জাতিসংঘ ও এর অঙ্গসংগঠন গত তিন দশকেরও বেশি সময় ধরে বিশ্ব জনসংখ্যা দিবসে বিশ্ববাসীকে শিশু, কিশোর-কিশোরী, তরুণ প্রজন্ম, সক্ষম দম্পতি, তাদের ছোট পরিবার গঠন, প্রজনন স্বাস্থ্যসেবা, মা ও শিশুমৃত্যু রোধে স্বাস্থ্যসেবা, বাল্যবিবাহ না হওয়া, সহিংসতা, বৈষম্য ও মানবাধিকার নিয়ে প্রকৃতি-পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা প্রভৃতি বিষয়ে নানা সচেতনতামূলক বাণী দিয়ে আসছে। উদ্দেশ্য, বিশ্বে যেন জনবিস্ফোরণ না ঘটে। যেন কাঙ্ক্ষিত পর্যায়ে জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণে রাখা যায়। এ ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশেও প্রতিবছর ১১ জুলাই বিশ্ব জনসংখ্যা দিবসটি পালিত হয় অত্যন্ত গুরুত্ব সহকারে।
বর্তমান বিশ্বে প্রতি ১০ থেকে ১৫ বছরে ১০০ কোটি জনসংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। এমন বৃদ্ধির প্রবণতা শুরু হয়েছে ১৯৮৭ সাল থেকে। তখন বিশ্বে জনসংখ্যা ছিল ৫০০ কোটি। জনসংখ্যা বৃদ্ধির এ প্রবণতায় ২০৫০ সাল নাগাদ বিশ্ব জনসংখ্যার যে চিত্রটি দাঁড়াবে, তা হিসাব করে জনমিতিবিদরা উদ্বেগের সঙ্গে বলেছেন-হয়তো একটা পৃথিবীতে এত মানুষের তখন সংকুলান হবে না। প্রয়োজন হবে আরও তিনটি পৃথিবীর। তাহলে পৃথিবীর অষ্টম জনবহুল বাংলাদেশের কী অবস্থা দাঁড়াবে ২০৫০ সালে! যে দেশে প্রতি বর্গকিলোমিটারে ১ হাজার ১৫ জন মানুষ বসবাস করছে, সেখানে কোটি কোটি জনসংখ্যা বৃদ্ধিতে তখন আমাদের আরও কয়টি বাংলাদেশের প্রয়োজন হবে?
বলা হচ্ছে, শতসহস্র বছর লেগেছিল বিশ্বে ১০০ কোটি মানুষ হতে। পরবর্তী ২০০ বছরে বা তারও বেশি সময়ে জনসংখ্যা বৃদ্ধি পায় ৭ গুণ। এরপর ১৯৮৭-তে বিশ্ব জনসংখ্যা দাঁড়ায় ৫০০ কোটি, ১৯৯৭-তে ৬০০ কোটি, ২০১১-তে ৭০০ কোটি, ২০২১-এ ৭৯০ কোটি, ২০৩০-এ হবে ৮৫০ কোটি, ২০৫০ সালে বিশ্বে জনসংখ্যা বৃদ্ধি পেয়ে দাঁড়াবে ৯৭০ কোটিতে, আর ২১০০ সালে হবে ১ হাজার ৯০ কোটি।
বিশ্বের অর্ধেক জনসংখ্যা বৃদ্ধি পায় ৯টি দেশে : ভারত, নাইজেরিয়া, কঙ্গো, পাকিস্তান, ইথিওপিয়া, তানজানিয়া, আমেরিকা, উগান্ডা, ইন্দোনেশিয়া। উল্লেখ্য, ২০২৪ সালেই ভারত হতে যাচ্ছে বিশ্বের সর্ববৃহৎ জন-অধ্যুষিত দেশ, যা চীনকেও ছাড়িয়ে যাবে। সবচেয়ে দ্রুত জনসংখ্যা বৃদ্ধি ও বর্ধনশীল দেশ হলো নাইজেরিয়া। পৃথিবীতে অনেক দেশ আছে যেখানে প্রতি মিনিটে ২৫০ শিশুর জন্ম হয়।
