Logo
Logo
×

বাতায়ন

চ্যাটজিপিটি ও শিক্ষার ভবিষ্যৎ

Icon

সৈয়দ মো. গোলাম ফারুক

প্রকাশ: ২৮ আগস্ট ২০২৩, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

চ্যাটজিপিটি ও শিক্ষার ভবিষ্যৎ

চ্যাটজিপিটি বা এ ধরনের কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা আসার পর পৃথিবীর বহু দেশে, এমনকি আমাদের দেশেও শিক্ষাক্ষেত্রে এর প্রভাব পড়তে শুরু করেছে। বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে শিক্ষার্থীদের অ্যাসাইনমেন্ট বা এ ধরনের কাজ তো চ্যাটজিপিটি করে দিচ্ছেই, এমনকি স্কুল পর্যায়েও অনেক কাজ এখন শিক্ষার্থীরা নিজেরা না করে চ্যাটজিপিটিকে দিয়ে করিয়ে নিচ্ছে। এভাবে ছাত্রছাত্রীদের সব কাজ যদি চ্যাটজিপিটিই করতে থাকে, তাহলে ওরা কেবল নামেই শিক্ষার্থী থাকবে আসল শিক্ষার্থী তো হবে ওই কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা। সে ক্রমেই আরও বুদ্ধিমান হবে আর শিক্ষার্থীরা হবে আরও বোকা। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা যে শুধু প্রশ্নের উত্তর বা অ্যাসাইনমেন্ট তৈরি করে দিচ্ছে তা নয়, সে পরীক্ষাও দিচ্ছে এবং শিক্ষার্থীদের চেয়ে অনেক ভালো রেজাল্ট করছে।

বলা বাহুল্য, এটা একটা বড় ধরনের সংকট। এতে শিক্ষার্থীদের চিন্তা, ক্ষমতা নষ্ট হবে এবং তাদের বার্ষিক দক্ষতা কমে যাবে। কারণ চিন্তা যা করার সেটা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা করবে; এবং সে চিন্তাকে প্রকাশ করার জন্য যে ভাষার প্রয়োজন হবে সেটাও সে আয়ত্ত করে নেবে। তাহলে বর্তমানে যে শিক্ষাব্যবস্থা আছে, সেখানে চ্যাটজিপিটি আরও সহজলভ্য হলে শিক্ষার্থীদের কাজ থাকবে সর্বসাকুল্যে দুটো। অ্যাসাইনমেন্ট বা বাড়ির কাজ হলে তারা সেগুলো চ্যাটজিপিটিকে দিয়ে করিয়ে নিয়ে কপি করে স্কুলে জমা দেবে। আর পরীক্ষা দেওয়ার আগে চ্যাটজিপিটিকে দিয়ে নোট তৈরি করে সেগুলো মুখস্থ করে খাতায় উগরে দিয়ে আসবে। মোট কথা, তাদের জ্ঞানচর্চা বা দক্ষতা বৃদ্ধি করার বিষয়টা প্রকৃতপক্ষে আর থাকবে না।

এ সমস্যা বা এরকম আরও অনেক সমস্যার সমাধান নিয়ে মার্কিন প্রেসিডেন্ট বাইডেনসহ আরও অনেক রাষ্ট্রনায়ক বলেছেন, এ চ্যাটজিপিটি বা এ ধরনের কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ব্যবহার অনেক সীমিত করে ফেলতে হবে। কিন্তু তাদের কথা যে কেউ অনুসরণ করছেন তার কোনো লক্ষণ এ পর্যন্ত পৃথিবীর কোথাও দেখা যায়নি। আসলে এটা সম্ভবও নয়। তাহলে কি আমরা শিক্ষার এ বিপর্যয়কে মেনে নেব? যদি লেখাপড়াকে আমরা এখনকার মতো জ্ঞান কিংবা কঠিন দক্ষতার (হার্ড স্কিলস) মধ্যেই সীমাবদ্ধ রেখে দেই তাহলে না মেনে উপায় নেই। কিন্তু শিক্ষাক্ষেত্রে যদি কেবল কোমল দক্ষতাকে (সফ্ট স্কিলস) প্রাধান্য দেওয়া যায়, তাহলে এ সমস্যা অনেক কমে আসবে। কারণ কোমল দক্ষতা অর্জনের জন্য যা যা লাগে বা যা যা করতে হয়, সেগুলো চ্যাটজিপিটি থেকে পাওয়া মুশকিল। কোমল দক্ষতা এমন এক ধরনের দক্ষতা যা শিক্ষার্থীকে তার চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য পরিবর্তনের মাধ্যমে বা আন্তঃব্যক্তিক মিথস্ক্রিয়ার মধ্য দিয়ে অর্জন করতে হয়। অর্থাৎ চ্যাটজিপিটি বা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ক্ষমতাটা হচ্ছে মূলত কঠিন দক্ষতা। সে খুব সহজেই জ্ঞান ও পেশাগত দক্ষতা অর্জন করে ফেলতে পারে। কিন্তু কোমল দক্ষতার জায়গাটা এখনো মূলত মানুষের। কারণ কোমল দক্ষতার জন্য মানুষের আবেগের প্রয়োজন হয়। সমাজবিজ্ঞানীরা এ দক্ষতাকে অনেক সময় ‘আবেগীয় আই কিউ’ অথবা ‘ই কিউ’ বলেন আর কঠিন দক্ষতাকে বলেন ‘আই কিউ’। কোমল দক্ষতার কিছু সুনির্দিষ্ট উদাহরণ হলো : সূক্ষ্মচিন্তন দক্ষতা, সৃষ্টিশীলতা, অভিযোজন করার ক্ষমতা, নৈতিকতা, যোগাযোগ, দলীয় কাজ, সহযোগিতা, সহমর্র্মিতা ইত্যাদি।

