স্বদেশ ভাবনা
প্রতিদ্বন্দ্বিতাহীন সিটি নির্বাচন নিয়েই ইসি সন্তুষ্ট?
আবদুল লতিফ মন্ডল
প্রকাশ: ১২ জুলাই ২০২৩, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
৪২টি নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলের মধ্যে সরকারি দল আওয়ামী লীগসহ দু-তিনটি দলের অংশগ্রহণে মে ও জুনে অনুষ্ঠিত হলো পাঁচ সিটি করপোরেশন নির্বাচন। সিটি করপোরেশনগুলো হলো-গাজীপুর, খুলনা, বরিশাল, রাজশাহী ও সিলেট। প্রায় দশ বছর ধরে দেশে জাতীয় সংসদ নির্বাচন ও স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলোর নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতাহীনতা ও অনিয়মের যে ধারা চালু রয়েছে, সম্প্রতি অনুষ্ঠিত পাঁচ সিটি নির্বাচন সেই ধারার বাইরে ছিল না।
এদিকে দশ বছর ধরে দেশে জাতীয় ও স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠান পর্যায়ে সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন অনুষ্ঠিত না হওয়ায় বৈশ্বিক গণতন্ত্র সূচকে বাংলাদেশের অবস্থান ও মানে অবনতি ঘটেছে। যুক্তরাজ্যের লন্ডনভিত্তিক সাময়িকী দি ইকোনমিস্টের ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (ইআইইউ) কর্তৃক ১৬৭টি দেশ-অঞ্চল নিয়ে তৈরি বৈশ্বিক গণতন্ত্র সূচক ২০২২-এ বাংলাদেশের অবস্থান ৭৩। ২০০৬ সালে বৈশ্বিক গণতন্ত্র সূচকে বাংলাদেশের অবস্থান ছিল ত্রুটিপূর্ণ গণতন্ত্র (flawed democracy) ক্যাটাগরিতে। এরপর থেকে দেশটি বৈশ্বিক গণতন্ত্র সূচকে এক ধাপ নিচে অর্থাৎ মিশ্র শাসন (hybrid regime) ক্যাটাগরিতে অবস্থান করছে।
গণমাধ্যমের খবর অনুযায়ী, ২৫ মে গাজীপুর সিটি করপোরেশনের নির্বাচনে ভোটারের গোপনীয়তা ভঙ্গ এবং পুলিশি হয়রানির অভিযোগ উঠেছিল। ১২ জুন বরিশাল সিটি করপোরেশন নির্বাচনের দিন ইসলামী আন্দোলনের মেয়রপ্রার্থী সৈয়দ ফয়জুল করীম সরকারি দলের সমর্থকদের হামলার শিকার হন। হামলা ও ব্যাপক অনিয়মের অভিযোগে ইসলামী আন্দোলন নির্বাচনের ফলাফল প্রত্যাখ্যান করে। জাতীয় পার্টির মেয়রপ্রার্থী ভোট চুরির অভিযোগ তোলেন। ২১ জুন সিলেট সিটি করপোরেশনে নির্বাচন পরিস্থিতি নিয়ে ২২ জুন যুগান্তরে একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। এতে বলা হয়, সিলেট সিটি করপোরেশন নির্বাচনে ভোটকেন্দ্রের ভেতর ও বাইরে একচেটিয়া প্রভাব ছিল আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের। নৌকা প্রতীকের ব্যাজ ধারণ করে তাদের ভোটারদের ভোট দিতে প্রভাবিত করতে দেখা গেছে। কোথাও কোথাও গোপনকক্ষে গিয়ে নিজেরাই অন্যের ভোট দিয়ে দিয়েছেন। আবার কেউ কেউ গোপনকক্ষে গিয়ে তার পছন্দের প্রার্থীকে ভোট দিয়েছেন কি না, তা নিশ্চিত হয়েছেন। গোপনকক্ষে ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিনে (ইভিএম) এভাবে ভোট প্রদান রোধে প্রশাসন ও পুলিশের সহযোগিতা না পেয়ে কয়েকজন প্রিসাইডিং কর্মকর্তা অসহায়ত্ব প্রকাশ করেছেন। এসব সত্ত্বেও প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) পাঁচ সিটি করপোরেশন নির্বাচন নিয়ে সন্তোষ প্রকাশ করেছেন। তিনি বলেছেন, ‘আমাদের সময়ে ক্রিটিক্যাল নির্বাচনগুলো (পাঁচ সিটিতে নির্বাচন) ভালো হয়েছে’ (যুগান্তর, ২২ জুন)। আগামী দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে আশাবাদ ব্যক্ত করে তিনি আরও বলেছেন, ইসির বিশ্বাস, জাতীয় নির্বাচনেও ভোটাররা উৎসাহিত হবেন। তারা বুঝে নেবেন ভোট উৎসবমুখর হতে পারে। তাই ভোটাররা আগ্রহী হবেন ভোটকেন্দ্রে যেতে। এসব সিটি করপোরেশনে ভোট অনুষ্ঠান প্রসঙ্গে মন্তব্য করতে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, সিটি নির্বাচনগুলোয় মানুষ সুন্দরভাবে ভোট দিয়েছে। কাজেই এ নির্বাচন নিয়ে কেউ কোনো প্রশ্ন তুলতে পারবে না।
