Logo
Logo
×

বাতায়ন

এ খামখেয়ালিপনার দায় কার?

Icon

বিমল সরকার

প্রকাশ: ০৪ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

এ খামখেয়ালিপনার দায় কার?

এসএসসি ও এইচএসসির মতো পাবলিক পরীক্ষার ফল প্রকাশ হলে আনন্দ আর বেদনার অনেক খবরই জানা যায়। এ আনন্দ-বেদনার খবরাদি কেবল পরীক্ষার্থী কিংবা শিক্ষার্থীদের ঘিরেই নয়, একই সঙ্গে পরীক্ষার দায়িত্বে থাকা শিক্ষক এবং আমাদের শিক্ষাব্যবস্থাকে ঘিরেও। প্রশ্ন দেখা দেয় আস্থা আর বিশ্বাস নিয়েও। পাশ-ফেল, ‘এ’ প্লাস পাওয়া আর না পাওয়া, অনুপস্থিত ও বহিষ্কার, ফলাফলে গড়মিল-এমন অনেক কিছু। কখনো কখনো প্রচলিত ব্যবস্থার অন্তঃসারশূন্যতাও প্রকাশ হয়ে পড়ে।

সংশয়-সন্দেহ ও অবিশ্বাস গুরুতর এক ব্যাধি। আর কর্তব্য-কর্মে অবহেলা অপরাধের শামিল। করোনা মহামারির উদ্দাম নৃত্য ও ভয়ালরূপ বিশ্বের মানুষ প্রত্যক্ষ করেছে। চরম উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা আর আতঙ্ক-অনিশ্চয়তার মধ্য দিয়ে বছর, মাস, সপ্তাহ ও দিনক্ষণ অতিবাহিত করেছি আমরা। একেকজনের কী দুঃসহ জীবন! কী বেদনাদায়ক অভিজ্ঞতা! অনেক ত্যাগ-ধৈর্য ও সংগ্রামের মাধ্যমে করোনাকে আমরা বলতে গেলে পরাস্ত করতে পেরেছি। সেসব দিনের কথা মনে হলে আজও গা শিউড়ে ওঠে।

করোনা দূর হয়েছে বটে; কিন্তু রেখে গেছে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, অর্থনীতি সবক্ষেত্রে তার বিষময় স্মৃতিচিহ্ন। স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়সহ সব ধরনের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ। অফিস-আদালত, কল-কারখানা বন্ধ। জীবনই বলতে গেলে স্থবির। সেই অনিশ্চয়তা থেকে আবার সোজা হয়ে দাঁড়ানো, কম কথা নয়। বেশ কিছুদিন তো গত হলো। দেশে সার্বিকভাবে করোনা মহামারির ধকলটি কি এই এক-দেড় বছরে আমরা কাটিয়ে উঠতে পেরেছি? অথচ হারানো সবকিছু পুনরুদ্ধারে আমাদের সবার আন্তরিকভাবে ঝাঁপিয়ে পড়ার কথা ছিল।

পাবলিক পরীক্ষা তথা আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায় এ এক অস্বস্তিকর রূপ! দেশের ১১টি শিক্ষা বোর্ডের অধীনে অনুষ্ঠিত ২০২৩ সালের এসএসসি ও সমমানের পরীক্ষার ফল প্রকাশিত হয় ২৮ জুলাই (২০২৩)। আশানুরূপ ফল বা গ্রেড না পাওয়ায় ২৯ জুলাই থেকে ৪ আগস্ট ২০২৩ পর্যন্ত পরীক্ষার্থীদের কাছ থেকে অনলাইনে খাতা পুনর্নিরীক্ষণের আবেদন গ্রহণ করা হয়। উল্লিখিত সময়ে বোর্ডগুলো দুই লাখের মতো পরীক্ষার্থী খাতা পুনর্নিরীক্ষণের জন্য আবেদন করে (জানা যায়, ভুক্তভোগী আবেদনকারীদের মধ্যে কেবল ঢাকা বোর্ডেরই রয়েছে ৭৩ হাজার)। এ বিষয়টি খুবই লক্ষণীয় যে, শিক্ষাক্ষেত্রে দিনে দিনে আস্থা ও বিশ্বাসের মাত্রাটি কমতে কমতে কোথায় গিয়ে ঠেকেছে। ২০ লাখ ৭২ হাজার পরীক্ষার্থীর মধ্যে পাশ করেছে ১৬ লাখ ৪১ হাজার। তাদের মধ্যে ফলাফলে অসন্তুষ্ট হয়ে ২ লাখই পুনর্নিরীক্ষণের জন্য আবেদন করেছে! পুনর্নিরীক্ষণের ফল প্রকাশের পর শিক্ষার্থীদের সংশয়-সন্দেহের বিষয়টির অনেকখানি প্রমাণিতও হলো। আমরা জানি না এ ব্যাপারে পরীক্ষক ও নিরীক্ষকসহ সংশ্লিষ্ট শিক্ষক এবং কর্তৃপক্ষের উপলব্ধি কী।