বিশ্বে ২০১০ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত মানুষের গড় আয়ু ছিল ৬৭ থেকে ৭১ বছর। ২০৪৫-২০৫০ সালে এ গড় আয়ু দাঁড়াবে ৭৭ বছরে। ২০৯৫-২১০০ সালে সম্ভাব্য গড় আয়ু হবে ৮৩ বছর। এ পরিপ্রেক্ষিতে ষাটের দশক থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশের জনমিতিক সূচকের ব্যাপক অগ্রগতি প্রশংসনীয় : জনসংখ্যা বৃদ্ধি ১.৩৭ শতাংশ, পরিবারপ্রতি গড় সন্তান ২.০৪, মাতৃমৃত্যু ১.৬৩ (প্রতি হাজারে জীবিত জন্মে), নবজাতকের মৃত্যু ০-২৮ দিন ১৫ জন (প্রতি হাজারে জীবিত জন্মে), ০-১ বছরের শিশুমৃত্যু ১১ জন (প্রতি হাজারে জীবিত জন্মে), ০-৫ বছরের শিশুমৃত্যু ২৮ জন (প্রতি হাজারে জীবিত জন্মে), পরিবার পরিকল্পনা পদ্ধতি ব্যবহারকারীর হার ৬৩.৯ শতাংশ, অপূর্ণ চাহিদা হ্রাস ১২ শতাংশ। বাংলাদেশের মানুষের গড় আয়ু এখন ৭২.৮ বছর। ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড ৬৬ শতাংশ (১০ কোটি ৫৬ লাখ, ইউএনডিপি)।
পাশাপাশি পুষ্টি কার্যক্রম, মা ও শিশু স্বাস্থ্যসেবা, শিশু, কিশোর-কিশোরীদের মানসিক স্বাস্থ্যসেবা, অটিজম সেবা ও পরামর্শের মাধ্যমে প্রতিটি পরিবারে শান্তি-সম্প্রীতি প্রতিষ্ঠায় এবং মা-শিশু স্বাস্থ্যে অর্জিত সূচক-সাফল্য রক্ষা করতে পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের ৫৫ হাজার কর্মকর্তা-কর্মচারী তাদের তৃণমূল পর্যায়ের লব্ধ জ্ঞান-অভিজ্ঞতায় ঘর থেকে ঘরে, ওয়ার্ড থেকে কমিউনিটিতে, সমতল থেকে দুর্গম জনপদে মানবিক ‘মেন্টর’ হিসাবে দায়িত্ব পালন করছেন।
বিশ্বজুড়ে জনবিস্ফোরণের বোঝা এই একটি পৃথিবীর পক্ষে বহন করা বা মানুষ-প্রকৃতি-পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা করা ক্রমেই কঠিন হয়ে উঠছে। এ কারণে গ্রিনহাউজ গ্যাসগুলোর-কার্বন ডাইঅক্সাইড, মিথেন, জলীয়বাষ্প, ওজোন, ক্লোরো-ফ্লুরো কার্বনের অতিরিক্ত ব্যবহারে বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধি পেয়েছে। ফলে বাংলাদেশ এ জলবায়ু পরিবর্তন, বৈশ্বিক উষ্ণতাজনিত দুর্যোগের অনিবার্য শিকার হয়ে তীব্র দাবদাহ, অতিবৃষ্টি-অনাবৃষ্টি, বজ্রপাত, ভূমিকম্প, ঝড়-জলোচ্ছ্বাসে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। এদেশের মানুষ, কৃষিজমি, সামগ্রিক উন্নয়ন ও অর্থনীতির ওপর পড়ছে বিরূপ প্রভাব।
সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা ও পৃথিবীপৃষ্ঠের তাপমাত্রা বৃদ্ধি পাওয়ায় একদিকে যেমন বাংলাদেশের বঙ্গোপসাগরঘেঁষা অঞ্চল, মালদ্বীপ, নিউইয়র্ক, লন্ডন, সিউল, টোকিওসহ বহু উপকূলীয় অঞ্চল সমুদ্রে তলিয়ে যাবে; আবার পৃথিবীপৃষ্ঠের উষ্ণতা বৃদ্ধিতে মেরু অঞ্চলের বরফ ও হিমবাহ গলে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি পেয়ে জলে ভাসবে মানুষ। আর কোটি কোটি মানুষ উদ্বাস্তু হবে এবং অকালে অনাহারে, নিরাশ্রয়ী হয়ে ও দুর্ভিক্ষে মৃত্যুবরণ করবে। বাড়বে মানুষের দেশান্তরী হওয়া। গাছগাছালি ধ্বংস হবে। এক বৈশ্বিক মানবিক বিপর্যয় দেখবে তখন সারা দুনিয়া।
এ অবনতিশীল বৈশ্বিক বিপর্যয় রুখতে বিশ্ব জনসংখ্যা দিবসে প্রতিবছর ১৯৯০ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত যত বাণী প্রতিপাদ্য হিসাবে পৃথিবীর সব রাষ্ট্র, রাষ্ট্রনেতা, সুশীল সমাজ, নানা স্তরের মানুষকে সচেতন করতে জানানো হয়েছে তা হলো-পরিবার পরিকল্পনা পদ্ধতি গ্রহণ করে জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে ছোট পরিবার গড়তে হবে। পরিবারে নারী ও শিশুর ওপর সহিংসতা ও বৈষম্য বন্ধ করে সমতা-সম্মান-মানবাধিকারের মাধ্যমে নারী, কিশোর-কিশোরীদের প্রজনন স্বাস্থ্যসেবা ও উন্নয়ন বিধান করতে হবে। বাল্যবিবাহ ও অনাকাঙ্ক্ষিত গর্ভধারণ হ্রাস করতে হবে। মা ও শিশুর স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করে মা ও শিশুমৃত্যু রোধ করতে হবে। কাঙ্ক্ষিত জন্মহার বা প্রজননহার যেন পরিবার, সমাজ, দেশ ও বিশ্বের উন্নয়ন, প্রকৃতি, পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা করতে পারে। বৈশ্বিক করোনা মহামারি ও বিভিন্ন দুর্যোগ-দুর্গতি মোকাবিলা করে নারী ও কিশোরীর প্রজনন স্বাস্থ্য এবং অধিকার নিশ্চিত করে জনসংখ্যা অবশ্যই কাঙ্ক্ষিত পর্যায়ে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে।
রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ, ব্যাপক অর্থনৈতিক মন্দা, জলবায়ু-প্রকৃতির অসহিষ্ণু অবস্থা মোকাবিলায় মানুষ নিরন্তর সংগ্রাম করছে। সমৃদ্ধি আনছে জীবনযাপনে। তারপরও জাতিসংঘের মহাসচিব অ্যান্তোনিও গুতেরেসের মতো শুভকামনা করে আমরাও বলতে পারি-বিশ্বের বিপুল জনসংখ্যা শুধু সংখ্যা নয়, কোটি কোটি মানুষের স্বপ্ন; সুযোগ ও নিত্যনতুন আবিষ্কারে তাদের মর্যাদাপূর্ণ তুষ্টিময় জীবন হয়ে উঠুক আগামী প্রজন্মের বাতিঘর। আমাদের বাংলাদেশও হয়ে উঠুক পরিকল্পিত জীবনযাপনের মাধ্যমে সুস্থ-সমৃদ্ধ জাতি।
চয়ন সেনগুপ্ত : সাবেক উপপরিচালক (আইএম); পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তর