দুই চীনা নেতার মধ্যে পার্থক্য যেখানে
সৈয়দ মো. গোলাম ফারুক
প্রকাশ: ১০ আগস্ট ২০২৩, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
একনায়ক কথাটা শুনলেই একজন ভয়ংকর অমানবিক অত্যাচারী শাসকের কথা মাথায় চলে আসে। কিন্তু ব্যতিক্রম তো থাকেই। এরকম ব্যতিক্রমী একনায়কদের আমরা কল্যাণকর একনায়ক বলি। আমার দৃষ্টিতে এর অন্যতম উদাহরণ হচ্ছেন ৪৫৮ খ্রিষ্টপূর্বাব্দের লুসিয়াস ধকুইঙ্কটিয়াস সিনসিনাটাস। তিনি কখনো ক্ষমতার পেছনে ছোটেননি। তিনি থাকতেন রোমের বাইরে তার খামার বাড়িতে। নিজের হাতে চাষ করতেন। সেই সময় যখন পার্শ্ববর্তী একটা দেশ থেকে রোমের ওপর হামলা করা হয় তখন সেনেট সিদ্ধান্ত নেয়-সেই দুর্যোগকালে রোমকে নেতৃত্ব দেওয়ার মতো একজন মানুষই আছেন এবং তিনি হচ্ছেন সিনসিনাটাস। ফলে তাকেই রোমের একনায়ক হিসাবে নিয়োগ করা হয়। কজন সিনেটর গিয়ে যখন সিনসিনাটাসকে এ সিদ্ধান্ত জানান, তখন তিনি তার জমিতে হাল চাষ করছিলেন। খবরটা পেয়ে তিনি ততক্ষণাৎ টোগা পরে রওয়ানা হয়ে গেলেন। একনায়কের দায়িত্ব গ্রহণ করলেন। এবং ১৬ দিনের মাথায় শত্রুকে পরাজিত করে রোমে শান্তি ও স্বস্তি ফিরিয়ে আনলেন। তার এ দক্ষতা যেমন বিস্ময়কর, ক্ষমতার প্রতি তার নির্মোহ দৃষ্টিভঙ্গিটাও তেমন অসাধারণ। তাকে ৬ মাসের জন্য একনায়ক হিসাবে মনোনীত করা হয়েছিল, কিন্তু তিনি ওই ১৬ দিন পর সবকিছু ছেড়েছুড়ে তার খামার বাড়িতে গিয়ে আবার লাঙ্গল ধরলেন।
এবার ওই একই দেশের জুলিয়াস সিজারের কথা ধরা যাক। আগেই বলেছি, রোমে একজন একনায়ক ৬ মাসের জন্য নিয়োগ পেতেন। জুলিয়াস সিজার কয়েক বার তার নিয়োগ নবায়ন করার পর তার একনায়কত্বকে স্থায়ী করে ফেলেন। ৪৪ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে যেদিন তাকে হত্যা করা হয়, সেদিন তার স্ত্রী ও অন্য অনেকের নিষেধ সত্ত্বেও তিনি সিনেটে যান; কারণ তাকে বলা হয়েছিল, সিনেট সদস্যরা সেদিন তাকে রোমের সম্রাট হিসাবে ঘোষণা করবেন। যা হোক, এ কথা বলে রিপাবলিকের অর্থাৎ রোমান গণতন্ত্রের সমর্থকরা এবং একনায়কতন্ত্রবিরোধী সিনেটররা সেদিন সিনেট কক্ষের ভেতরে তাকে হত্যা করে। কিন্তু অবাক করা বিষয় হলো, রিপাবলিক বা গণতন্ত্র যাদের কথা বলে বা যাদের পক্ষ নেয়, সেই জনগণই হত্যাকারীদের বিপক্ষে চলে গেল এবং সিজারের গুণগান গাইতে থাকল। ফলে ক্ষমতায় বসল সিজারেরই উত্তরাধিকারী অক্টেভিয়ান, যিনি অগাস্টাস সিজার নাম ধারণ করে সেই সম্রাট হয়েই দীর্ঘদিন সুনামের সঙ্গে রোম শাসন করলেন।
একজন শাসক হিসাবে সিজারের এতই সুনাম হয়েছিল যে, পরে জার্মানিতে তার নামের অনুকরণে শাসকরা কাইজার নামটি গ্রহণ করেন এবং রাশিয়ার শাসকরা বনে যান জার। শেকসপিয়ার ছাড়াও আরও অনেক শিল্পী-সাহিত্যিক তার জীবনকে উপজীব্য করে নানা সাহিত্য ও শিল্পকর্ম রচনা করেন, যা এখনো পঠিত ও অভিনীত হচ্ছে।
