তাদের হীনম্মন্যতা এখনো নিঃশেষ হয়ে যায়নি। নিঃশব্দে তারা ঘুরছে পাড়া-মহল্লা-দেশের আনাচে-কানাচে। এদের পূর্বসূরিরা সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি বাংলাদেশের স্থপতি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করেই ক্ষান্ত হয়নি, তারা তাদের স্থলাভিষিক্ত করে গেছে হয় নিজ বংশের কাউকে, না হয় আত্মীয়স্বজনের মধ্য থেকে বিষাক্ত কতগুলো নেকড়েকে। এরা আছে দেশের ভেতরে, আছে দেশের বাইরে। খুনিদের পাঁচজন তো বহাল তবিয়তে দিন কাটাচ্ছে আমেরিকা, কানাডায় এবং নাম না-জানা অন্য কোনো দেশে, ছদ্মবেশে, নীরবে নিভৃতে। তারা ষড়যন্ত্রের বেড়াজালে আটকে বঙ্গবন্ধুকে সপরিবার নির্মমভাবে হত্যা করেই থেমে থাকছে না; বাংলাদেশের রূপকারের অনেক ভালোবাসায় মোড়ানো জাতিরাষ্ট্রটিকে নাস্তানাবুদ করতে সদা তৎপর। দেশের ভেতরে থাকা এদের দোসররা সুযোগ বুঝেই মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে। তারা ভুলে গেছে, বঙ্গবন্ধুর সশরীর উপস্থিতি না থাকলেও তিনি প্রোথিত হয়ে আছেন দেশপ্রেমীদের হৃদয়ে, থাকবেন চিরকাল ধরে। চির অম্লান হয়ে আছেন তিনি সবার মনের মুকুরে।
বঙ্গবন্ধুর দুই কন্যা বিদেশে থাকার কারণে বেঁচে গেছেন নির্মম হত্যাযজ্ঞের হাত থেকে। বাকি সবাইকে যেভাবে হত্যা করা হয়েছে, তা ইতিহাসের পাতায় বিরল। যারা পরিকল্পিতভাবে এ হত্যাযজ্ঞের পেছনে কুশীলব হিসাবে কাজ করেছে, তারা একটু ভাবল না সদ্যস্বাধীন দেশটির ভবিষ্যতের কথা, কোটি মানুষের ভাগ্যের কথা, আপন ভূমির মান-সম্ভ্রমের কথা। সাতচল্লিশের তথাকথিত স্বাধীনতার চাদরের আবরণে ঢেকে থাকা পরাধীনতার শেকলে শৃঙ্খলিত এ লোকগুলো কেন ভাবল না, এমন একজন মহান ব্যক্তিকে তারা শেষ করে দিচ্ছে, যিনি জীবনের সোনালি দিনগুলো পাকিস্তানি সামরিক শোষকদের কারাগারে কাটাতে বাধ্য হয়েছেন শুধু বাঙালিদের ভালোবাসার কারণে, যিনি অনবরত অত্যাচার-নিপীড়নের শিকার হয়েছেন দেশের অর্থনৈতিক মুক্তির কথা বলার কারণে, স্বৈরশাসকের রক্তচক্ষুর শ্যেনদৃষ্টির ভেতরে দিন কাটিয়েছেন তার দীর্ঘ সংগ্রামী জীবনে, মৃত্যুর মুখোমুখি হয়েছেন অনেকবার বাঙালির প্রতি তার গভীর মমতার কারণে।
’৭৫-পরবর্তী ২০টি বছর তখনকার প্রজন্মকে বঙ্গবন্ধুর বিষয়ে এবং স্বাধীনতা অর্জনের/বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস জানতেই দেওয়া হয়নি। তারা জানিয়েছে শুধু বিকৃত ইতিহাস, মিথ্যায় ঠাসা গালগল্প। ইতিহাসের নামে স্কুল-কলেজের কারিকুলামে ঢুকিয়েছিল নির্জলা মিথ্যা তথ্য, যার ছিল না কোনো ভিত্তি, ছিল না কোনো বাস্তবতা। আমার জানামতে, একটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়কেও মুক্তিযুদ্ধবিরোধী শক্তির লোকজন মিথ্যা ইতিহাস তৈরির কারখানা বানিয়েছিল। বিকৃত ইতিহাস তৈরি করে দেশব্যাপী ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা লাখ লাখ কোমলমতি শিক্ষার্থীদের হাতে তা তুলে দেওয়া হয়েছিল। আজ পর্যন্ত সে ইতিহাস-বিকৃতির হোতা শিক্ষক নামের কুলাঙ্গারদের কোনো বিচার হয়নি। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষ শক্তি ক্ষমতায় না আসা পর্যন্ত প্রায় বিশ বছরের অধিককাল ধরে ইতিহাস হত্যার কাজ করেছে ওরা। বারবার হত্যা করেছে, বারবার কবর দিয়েছে। কিন্তু ইতিহাসই সাক্ষী, তারা তাদের জঘন্য দুষ্কর্ম সফল করতে পারেনি। সঠিক ইতিহাস কথা বলা শুরু করেছে যখনই বঙ্গবন্ধুর সুদক্ষ কন্যার স্ট্র্যাটেজিক নেতৃত্বের বদৌলতে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি সরকার গঠন করতে পেরেছে দীর্ঘকাল ধরে নিষ্পেষিত হওয়ার পর, জনগণের স্বতঃস্ফূর্ত ম্যান্ডেটের কারণে। সত্য ইতিহাস রাস্তা খুঁজে পেয়েছে। কিন্তু ’৭৫-পরবর্তী সামরিক জান্তার আমলে জোর করে ক্ষমতা দখলের পর থেকে যে প্রজন্ম ভুল ইতিহাস পড়েছে, শিখেছে, তাদের অনেকেই ভুলের খেসারত দিচ্ছে জঙ্গিপনার আশ্রয় নিয়ে, বিভ্রান্ত হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে সন্ত্রাসের চারণভূমিতে পা দিয়ে। এরাই নিরীহ মানুষকে পেট্রোল বোমা দিয়ে মেরেছে এবং মারছে, বাসে আগুন ধরিয়ে দিয়ে যাত্রীদের হত্যা করেছে, মানুষের কল্যাণে নিয়োজিত আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের ইটপাথর মেরে থ্যাঁতলে দিয়েছে, জনমনে ভীতির সঞ্চার করেছে। আজও তারা তৎপর। মিথ্যায় ভরা ভুল ইতিহাস এজন্য মূলত দায়ী।
যারা বঙ্গবন্ধুকে, বাংলাদেশের স্বাধীনতাকে হেয় করার চেষ্টা করেছেন এবং করছেন, তাদের কয়েকটি বিষয় সঠিকভাবে অনুধাবন করার জন্য কয়েকটি সত্য বিষয় তুলে ধরছি। সবকটি ১৯৭২-৭৪ সালে বিভিন্ন পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল। স্বাধীনতার অব্যবহিত পরে রাওয়ালপিন্ডির কারাগার থেকে মুক্ত হয়ে বাংলাদেশে প্রত্যাবর্তনের পর বঙ্গবন্ধু ক্লান্তদেহে অক্লান্ত মনোবল নিয়ে শুরু করেছিলেন ‘বাস্তব বাংলাদেশ’ বিনির্মাণের কাজ। ঘরের এবং বাইরের স্বার্থে তিনি জাতীয়তাবাদের সঙ্গে সংমিশ্রণ ঘটিয়েছিলেন আন্তর্জাতিকতাবাদের, আর ডাক দিয়েছিলেন স্পষ্ট রূপরেখাসহ দ্বিতীয় বিপ্লবের। ঘোষণা করেছিলেন শোষণমুক্ত সমাজ গড়ার। প্রাথমিকভাবে পদক্ষেপ নিয়েছিলেন দেশের মানুষকে দুমুঠো অন্ন আর পরনের বস্ত্রের ব্যবস্থা করার।
যারা এখনো মহান মুক্তিযুদ্ধের ভয়াল স্মৃতি নিয়ে বেঁচে আছেন, তাদের জানা আছে তখনকার সদ্য স্বাধীনতাপ্রাপ্ত দেশটির সার্বিক অবস্থা। তখন ছিল বিধ্বস্ত অর্থনীতি, বিপর্যস্ত রাজনীতি, বিক্ষত সমাজ-শিক্ষাব্যবস্থা, ধসে পড়া শিল্প-ব্যবসা-বাণিজ্য, ভেঙে পড়া আইনশৃঙ্খলা, পুনর্বাসনের খোঁজে কোটিখানেক ভারতফেরত সর্বস্বহারা বাঙালি শরণার্থীসহ আশ্রয়হীন মানুষ, পাকিস্তানি হানাদার