Logo
Logo
×

বাতায়ন

স্বদেশ ভাবনা

প্রয়োজনীয় খাদ্যশস্য আমদানিতে দেরি নয়

Icon

আবদুল লতিফ মন্ডল

প্রকাশ: ৩০ আগস্ট ২০২৩, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

প্রয়োজনীয় খাদ্যশস্য আমদানিতে দেরি নয়

গত ২৭ আগস্ট একটি পত্রিকার (প্রথম আলো) খবরে বলা হয়েছে, বিশ্ববাজার থেকে কম দামে চাল ও গম কিনতে পারছে না সরকার। ভারত সিদ্ধ চাল রপ্তানিতে শুল্ক বাড়িয়েছে। মিয়ানমার চাল আমদানিতে বেশি দাম চাইছে। দাম বেড়ে গেছে থাইল্যান্ডেও। এ খবর প্রকাশের এক মাস আগে অর্থাৎ গত ১০ জুলাই নওগাঁর নিয়ামতপুর উপজেলা পরিষদ মিলনায়তনে এক অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে খাদ্যমন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদার বলেছিলেন, ‘চলতি বছর বোরো ধানের বাম্পার ফলন হয়েছে। সরকারি গুদামগুলোয় চাল রাখার জায়গা নেই। এবার বিদেশ থেকে এক ছটাক চালও আমদানি করতে হবে না।’ কৃষিমন্ত্রী আবদুর রাজ্জাকও সম্প্রতি আশা প্রকাশ করেছেন, দেশে উৎপাদিত চাল দিয়েই চাহিদা মিটবে। তবে সরকার চলতি অর্থবছরে পাঁচ লাখ টন চাল আমদানি করতে চায় বলে পত্রপত্রিকায় খবর প্রকাশিত হয়েছে। চাল আমদানির সিদ্ধান্ত হবে সঠিক। চাহিদার তুলনায় দেশে চালের উৎপাদন কম এবং সে কারণেই চাহিদা ও উৎপাদনের ফাঁক পূরণে বছরের পর বছর ধরে সরকারি-বেসরকারি খাতে প্রয়োজনীয় চাল আমদানি করা হচ্ছে। সদ্যসমাপ্ত মৌসুমে বোরোর স্বাভাবিক উৎপাদন, কম বৃষ্টি ও তীব্র খরায় আউশে লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে কম উৎপাদন এবং দেরিতে বৃষ্টির কারণে আমন আবাদের জমির পরিমাণ কমে যাওয়ায় সম্ভাব্য উৎপাদন হ্রাস, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ, বৈশ্বিকভাবে গমের মজুত হ্রাস, বিশ্বের শীর্ষ চাল রপ্তানিকারক দেশ ভারতের সিদ্ধ চাল রপ্তানিতে ২০ শতাংশ করারোপ এবং আতপ চাল রপ্তানি বন্ধের ফলে আন্তর্জাতিক বাজারে দামের ঊর্ধ্বমুখিতা বিবেচনায় নিয়ে চলতি অর্থবছরে চাহিদা অনুযায়ী খাদ্যশস্য (চাল, গম) আমদানি কার্যক্রম ত্বরান্বিত করার প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরাই এ নিবন্ধের উদ্দেশ্য।

