Logo
Logo
×

বাতায়ন

ডেঙ্গুজ্বরের লক্ষণ

রোগীকে কখন হাসপাতালে নিতে হবে

Icon

ডা. মনজুর হোসেন

প্রকাশ: ০৬ জুলাই ২০২৩, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

রোগীকে কখন হাসপাতালে নিতে হবে

ফাইল ছবি

প্রতিবছর এ মৌসুমে ডেঙ্গুজ্বর বেড়ে যায়। এবারও ঢাকাসহ সারা দেশে ক্রমান্বয়ে বাড়ছে এডিস মশাবাহিত ডেঙ্গুজ্বরে আক্রান্তের সংখ্যা। শিশু-কিশোররাই এ জ্বরে আক্রান্ত হয় বেশি। বেশির ভাগ ডেঙ্গুর ক্ষেত্রে উপসর্গবিহীন বা হালকা লক্ষণ দেখা যায়।

ডেঙ্গুজ্বর কিছু ক্ষেত্রে গুরুতর অসুস্থতায় রূপ নিতে পারে, যা শিশু ও প্রাপ্তবয়স্কদের বিভিন্ন জটিলতাসহ মৃত্যুও ঘটাতে পারে। সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালে ডেঙ্গু রোগীর ভর্তি সংখ্যা ক্রমেই বাড়ছে। অনেক রোগী মারাও যাচ্ছে। এসব মৃত্যুর বেশির ভাগেরই কারণ হচ্ছে চিকিৎসা শুরু করতে দেরি হওয়া। দেরির কারণে জটিলতা দেখা দেয় এবং রোগীর অবস্থা আরও খারাপের দিকে চলে যায়। তাই ডেঙ্গুজ্বর হলে, বিশেষ করে শিশুদের ডেঙ্গুজ্বর হলে, কোন কোন লক্ষণ থাকলে দ্রুত হাসপাতালে নিতে হবে তা সবার জানা জরুরি।

ডেঙ্গুজ্বরের লক্ষণ নির্ভর করে এর ধরন বা ক্যাটাগরির ওপর। ডেঙ্গুজ্বরের তিনটি ধরন বা ক্যাটাগরি আছে : ‘এ’ বা সাধারণ, ‘বি’ বা ঝুঁকিপূর্ণ এবং ‘সি’ বা গুরুতর ও মারাত্মক ক্যাটাগরি। প্রথম ক্যাটাগরির রোগীরা স্বাভাবিক থাকে। তাদের শুধু জ্বর থাকে। অধিকাংশ ডেঙ্গু রোগী ‘এ’ ক্যাটাগরির। তাদের হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার কোনো প্রয়োজন নেই। বাড়িতে বিশ্রাম নেওয়াই যথেষ্ট।

অন্যদিকে, ‘বি’ ক্যাটাগরির ডেঙ্গু রোগীদের হাসপাতালে কিছু ক্ষেত্রে ভর্তি হওয়া প্রয়োজন হয়। রোগীর যদি অত্যধিক পেটে ব্যথা থাকে, বমি হয় অথবা রোগী যদি অন্তঃসত্ত্বা বা স্থূল হয়। এছাড়া ডেঙ্গুজ্বরের সঙ্গে অন্যান্য দ্বীর্ঘমেয়াদি রোগের উপস্থিতি থাকে, যেমন ডায়াবেটিস, জন্মগত ত্রুটি, কিডনি বা লিভারের সমস্যা ইত্যাদি ক্ষেত্রে হাসপাতালে ভর্তি হওয়াই ভালো।

‘সি’ ক্যাটাগরির ডেঙ্গুজ্বর সবচেয়ে খারাপ। এতে লিভার, কিডনি ও মস্তিষ্ক ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। কিছু ক্ষেত্রে রোগীর নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্র বা আইসিইউর প্রয়োজন হতে পারে।

