Logo
Logo
×

বাতায়ন

এমন খামখেয়ালিপনার জবাব কী?

Icon

বিমল সরকার

প্রকাশ: ১৬ জুলাই ২০২৩, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

এমন খামখেয়ালিপনার জবাব কী?

যিনি যাই ভাবুন আর বলুন, ঘটনাটিকে এক কথায় চরম দায়িত্বহীনতা ও খামখেয়ালিপনার পরিণতি ছাড়া আর কিছু ভাবতে পারি না।

কল্পনার অতীত, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কচিকাঁচা কিশোর-কিশোরীদের শিক্ষা নিয়ে এমন তামাশাও হয়! দামি পোশাক পরে এলাম আর গেলাম, লোকসমাজে মেলামেশা করলাম-এর নাম শিক্ষকতা নয়।

সৃজনশীল পদ্ধতি অনুযায়ী শ্রেণিকক্ষে পাঠদান ও পরীক্ষার প্রশ্নপত্র প্রণয়ন করার আগে প্রত্যেক শিক্ষকেরই একটি সৃজনশীল মন থাকা চাই। মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক স্তরে বিভিন্ন পরীক্ষায় সৃজনশীল পদ্ধতিতে লেখা উত্তরপত্র মূল্যায়নের ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। কেবল পড়াশোনা আর জানাবোঝা নয়, পরীক্ষকের সৃজনশীল মনও থাকা দরকার। অথচ আজ থেকে দেড় দশক আগে স্কুল ও কলেজ স্তরে সৃজনশীল পদ্ধতি চালু করা হলে দুই বছর, এমনকি পাঁচ-সাত বছর পরও সংবাদমাধ্যমে শিরোনাম হয় : স্কুল-কলেজের শিক্ষকদের পঞ্চাশ শতাংশের বেশি সৃজনশীল পদ্ধতি কী তা সঠিবভাবে জানেন না। এতদিনে এ পরিস্থিতির কি খুব একটা ইতিবাচক পরিবর্তন হয়েছে? অবস্থাদৃষ্টে আমার তা মনে হয় না।

নেত্রকোনা জেলার মদন উপজেলার একটি উচ্চবিদ্যালয়। নবম শ্রেণির শিক্ষার্থীদের অর্ধবার্ষিক পরীক্ষা চলমান। সময়সূচি অনুযায়ী ৭ জুন ইংরেজি প্রথম আর ৮ জুন ইংরেজি দ্বিতীয়পত্রের পরীক্ষা। এরই মধ্যে সংবাদমাধ্যমে খবর হয়েছে ‘প্রশ্নপত্র ফাঁস, স্কুলের নামও ভুল’ শিরোনামে। ফেসবুকে বেশ শোরগোল। জানাজানির পর আলোচনা-সমালোচনার মুখে দ্বিতীয়পত্রের পরীক্ষাটি স্থগিত করা হয়। প্রধান শিক্ষকের ভাষ্য : বুধবার (৭ জুন) প্রথমপত্রের পরীক্ষার দিন ভুল করে দুই-তিনটি কক্ষে পরীক্ষার্থীদের মধ্যে ইংরেজি দ্বিতীয়পত্রের প্রশ্ন বিতরণ করা হয়। বিষয়টি নজরে এলে তাৎক্ষণিক ওই প্রশ্ন তুলে নেওয়া হয়। তবে কিছু দুষ্ট ছাত্র হয়তো প্রশ্নটির ছবি তুলে রেখে পরে ফেসবুকে ছেড়ে দেয়। ‘প্রশ্নপত্রে বিদ্যালয়টির নাম ভুল হলো কীভাবে’ সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নের জবাবে প্রধান শিক্ষক বলেন, ‘কেটে সংশোধন করে দিয়েছি এবং যারা প্রশ্নপত্র তৈরি করেছেন তাদের কাছে এ বিষয়ে জানতে চেয়েছি।’

এ পর্যন্ত পড়ে সবার মনে উল্লিখিত বিষয়টি সম্পর্কে জানার কৌতূহল হয়তো রয়েই গেছে। কারণ, এতক্ষণে প্রশ্নপত্র ফাঁসের কথা জানা গেলেও বিদ্যালয়ের নামটি কীভাবে ভুল হলো তা স্পষ্ট হয়নি। ফাঁস হওয়া ওই প্রশ্নপত্রটিতে স্কুলের নামটি ভুল লেখা হয়েছে। বিদ্যালয়টির নাম ‘বালালী বাঘমারা উচ্চবিদ্যালয়’ হলেও প্রশ্নে লেখা রয়েছে ‘বালালী বাগজান উচ্চবিদ্যালয়’। সংবাদমাধ্যমে প্রকাশ, এ নিয়ে অভিভাবক, সাবেক ও বর্তমান শিক্ষার্থীসহ সচেতন ব্যক্তিরা বিস্মিত হয়েছেন। বিভিন্নভাবে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন তারা।