গত ২৮ আগস্ট প্রকাশিত পুনর্নিরীক্ষণের ফলাফলে দেখা যায়, ১১টি বোর্ডে ফেল থেকে পাশ করেছে মোট ২ হাজার ২৮৬ শিক্ষার্থী। তাদের মধ্যে (ফেল থেকে) ছয়জন সর্বোচ্চ জিপিএ-৫ অর্জন করেছে। শুধু তাই নয়, পুনর্নিরীক্ষণে ফল পরিবর্তিত হওয়া শিক্ষার্থীদের মধ্যে নতুন করে মোট ১ হাজার ৬২৮ জন ‘এ’ প্লাসও পেয়েছে। ১১টি বোর্ডের মধ্যে আগের গ্রেড থেকে উন্নীত হয়ে ঢাকা বোর্ডে নতুন করে ‘এ’ প্লাস পায় ৩৬২ এবং চট্টগ্রাম বোর্ডে ১৬২ জন। এছাড়া কুমিল্লায় ৯৬, যশোরে ৫২, ময়মনসিংহে ১৫১, দিনাজপুরে ৭৩, রাজশাহীতে ৫৯, সিলেটে ৪৯ এবং বরিশাল বোর্ডে ২৯ শিক্ষার্থী (কারিগরি বোর্ডের পরিসংখ্যান জানা যায়নি)।

ফেল করার পর খাতা পুনর্নিরীক্ষণে পাশ করা বা জিপিএ-৫ পাওয়ায় স্বাভাবিকভাবেই খুশি হয়েছে শিক্ষার্থীরা। একই সঙ্গে খুশি ওদের অভিভাবকরাও; কিন্তু তারা এহেন খামখেয়ালিপনার জন্য দোষারোপ করছেন পরীক্ষক ও নিরীক্ষকের দায়িত্বে থাকা শিক্ষকদের ওপর। তারা বলছেন, উত্তরপত্র নিরীক্ষকদের দায়িত্ব অবহেলায় প্রথমে খারাপ করা এসব শিক্ষার্থীকে একটি মাস প্রচণ্ড মানসিক যন্ত্রণায় ভুগতে হয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে শিক্ষা বোর্ডগুলো বলছে, পরীক্ষক-নিরীক্ষকদের সতর্ক করার পরও এমনটা হচ্ছে, আগামী দিনে তাদের পরীক্ষার দায়িত্ব থেকে বাদ দেওয়া হবে। দোষী শিক্ষকরা আর সুযোগ পাবেন না।

পরীক্ষার খাতা পুনর্মূল্যায়ন ও পুনর্নিরীক্ষণ এক বিষয় নয়। ফল প্রকাশের পর আশাহত পরীক্ষার্থীর আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে যা করা হয় তা পুনর্নিরীক্ষণ, পুনর্মূল্যায়ন নয়। পুনর্নিরীক্ষণ মানে খাতায় প্রদত্ত নম্বরের যোগ-বিয়োগের হিসাব। পরীক্ষক প্রদত্ত নম্বরে কোনো গড়মিল আছে কি না, তা যাচাই করে দেখেন নিরীক্ষক। কিন্তু খাতা মূল্যায়নে ‘এক পরীক্ষক ব্যবস্থায়’ ফলাফলে পরীক্ষার্থীরা অসন্তুষ্ট হলেও দ্বিতীয়বার মূল্যায়নের কোনো সুযোগ নেই। পরীক্ষার ফলাফল প্রণয়নে নিরীক্ষার অবশ্যই গুরুত্ব রয়েছে। তার চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে খাতা মূল্যায়ন। খাতা মূল্যায়নে নিয়োজিত পরীক্ষকের ওপর থাকেন একজন প্রধান পরীক্ষক। এ পরীক্ষক ও প্রধান পরীক্ষক কর্তব্যকর্মে অবহেলা বা নীতি-দায়িত্বহীনতার পরিচয় দিলে এর প্রতিকার কী?

শুধু নিরীক্ষণে কেন, খাতা মূল্যায়নে পরীক্ষক বা প্রধান পরীক্ষকের ত্রুটি-বিচ্যুতি থাকতে পারে না? এসবকিছু নিয়ে সবাইকে নতুন করে ভাবতে হবে। তা না হলে যেভাবে কিশোর-কিশোরী ও তরুণ-তরুণী শিক্ষার্থীরা খাতা পুনর্নিরীক্ষণের দিকে ঝুঁকছে, তা অব্যাহত থাকলে অদূর ভবিষ্যতে বোধকরি কেবল লাখ লাখ নয়, এক-চতুর্থাংশ কিংবা অর্ধেকসংখ্যক পরীক্ষার্থীকেই সংশয়-সন্দেহ গ্রাস করে বসবে। পরীক্ষার্থীদের এরূপ পৌনঃপুনিক উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার অবসান চাই। পরীক্ষা নিয়ে সবার মাঝে আস্থা ও বিশ্বাস ফিরিয়ে আনা চাই।

বিমল সরকার : অবসরপ্রাপ্ত কলেজ শিক্ষক; কলাম লেখক

 

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : সাইফুল আলম

প্রকাশক : সালমা ইসলাম