ডেঙ্গুজ্বরের লক্ষণ

ডেঙ্গুজ্বরের লক্ষণগুলো সাধারণত সংক্রমণের ৩ থেকে ১৪ দিন পর শুরু হয়। ডেঙ্গুজ্বরের লক্ষণ এর পর্যায় ও প্রকারভেদের ওপর নির্ভর করে। অর্থাৎ ডেঙ্গুজ্বর হওয়ার পর একেক পর্যায়ে বিভিন্ন লক্ষণ প্রকাশ পায়। ডেঙ্গুজ্বরের পর্যায় সাধারণত তিন ভাগে বিভক্ত। প্রথমটি হলো ফেব্রাইল ফেইস বা জ্বরের পর্যায়, যা ২ থেকে ৭ দিন স্থায়ী হয়। এক্ষেত্রে তাপমাত্রা হঠাৎই বেড়ে যায়। ২ থেকে ৫ দিনের মধ্যে শরীরের বেশির ভাগ অংশে লাল ফুসকুড়ি দেখা দিতে পারে। দ্বিতীয়টি হলো, ক্রিটিক্যাল ফেস বা গুরুতর পর্যায়, যা ৪৮ থেকে ৭২ ঘণ্টা স্থায়ী হয়। জ্বর খুব একটা থাকে না, কিন্তু রোগী ক্লান্ত হয়ে পড়ে। রক্তকণিকার মধ্যে শ্বেতকণিকা ও প্লেটলেট বা অনুচক্রিকা কমে যায়। হেমাটোক্রিট (রক্তের হিমোগ্লোবিনের ঘনত্ব) বেড়ে যায়। তৃতীয় ও শেষটি হলো কনভালোসেন্ট বা রোগ থেকে উন্নতি হওয়ার পর্যায়।

সাধারণ বা ক্লাসিক্যাল জ্বর

এক্ষেত্রে জ্বর থাকে সাধারণত ২ থেকে ৭ দিন। উচ্চমাত্রার জ্বরের সঙ্গে মাথাব্যথা, বমি বমি ভাব ও বমি, খাওয়ায় অরুচি, শরীরের বিভিন্ন অস্থিসন্ধি ও মাংসপেশিতে তীব্র ব্যথা, চোখে ব্যথা অনুভূত হয়। চতুর্থ দিনে শরীরে ফুসকুড়ি দেখা যায়। ডেঙ্গুর এসব লক্ষণ সাধারণত ২ থেকে ৭ দিন স্থায়ী হয়। বেশির ভাগ মানুষই এক সপ্তাহ পর সুস্থ হয়ে যায়।

ডেঙ্গু হেমোরেজিক বা রক্তক্ষরণজনিত জ্বর : ডেঙ্গু হেমোরেজিক জ্বরে তীব্র পেটব্যথা হয়। বমি করতে করতে ক্লান্ত হয়ে পড়া, হাত-পা ছেয়ে দেওয়া, রক্তে অনুচক্রিকার মাত্রা অতিরিক্ত মাত্রায় কমে যাওয়া, রক্ত বমি হওয়া, দাঁতের মাড়ি থেকে রক্তপাত হওয়া, কালো পায়খানা হওয়া-এগুলো তীব্র ডেঙ্গুজ্বরের লক্ষণ বলে গণ্য হয়। একসময় রক্তপাত বেশি মাত্রায় হয়। প্লাজমা লিকেস বা রক্ত রস বেরিয়ে পেটের মধ্যে জমে, ফুসফুসে পানি জমে, যার ফলে শ্বাসকষ্ট হয়।

ডেঙ্গু শক সিন্ড্রোম বা মারাত্মক ডেঙ্গুজ্বর

এক্ষেত্রে মারাত্মক জটিলতার সৃষ্টি হয়। প্লাজমা লিক, তরল জমা, শ্বাসকষ্ট, মারাত্মক রক্তপাতের কারণে রক্তচাপ বিপজ্জনক মাত্রায় নেমে যেতে পারে। পরিণতিতে ডেঙ্গু শক সিনড্রোম হতে পারে। অনেক সময় এর থেকে মৃত্যুও হতে পারে। রক্তচাপ বিপজ্জনক মাত্রায় নেমে যেতে পারে, যার ফলে শক হয়। অভ্যন্তরীণ রক্তপাত হয় এবং লিভার ও কিডনি ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। মারাত্মক ডেঙ্গুজ্বরে মৃত্যুও হতে পারে।

