বঙ্গবন্ধু ছিলেন নিপীড়িত মানুষের কণ্ঠস্বর
মোনায়েম সরকার
প্রকাশ: ০৩ আগস্ট ২০২৩, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
ফাইল ছবি
একটি পরাধীন জাতির জন্য স্বাধীনতার স্বপ্ন দেখা স্বাভাবিক। কোনো মানুষই পরাধীন থাকতে চায় না। পরাধীনতার শৃঙ্খলে যে আটকা পড়েছে, সেই বুঝতে পারে পরাধীনতার যন্ত্রণা কত ভয়াবহ ও দুঃসহ। পরাধীন বাঙালিকে যে মহামানব স্বাধীনতার স্বপ্ন দেখিয়েছিলেন এবং সেই স্বপ্নের বাস্তবায়ন করেছিলেন তার নাম শেখ মুজিবুর রহমান। শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন অসম সাহসী একজন মুক্তির দূত। তিনি পরাধীন বাঙালিকে মুক্তি দিতে নিজের জীবনবাজি রেখেছিলেন। পৃথিবীর ইতিহাসে নিজের প্রাণবিসর্জন দিয়ে জাতিকে মুক্তি দেওয়ার মতো নেতা হাতেগোনা কয়েকজন মাত্র আছেন, তাদের মধ্যে শেখ মুজিব একজন। সেজন্যই বাঙালি জাতি তাকে বঙ্গবন্ধু উপাধিতে ভূষিত করেছে। তিনি হয়েছেন জাতির পিতা।
বাংলাদেশের স্বাধীনতার ইতিহাস কালে কালে খণ্ডিত হয়েছে। অবৈধভাবে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়ে যার যার সুবিধামতো সে সে নতুন ইতিহাস লিখতে চেষ্টার কোনো ত্রুটি করেনি; কিন্তু সত্য এমন এক অমোঘ শক্তি, যাকে কেউ কোনোদিন শেষ করতে পারেনি। শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের স্বাধীনতাসংগ্রামে কতখানি ভূমিকা রেখেছিলেন, তা কমবেশি সব বাঙালিই জানেন। সেই বহুল চর্চিত ইতিহাসকেই আবার নতুন করে পাঠককে স্মরণ করিয়ে দেওয়ার জন্য আজ কলম ধরেছি। আশা করি, নবীন-প্রবীণ পাঠক সমাজ আমার এ লেখার সঙ্গে একমত পোষণ করবেন। এখানে আমি ব্যক্তিগত কোনো কাল্পনিক সত্য পরিবেশন করব না-ঐতিহাসিকভাবে যা সত্য, তাকেই তুলে ধরার চেষ্টা করব মাত্র।
ঐতিহাসিক লাহোর প্রস্তাবে বাংলাদেশের স্বপ্ন প্রোথিত থাকলেও তা নিয়ে যথেষ্ট অস্পষ্টতা ছিল। কেউ-ই সেই মুহূর্তে স্বাধীন বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখার সাহস পাননি। সেই সময় সেটা দেখা সম্ভবও ছিল না; কিন্তু ১৯৭০ সালের নির্বাচন বাংলাদেশের স্বপ্নকে যেন নতুন করে সবার চোখে দোলা দিয়ে যায়। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে শেখ মুজিব সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতা হয়ে যখন পাকিস্তানের ক্ষমতায় বসার যোগ্যতা অর্জন করলেন, তখন দেখা গেল পাকিস্তানি শাসক-শোষকরা বাঙালি এ নেতার কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে টালবাহানা শুরু করল। শুধু তা-ই নয়, ২৫ মার্চ কালরাত্রিতে আকস্মিকভাবে পাকিস্তানি দখলদার বাহিনী জোরপূর্বক যুদ্ধ ঘোষণা করে নিরস্ত্র বাঙালিদের বিরুদ্ধে। সেই যুদ্ধের সব দোষ চাপানো হয় বঙ্গবন্ধুর ওপর। বঙ্গবন্ধু ছিলেন পাকিস্তানি সামরিক জান্তার চোখে এক মূর্তিমান আতঙ্ক। তিনি যেভাবে বাঙালি জাতির স্বাধিকারের বিষয়টি পরিষ্কার করে তোলেন, বাঙালি