গত ৩০ এপ্রিল কৃষি মন্ত্রণালয়ের সম্মেলনকক্ষে এক প্রেস ব্রিফিংয়ে কৃষিমন্ত্রী আশা প্রকাশ করেন, এ বছর বোরোতে রেকর্ড ২ কোটি ২০ লাখ টনের মতো চাল উৎপাদন হবে। এ উৎপাদন ২ কোটি ১৫ লাখ টন লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ৫ লাখ টন বেশি। তবে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) এখন পর্যন্ত বোরোর উৎপাদনসংক্রান্ত তথ্য প্রকাশ করেনি। তবে অতীতের উদাহরণ থেকে অনেকটা জোর দিয়ে বলা যায়, কৃষি মন্ত্রণালয়ের হিসাবের সঙ্গে বিবিএসের হিসাবের তারতম্য ঘটবে অর্থাৎ বিবিএসের হিসাবে বোরোর উৎপাদন হ্রাস পাবে। এদিকে দেশে সদ্যসমাপ্ত বোরো, সমাপ্তপ্রায় আউশ এবং চলমান আমন ফসলের উৎপাদন নিয়ে অতিসম্প্রতি মার্কিন কৃষি বিভাগের (ইউএসডিএ) প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, বোরোর উৎপাদন দুই টনে দাঁড়িয়েছে। প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, মৌসুমে কম বৃষ্টি এবং তীব্র খরার কারণে আবাদি জমির পরিমাণ হ্রাস পাওয়ায় আউশ উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে কম হবে এবং তা দাঁড়াবে ২৪ লাখ টনে। চলমান আমন ফসল সম্পর্কে ইউএসডিএ’র প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সময়মতো প্রচুর বৃষ্টিপাতের অভাবে আমন আবাদের জমি ও উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা যথাক্রমে ৩ শতাংশ ও ৪ শতাংশ হ্রাস পাবে। আমন আবাদের জমি ও উৎপাদনের পরিমাণ দাঁড়াবে যথাক্রমে ৫৭.৫ লাখ একর ও ১ কোটি ৪০ লাখ টনে। এ উৎপাদন গত বছর সরকারি হিসাবে উৎপাদিত ১ কোটি ৬৩ লাখ টনের চেয়ে ২৩ লাখ টন কম। তবে কৃষিমন্ত্রী বলেছেন, আগস্টে বৃষ্টি বেড়েছে। ফলে আমনে উৎপাদন বাড়তে পারে।

আমাদের প্রধান খাদ্যশস্য চাল। ইউএসডিএ’র হিসাবে বোরো, আউশ ও আমন মিলে অভ্যন্তরীণ উৎপাদন থেকে চলতি অর্থবছরে চালের প্রাপ্যতা দাঁড়াবে ৩ কোটি ৬৪ লাখ টন। অন্যদিকে খাওয়ার জন্য প্রয়োজন হবে ৩ কোটি ৮০ লাখ টন। এর অর্থ দাঁড়ায় দেশের চাহিদা পূরণে ১৬ লাখ টন চাল আমদানি করতে হবে। আন্তর্জাতিক মিডিয়ায় প্রকাশিত খবর অনুযায়ী, বিশ্বে চাল রপ্তানিকারক দেশগুলো চাল বাণিজ্য ও সরবরাহ কমিয়ে দিয়েছে। ফলে সাম্প্রতিক সময়ে চালের দাম বেড়েছে। প্রধান খাদ্য হিসাবে চালের ওপর নির্ভরশীল অনেক দেশে খাদ্য নিরাপত্তাহীনতার শঙ্কা তৈরি হয়েছে। গত ২৫ আগস্ট বিশ্বে চাল রপ্তানিতে শীর্ষস্থানের অধিকারী ভারত সিদ্ধ চাল রপ্তানিতে ২০ শতাংশ শুল্কারোপ করেছে। এর আগে গত ২০ জুলাই ভারত আতপ চাল রপ্তানি বন্ধ করে দেয়। বিশ্বের মোট চাল রপ্তানির ৪০ শতাংশেরও বেশি আসে ভারত থেকে। এ দেশটি থেকে চাল রপ্তানি কমে যাওয়ার অর্থ হলো বিশ্ববাজারে পণ্যটির দাম বেড়ে যাওয়া। এদিকে ভারতের আতপ চাল রপ্তানি বন্ধ এবং সিদ্ধ চাল রপ্তানিতে ২০ শতাংশ শুল্কারোপ চাল রপ্তানিতে বিশ্বের অন্যতম শীর্ষ দেশ থাইল্যান্ডের চালের বাজারকে অস্থিতিশীল করে তুলেছে বলে আন্তর্জাতিক মিডিয়ায় খবর প্রকাশিত হয়েছে। আরেকটি বড় চাল রপ্তানিকারক দেশ ভিয়েতনামেও যে শিগ্গির চালের বাজার অস্থিতিশীল হয়ে পড়বে তা বলার অপেক্ষা রাখে না। এসবের ফলে বাংলাদেশসহ চাল আমদানিকারক দেশগুলোর বেশি দামে চাল কেনা ছাড়া আর কোনো উপায় থাকবে না। দেশে বর্তমানে চালের দাম সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতার নাগালের বাইরে। আন্তর্জাতিক বাজারে নতুন করে চালের দাম বৃদ্ধির ফলে দেশে চালের দাম আরও বাড়বে, যা সাধারণ মানুষের দুঃখ-কষ্ট আরও বাড়াবে।

