মিঠে কড়া সংলাপ
সরকারি অফিসের জনভোগান্তি দূর হবে কবে?
ড. মুহাম্মদ ইসমাইল হোসেন
প্রকাশ: ০২ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
দিনের পর দিন সরকারের বিভিন্ন দপ্তর-অধিদপ্তরে জনভোগান্তি যে বেড়েই চলেছে, সে কথাটি বোধহয় এখন আর কেউ অস্বীকার করতে পারবেন না। কারণ, প্রায় প্রতিটি সরকারি দপ্তরই এখন স্বার্থান্বেষী মহলের একেকটি আস্তানা। একশ্রেণির আমলা-কর্মচারীর ঘুসের টাকায় পকেট ভরা, তথা পেট মোটা করা এখন একটি অত্যন্ত সহজ এবং স্বাভাবিক ঘটনায় পরিণত হয়েছে।
ঘুসের টাকা না পেলে এ শ্রেণির আমলা-কর্মচারীরা সেবাপ্রার্থী সাধারণ মানুষের সঙ্গে ভালোভাবে কথাও বলেন না, ভালো ব্যবহারও করেন না; কারণ, চেয়ারে বসে প্রতিদিনই তারা ঘুসপ্রাপ্তির জন্য উন্মুখ হয়ে থাকেন। আর তাদের সেই মানসিক অবস্থায় সরকারি সেবা পেতে যখন এমন কোনো ব্যক্তি তাদের সামনে উপস্থিত হন, যার কাছে ঘুস পাওয়া যাবে না, তাকে বসতে বলা বা তার প্রতি কোনো ধরনের সৌজন্য প্রদর্শন দূরে থাক, সে ক্ষেত্রে এমন আচার-আচরণ করা হয় যে, সেবাপ্রার্থী আগত ব্যক্তি সেখান থেকে বের হয়ে যেতে বাধ্য হন।
যদিও সরকারি অফিসে আগত সাধারণ মানুষের প্রতি আমলা-কর্মচারীদের এসব আচার-আচরণ নতুন কিছু নয়। বহুকাল, বহুযুগ থেকেই আমাদের দেশের মানুষ এমন পরিস্থিতির শিকার। তবে বর্তমান সময়ে যে পরিস্থিতির আরও অবনতি হয়েছে, সে কথাটি বলাই বাহুল্য। আর তার প্রধান কারণ হলো, সমাজে অনিয়ম, অনাচার, দুর্নীতির ব্যাপক প্রসার ঘটেছে। যে কোনো ব্যক্তি, যে কোনো পর্যায়ে দুর্নীতি করেই এখন পার পেয়ে যাচ্ছেন। ব্যাংকের টাকা মেরে দেওয়া থেকে শুরু করে অফিসে বসে ঘুস খাওয়া-এ সবই এখন একটি কালচারে পরিণত হয়েছে।
সরকারি অফিসে একেবারেই সৎ বা ভালো মানুষ যে নেই, তা নয়। কিন্তু আনুপাতিক হারে তাদের সংখ্যা অত্যন্ত কম হওয়ায় এসব ব্যক্তির প্রচেষ্টা সেখানকার কর্মকাণ্ডে কোনো ইতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারছে না। কারণ, কোনো একটি দপ্তরে দশজন খারাপ বা ঘুসখোর ব্যক্তি থাকলে সেখানে যদি একজন সৎ বা ভালো ব্যক্তি থাকেন, তাহলে সেখানে তার একার পক্ষে কোনো ভালো কাজের প্রতিফলন ঘটানো সম্ভব নয়। বরং এসব সৎ ব্যক্তি কোণঠাসা অবস্থায় পড়ে আছেন। ফলে তাদের কাজের সুফল থেকেও জনসাধারণ বঞ্চিত হচ্ছেন। আর অসৎ বা ঘুসখোর মানুষের ঘেরাটোপে থাকা এ শ্রেণির ভালো মানুষ কোনোমতে চাকরির মেয়াদ পার করে দেওয়ার কথা চিন্তা-ভাবনা মাথায় রেখে দিন গুজরান করে চলেছেন।