এটি বিচ্ছিন্ন কোনো ঘটনা হলে হয়তো বলার কিছু থাকত না, এড়িয়েও যাওয়া যেত সহজে। কিন্তু বাস্তবতা হলো, বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে এমন ঘটনা একের পর এক ঘটেই চলেছে। সংশ্লিষ্টদের হাতে সময় যেমন নেই(!), নেই কারও কাছে জবাবদিহিতার বালাই(?)। স্কুল-কলেজের প্রধান শিক্ষক এবং অধ্যক্ষরাও আজকাল পুলিশ বা প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের মতোই কথা বলেন : ‘অভিযোগ পেলে ব্যবস্থা গ্রহণ করব’ কিংবা ‘তদন্ত কমিটি করে দিয়েছি’।

আসলে কে কার দেখভাল করবে। দেশজুড়ে এখন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের (বিদ্যালয়, মহাবিদ্যালয়, বিশ্ববিদ্যালয়) একেবারে ছড়াছড়ি। এসব প্রতিষ্ঠানে নির্বাহী প্রধান ও শিক্ষকসহ বিভিন্ন পদে অযোগ্য লোকদেরও প্রচণ্ড ভিড়। একদিকে যোগ্যতা, সততা, কর্মনিষ্ঠা, দায়িত্ববোধ ও দক্ষতা; অন্যদিকে অকর্মণ্যতা, ফাঁকিবাজি, অসততা ও স্বার্থপরতা-আকার-আকৃতি আর কর্মপরিধি যেমনই হোক, একটি প্রতিষ্ঠানে কে কাকে চেনেন না কিংবা কে কার বিষয়ে জানেন না?

প্রথমপত্রের পরীক্ষায় দ্বিতীয়পত্রের প্রশ্নপত্র বিলিবণ্টন। তাছাড়া প্রশ্নপত্রের উপরে দেওয়া বিদ্যালয়ের নামটির বানানই ভুল। আমরা ভাবতে পারি না। সংশ্লিষ্ট শিক্ষকদের মধ্যে একজনের হাত, দুজনের হাত এভাবেই তো পরীক্ষার হলে শিক্ষার্থীদের হাতে প্রশ্নপত্রটি পৌঁছে। অন্যদিকে বিদ্যালয়ের নামের বানানটি বিকৃত হলেও শনাক্ত হলো শিক্ষক না, পরীক্ষার হল পর্যন্ত গড়িয়ে ওই শিক্ষার্থীদের কাছেই!

ফাঁকিবাজিরও একটা সীমা থাকা উচিত। সরকার থেকে নামমাত্র ‘অনুদান’ আর যার যার প্রতিষ্ঠান থেকে সামান্য বেতনে স্কুল-কলেজে দায়িত্ব পালন করেছেন আমাদের শিক্ষকরা। কায়ক্লেশে জীবনযাপন করলেও সততা, আদর্শ ও দায়িত্ব পালনে তারা ছিলেন মজবুত। অভ্যন্তরীণ পরীক্ষার প্রশ্নপত্র প্রণয়ন এবং উত্তরপত্র মূল্যায়নে টাকা বরাদ্দ ছিল তাদের ভাবনারও অতীত। ছিটেফোঁটা হলেও এমন মূল্যবোধের রেশ আমরাও অনেকটা দেখে এসেছি। হাল জমানায় প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল হলেও স্কুল-কলেজের শিক্ষকদের বেতন-ভাতার পরিমাণ ও অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা উল্লেখ করার মতো।

অনেক কাজ ও দায়িত্ব পালনের জন্য এখন প্রতিষ্ঠান থেকে টাকা পাওয়ার বন্দোবস্ত রয়েছে। তা সত্ত্বেও প্রশ্নপত্র প্রণয়নসহ পেশাগত দায়িত্ব পালনে একেকজনের এ কেমন ফাঁকিজুকি? এটিকে কেবল খামখেয়ালিপনা না, বড় অপরাধ বলেও গণ্য করা যায়। শিক্ষকতার মতো মহান পেশাটি কিছু লোকের কারণে কোনদিকে ধাবিত হচ্ছে? প্রতিষ্ঠানে প্রতিষ্ঠানে আদর্শের বদলে এ কী ধরনের জাল-চালিয়াতি? যে প্রতিষ্ঠানে চাকরি করে সংসার চালান, মূলত যাদের জন্য শিক্ষক হিসাবে তিনি পরিচিত ও সম্মানিত, সেই বিদ্যালয় কিংবা শিক্ষার্থীর প্রতি তার এ কী দায়বোধ!

বিমল সরকার : অবসরপ্রাপ্ত কলেজ শিক্ষক

 

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : সাইফুল আলম

প্রকাশক : সালমা ইসলাম