আর কোনো নেতার পক্ষে তা সম্ভব হয়নি। শেখ মুজিব জানতেন পাকিস্তানিরা কোনোদিনই বাঙালিদের হাতে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার ভার দেবে না। অবশ্য এ কথা এখন পাকিস্তানিদের লেখা বিভিন্ন বইপুস্তক থেকেও জানা যাচ্ছে। সিদ্দিক সালিক নামে একজন প্রত্যক্ষদর্শী পাকিস্তানি চক্রের অনেক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পরিবেশন করেছেন তার ‘Witness to Surrender’ গ্রন্থে। ১৯৭০ সালের জানুয়ারিতে তিনি ছিলেন সেনাবাহিনীর জনসংযোগ অফিসার, ঢাকায় পা দিয়েই তিনি শোনেন ইয়াহিয়া খান বাঙালিকে ‘বেজন্মা (বাস্টার্ড)’ বলে গালাগাল করছেন। এমনকি ইয়াহিয়া খান নিজের লোকদের শুনিয়ে শুনিয়েও শেখ মুজিবুর রহমানকে ‘বাস্টার্ড’ বলেছিলেন। ইয়াহিয়া খান যখন পাকিস্তানের সম্ভাব্য প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে সংলাপরত, সেই সময়ও ইয়াহিয়া খান তার সঙ্গীদের আশ্বস্ত করতেন এই বলে যে, ‘ব্ল্যাক বাস্টার্ডদের’ ক্ষমতা দেওয়া যাবে না। সিদ্দিক সালিক নিজ কানে এসব কথা শুনেছেন বলে তার বইতে উল্লেখ করেছেন। ভুট্টো ও ইয়াহিয়া খানের ভরসা ছিল চীন ও আমেরিকার ওপর। চীন ভারতবর্ষকে ঠেকিয়ে রাখবে আর আমেরিকা সোভিয়েত ইউনিয়নকে।
শেখ মুজিবুর রহমান জানতেন বাংলাদেশ একদিন স্বাধীন হবে ঠিকই, তবে সেই স্বাধীনতার জন্য তার জীবন বিপন্ন হবে। তাকে মরতে হবে। জুলফিকার আলী ভুট্টো একটি বই লেখেন, ‘দ্য গ্রেট ট্র্যাজেডি’ নামে। সেই বইয়ে তিনি উল্লেখ করেন, ঢাকায় ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে শেখ মুজিবুর রহমানের যখন প্রহসনের সংলাপ চলছিল, তখন ভুট্টোর সঙ্গে শেখ মুজিবের একবার দেখা হয়। প্রেসিডেন্ট ভবনেই তাদের দেখা হয়েছিল। শেখ মুজিব ভুট্টোকে আড়ালে ডেকে নিয়ে বলেছিলেন, ‘এরা কিন্তু আগে আমাকে মারবে, তারপর তোমাকে।’ ভুট্টো নাকি তখন নাটকীয়ভাবে জবাব দিয়েছিলেন এই বলে যে-‘আমি সেনাবাহিনীর হাতে মরব তবু ইতিহাসের হাতে মরব না।’ পরবর্তীকালে আমরা দেখলাম শেখ মুজিবের অনুমানই সত্য হতে। ভুট্টো সেনাবাহিনীর হাতে মারা পড়লেন ঠিকই।
ইয়াহিয়া খান শেখ মুজিবকে রাষ্ট্রদ্রোহী বলে ঘোষণা করেছিলেন, ‘This time Mujib will not go unpunished’. তিনি বলেছিলেন, শেখ মুজিবকে তিনি শাস্তি না দিয়ে ছাড়বেন না এবং হুংকার দিয়েছিলেন এক ইঞ্চি ভূমিও ছেড়ে দেওয়া হবে না। পাকিস্তানি জেনারেলদের বড় রকমের দুশ্চিন্তা ছিল বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে। তাকে বন্দি করতে পারা যাবে কি না, করা গেলে কোথায়, কীভাবে তাকে রাখাটা ঠিক হবে, এসব নিয়ে অনিশ্চয়তা বিদ্যমান ছিল। বন্দি করার কাজটা যখন সম্পন্ন হলো, তখন টিক্কা খান এতটাই আত্মবিশ্বাসী ছিলেন যে, ভেবেছিলেন বাঙালির বন্দি নেতাকে ঢাকায়ই রাখবেন এবং প্রকাশ্যেই বিচার করবেন। তবে যারা কিছুটা কম হিংস্র ও অধিক