সরকারি অফিসগুলোয় কাজ পেতে জনসাধারণের ভোগান্তির আরও একটি বড় কারণ হলো, অফিসে অফিসে প্রায়ই বিরামহীন মিটিংয়ের আয়োজন করা হয়। ফলে দূরদূরান্ত থেকে আগত সেবাপ্রার্থীরা এসব মিটিংয়ের ফাঁদে পড়ে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্নভাবে নাজেহাল হয়ে থাকেন। কখন মিটিং শেষ হবে, এ আশায় তারা ঘণ্টার পর ঘণ্টা অফিসের করিডোর, বারান্দায়, এমনকি রাস্তায় গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকেন। কিন্তু অনেক সময়ই তাদের সে অপেক্ষার প্রহর শেষ হয় না; মিটিং চলতেই থাকে। কারণ, যখন-তখন শুরু হওয়া এসব মিটিং কোনো নিয়ম বা সময় বেঁধে চলে না।
এমনি একটি ঘটনায় কাজের জন্য জনৈক ব্যক্তি একদিন একটি মন্ত্রণালয়ে গিয়ে জানতে পারলেন, মন্ত্রণালয়ের সব কর্মকর্তা আজ দিনভর টানা মিটিংয়ে ব্যস্ত থাকবেন। আর ঘটনাটির বাস্তব প্রতিফলন দেখে তিনি সেদিন ফেরত এসে, পরদিন আবার গিয়ে সেখানে এলাহী কর্মকাণ্ডের সমাহার দেখতে পেলেন। কোনো একজন অতিরিক্ত সচিব সেখান থেকে বদলি হয়ে অন্যত্র যাচ্ছেন বিধায় ফুলের তোড়া, মিষ্টি, কেক, বিস্কুট, কলা ইত্যাদি নিয়ে হলরুমে ঢোকানো হচ্ছে।
আর সে অবস্থায় ফেয়ারওয়েল মিটিং বেলা ১১টায় শুরু হওয়ার কথা থাকলেও সকাল ১০টার সময়ই সেখানে সাজসাজ রব পড়ে গেছে। এ অবস্থায় কাজের জন্য সেখানে পরদিন গিয়েও ভুক্তভোগী ভদ্রলোককে প্রমাদ গুনতে হলো। কারণ, পরিবেশ-পরিস্থিতির কারণে তার কাজের কথা কাউকে বলা গেল না। অবশেষে দুপুর গড়িয়ে দেড়টায় সময়ও সেই মিটিং শেষ না হওয়ায় সেদিনও কাজটি করতে না পারার দুঃখ নিয়েই তাকে ফিরে আসতে হলো।
এখানে কথাগুলো বলার কারণ হলো, এসব কথায় সরকার বা যারা সরকার চালান অথবা যারা সরকারি উচ্চমহলে আছেন, তাদের কানে যদি কিছু পানি ঢোকে। আর তাদের কানে পানি না ঢুকলে তো তারা এসব বুঝতেও পারবেন না; কারণ, তারা নিজেরা কেউই এসব ঘটনার ভুক্তভোগী নন। এসব ঘটনার ভুক্তভোগী দেশের সাধারণ মানুষ। এ অবস্থায় এসব ঘটনায় যে সরকারের ভাবমূর্তি বিনষ্ট হচ্ছে, সে কথাটিও ভেবে দেখা প্রয়োজন। বর্তমান অবস্থায় দেশের মানুষ যে ভাবতে শুরু করেছেন, আমলারা নিয়ন্ত্রণহীনভাবে তাদের নিজেদের খেয়ালখুশি মতো চলতে শুরু করেছেন, এ কথাটিও তো সত্যি। সুতরাং, যেসব আমলা জবাবদিহিতার বাইরে চলে গেছেন বা যাচ্ছেন, তাদেরও তো নিয়ন্ত্রণ করা প্রয়োজন, নাকি?