দেশে নির্বাচনের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জামায়াতে ইসলামীসহ অধিকাংশ বিরোধী রাজনৈতিক দলের বর্জনে ১৯৮৮ সালে অনুষ্ঠিত চতুর্থ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মধ্য দিয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতাহীন নির্বাচনের শুরু। নির্বাচনব্যবস্থায় বড় রকমের অনিয়ম দেখা দিলে তৎকালীন রাষ্ট্রপতি এইচএম এরশাদের নেতৃত্বাধীন জাতীয় পার্টি সরকারের পদত্যাগের দাবিতে এসব দল চতুর্থ জাতীয় সংসদ নির্বাচন বর্জন করে। ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি বিএনপির শাসনামলে দ্বিতীয়বার অনুষ্ঠিত হয় প্রতিদ্বন্দ্বিতাহীন জাতীয় নির্বাচন। ১৯৯১ সালের ফেব্রুয়ারিতে অনুষ্ঠিত পঞ্চম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জয়ী হয়ে বিএনপি সরকার গঠন করে। ১৯৯৪ সালে মাগুরার একটি আসনে উপনির্বাচনে অনিয়ম ও ভোট কারচুপির অভিযোগ এনে তৎকালীন প্রধান বিরোধী দল আওয়ামী লীগ নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে সংসদ নির্বাচনের দাবিতে আন্দোলন শুরু করে। অন্য দুটি বিরোধী দল জাতীয় পার্টি ও জামায়াতে ইসলামীও একই দাবিতে আন্দোলন করে। বিরোধী জোটের দাবি অনুযায়ী, জাতীয় সংসদ নির্বাচনকালীন নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা প্রবর্তনে প্রয়োজন সংবিধানের সংশোধন। সংবিধান সংশোধনে প্রয়োজন সংসদের মোট সদস্য সংখ্যার অন্যূন দুই-তৃতীয়াংশ সদস্যের সমর্থন। সংসদে বিএনপির দুই-তৃতীয়াংশ সদস্য না থাকায় বিএনপি সরকার সংসদ বিলুপ্ত ঘোষণা করে এবং ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি ষষ্ঠ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের ব্যবস্থা করে। প্রধান বিরোধী দল আওয়ামী লীগসহ অধিকাংশ বিরোধী রাজনৈতিক দল বর্জিত এ নির্বাচনে বিএনপি দুই-তৃতীয়াংশের বেশি আসনে জয়লাভ করে সরকার গঠন করে। অতঃপর বিরোধী দলের দাবির প্রতি সম্মান জানিয়ে বিএনপি সরকার সাংবিধানিক প্রক্রিয়া অনুসরণ করে ওই বছরের মার্চে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা প্রবর্তন করে এবং ক্ষমতা থেকে সরে দাঁড়ায়। তাই বাহ্যত প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক না হলেও ষষ্ঠ জাতীয় সংসদ নির্বাচন ছিল সৎ উদ্দেশ্যপ্রণোদিত।
তৃতীয়বারের মতো প্রতিদ্বন্দ্বিতাহীন জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় ২০১৪ সালের জানুয়ারিতে। ১৯৯৬ সালের মার্চে বিএনপি সরকার প্রবর্তিত জাতীয় সংসদ নির্বাচনকালীন নির্দলীয় সরকারব্যবস্থার অধীনে ১৯৯৬ সালে (জুন) সপ্তম, ২০০১ সালে (অক্টোবর) অষ্টম এবং ২০০৮ সালে (ডিসেম্বর) অনুষ্ঠিত নবম সংসদ নির্বাচন জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে প্রশংসিত হলেও নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ক্ষমতায় এসে আওয়ামী লীগ সরকার সংবিধান সংশোধনের (পঞ্চদশ সংশোধন) মাধ্যমে নির্দলীয় সরকারব্যবস্থা বাতিল করে। এতে দলীয় সরকারের অধীনে জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের বিধান প্রতিষ্ঠা পায়। তৎকালীন প্রধান বিরোধী দল বিএনপি নির্বাচনকালীন নির্দলীয় সরকারব্যবস্থা পুনরায় প্রবর্তনের দাবিতে আন্দোলন শুরু করে। দাবি আদায়ে ব্যর্থ হয়ে বিএনপি নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোট ও ৮টি সমমনা দল ২০১৪ সালের জানুয়ারিতে অনুষ্ঠিত দশম সংসদ নির্বাচন বর্জন করলে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ এবং গুটিকয়েক দলের অংশগ্রহণে অনুষ্ঠিত হয় নির্বাচন। এ নির্বাচনে জাতীয় সংসদের মোট ৩০০ আসনের বেশির ভাগ আসনে অর্থাৎ ১৫৪টিতে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় সদস্য নির্বাচিত হন। এর ফলে বাংলাদেশে গণতন্ত্র দুর্বল হয়ে পড়ে। দশম সংসদ নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক না হওয়ায় এবং এতে জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষার বিশ্বাসযোগ্য প্রতিফলন না ঘটায় তা দেশে-বিদেশে সমালোচিত হয়।
২০১৪ সালের জানুয়ারির অনেকটা একদলীয় দশম জাতীয় নির্বাচনের প্রভাব পড়ে স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলোর নির্বাচনের ওপর। স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠান যেমন: উপজেলা পরিষদ নির্বাচন-২০১৪, ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন, ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন ও চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন নির্বাচন-২০১৫, পৌরসভা নির্বাচন-২০১৫ এবং ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন-২০১৬-এ ভোটকেন্দ্র দখল, ব্যালট ছিনতাই, ভোটকেন্দ্র থেকে বিএনপিসহ বিরোধী দলগুলোর এজেন্টদের তাড়িয়ে দেওয়া প্রভৃতি অনিয়মের মাধ্যমে শাসক দল আওয়ামী লীগ মনোনীত-সমর্থিত প্রার্থীদের একচেটিয়া জয় নিশ্চিত করা হয় বলে অভিযোগ ওঠে।
একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে নজিরবিহীন অনিয়মের অভিযোগ তুলে মাঠের বিরোধী দল বিএনপি নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোট, আটদলীয় বাম গণতান্ত্রিক জোট এবং আরও কয়েকটি বিরোধী দল স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলোর নির্বাচনে অংশগ্রহণ না করার সিদ্ধান্ত নেয়। এর ফলে সরকারি দল আওয়ামী লীগসহ গুটিকয়েক দলের অংশগ্রহণে অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলোর নির্বাচন। সম্প্রতি অনুষ্ঠিত পাঁচ সিটি করপোরেশন নির্বাচনও এর ব্যতিক্রম নয়।
গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা, এর প্রাতিষ্ঠানিকীকরণ ও বিকাশের অন্যতম শর্তাবলি হলো সুষ্ঠু ও প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক নির্বাচন, সেই নির্বাচন জাতীয় বা স্থানীয় যে পর্যায়েই অনুষ্ঠিত হোক। প্রতিদ্বন্দ্বিতাহীন নির্বাচন গণতন্ত্রের জন্য অশনিসংকেত। এযাবৎ দেশের জাতীয় ও স্থানীয় নির্বাচনি কর্মকাণ্ডে সুষ্ঠু ও প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক নির্বাচনের শর্ত অধিকাংশ সময় পূরণ হয়নি। প্রতিদ্বন্দ্বিতাহীন চতুর্থ, ষষ্ঠ ও দশম সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের পর সংশ্লিষ্ট ইসিগুলো প্রকাশ্যে সন্তোষ প্রকাশ করেছিল কি না, তা জানা না গেলেও নজিরবিহীন অনিয়মের মধ্য দিয়ে অনুষ্ঠিত একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর কেএম নূরুল হুদা নেতৃত্বাধীন ইসি সংবাদ সম্মেলন করে সন্তোষ প্রকাশ করেছিল। পরবর্তী সময়ে স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রতিদ্বন্দ্বিতাহীন নির্বাচন করেও ওই ইসি সন্তুষ্ট ছিল। সম্প্রতি পাঁচ সিটিতে অনুষ্ঠিত প্রতিদ্বন্দ্বিতাহীন নির্বাচনে সন্তোষ প্রকাশের মাধ্যমে বর্তমান ইসি প্রতিদ্বন্দ্বিতাহীন দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের ইঙ্গিত দিচ্ছে না তো?
আবদুল লতিফ মন্ডল : সাবেক সচিব, কলাম লেখক
latifm43@gmail.com