এরকম উদাহরণ যে খুব বেশি আছে তা নয়। তাদের মধ্যে তুরস্কের মোস্তফা কামাল আতাতুর্ক, সিঙ্গাপুরের লি কুয়ান ও যুগোস্লাভিয়ার টিটোর নাম উল্লেখযোগ্য। যা হোক, চীনের বর্তমান নেতা কোন দলে পড়েন সেটা বলা খুব মুশকিল, কারণ চীনের সব খবরাখবর যে আমরা খুব ভালোভাবে পাই তা নয়। তবে শি জিনপিংয়ের নেতৃত্বে যে চীনের শনৈঃশনৈঃ উন্নতি হচ্ছে, এটা কেউ অস্বীকার করে না। একনায়ক হিসাবে তিনি কেমন সেটা তারই উত্তরসূরি মাও জে দংয়ের সঙ্গে তুলনা করে দেখা যেতে পারে।
শি জিনপিং যত বেশি ক্ষমতা করায়ত্ত করছেন, সমালোচকরা ততই তার সঙ্গে মাও জে দংয়ের মিল খুঁজে পাচ্ছেন। এবং বলার চেষ্টা করছেন, ১৯৭৬ সালে মৃত্যুর আগের দুই দশকে মাও যেমন তার একনায়কত্ব দিয়ে দেশকে ধ্বংসের কিনারায় নিয়ে গিয়েছিলেন, শি জিনপিংয়ের নেতৃত্বে আবার তার পুনরাবৃত্তি ঘটবে। তারা বলেন, মাও জে দংয়ের নেতৃত্বে রাষ্ট্রীয় সব প্রতিষ্ঠান দুর্বল হয়ে পড়েছিল, মাও ক্ষমতা নিজের হাতে কেন্দ্রীভূত করতে করতে নিজের লোকদের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছিলেন, এবং বহু মানুষ তার অন্যায়-অত্যাচারের শিকার হয়েছিল। এ কারণেই তার সময় প্রায় এক কোটি মানুষ না খেতে পেয়ে মারা যায়।
এ দুর্ভিক্ষের ঘটনাটা ঘটেছিল ১৯৫০-এর দশকে। মাও জে দংয়ের ইচ্ছা ছিল তিনি চীনকে খুব দ্রুত একটা সুপার পাওয়ারে পরিণত করবেন। তিনি ভাবলেন প্রথমে তিনি কৃষিপণ্যের উৎপাদন বাড়াবেন তিন গুণ। তারপর উদ্বৃত্ত কৃষিপণ্য রপ্তানি করে সেই অর্থ দিয়ে অস্ত্রশস্ত্র ও ভারী যন্ত্রপাতি আমদানি করবেন। সচরাচর একনায়করা যেমন নিজেদের ভাবনাকেই সর্বোত্তম মনে করেন, এবং অন্যরা যেমন ধরেই নেন যে কর্তার ইচ্ছাতেই কর্ম, চীনে ঠিক তা-ই ঘটল। কৃষিপণ্যের উৎপাদন বাড়ানোর কড়া আদেশ জারি হলো। কেউ আর তাকে বলতে সাহস করল না যে এটা সম্ভব নয়। এবং ১৯৫৮ সালে আমলারা এদিক ওদিক দু-একটা শূন্য বসিয়ে ঠিকই হিসাব করে দেখিয়ে দিল যে সে বছর আগের চেয়ে ৫০ শতাংশ বেশি খাদ্যশস্য উৎপন্ন হয়েছে। মাও সেই ভরসায় লাখ লাখ টন খাদ্যশস্য রপ্তানি করে সেই অর্থে যা কিনতে চেয়েছিলেন কিনলেন। ফলাফল হলো মারাত্মক। ইতিহাসের ভয়াবহতম দুর্ভিক্ষে প্রায় এক কোটি মানুষ মারা গেল।
১৯৬১ সালের দিকে এসে মাও তার বেশিরভাগ সহকর্মীর ওপর থেকে বিশ্বাস হারিয়ে ফেলেন। যাকে সাংস্কৃতিক বিপ্লব বলা হয়, সেই বিপ্লবের সময় অর্থাৎ ১৯৬৬ সালে তিনি একদিকে নেতাদের বিভিন্ন জায়গায় খোঁজখবর নেওয়ার জন্য পাঠান, অন্যদিকে জনগণকে তাদের বিরুদ্ধে খেপিয়ে তোলেন; অর্থাৎ তিনি ‘রাষ্ট্রের গভীরে যে আরেকটি রাষ্ট্রে’র অস্তিত্ব অনুভব করেছিলেন, তার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেন।