এখন প্রশ্ন হলো, বিড়ালের গলায় ঘণ্টাটি বাঁধবেন কে? কারণ, সবাই যদি গড্ডলিকা প্রবাহে গা ভাসিয়ে দেন, তাহলে ইতোমধ্যে ক্ষতি যা হওয়ার তা তো হয়েই গেছে, বাকিটুকুও কিন্তু রক্ষা করা যাবে না। অতএব, ক্ষতি হওয়ার বাকি যেটুকু আছে, সেটুকু বাঁচিয়েও দেশ ও জাতিকে এখনো রক্ষা করা যায়। আর সেজন্য কাউকে না কাউকে বিড়ালের গলায় ঘণ্টা বাঁধার কাজটিও করতে হবে। আর এসব কথা বিবেচনা করে এমন একটি পদ্ধতি উদ্ভাবন করা প্রয়োজন, সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের কারণে যেন সরকারের ভাবমূর্তির আর কোনো ক্ষতি না হয়।
কারণ, এমনিতেই দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্র-চক্রান্ত মোকাবিলায় সরকারকে ব্যস্ত সময় পার করতে হচ্ছে; তার ওপর যদি সরকারি সেবা পেতে সরকারি দপ্তরগুলোয় জনসাধারণের ভোগান্তি বেড়ে যায় এবং ফলস্বরূপ তা যদি সরকারের জনপ্রিয়তা বা ভাবমূর্তিতে আঘাত হানে, তাহলে সরকারের জন্য তা বোঝার ওপর শাকের আঁটি হয়ে দাঁড়াবে। সুতরাং, কোনোভাবেই যেন অসৎ ও স্বার্থান্বেষী শ্রেণির সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীরা কোনো ধরনের আশকারা না পান, সরকারের উচ্চমহলের সে বিষয়ে সজাগ দৃষ্টি রাখা উচিত বলে মনে করি। অন্যথায় আখেরে সরকারকেই কিন্তু এসবের মাশুল গুনতে হবে।
একশ্রেণির সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী নিজেদের স্বার্থ উদ্ধারে অনিয়ম ও অসৎ কর্মকাণ্ডে লিপ্ত হবেন, ঘুস না পেলে ফাইলে অযথা আপত্তি দিয়ে জনগণকে বিপদে ফেলবেন, মানুষের ভাগ্য নিয়ে ছিনিমিনি খেলবেন, নিজেদের হীন স্বার্থ হাসিল করার জন্য দিনের পর দিন, মাসের পর মাস মানুষকে ঘুরিয়ে নাস্তানাবুদ করবেন-এ অবস্থা যাতে আর একদিনও না চলতে পারে, সেদিকেও সরকারের দৃষ্টি দেওয়া প্রয়োজন। কারণ, বর্তমানে সরকারবিরোধী রাজনীতি ও অন্যান্য ঘটনা মোকাবিলার কারণে এসব দিকে সরকারের দৃষ্টি কমে গেছে বলেই মনে হয়। ফলে অনেকেই সরকারি চেয়ারকে ব্যক্তিগত স্বার্থ উদ্ধারের হাতিয়ার হিসাবে ব্যবহার করে চলেছেন।
পরিশেষে, ১৭ কোটি মানুষের এদেশে সব মানুষের সমঅধিকারের কথাটি আমাদের সংবিধানে যেভাবে লিখিত আছে, বিধৃত করা আছে, দেশের সব মানুষই যেন সমভাবে সেই অধিকার ভোগ করতে পারেন, তার সুব্যবস্থা করা প্রয়োজন। আর শুধু ‘প্রয়োজন’ বললেও ভুল হবে, অবস্থা যেখানে এসে দাঁড়িয়েছে, বিষয়টির প্রতি নজর দেওয়াকে আশু প্রয়োজন বলাই সমীচীন। কারণ, লাখো মানুষের রক্তের বিনিময়ে স্বাধীন করা এ দেশটি আজ এখনো কোনো ব্যক্তি বা শ্রেণির হীনস্বার্থ উদ্ধারের হাতিয়ার হয়ে থাকুক, সে অবস্থাটি আর একদিনও চলতে দেওয়া উচিত নয়।
সুতরাং, যারা দেশ চালান, সরকার চালান, দেশের একজন নাগরিক হিসাবে তাদের প্রতি আবেদন, অসৎ ও ঘুসখোর শ্রেণির সরকারি আমলা-কর্মচারীসহ ব্যাংকের টাকাচোরদের কঠোরভাবে দমন করে অবিলম্বে এসব ক্ষেত্রে সুশাসন প্রতিষ্ঠিত করা হোক। সরকারি অফিসের জনভোগান্তি দূর করার মাধ্যমে জনসাধারণের সামনে দৃষ্টান্ত প্রতিষ্ঠা করে সরকারের সদিচ্ছার প্রমাণ দেওয়া হলে তা একটি অগ্রগতি বলেই বিবেচিত হবে। আর দেশের মানুষও সরকারি অফিসের জনভোগান্তি দূর হবে কবে, সেই দিনটির অপেক্ষায় আছেন।
ড. মুহাম্মদ ইসমাইল হোসেন : কবি, প্রাবন্ধিক, কলামিস্ট