বাস্তববাদী ছিলেন, তারা স্বস্তি পেয়েছিলেন তাকে পশ্চিম পাকিস্তানে পাঠাতে পেরে। কিন্তু ইয়াহিয়া তাকে নিয়ে কী করবেন সে প্রশ্ন ইয়াহিয়ার নিজের জন্য গুরুত্বপূর্ণ ছিল। তার ওপর আন্তর্জাতিক চাপ ছিল মুজিবের সঙ্গে আলোচনা করে রাজনৈতিক সমঝোতায় পৌঁছার; কিন্তু মুজিবকে প্রকাশ্যে রাষ্ট্রদ্রোহী হিসাবে ঘোষণা দেওয়ার পর সেটি আর সম্ভব ছিল না। ওদিকে সেনাবাহিনী আশা করছিল তার বিচার করা হবে। তাই বিচারের ঘোষণা তাকে দিতে হয়েছিল এবং আয়োজনও করা হয়েছিল। তবে ইয়াহিয়ার বাঙালি উপদেষ্টা ও মন্ত্রী জিডব্লিউ চৌধুরীকে উদ্ধৃত করে হাসান জহির লিখেছেন, বিচারের ব্যাপারে ইয়াহিয়া যে স্থিরসংকল্প ছিলেন তা নয়। নানা টানাপোড়েনের মধ্যে বিশেষ সামরিক আদালতে বিচারের প্রতিক্রিয়াটি ঠিকই শুরু হয়ে গিয়েছিল। বিচারের সূত্রপাত ১১ আগস্ট, সমাপ্তি ১ ডিসেম্বর। সর্বসম্মত মৃত্যুদণ্ডের রায় দেওয়া হয় ডিসেম্বরের ৪ তারিখে; জেলখানার পাশে কবরও খনন করা হয়েছিল। কিন্তু ততক্ষণে তো যুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে। রায় কার্যকর করার প্রশ্নটা তাই অবান্তর হয়ে পড়েছিল। তদপুরি আমেরিকানরা নাকি দাবি করেছিল এবং সম্মতিও আদায় করে নিয়েছিল যে, মুজিবের বিরুদ্ধে রায় বাস্তবায়ন করা হবে না। যুদ্ধ এসে অনেক কিছুরই মীমাংসা করে দিয়েছে। কিন্তু আমরা পরে দেখলাম পাকিস্তানি গোষ্ঠীর সব হুংকার বাঙালি ভন্ডুল করে দিয়েছে। পাকিস্তানিরা শুধু এক ইঞ্চি ভূমি নয়, পুরো বাংলাদেশকেই মুজিবের হাতে ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়েছিলেন।
বঙ্গবন্ধু ছিলেন নিপীড়িত বাঙালির কণ্ঠস্বর, তার বজ্রকণ্ঠের ভেতর দিয়েই প্রকাশ পেত বাঙালির আশা-আকাঙ্ক্ষা, বেদনা, বিক্ষোভ। এজন্য পাকিস্তানিদের চোখে এবং পাকিস্তানিদের এদেশীয় দোসরদের চোখে শেখ মুজিবুর রহমানই ছিলেন এক নম্বর শত্রু। হামুদুর রহমান কমিশনের তদন্ত রিপোর্ট থেকে জানা যায় আরেক তথ্য। ওই রিপোর্ট শেখ মুজিবকে কোর্ট মার্শাল করা দরকার বলে জানায়। কিন্তু তার কোর্ট মার্শাল হলো না। কারণ, ক্ষমতায় এসে ভুট্টো নানা ধান্ধায় ব্যস্ত হয়ে পড়েন। তাছাড়া ভারতে আটক ৯০ হাজার সৈনিক ফেরত আনা, বাংলাদেশ যে ১৯৫ জনকে বিশেষ করে চিহ্নিত করে বিচারের জন্য তাদের রক্ষা করা-এসব করতে করতে ভুট্টো আর শেখ মুজিবকে নিয়ে বেশি মাথা ঘামাতে পারেননি। তাছাড়া এটিও অস্বীকারের উপায় নেই, তখন শেখ মুজিবের বিচার করতে গেলে ভুট্টো আর ইয়াহিয়া খানকেও কড়া মূল্য দিতে হতো।
সবচেয়ে মজার বিষয় হলো, পুরো পাকিস্তানি গোষ্ঠীকে একা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব যেভাবে মোকাবিলা করেছেন এবং বঙ্গবন্ধুকে সামনে রেখে বাঙালি জাতি যে লড়াই করেছেন, তা ভাবতে গেলে বিস্মিত হতে হয়। অত্যন্ত ঠান্ডামাথায় বঙ্গবন্ধু সবকিছুকে এমনভাবে ম্যানেজ করেছেন যে, দূরদর্শী নেতা না হলে ওই রকমের পরিস্থিতি থেকে একটি জাতিকে স্বাধীন করা মোটেই সম্ভব ছিল না।