এবার শি জিনপিংকে কেন একজন ‘দ্বিতীয় মাও’ বলা যাবে না, তা দেখা যাক। মাও ছিলেন র্যাডিকেল। যার ওপর তার আস্থা ছিল না তাকে তিনি ধ্বংস করে ফেলতে চাইতেন। পার্টির ভেতরে আন্তঃশৃঙ্খলা স্থাপন করে যে আমলাদের সুপথে নিয়ে আসা যাবে এ বিশ্বাস তার ছিল না। তিনি তার ক্যাডারদের ওপর জনতার চাপ প্রয়োগ করে এবং তাদের সহিংস শ্রেণি সংগ্রামের মধ্য দিয়ে নিয়ে গিয়ে বিশুদ্ধ করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু শির কৌশল একেবারেই আলাদা। তিনিও পার্টি সদস্যদের আত্মশুদ্ধি চান তবে সেটা অন্যভাবে। কিছু কঠোর মূল্যায়ন ও পরিবীক্ষণ কর্মকর্তার মাধ্যমে তিনি শুদ্ধি অভিযান পরিচালনা করেন। অর্থাৎ মাও শাসন করতেন বটম-আপ পদ্ধতিতে আর শি শাসন করছেন টপ-ডাউন উপায়ে। কোথাও যেন কোনো নৈরাজ্য সৃষ্টি না হয় সেদিকে কড়া নজর রাখছেন তিনি। সমাজ ও অর্থনীতির প্রতিটি ক্ষেত্রে তিনি তার পার্টির হাতকে বিস্তৃত করেছেন। তিনি সেন্সরশিপ, পর্যবেক্ষণ ও প্রোপাগান্ডার এক বিশাল নেটওয়ার্ক তৈরি করে জনগণকে নিয়ন্ত্রণ করছেন, তাদের কারও ওপর রাষ্ট্রশক্তি লেলিয়ে দিচ্ছেন না বা যা খুশি করার সুযোগ দিচ্ছেন না। মাও ‘রাষ্ট্রের গভীরে যে আরেকটি রাষ্ট্রের’ অস্তিত্বকে বিলুপ্ত করতে চেয়েছিলেন, শি সেই ‘রাষ্ট্রের’ মাধ্যমে তার ক্ষমতাকে সুদৃঢ় করতে চেয়েছেন।
চীনের এক সময়কার প্রেসিডেন্ট লিউ শাউকির সঙ্গে এ দুই নেতার সম্পর্ক নিয়ে একটু আলোচনা করলেই বিষয়টি স্পষ্ট হবে। মাওয়ের মতে, লিউ শাউকি ছিলেন সেই ‘রাষ্ট্রের গভীরের রাষ্ট্রের’ নেতা। তিনি ছিলেন মস্কোতে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত পার্টি সংগঠক এবং পার্টি শৃঙ্খলার ক্ষেত্রে আপসহীন। ১৯৬১ সালে নিজের এলাকা হুনানে তিনি যখন দেখলেন যে মাওয়ের ‘গ্রেট লিপ ফরওয়ার্ড’ প্রোগ্রাম সেখানে সর্বনাশ ডেকে আনছে, তিনি সেটা তার নেতা মাওকে একান্তে জানালেন। সেটাই তার কাল হয়ে দাঁড়ায়। তিনি তার নেতার ক্রোধ ও অত্যাচারের শিকার হন।
লিউ যে গ্রামে গিয়ে থেকে মাওয়ের ‘গ্রেট লিপ ফরওয়ার্ড’ প্রোগ্রামের ব্যর্থতার বিষয়ে সম্যক উপলব্ধি করেছিলেন, সেই গ্রামে এখন তার স্মরণে একটা জাদুঘরের মতো করা হয়েছে। দেশের এক সময়কার প্রেসিডেন্ট যে মাটির ঘরে থাকতেন, যে দুটি বেঞ্চকে পাশাপাশি রেখে তার ওপর ঘুমাতেন, সেসব এবং তখনকার কিছু ফটোগ্রাফ দিয়ে সেই জায়গাটাকে আগের মতো করে রাখার একটা চেষ্টা করা হয়েছে। ২০১৮ সালে শি তার এক বক্তৃতায় অত্যন্ত ভক্তিভরে এ স্মৃতিচিহ্নগুলোর কথা বলেন এবং যে ‘বাস্তবতার মধ্য দিয়ে সত্যকে দেখতে পায়’, সেরকম একজন পার্টি ক্যাডারের উদাহরণ দিতে গিয়ে শ্রদ্ধার সঙ্গে লিউর নাম উচ্চারণ করেন।
শি যে মাওকে অন্ধভাবে অনুসরণ করবেন না, সেটা তো তার লিউকে দেখার চোখ দিয়েই বোঝা যায়। এবং এটাও আন্দাজ করতে অসুবিধা হয় না যে, শত্রুর মুখে ছাই দিয়ে শি জিনপিংয়ের একনায়কতন্ত্র অনেক বেশি কার্যকর ও টেকসই হবে।
সৈয়দ মো. গোলাম ফারুক : পিএসসির সদস্য; মাউশি ও নায়েমের সাবেক মহাপরিচালক