Logo
Logo
×

বাতায়ন

একজন বীর মুক্তিযোদ্ধার বিদায়

Icon

কর্নেল মোহাম্মদ আবদুল হক (অব.)

প্রকাশ: ১৯ আগস্ট ২০২৩, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

একজন বীর মুক্তিযোদ্ধার বিদায়

মহান স্বাধীনতাযুদ্ধে জীবনবাজি রেখে হানাদার পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে অসম, দুঃসাধ্য ও কঠিন যুদ্ধ করে যারা এ মাতৃভূমি বাংলাদেশকে আমাদের জন্য উপহার দিয়েছিলেন, তাদেরই একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা এয়ার ভাইস মার্শাল (অব.) সুলতান মাহমুদ আমাদের ছেড়ে মহান সৃষ্টিকর্তা আল্লাহ্ রাব্বুল আলামিনের কাছে ফিরে গেছেন গত ১৪ আগস্ট। স্বাধীনতাযুদ্ধে এ বীর মুক্তিযোদ্ধা স্থল ও আকাশযুদ্ধের অসাধারণ এক কমান্ডার ছিলেন। তিনি ছিলেন অত্যন্ত ধর্মপ্রাণ ব্যক্তি, ইসলামী জীবন বিধানের একনিষ্ঠ অনুসারী।

১৯৪৪ সালে ফেনী জেলার ছাগলনাইয়া উপজেলার নিজকুনজরা মজলিস বাড়িতে (নানাবাড়ি) জন্মগ্রহণ করেন সুলতান মাহমুদ। পৈতৃক বাড়ি ফেনীর দাগনভূঁইয়া উপজেলায়। তার বাবার নাম নূরুল হুদা এবং মায়ের নাম আঙ্কুরের নেছা। শিশুকালে তিনি নানাবাড়িতে বড় হয়েছেন। শৈশবে তার নাম ছিল জামাল। একই গ্রামের নিজকুনজরা সরকারি প্রথমিক বিদ্যালয়ে প্রাথমিক শিক্ষা লাভ করেন। স্ত্রীর নাম ফেরদৌস আরা মাহমুদ। তাদের এক মেয়ে ও এক ছেলে। তাদের তিন ভাইয়ের মধ্যে অন্য দুজন হলেন কামাল মাহমুদ এবং জহির উদ্দিন মাহমুদ মামুন। মামুন বাংলাদেশের একটি শিল্প গ্রুপের প্রধান। স্বাধীনতাযুদ্ধে সাহসিকতার সঙ্গে যুদ্ধ করার জন্য বাংলাদেশ সরকার সুলতান মাহমুদকে ‘বীর উত্তম’ খেতাব প্রদান করে। স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধে বিশেষ অবদানের জন্য ২০১৮ সালে তিনি ‘স্বাধীনতা পদক’ লাভ করেন।

সুলতান মাহমুদ ১৯৬২ সালের ১ জুলাই বিমানবাহিনীর জিডি পাইলট হিসাবে সে সময়ের পাকিস্তান এয়ারফোর্স একাডেমি থেকে কমিশন লাভ করেন। তার নম্বর ছিল 267F। ১৯৭১ সালে সুলতান মাহমুদ পাকিস্তানি বিমানবাহিনীর মৌরীপুর বিমানঘাঁটিতে কর্মরত ছিলেন, যার অবস্থান ছিল করাচিতে। তখন তার পদবি ছিল ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট। মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিতে মে মাসে সেখান থেকে পালিয়ে শ্রীলংকা হয়ে ঢাকায় আসেন তিনি। ঢাকা থেকে ভারতে যাওয়ার পথে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী তাকে আটকের চেষ্টায় তাড়া করে। এ অবস্থায় দাউদকান্দি ফেরিঘাটের কাছে তিনি সাঁতরে মেঘনা নদী পার হন। অনেক বাধাবিপত্তি পেরিয়ে শেষ পর্যন্ত ভারতে পৌঁছাতে সক্ষম হন।