কর্তৃক ধ্বংস করে ফেলা ফসল-বীজ-হালচাষের গবাদি পশু-সার সংকটে দিশেহারা কৃষক, একদিকে মুক্তিযুদ্ধবিরোধী এবং আরেক দিকে পথহারা স্বার্থান্ধ কতিপয় ছদ্মদেশপ্রেমী মুনাফিক রাজনীতিকের জনগণের মাঝে বিভাজন সৃষ্টির অপপ্রয়াস প্রভৃতি জটিল বিষয়। এগুলো ছিল অভাবনীয় কঠিন চ্যালেঞ্জ, যা তখনকার ভুক্তভোগীরা ছাড়া এখনকার অনেকের পক্ষে বুঝে ওঠাও প্রায় অসম্ভব। সেই প্রতিকূল সময়ে অসম্ভবতার এক প্রাচীরের এক পাশে প্রায় এককভাবে অবস্থান নিয়ে সত্যিকারের দেশপ্রেমী বাঙালিদের ওপর আস্থা রেখে প্রাচীর ভাঙার কাজে হাত দিয়েছিলেন ইতোপূর্বেই ভয়কে জয় করে নেওয়া বঙ্গবন্ধু; অকুতোভয়ে তিনি শুরু করেছিলেন দেশ পুনর্গঠনের কাজ। বাহাত্তরের ১০ জানুয়ারি স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের পর থেকেই মাত্র সাড়ে তিন বছর সময়কালে বিভিন্ন উপলক্ষ্যে বঙ্গবন্ধু অনেক পদক্ষেপ নিয়েছিলেন শুধু নব্য দেশটাকে বাঁচানোর জন্য, দেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষকে একটু শান্তি, একটু ভরসা দেওয়ার জন্য। বিভিন্ন দিক থেকে শুরু করা ষড়যন্ত্র এবং অশুভ শক্তির পাঁয়তারা রোখা, মুক্তিযোদ্ধারাসহ যাদের কাছে অস্ত্র ছিল তাদের কাছ থেকে অস্ত্রগুলো জমা নেওয়া, সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের পাকিস্তানি আমলাতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গি পালটানো, পাকিস্তানে আটকে পড়া বাঙালিদের বাংলাদেশে ফিরিয়ে আনা ও বাংলাদেশের হিস্যা মিটিয়ে দেওয়ার জন্য পাকিস্তানসহ বিশ্বসমাজের ওপর কূটনৈতিক চাপ প্রয়োগ, দালাল আইনে আটক এবং পরে বঙ্গবন্ধুর মানবিক নির্দেশে মুক্তিপ্রাপ্ত মুক্তিযুদ্ধবিরোধীদের নিত্যষড়যন্ত্র, আঞ্চলিকতাবাদের বিষ, দেশবিরোধীদের গুপ্তহত্যার বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান প্রভৃতি চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হয়েছে বঙ্গবন্ধুকে।
বঙ্গবন্ধুকে হত্যার ষড়যন্ত্র তিয়াত্তরেও হয়েছিল, যা ১৯৭৩-এর ৫ জানুয়ারি একটি দৈনিকে প্রকাশিত হয়। ষড়যন্ত্র অব্যাহত ছিল। তার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের মূল কারণ ছিল তিনি দেশের সার্বভৌমত্ববিরোধী, মুক্তিযুদ্ধবিরোধী, মুক্তিযুদ্ধকালীন লাখ লাখ বাঙালি হত্যাকারী রাজাকার-আলবদরদের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নিয়েছিলেন, বারবার স্বাধীন দেশের বিরোধিতাকারীদের এবং শান্তির শত্রুদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করেছিলেন, বিভিন্ন বিপর্যয় মোকাবিলাসহ আন্তর্জাতিক মৈত্রী প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষমতার পরিচয় দিয়েছিলেন, অতি অল্প সময়ের মধ্যে চৌকশ কূটনীতির মাধ্যমে পাকিস্তানের কাছ থেকে স্বাধীন বাংলাদেশের স্বীকৃতি