তাহলে শিক্ষাক্ষেত্রে আমরা যদি কোমল দক্ষতা অর্জনকে একটা গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় নিয়ে আসি, তাহলে চ্যাটজিপিটি বা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা আমাদের তেমন ক্ষতি করতে পারবে না। শিক্ষাক্ষেত্রে কোমল দক্ষতাকে গুরুত্ব দেওয়ার আরেকটা কারণ আছে। সেটা হচ্ছে চাকরি বাজারে চাকরিদাতারা আর আগের মতো কঠিন দক্ষতাকে প্রাধান্য না দিয়ে কোমল দক্ষতাকে খুঁজছেন। কারণ আমরা একটু আগেই দেখেছি, মানুষ তার কঠিন দক্ষতা দিয়ে যা উৎপাদন করতে পারে এখন একটা যন্ত্র তার চেয়ে অনেক নিখুঁতভাবে এবং অনেক বেশি পরিমাণে উৎপাদন করতে পারে। ডাক্তারদের কথাই ধরুন। ডাক্তাররা আগে চোখ দেখে, মুখ দেখে, হাত টিপে, পেট টিপে রোগীর রোগ নির্ণয়ের চেষ্টা করতেন। এখন অবশ্য আর হাত-পেট টিপতে হয় না। এখন তার কাছে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই তিনি কিছু টেস্ট করতে বলে দেন এবং রোগ নির্ণয়ের কাজটা মূলত একটা যন্ত্রই করে দেয়।

ডাক্তার এখন সেসব টেস্ট রেজাল্টের বিশ্লেষণ করেন মাত্র। তবে এ কাজটাও এখন কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার হাতে চলে যাচ্ছে। কয়েকদিন পর রোগীর চিকিৎসা কী হবে তাও সে বাতলে দেবে। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা চালিত রোবট তো ইতোমধ্যেই অপারেশন করা শুরু করে দিয়েছে। হাঁটু থেকে শুরু করে হার্টের অপারেশনের মতো বহু জটিল অপারেশনের কাজ ইতোমধ্যেই সফলভাবে সম্পন্ন করা হয়েছে। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, সবই যদি যন্ত্র করে দেয় তাহলে ডাক্তার করবে কী? তিনি কি বেকার হয়ে যাবেন? না, চিকিৎসাক্ষেত্রে তার কোমল দক্ষতার প্রয়োজন কখনো ফুরোবে না এবং সেটা খুব জরুরিও বটে। রোগীর প্রতি সহমর্মিতা প্রদর্শন করা, রোগীকে তার সমস্যাগুলো সুন্দরভাবে বুঝিয়ে দেওয়া, রোগীর কথাগুলো মনোযোগ দিয়ে শোনা, রোগীর সঙ্গে চমৎকার ব্যবহার করে তাকে মানসিক প্রশান্তি দেওয়ার মতো কাজগুলো তো যন্ত্র করতে পারবে না, সেগুলো ডাক্তারকেই করতে হবে। শুধু চিকিৎসকের বেলায় নয়, সব পেশাতেই মানুষের চাকরি পাওয়ার ক্ষেত্রে বা চাকরিতে উন্নতি করার ক্ষেত্রে এটা প্রমাণ করতে হবে যে, তার কোমল দক্ষতা আছে।

