Logo
Logo
×

বাতায়ন

বিনিয়োগকারী ধরে রাখতে কমিশনের উদ্যোগ কী?

Icon

জাহিরুল ইসলাম

প্রকাশ: ২০ জুলাই ২০২৩, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

বিনিয়োগকারী ধরে রাখতে কমিশনের উদ্যোগ কী?

ফাইল ছবি

দেশের পুঁজিবাজারে বিনিয়োগকারীদের তথ্য সংরক্ষণকারী প্রতিষ্ঠান সেন্ট্রাল ডিপোজিটরি বাংলাদেশ লিমিটেডের (সিডিবিএল) বরাত দিয়ে একটি জাতীয় দৈনিকে প্রকাশিত প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, গত দুবছরে দেশে বেনিফিশিয়ারি ওনার্স (বিও) হিসাব বন্ধ হয়েছে প্রায় সাড়ে ছয় লাখ। অনেকের জানা, শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ করতে হলে ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান-সবার জন্য বিও হিসাব থাকা বাধ্যতামূলক।

এটি খুলতে হয় স্টক এক্সচেঞ্জে নিবন্ধিত কোনো ব্রোকারেজ হাউজে। সংশ্লিষ্ট হিসাবের তথ্য সিডিবিএলে দাখিলের মাধ্যমে তা সক্রিয় হওয়ার পরই কেবল কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান কেনাবেচা করতে পারেন তালিকাভুক্ত কোনো কোম্পানির শেয়ার। ব্যক্তির একাধিক ব্রোকারেজ হাউজে হিসাব খোলার সুযোগ রয়েছে। তাই উল্লিখিত সময়ে ঠিক কতজন বিনিয়োগকারী শেয়ারবাজার থেকে তাদের বিনিয়োগ প্রত্যাহার করেছেন, সিডিবিএলের এ পরিসংখ্যান থেকে তা নির্ণয় করা মুশকিল। তবে এটা স্পষ্ট, সাড়ে ছয় লাখ না হোক, হিসাবধারী ‘ব্যক্তি’ এর কাছাকাছি হলেও সংখ্যার বিচারে তা অনেক বড়। উল্লেখ্য, এসব হিসাব বন্ধের পর দেশে বিও হিসাবধারী হ্রাস পেয়ে দাঁড়িয়েছে মাত্র ১৮ লাখে।

আমাদের দেশের জনসংখ্যা এখন প্রায় ১৮ কোটি। এর বিপরীতে ১৮ লাখ বিনিয়োগকারী শতকরার হিসাবে মাত্র এক ভাগ। উদ্বেগের বিষয় হলো, বৃদ্ধি না পেয়ে সংখ্যাটি বরং দিন দিন হ্রাস পাচ্ছে। ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) পরিচালক শাকিল রিজভী অবশ্য পত্রিকাটিকে এর ব্যাখ্যায় বলেছেন, বন্ধ হওয়া সাড়ে ছয় লাখ বিও হিসাবের মধ্যে প্রকৃত বিনিয়োগকারী হতে পারে মাত্র ৫০ হাজার। অবশিষ্ট ছয় লাখ আইপিও (প্রাথমিক গণপ্রস্তাব) শিকারি। অনেকের হয়তো মনে আছে, ২০২০ সালে আইপিওর নিয়মে পরিবর্তন আনে পুঁজিবাজারের নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি)।

সে সময় আইপিও শেয়ার বরাদ্দের ক্ষেত্রে প্রচলিত লটারির নিয়ম বাতিল করা হয়। চালু হয় প্রো-রাটা পদ্ধতি। এতে সব আবেদনকারীকে বরাদ্দ দেওয়া হয় সমানসংখ্যক শেয়ার। এতে আইপিও শেয়ার নিয়ে যে রমরমা ব্যবসা বহুদিন প্রচলিত ছিল, তার সুযোগ বন্ধ হয়ে যায়। অন্যদিকে আইপিও শেয়ারে আবেদনের জন্য চালু করা হয় সেকেন্ডারি মার্কেটে ন্যূনতম বিনিয়োগের বিধান। এ অবস্থায় আইপিও শেয়ারে আবেদনের জন্য যারা একাধিক হিসাব পরিচালনা করতেন, তাদের পক্ষে ওইসব হিসাব সচল রাখা অনেকটাই কঠিন হয়ে পড়ে। এদিকে শুধু হাতেগোনা কয়েকটি শেয়ার পাওয়ার জন্য বিও হিসাব মেইনটেইন করাও তাদের জন্য পরিণত হয় লোকসানি প্রজেক্টে। এসব যুক্তিতে শাকিল রিজভীর বক্তব্য কিছুটা সঠিক মনে হতে পারে। তবে সাড়ে ছয় লাখের মধ্যে প্রকৃত বিনিয়োগকারী ৫০ হাজার হলেও বিষয়টিকে হালকাভাবে নেওয়ার সুযোগ নেই। শেয়ারবাজার থেকে তাদের বিনিয়োগ প্রত্যাহারে যেমন রয়েছে উদ্বেগ, তেমনি কিছু প্রশ্ন।

শুরুতেই উদ্বেগের কথা বলি। আমাদের দেশের পুঁজিবাজারে প্রতিষ্ঠানের বিনিয়োগ আশপাশের অনেক দেশের চেয়ে কম। বিনিয়োগে আসার মতো অনেক প্রতিষ্ঠান থাকলেও তারা কেন আসছে না, তার পেছনে রয়েছে নানা কারণ। এদিকে যেসব প্রতিষ্ঠান বিনিয়োগে রয়েছে, তারাও সক্ষমতার পুরোপুরি বিনিয়োগ করছে না বলে খবর আছে। এটা ঠিক, শেয়ারবাজারে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের থাকে ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি। উভয়ের জন্য ভিন্নতা রয়েছে পরিপালনের ক্ষেত্রেও। এর মধ্যে পুঁজিবাজারে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি সক্ষমতাপূর্ণ ব্যাংক খাতের প্রতিষ্ঠানগুলোর এক্সপোজার কীভাবে গণনা করা হবে, সে ব্যাপারেও নীতিগত সংস্কার কার্যক্রম ঝুলে ছিল দীর্ঘদিন। নিকট অতীতেই এর সমাধান হলেও বাজারে তার ইতিবাচক প্রভাব খুব একটা পড়েনি।

এ অবস্থায় বাজারে স্বাভাবিকতা ফেরানোর জন্য জরুরি ছিল বিদ্যমান ব্যক্তি বিনিয়োগকারীদের স্বতঃস্ফূর্ত ও সক্রিয় অংশগ্রহণ বাড়ানোর উদ্যোগ। কিন্তু তা হয়নি। বরং ক্ষেত্রবিশেষে নেওয়া হয়েছে বিপরীতধর্মী উদ্যোগ। খেয়াল করলে দেখা যাবে, বিনিয়োগকারীরা যে অ্যাপের মাধ্যমে এতদিন ফ্রিতে ট্রেড করতেন, তাতেও মাসিক ফি নির্ধারণের মতো উদ্যোগ এরই মধ্যে নিয়েছে ডিএসই। এ ব্যাপারে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বিনিয়োগকারীদের প্রতিক্রিয়ায় দেখা যায়, বিষয়টিকে অনেকেই নেননি ইতিবাচকভাবে। এতে ভবিষ্যতে নিষ্ক্রিয় বিনিয়োগকারী সংখ্যায় বাড়লেও অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না। মনে রাখা দরকার, আরও বেশি বিনিয়োগকারী নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়লে বাজারকে গতিশীল করা আরও কঠিন হবে।

বছরখানেক হলো প্রায় ‘স্থবির’ অবস্থায় রয়েছে আমাদের পুঁজিবাজার। এমন অবস্থা দীর্ঘায়িত হওয়ারও রয়েছে নানা বিপদ। বাজারের বিনিয়োগ থেকে দীর্ঘদিন রিটার্ন না পেলে সংশ্লিষ্টদের মধ্যে সৃষ্টি হয় নেতিবাচক প্রক্রিয়া। এতে বাজারের ওপর বিশেষত ব্যক্তি বিনিয়োগকারীদের আস্থাহীনতা আরও বাড়তে পারে। বর্তমান পরিস্থিতিতে অনেকেই চাইছেন বাজার থেকে বিনিয়োগ প্রত্যাহার করতে। কিন্তু ফ্লোর প্রাইস এবং নিজের পোর্টফোলিওতে থাকা শেয়ারের ক্রেতা না থাকায় অনেকে হয়তো ইচ্ছা সত্ত্বেও বাজার ছাড়তে পারছেন না। এমন পরিস্থিতি অব্যাহত থাকলে ফ্লোর প্রাইস তুলে দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আবারও শুরু হতে পারে বাজার থেকে বিনিয়োগ প্রত্যাহার এবং বিও হিসাব বন্ধের হিড়িক। এ থেকে বিনিয়োগকারীদের একাংশকে দমানো সম্ভব নাও হতে পারে। সেটা হবে বাজারের জন্য আরও বড় ক্ষতির কারণ।

মনে রাখা দরকার, ব্যাংক খাতে আমানতের বিপরীতে মুনাফার হার যখন বেশি থাকে, তখন পুঁজিবাজারে বিনিয়োগে মানুষ স্বভাবতই উৎসাহ হারায়। কারণ, ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান নির্বিশেষে পুঁজির নিরাপত্তার পাশাপাশি মুনাফারও নিশ্চয়তা চায়। ব্যাংক খাতে ঋণের বিপরীতে নয় শতাংশ মুনাফার যে হার এতদিন বেঁধে দেওয়া ছিল, গত মাসে ঘোষিত মুদ্রানীতিতে তা বাদ দেওয়া হয়েছে। জুলাইয়ের শুরু থেকে কার্যকর হয়েছে ঋণের নতুন মুনাফার হার। এতে আমানতকারীদেরও বর্ধিত হারে মুনাফাপ্রাপ্তির সম্ভাবনা বেড়েছে। এ অবস্থায় রিটার্নপ্রাপ্তির অনিশ্চয়তা এবং বিদ্যমান ঝুঁকিগুলো বিবেচনায় অনেকে শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ রাখতে চাইবে না। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে বিও হিসাব সচল রেখেও বিনিয়োগকারীরা যদি বাজার থেকে তাদের বিনিয়োগ প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত নেয়, তাহলে পরিস্থিতি কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে ভাবা যায়!