মনে রাখবেন

তীব্র পেটে ব্যথা, ক্রমাগত বমি, শ্বাসকষ্ট ও অস্থিরতা দেখলে দ্রুত হাসপাতালে নিয়ে যেতে হবে। মনে রাখতে হবে, ডেঙ্গু হেমোরেজিক জ্বরের চিকিৎসা না করা হলে মৃত্যুহার ২০ থেকে ৫০ শতাংশ হতে পারে। তবে সাধারণ ডেঙ্গুর বেলায় ১ শতাংশেরও কম ক্ষেত্রে মারাত্মক হয়। অন্যদিকে ডেঙ্গু হেমোরেজিক জ্বর ২.৫ শতাংশের ক্ষেত্রে মারাত্মক হয়।

ডেঙ্গুজ্বরের চিকিৎসা

সাধারণ ডেঙ্গুজ্বরে চিকিৎসক বাড়িতে বিশ্রামে থাকার পরামর্শ দেন। সঙ্গে জ্বর কমানোর জন্য মাত্রা অনুযায়ী প্যারাসিটামল সিরাপ বা ট্যাবলেট খেতে হবে। প্রয়োজনে সাপোজেটরি ব্যবহার করতে হবে। তবে জ্বর কমানোর জন্য কোনো অবস্থাতেই এসপিরিন বা ক্লোফেনাক, ভলটারিন ধরনের ওষুধ দেওয়া যাবে না। মাথা ধুয়ে গা মুছে দিতে হবে। প্রচুর পরিমাণে তরল, খাবার স্যালাইন ও পানি খাওয়াতে হবে। মাঝারি বা তীব্র ডেঙ্গুজ্বরে সাধারণত হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার প্রয়োজন পড়ে। এক্ষেত্রে সাধারণত ইন্ট্রাভেনাস হাইড্রেশন বা স্যালাইন দেওয়ার প্রয়োজন হয়। রক্তক্ষরণ বেশি হলে তার জন্য প্রয়োজনে রক্ত দেওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। অ্যান্টিবায়োটিকের খুব বেশি দরকার হবে না, যদি না শিশুর মধ্যে অন্যান্য সেকেন্ডারি ইনফেকশন থাকে; যেমন-নিউমোনিয়া, বুকে ইনফেকশন, প্রস্রাবে ইনফেকশন ইত্যাদি।

ডেঙ্গুজ্বর প্রতিরোধে করণীয়

বাহক এডিস মশা দমন করাই ডেঙ্গুজ্বর প্রতিরোধের প্রধান উপায়। এক্ষেত্রে আমাদের করণীয় হলো-বাসগৃহে ফুলের টব, পরিত্যক্ত টায়ার, ডাবের খোসা ইত্যাদিতে পানি জমতে না দেওয়া; পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখা, দিনের বেলায় মশারি ব্যবহার করা। অর্থাৎ রোগ ছড়ানোর আগেই এডিস মশা নির্মূল করে ডেঙ্গুজ্বর প্রতিরোধের ব্যবস্থা গ্রহণ করা। স্কুল-কলেজের ছাত্র-শিক্ষক ও অভিভাবকসহ দেশের সর্বস্তরের জনগণ সচেতন হলেই ভয়াবহ ডেঙ্গুজ্বর প্রতিরাধ করা সম্ভব। বৃষ্টির পানি জমে থাকলেই ভয়াবহ রূপে ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব দেখা দেয়। দেশের প্রায় সব স্থানেই ডেঙ্গুর বাহক এডিস মশার ডিম রয়েছে। বছরব্যাপী মশক নিধন কার্যক্রম চালিয়ে এসব ডিম ধ্বংস করা সম্ভব। প্রতিকূল পরিবেশে এসব ডিম সুপ্ত অবস্থায় দীর্ঘদিন থাকতে পারে। যখনই বৃষ্টি পড়ে পানি জমতে শুরু করে, তখন ওই ডিম থেকে মশা বেরিয়ে আসে। পরিস্থিতি এড়াতে এখনই সারা দেশে ডেঙ্গুর সম্ভাব্য প্রজনন ক্ষেত্র ধ্বংস করতে হবে।

ডা. মনজুর হোসেন : শিশুরোগ ও শিশু হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ; সভাপতি, বাংলাদেশ শিশু সংক্রামক ব্যাধি সমিতি; সাবেক অধ্যাপক ও পরিচালক, ঢাকা শিশু হাসপাতাল

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : সাইফুল আলম

প্রকাশক : সালমা ইসলাম