ভারতে তখন সমবেত হয়েছিলেন পাকিস্তানি বিমানবাহিনীর আরও কয়েকজন বাঙালি সদস্য। তারা মুক্তিবাহিনীর প্রধান সেনাপতি আতাউল গণি ওসমানীর কাছে অনুরোধ করেন মুক্তিবাহিনীর জন্য বিমান উইং গঠনের। কিন্তু বাস্তবে তখন তা করা সম্ভব ছিল না। এ অবস্থায় সুলতান মাহমুদ বসে থাকেননি। যোগ দেন স্থল যোদ্ধাদের সঙ্গে। তিনি প্রথমে যুদ্ধ করেন দুই নম্বর সেক্টরে। পরে এক নম্বর সেক্টরে। তিনি দুই নম্বর সেক্টর ও পরবর্তী সময়ে সেক্টর এক-এর কমান্ডিং অফিসার হিসাবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। বেশ কয়েকটি অপারেশনে তিনি সাহসিকতার সঙ্গে অংশ নেন।

এর মধ্যে চট্টগ্রামের মদুনাঘাট বিদ্যুৎ সাবস্টেশন ধ্বংসের অপারেশন উল্লেখযোগ্য। মদুনাঘাট বিদ্যুৎ স্টেশনটির অবস্থান চট্টগ্রাম কাপ্তাই সড়কের হালদা নদীর পশ্চিম পাশে। সেখানে ছিল পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর একটি দল। সাবস্টেশনের চারদিকের বাংকারে ছিল তাদের অবস্থান। অক্টোবরের শেষে একদিন সুলতান মাহমুদের নেতৃত্বে একদল মুক্তিযোদ্ধা সেখানে অতর্কিতে আক্রমণ করে। তাদের আক্রমণে সাবস্টেশনটি ধ্বংস হয়। কিন্তু পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর পালটা আক্রমণে সুলতান মাহমুদ আহত এবং তার এক সহযোদ্ধা শহিদ হন। সেদিন তিনি যথেষ্ট রণকৌশল ও বীরত্ব প্রদর্শন করেন। এরপর তিনি আর স্থলযুদ্ধে অংশ নিতে পারেননি।

১৯৭১-এর ২৮ সেপ্টেম্বর ভারতের নাগাল্যান্ডের ডিমাপুরের একটি পরিত্যক্ত বিমানঘাঁটিতে গঠন করা হয় বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর প্রথম কিলোফ্লাইট। সুলতান মাহমুদের উদ্ভাবনী ধারণা ও উদ্দীপনা কিলোবাহিনী প্রতিষ্ঠায় অনুপ্রাণিত করে। সুলতান এ গেরিলা বিমানবাহিনীর অধিনায়ক ছিলেন। ১০ জন পাইলট, ৬৭ জন টেকনিশিয়ান, একটি এলয়েড থ্রি হেলিকপ্টার, একটি অটার ও একটি ডিসি থ্রি ডকোডা উড়োজাহাজ নিয়ে এর যাত্রা শুরু। প্রশিক্ষণ চলে দুই মাস। কিলোফ্লাইটের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন সুলতান মাহমুদ। ১৯৭১ সালের ৩ ডিসেম্বর প্রথম অভিযানে অত্যন্ত সাহসিকতার সঙ্গে বাংলার আকাশসীমায় প্রবেশ করে সফল অভিযান পরিচালনা করেন কিলোফ্লাইটের সদস্যরা। নারায়ণগঞ্জের গোদনাইল তেলের ডিপোতে সফল আঘাত হানে স্কোয়াড্রন লিডার সুলতান মাহমুদ ও ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট বদরুল আলমের নেতৃত্বে একটি এলয়েড হেলিকপ্টার।