তবে বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থায় যেখানে এখনো কঠিন দক্ষতা প্রাধান্য বিস্তার করে আছে, সেখানেও চ্যাটজিপিটি একটা ইতিবাচক ভূমিকা পালন করতে পারে। তবে সেটা শিক্ষার্থীদের ক্ষেত্রে নয়, শিক্ষকের ক্ষেত্রে। শিক্ষক তার শিক্ষাদানের স্তরটা আরও একটু উপরে নিয়ে যেতে পারেন বা শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে আরও উন্নত মানের বিশ্লেষণ বা ব্যাখ্যা দাবি করতে পারেন। যেমন-আগে একজন অর্থনীতির শিক্ষক তার শিক্ষার্থীদের কেইনসের মতবাদ নিয়ে একটি প্রবন্ধ রচনা করতে বলতেন। এখন এরকম বাড়ির কাজ দিলে শিক্ষার্থীরা অবধারিতভাবে চ্যাটজিপিটি বা এরকম কোনো কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাকে দিয়ে অনায়াসে দ্রুততম সময় অতি চমৎকার একটি প্রবন্ধ লিখিয়ে নিতে পারবে। কিন্তু শিক্ষক যদি ওরকম কোনো রচনা লিখতে না বলে চ্যাটজিপিটির ওই লেখাটির ওপর একটা রিভিউ লিখতে বলেন, তাহলে কিন্তু শিক্ষার্থীর জ্ঞানের পরিধি ও চিন্তাক্ষমতা আগের চেয়ে অনেক বেড়ে যাবে। এছাড়াও শিক্ষকরা তাদের পাঠ পরিকল্পনা বা ওয়ার্কশিট তৈরি করার ক্ষেত্রে চ্যাটজিপিটির সাহায্য নিতে পারেন।

সম্প্রতি খান অ্যাকাডেমি চ্যাটজিপিটির সর্বশেষ ভার্সন জিপিটি-৪ ব্যবহার করে খান-মিগো বলে একটি প্রোগ্রাম চালু করেছে। সেখানে একজন শিক্ষার্থী যদি অঙ্কে ভুল করে, তাহলে চ্যাটবট তাকে সাহায্য করে; বিজ্ঞানের বা ইংরেজির ক্লাসে প্রশ্ন করার ক্ষেত্রে শিক্ষককে পরামর্শ দেয়; বা ইতিহাসের কোনো বিষয় নিয়ে শিক্ষার্থীরা চ্যাটবটের সঙ্গে বিতর্ক করতে পারে ইত্যাদি। খান অ্যাকাডেমির প্রতিষ্ঠাতা সাল খান, যার আদি বাড়ি বাংলাদেশে, তিনি চ্যাটজিপিটি ব্যবহারের সুবিধা সম্পর্কে বলেছেন, ‘এটা আমাদের এ সুবিধা দিয়েছে যে, এখন আমাদের প্রত্যেক শিক্ষার্থী একজন করে আলাদা শিক্ষক পায়; এবং আমাদের প্রত্যেক শিক্ষক পায় এক বা একাধিক সহকারী।’

অনেকে বলেন, ‘ভয় পাওয়ার কিছু নেই, এর আগেও তো প্রথম, দ্বিতীয়, ও তৃতীয় শিল্প বিপ্লব এসেছে, তখনো তো মানুষের মনে হয়েছে, সব ধ্বংস হয়ে যাবে; কই তা তো হয়নি।’ কথাটা পুরোপুরি সত্য নয়। আর কিছু না হোক, পরিবেশ ধ্বংস হয়েছে। মানুষে মানুষে সম্পর্কেও বড় ধরনের পরিবর্তন এসেছে। তবে লাভ বেশি হয়েছে, না ক্ষতি-সেটা বলা মুশকিল। তবে এটা ঠিক, আমরা সচেতন হলে ক্ষতিটা অনেক কম হতো।

আগে যাই হোক, এবার সচেতন হতেই হবে। কারণ এবার যে ক্ষতি হবে সেটা অন্য যে কোনো সময়ের তুলনায় অনেক বেশি। এখন আর কেবল পরিবেশ বা মানুষে মানুষে সম্পর্ক নয়; এবার খোদ মানুষই অচল, নিষ্ক্রিয় ও বুদ্ধিহীন হয়ে পড়বে। এত সাধ ও সাধনা করে যে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা সে তৈরি করল, শেষে দেখা যাবে সেই কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাই প্রভু হয়ে তাকে বোধবুদ্ধিহীন জড়পদার্থের মতো এক নিম্নশ্রেণির দাসে পরিণত করেছে।

সৈয়দ মো গোলাম ফারুক : পিএসসির সদস্য; মাউশি ও নায়েমের সাবেক মহাপরিচালক

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম