ্ত তথ্যে জানা যায়, সরকারি নিয়ন্ত্রণে থাকা পাটকলগুলোর মধ্য থেকে ১৭টি পাটকল লিজ দেওয়ার জন্য আগ্রহীদের কাছ থেকে দরপত্র আহ্বান করে বিজেএমসি। ১৪টি পাটকলের জন্য ৫১টি দরপত্র পড়েছে, যেগুলো পাট ও বস্ত্র মন্ত্রণালয়ে প্রক্রিয়াধীন আছে। বন্ধ ঘোষণার আগে বিজেএমসির আওতাধীন পাটকলগুলোতে হেসিয়ান, স্যাকিং, কার্পেট ব্যাকিং, ক্লথ, উন্নতমানের রপ্তানিযোগ্য পাটের সুতা, জিওজুট, কটন ব্যাগ, নার্সারি পট, ফাইল কভার ইত্যাদি উৎপাদিত হতো।

বাংলাদেশ অর্থনৈতিক সমীক্ষা ২০২০-এর তথ্য মোতাবেক, বিজেএমসির নিয়ন্ত্রণাধীন পাটকলগুলোতে ২০১৮-১৯ অর্থবছরে পাটজাত পণ্যের উৎপাদন ছিল ৭২,০১০ টন। এসব পাটকল পাটজাত পণ্য উৎপাদনে না থাকায় এবং শুধু বেসরকারি খাতের পাটকলগুলোয় কাঁচা পাটের চাহিদা থাকায় কাঁচা পাটের চাহিদা কমে গেছে, যা স্থানীয় বাজারে কাঁচা পাটের মূল্য হ্রাসে ভূমিকা রেখেছে।

চার. দেশের পাটপণ্যের ওপর ভারতের অ্যান্টি-ডাম্পিং শুল্ক আরোপ : ২০১৭ সালে ভারত সরকার বাংলাদেশের পাটপণ্য রপ্তানির ওপর প্রতি টনে ১৯ থেকে ৩৫২ ডলার পর্যন্ত অ্যান্টি-ডাম্পিং শুল্কারোপ করে। বাংলাদেশের কোনো প্রতিষ্ঠানকে ভারতে পাটের সুতা, চট ও বস্তা রপ্তানি করতে এ হারে শুল্ক পরিশোধ করতে হচ্ছে। আগে এ পণ্যগুলোর মোট মূল্যের ওপর ৪ শতাংশ শুল্কারোপ ছিল। এর সঙ্গে অ্যান্টি-ডাম্পিং শুল্ক যোগ করায় ভারতে এসব পণ্যের রপ্তানি বহুলাংশে কমে গেছে। বাংলাদেশ জুট স্পিনার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিজেএসএ) ভাইস-চেয়ার ও গোল্ডেন জুট ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. মৃধা মনিরুজ্জামান মনির বলেছেন, অ্যান্টি-ডাম্পিং শুল্কের কারণে ভারতে বাংলাদেশের রপ্তানি ক্রমান্বয়ে কমছে।

একই দেশের পণ্য আমদানির ক্ষেত্রে দুই ধরনের নীতি থাকতে পারে না। ফিনিশ্ড গুডসে অ্যান্টি-ডাম্পিং ডিউটি দেওয়ায় ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছি; কিন্তু নিজেদের মিলগুলোর জন্য তারা র’জুট নিয়ে যাচ্ছে। আমরা সরকারের কাছে দাবি জানিয়েছি, অ্যান্টি-ডাম্পিং তুলে দেওয়া হোক অথবা র’জুট আমদানির ওপর কর বাড়ানো হোক। প্রাপ্ত তথ্যে দেখা যায়, পাটপণ্যের ওপর আরোপিত অ্যান্টি ডাম্পিং শুল্ক প্রত্যাহারের জন্য বাংলাদেশ সরকারের অনুরোধে সাড়া না দিয়ে ভারত সরকার এ শুল্কারোপের সময়কাল ৩০ ডিসেম্বর ২০২২ থেকে পাঁচ বছর বাড়িয়েছে।

পাঁচ. স্থানীয় পর্যায়ে কাঁচাপাট ক্রয়ে সিন্ডিকেশন : বিজেএমসির নিয়ন্ত্রণাধীন পাটকলগুলো বন্ধ ঘোষণার আগে সরকারি-বেসরকারি খাতে প্রতিযোগিতার মাধ্যমে স্থানীয় পর্যায়ে পাট কেনা হতো। এক তথ্যে জানা যায়, বিজেএমসির নিয়ন্ত্রণাধীন পাটকলগুলোতে ব্যবহারের জন্য ১৮২টি কেন্দ্রের মাধ্যমে পাট কেনা হতো। বিজেএমসি ২০১৯-২০ অর্থবছরে কৃষকের কাছ থেকে সরাসরি সর্বমোট ৬১,২২৩ টন কাঁচা পাট ক্রয় করে। এখন বিজেএমসি বাজারে না থাকায় শুধু বেসরকারি পাটকলগুলো বাজার থেকে পাট কিনছে। এসব পাটকলে পাট সরবরাহকারী মধ্যস্বত্বভোগী পাইকার ও ব্যবসায়ীরা স্থানীয় পর্যায়ে সিন্ডিকেশনের মাধ্যমে পাটচাষিদের কাছ থেকে কম দামে পাট কিনছে বলে মিডিয়ায় অভিযোগ উঠেছে।

ছয়. রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাব : ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের কারণে বাংলাদেশ থেকে পাট ও পাটজাত পণ্য রপ্তানিতে ভাটা পড়েছে। দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডের ৬ এপ্রিলের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে বাংলাদেশের পাট ও পাটজাত পণ্যের রপ্তানি ২১.২৩ শতাংশ হ্রাস পেয়েছে। এর ফলে মিলগুলোতে পাটের চাহিদা কিছুটা কমেছে, যা স্থানীয় পর্যায়ে পাটের দাম হ্রাসে ভূমিকা রেখেছে।

কৃষক পর্যায়ে পাটের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিতে স্বল্পমেয়াদি ও দীর্ঘমেয়াদি ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। স্বল্পমেয়াদি ব্যবস্থাগুলোর মধ্যে রয়েছে-ক. কৃষক পর্যায়ে পাটচাষে ব্যয় হ্রাসে সরকার থেকে যথোপযুক্ত প্রণোদনা প্রদান। খ. বন্ধ ঘোষিত সরকারি পাটকলগুলোর লিজ প্রদান ত্বরান্বিতকরণ। এসব পাটকল উৎপাদনে গেলে পাটের চাহিদা বেড়ে যাবে, যা কৃষক পর্যায়ে পাটের দাম বৃদ্ধিতে সহায়ক হবে। গ. স্থানীয় বাজার পর্যায়ে বিভিন্ন মানের কাঁচা পাটের দাম সরকার কর্তৃক এমনভাবে নির্ধারণ করে দিতে হবে, যাতে উৎপাদন ব্যয় মেটানোর পরও পাটচাষিরা লাভবান হন। দীর্ঘমেয়াদি ব্যবস্থা হিসাবে পাটের একর বা হেক্টরপ্রতি উৎপাদনশীলতা বাড়াতে প্রয়োজনীয় সব ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। পাটের উৎপাদনশীলতা বাড়ানো গেলে উৎপাদন ব্যয় কমবে।

আবদুল লতিফ মন্ডল : সাবেক সচিব, কলাম লেখক

latifm43@gmail.com

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : সাইফুল আলম

প্রকাশক : সালমা ইসলাম