১৯৭১ সালের ৩ ডিসেম্বর মুক্তিবাহিনীর বিমান উইংয়ের মাধ্যমে প্রথম যে আক্রমণ পরিচালনা করা হয়, এর একটির দায়িত্ব ছিল তার ওপর। তার নেতৃত্বে পরিচালিত হয় গোদনাইল অপারেশন। এ অপারেশনে তার সহযোদ্ধা ছিলেন বদরুল আলম। তারা একটি এলয়েড হেলিকপ্টারের সাহায্যে নারায়ণগঞ্জের গোদনাইল তেলের ডিপোতে আক্রমণ চালান। ভারতের কৈলাসটিলা বিমানঘাঁটি থেকে পূর্বনির্ধারিত সময়ের মধ্যেই তারা গোদনাইলে পৌঁছাতে সক্ষম হন। নির্ধারিত দূরত্বে পৌঁছেই শুরু করেন আক্রমণ। সেদিন তারা হেলিকপ্টার থেকে ১৪টি রকেট নিক্ষেপ করে ইএসএসও-র দুটি তেলের ডিপো সম্পূর্ণভাবে ধ্বংস করে দেন। আরও কয়েকটি আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়। সুলতান মাহমুদ পরে সিলেট, কুলাউড়া, কুমিল্লা, ভৈরব, শমশেরনগরসহ আরও কয়েকটি স্থানে হেলিকপ্টারের সাহায্যে আক্রমণে অংশ নেন।

মুক্তিযুদ্ধের শেষ পর্যায়ে তিনি ও সাহাবউদ্দিন আহমেদ বীর উত্তম একদিন হেলিকপ্টারে সিলেট শহরের অবস্থা পর্যবেক্ষণ করছিলেন। বিমানবন্দরে অবতরণ করা মাত্র তারা পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর আক্রমণের মুখে পড়েন। হেলিকপ্টারে কয়েকটি গুলি লাগে। সুলতান মাহমুদ অত্যন্ত সাহসিকতার সঙ্গে হেলিকপ্টারটি নিয়ে পাকিস্তানি সেনাদের কবল থেকে বেরিয়ে যান।

বাংলাদেশ বিমানবাহিনীকে সুসংগঠিত ও শক্তিশালী বাহিনী হিসাবে গড়ে তোলার ক্ষেত্রে সুলতান মাহমুদের অবদান অসামান্য। স্বাধীনতার পর ধাপে ধাপে এয়ার ভাইস মার্শাল পদে উন্নীত হন তিনি। বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর প্রধান হিসাবে দায়িত্ব পালন করেন ২৩ জুলাই ১৯৮১ থেকে ২২ জুলাই ১৯৮৭ পর্যন্ত।

গত ১৪ আগস্ট রাত ৮টা ৪০ মিনিটে রাজধানীর একটি হাসপাতালে শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন এই ধর্মপ্রাণ মানুষটি। বাংলাদেশ যত দিন এ পৃথিবীর বুকে টিকে থাকবে, দেশের মানুষ তত দিন এই বীর মুক্তিযোদ্ধাকে স্মরণ করবেন। মহান আল্লাহর কাছে তার আত্মার মাগফিরাত কামনা করছি।

তাকে স্মরণ করে পরিকল্পনামন্ত্রী এমএ মান্নান বলেছেন, সুলতান মাহমুদ ও আমি একই স্কুলে (সারগোদা) পড়াশোনা করেছি। সুলতান মাহমুদ তার জ্যেষ্ঠ সহপাঠী ও বন্ধু ছিলেন। ছাত্রজীবনে তিনি অমায়িক ব্যবহার করতেন ও অত্যন্ত বন্ধুবৎসল ছিলেন। বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে অংশগ্রহণ করে তিনি বীরত্বপূর্ণ অবদান রাখেন এবং দেশের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ সামরিক উপাধি বীর উত্তম খেতাব এবং পরবর্তী সময়ে মর্যাদাপূর্ণ স্বাধীনতা পদকে ভূষিত হন। দেশাত্মবোধ ও সাহসিকতাপূর্ণ কাজে সুলতান মাহমুদের অবদানের কথা বাঙালি জাতি চিরদিন স্মরণ রাখবে। মন্ত্রী মরহুমের বিদেহী আত্মার মাগফিরাত কামনা করেন এবং তার শোকাহত পরিবারের প্রতি গভীর সমবেদনা জানান।

কর্নেল মোহাম্মদ আবদুল হক, পিএসসি (অব.) : সামরিক ইতিহাস ও নিরাপত্তা বিশ্লেষক

 

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : সাইফুল আলম

প্রকাশক : সালমা ইসলাম