আদায় করেছিলেন, শোষণমুক্ত সমাজ গড়ার প্রত্যয় নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন, রাষ্ট্রীয় জীবনে জনগণের রায়কেই চূড়ান্ত বলে ঘোষণা করেছিলেন, দেশের প্রত্যেক মানুষের খাদ্য, শিক্ষা, আশ্রয় আর উন্নত জীবনের অধিকারী করার প্রত্যয় ব্যক্ত করেছিলেন, সমাজতন্ত্র কায়েম করে জনগণের পাশে থেকে জনগণের মঙ্গলের জন্য কাজ করতে করতে জনগণের মধ্যেই মরতে চেয়েছিলেন। স্বাধীনতাবিরোধীদের কাছে তিনি অজনপ্রিয় হয়ে উঠেছিলেন আরও কিছু কারণে : তিনি ছাত্রসমাজ আর যুবসমাজকে সমাজের দায়িত্ব পালনের জন্য উদ্বুদ্ধ করেছিলেন, শিক্ষকদের প্রতি ভবিষ্যৎ নেতৃত্বদানের যোগ্য চরিত্রবান মানুষ গড়ার আহ্বান জানিয়েছিলেন, সমাজবিরোধী ও দুষ্কৃতকারীদের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নিয়েছিলেন, শিক্ষা-সংকটের অবসানসহ শিক্ষা পদ্ধতির আমূল পরিবর্তন শুরু করেছিলেন, সোনালি আঁশের সোনালি স্বপ্ন সফল করার লক্ষ্যে পাটশিল্পের উন্নতিসহ পাটশিল্পের স্বার্থরক্ষা করতে পদক্ষেপ নিয়েছিলেন, নারী প্রগতি আন্দোলনকে সমর্থন দিয়েছিলেন, সামাজিক অনাচারকারীদের বিরুদ্ধে জনগণকে ঐক্যবদ্ধ করার পদক্ষেপ নিয়েছিলেন এবং জনগণের দুঃখ-দুর্দশার সুযোগ নিয়ে কুচক্রীদের ছিনিমিনি না খেলতে হুঁশিয়ার করেছিলেন।
১৯৭৫-এর ১৫ আগস্ট পর্যন্ত দিকে দিকে মুখরিত ছিল এক নাম, আর তা ছিল শেখ মুজিব। সেদিন স্বাধীনতা ও গণতন্ত্রের কুচক্রীরা এ নামটি মুছে ফেলার চেষ্টা করেছে। আজও তাদের অপতৎপরতা চলছে বঙ্গবন্ধুর কন্যার বিরুদ্ধে, তার সরকারের বিরুদ্ধে। এখনো পাওয়া যায় তাদের অশুভ পায়ের আওয়াজ। বঙ্গবন্ধু আজ নেই। কিন্তু আছেন দেশব্যাপী হাজারো লক্ষ ভক্ত। তিনি অন্তরালে থেকে দেখছেন তার অনুসারীরা কীভাবে তারই বিশ্বস্বীকৃত রাষ্ট্রনায়ক কন্যা শেখ হাসিনার কল্যাণমুখী নেতৃত্বে দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন, কীভাবে সব অপশক্তিকে মোকাবিলা করছেন, কীভাবে তার গড়া দেশকে উন্নয়নের পথে ধরে রাখছেন, কীভাবে শত কূটচাল এড়িয়ে মুক্তিযুদ্ধের সমর্থক সরকারকে বিগত বছরগুলোয় বারবার শাসন-ক্ষমতায় ধরে রাখছেন উন্নয়নের ধারাবাহিকতা অব্যাহত রাখার লক্ষ্যে আর স্বাধীনতাবিরোধীদের ষড়যন্ত্র মোকাবিলা করার মানসে। বঙ্গবন্ধুর বিদেহী আত্মা শান্তি পাবে যখন তিনি পরলোক থেকে দেখবেন-এ দেশের জনগণ যাদের তিনি মনপ্রাণ দিয়ে ভালোবাসতেন, তারা তার কন্যাকে বারবার সুযোগ দিচ্ছে তারই রেখে যাওয়া স্বপ্ন বাস্তবায়ন করার লক্ষ্যে, সবুজে-শ্যামলে মায়াময় বাংলাদেশকে উন্নত বিশ্বের কাতারে পৌঁছার লক্ষ্যপূরণে শক্তিশালী করতে। আজ এ দিনে আমরা মহান স্রষ্টার কাছে বঙ্গবন্ধুর আত্মার মাগফিরাত কামনা করছি।
ড. এম এ মাননান : অধ্যাপক; সাবেক উপাচার্য, উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়