সরকারি গুদামে চালের মজুত ও দেশের খাদ্য নিরাপত্তা নিয়ে দুটি কথা বলতে চাই। খাদ্য সচিব বলেছেন, সরকারি গুদামে যথেষ্ট চাল আছে, ডিসেম্বর পর্যন্ত কোনো চিন্তা নেই। এ ধরনের কথা এর আগেও নীতিনির্ধারকদের মুখে অনেকবার শোনা গেছে। চলতি অর্থবছরে খাওয়ার জন্য ৩ কোটি ৮০ লাখ টন চালের প্রয়োজন হলে মাসে দরকার হবে প্রায় ৩২ লাখ টন। খাদ্য মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটের তথ্য অনুযায়ী, ২৪ আগস্ট সরকারি গুদামে চাল মজুতের পরিমাণ ছিল ১৫ লাখ ৪৭ হাজার টন। এ চাল বড়জোর দেশের দু’সপ্তাহের প্রয়োজন মেটাতে পারে। দেশে চালের প্রয়োজন মেটানো বা খাদ্য নিরাপত্তার সঙ্গে এ চালের তেমন কোনো সম্পর্ক নেই। যেসব কারণে সরকার অভ্যন্তরীণ উৎপাদন থেকে চাল সংগ্রহ করে সেগুলো হলো-এক. ধান কাটা ও ঘরে তোলার মৌসুমে বাজারে দাম স্থিতিশীল রাখা, যাতে মৌসুমের শুরুতে চাল বিক্রি করতে গিয়ে কৃষক ন্যায্য দাম থেকে বঞ্চিত না হন। দুই. সরকারি গুদামে ধান-চালের ভালো মজুত গড়ে তোলার মাধ্যমে চালকল মালিক ও চাল ব্যবসায়ীদের চালের দাম বাড়াতে নিরুৎসাহিত করা। তিন. বাজারে চালের দাম বাড়লে সরকারি মজুত থেকে খোলাবাজারে ও ন্যায্যমূল্যের দোকানে চাল বিক্রির মাধ্যমে এর দাম স্থিতিশীল রাখা। চার. সরকারের লক্ষ্যমুখী খাদ্য বিতরণ কর্মসূচি বাস্তবায়ন করা।

এখন গম নিয়ে আলোচনা করা যাক। গম আমাদের দ্বিতীয় খাদ্যশস্য। হাউজহোল্ড ইনকাম অ্যান্ড এক্সপেন্ডিচার সার্ভে (হায়েস) ২০১৬ অনুযায়ী, ২০১৬ সালে জাতীয় পর্যায়ে মাথাপিছু দৈনিক খাদ্য হিসাবে গমের ব্যবহার ছিল ১৯ দশমিক ৮ শতাংশ। ২০০৫ সালের হায়েসে জাতীয় পর্যায়ে মাথাপিছু দৈনিক খাদ্য হিসাবে গমের ব্যবহার ছিল ১২ দশমিক ১ শতাংশ। এ থেকে বোঝা যায় গমের ব্যবহার কতটা বেড়েছে। ২০১৬ সালের পর গমের ব্যবহার যে আরও বেড়েছে তা অনেকটা জোর দিয়ে বলা যায়। গমের চাহিদা ক্রমেই বেড়ে চললেও এর উৎপাদন নব্বইয়ের দশকের শেষদিকের তুলনায় বহুলাংশে কমেছে। সরকারি তথ্য মোতাবেক, ১৯৯৮-৯৯ অর্থবছরে দেশে গমের উৎপাদন হয়েছিল ১৯ লাখ ৮ হাজার টন। এরপর থেকে গমের উৎপাদন কমতে থাকে এবং বাংলাদেশ অর্থনৈতিক সমীক্ষা ২০২৩ অনুযায়ী, ২০২১-২২ অর্থবছরে পণ্যটির উৎপাদনের পরিমাণ ছিল ১০ লাখ ৮৬ টন। গমের এ উৎপাদন দেশের চাহিদার (কম-বেশি ৭০ লাখ টন) ছয় ভাগের এক ভাগ। অর্থাৎ গমের ক্ষেত্রে দেশ প্রায় পুরোটাই আমদানিনির্ভর।