ভোগ্যপণ্যের বাজারে জিনিসের দাম কমলে চাহিদা বাড়ে। শেয়ারবাজারে দেখা যায় উলটো চিত্র। এখানে শেয়ারের দাম কমে মন্দাবস্থা তৈরি হলে বিনিয়োগকারীরাও বাজার ছাড়তে শুরু করে। বাজারে নতুন বিনিয়োগকারী আসার সম্ভাবনা কেবল তখন তৈরি হয়, যখন বাজার স্বাভাবিক থাকে। দীর্ঘদিন ধরে বাজারে যে অবস্থা বিরাজ করছে, তাতে পরিস্থিতির সহসা পরিবর্তন হবে, এ কথা নিশ্চিত বলা যাচ্ছে না। এ অবস্থায় বিএসইসির উচিত বিদ্যমান বিনিয়োগকারীরা যাতে বাজারে সক্রিয় থাকে, হতাশ হয়ে বাজার না ছাড়ে, সে ব্যাপারে উদ্যোগ নেওয়া।

এবার প্রশ্নগুলো উল্লেখ করি। বিনিয়োগকারীদের বাজার ছাড়ার তথ্য কমিশনের কাছে নিশ্চয়ই রয়েছে। তারা কেন বাজার ত্যাগ করছেন, কমিশন কি কখনো কারণগুলো সংশ্লিষ্টদের কাছে জানার চেষ্টা করেছে? নিয়ন্ত্রক সংস্থা হিসাবে বিএসইসির দায়িত্ব তো শুধু পরিপালনগত দিকগুলো দেখভাল করা নয়, বিনিয়োগকারীদের স্বার্থেরও সুরক্ষা নিশ্চিত করা। যেসব প্রকৃত বিনিয়োগকারী এ সময়ে বাজার ত্যাগ করলেন, তাদের স্বার্থ সুরক্ষার দায়িত্ব কি কমিশনের ছিল না? অনেক বিদেশি বিনিয়োগকারীও আমাদের শেয়ারবাজার ত্যাগ করেছেন এ সময়ে। তাদের বিনিয়োগ প্রত্যাহারের কারণও বিভিন্ন সময়ে আলোচিত হয়েছে সংবাদমাধ্যমে। কমিশনসংশ্লিষ্টরা হয়তো বলবেন, বাজারে বিনিয়োগকারীদের আগমন ও প্রস্থান একটি নিয়মিত প্রক্রিয়া। কিন্তু কথা হলো, এতে বাজারে যে ‘অস্বাভাবিক’ পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে, কমিশনের দৃষ্টিতে সেটাও কি ‘স্বাভাবিক’?

অস্বীকার করা যাবে না, বাজারে বিনিয়োগকারী যত কমবে, স্থবিরতা তত বেশি দীর্ঘায়িত হবে। এজন্য বিনিয়োগকারীদের বাজার ত্যাগের সুনির্দিষ্ট কারণগুলো চিহ্নিত করতে অংশীজনদের সঙ্গে আলোচনার উদ্যোগ নেওয়া জরুরি। চিহ্নিত সমস্যাগুলো নিরসনে দ্রুত উদ্যোগ নেওয়াও এখন সময়ের দাবি। একইসঙ্গে নতুন বিনিয়োগকারীরা যাতে এ বাজারের প্রতি আগ্রহী ও আস্থাশীল হতে পারেন, সে ব্যাপারেও নেওয়া দরকার কার্যকর পদক্ষেপ। এতে বিনিয়োগকারীর স্বার্থ সুরক্ষা তো হবেই, বাজারে গতিশীলতা সৃষ্টিও সহজ হবে। অর্থনীতির আকৃতির তুলনায় আমাদের পুঁজিবাজার এখনো অনেক ছোট। বিনিয়োগকারীরা অব্যাহতভাবে তাদের বিনিয়োগ প্রত্যাহার করলে বাজার মূলধনও স্বভাবতই কমবে। তা কি ভালো হবে আমাদের অর্থনীতির জন্য? দেশের অর্থনীতির সঙ্গে পুঁজিবাজারের আকার সামঞ্জস্যপূর্ণ করার উদ্যোগ গ্রহণের দায়িত্বও কি কমিশনের নয়?

জাহিরুল ইসলাম : ব্যাংক কর্মকর্তা

zahirul.du@gmail.com

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : সাইফুল আলম

প্রকাশক : সালমা ইসলাম