আজ অনেকেই বলেন, মুজিব যখন বুঝতেই পেরেছিলেন সংলাপে কিছু হবে না, তাহলে ৭ মার্চের ভাষণে তিনি কেন সরাসরি স্বাধীনতার ঘোষণা দিলেন না। বঙ্গবন্ধুর কাছে খবর ছিল বিমানবাহিনী ও হেলিকপ্টার তৈরি ছিল লাখ লাখ মানুষের ওপর আক্রমণ করার জন্য। বঙ্গবন্ধু যখন তার বক্তব্যে বলেন-‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’, তখন স্বাধীনতা ডাকের আর বাকি রইল কী? এ প্রশ্নেরও উত্তর আছে সিদ্দিক সালিকের বইয়ে। সিদ্দিক সালিক তার বইয়ে লিখেছেন, ‘২৫ মার্চ রাতে গণহত্যা শুরুর সঙ্গে নাকি বেতারে শেখ মুজিবুর রহমানের নিজের কণ্ঠে রেকর্ড করা স্বাধীনতার একটি ঘোষণা শোনা গিয়েছিল।’ যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের অনেক পত্রপত্রিকায় বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণার সাক্ষ্যপ্রমাণ পাওয়া যায়। এ কথা কেউ বিশ্বাস করুক আর না করুক, তবে এটা ঠিক যে, পাকিস্তানিরা আক্রমণ না করলে তারা নির্ঘাত আক্রান্ত হতো, স্বাধীনতার রেকর্ড করা একটি ঘোষণাসহ বঙ্গবন্ধু ও আওয়ামী লীগ সেভাবেই প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছিল। পাকিস্তানি শাসক আইয়ুব, ইয়াহিয়া, ভুট্টো, টিক্কা, নিজামীসহ সবার নামই ইতিহাসের পাতা থেকে বিলীন হয়ে গেছে। বঙ্গবন্ধুর নামে ইতিহাসে নতুন অধ্যায়ের সৃষ্টি হয়েছে।
স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলার ইতিহাসে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট একটি কালো অধ্যায়ের সূচনা হয়। এদিন কেবল বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করা হয়নি, মুজিবপত্নী বঙ্গমাতা ফজিলাতুননেছা মুজিব, তার পুত্র-পুত্রবধূসহ পরিবারের অন্যদেরও হত্যা করা হয়েছিল। তার দুই কন্যা শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা বিদেশে থাকায় দৈবক্রমে প্রাণে বেঁচে যান। কেবল ব্যক্তিস্বার্থ সিদ্ধি বা ব্যক্তিগত আক্রোশ নয়, বঙ্গবন্ধু হত্যার সঙ্গে জড়িত ছিল দেশীয় ও আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রকারী চক্র, যারা বাংলাদেশের স্বাধীনতা চায়নি। এ চক্র এখনো সক্রিয় রয়েছে, তা আমরা প্রতিনিয়তই বুঝতে পারছি। বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ড নিঃসন্দেহে নির্মম এবং নৃশংস। বঙ্গবন্ধুর আত্মস্বীকৃত খুনিরা সদম্ভে ঘোষণা করেছে খুনের কথা। তবুও এ নৃশংস হত্যাকাণ্ডের বিচারপ্রক্রিয়া বন্ধ ছিল দীর্ঘ একুশ বছর।
আজ যারা কথায় কথায় মানবাধিকার ও গণতন্ত্রের বুলি কপচায়, তাদের কাছে জানতে ইচ্ছা হয়, বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর কোথায় ছিল মানবাধিকারের চেতনা? কাউকে পরিবারসহ হত্যা করাই বা ছিল কেমন গণতান্ত্রিক পদ্ধতি?
মোনায়েম সরকার : রাজনীতিক, লেখক ও মহাপরিচালক, বিএফডিআর