২০২০ সালের ফেব্রুয়ারিতে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পরপরই বিশ্বব্যাপী গমের দাম বাড়তে শুরু করে। জাতিসংঘ ও তুরস্কের মধ্যস্থতায় ২০২২ সালের ২২ জুলাই রাশিয়া ও ইউক্রেনের মধ্যে ‘কৃষ্ণসাগর শস্যচুক্তি’ নামে স্বাক্ষরিত চুক্তি থেকে রাশিয়া সম্প্রতি বের হয়ে যাওয়ায় গম রপ্তানিতে অন্যতম শীর্ষ দেশ ইউক্রেনের গম রপ্তানি বাধাগ্রস্ত হয়েছে। এতে বিশ্ববাজারে গমের সরবরাহ কমবে এবং দাম আরও বাড়বে। গম উৎপাদনে বিশ্বে দ্বিতীয় স্থানের অধিকারী ভারত গম রপ্তানি বন্ধ করে দেওয়ায় আন্তর্জাতিক বাজারে গমের সরবরাহ আরও হ্রাস পেয়েছে। মার্কিন কৃষি বিভাগের ওয়ার্ল্ড এগ্রিকালচারাল সাপ্লাই অ্যান্ড ডিম্যান্ড এস্টিমেটসের (ডব্লিউএসডিই) প্রতিবেদনের বরাত দিয়ে ১৬ আগস্ট বণিক বার্তায় প্রকাশিত এক খবরে বলা হয়েছে, ২০২৩-২৪ বিপণন মৌসুম শেষে গমের বৈশ্বিক মজুত কমে আট বছরের মধ্যে সর্বনিম্নে নামার আশঙ্কা রয়েছে। মজুতের পরিমাণ ধরা হয়েছে ২৬ কোটি ৫৬ লাখ টন, যা ২০১৫-১৬ বিপণন মৌসুমের পর সর্বনিু। এদিকে মজুতের পাশাপাশি গমের বৈশ্বিক সরবরাহ পূর্বাভাসও কমানো হয়েছে ডব্লিউএসডিই প্রতিবেদনে। সরবরাহ সংকটের আশঙ্কায় আবারও গমের দাম বাড়তে শুরু করেছে। বাংলাদেশ গমে আমদানিনির্ভর হওয়ায় একদিকে অধিক দামে গম আমদানি করতে হবে, অন্যদিকে জনগণকে আরও বেশি দামে আটা-ময়দা কিনতে হবে। এমনিতেই তাদের বর্তমানে মোটা চালের দামের চেয়ে বেশি দাম (প্রতি কেজি ৬০-৬৫ টাকা) দিয়ে আটা কিনতে হচ্ছে।

সবশেষে বলতে চাই, বৈশ্বিক পর্যায়ে খাদ্যশস্যের মজুত হ্রাস, সরবরাহ সংকট ও মূল্যের ঊর্ধ্বমুখিতা বিবেচনায় নিয়ে প্রয়োজনীয় চাল ও গম আমদানির জন্য সরকারকে এখনই কার্যক্রম শুরু করতে হবে। বিশ্বে চাল রপ্তানিতে শীর্ষস্থানের অধিকারী ভারত চাল রপ্তানিতে নানারকম বিধিনিষেধ আরোপ করায় অন্য দুটি বড় চাল রপ্তানিকারক দেশ থাইল্যান্ড ও ভিয়েতনামে চালের বাজারে অস্থিরতা দেখা দিয়েছে। রাশিয়া শস্যচুক্তিতে পুনরায় যোগদান না করা পর্যন্ত গমের দাম বৃদ্ধি ছাড়া হ্রাসের কোনো সম্ভাবনা নেই বললেই চলে। তাই জনগণের খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিতের স্বার্থেই অগ্রাধিকার ভিত্তিতে প্রয়োজনীয় চাল ও গম আমদানির ব্যবস্থা নিতে হবে।

আবদুল লতিফ মন্ডল : সাবেক খাদ্যসচিব, কলাম লেখক

latifm43@gmail.com

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : সাইফুল আলম

প্রকাশক : সালমা ইসলাম