নারীর স্বাস্থ্যগত সুরক্ষায় বিশেষ পদক্ষেপ নিন
প্রণব মজুমদার
প্রকাশ: ০৫ জুলাই ২০২৩, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
আমাদের প্রধানমন্ত্রী নারীবান্ধব। ভাবেন তাদের নিয়ে সবসময়। নিঃসন্দেহে বলা যায়, দেড় দশকের উন্নয়নে দেশের নারীরা অনেকটা পথ এগিয়েছে। নারীর ক্ষমতায়ন বেড়েছে। কর্মযোগে এ সময়ে নারীর অংশগ্রহণ বেশ বৃদ্ধি পেয়েছে। রাজনীতির শীর্ষ পদে নারী। প্রধানমন্ত্রী, জাতীয় সংসদের স্পিকার, বিরোধী দলের নেতা নারী। সচিব, প্রশাসক, মন্ত্রী, স্থানীয় সরকারপ্রধান, বিচারক, শিক্ষাবিদ, নগর মাতা, রেলচালক, লেগুনাচালক, পাঠাও চালক, শ্রমিক, চিকিৎসক, সাংবাদিক-প্রায় সব পদ ও স্থানেই নারীর নেতৃত্ব ও ক্ষমতা বেড়েছে। তা হয়েছে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও তার সরকারের ঐকান্তিক আগ্রহে। নারীকে অগ্রাধিকার দিয়ে ২০০৯ সাল থেকে দেশে চালু হয় জাতীয়ভাবে জেন্ডার বাজেট। জাতীয় বাজেটে নারীর অগ্রগতি ও অধিকার প্রতিষ্ঠায় সরকারিভাবে এ উদ্যোগ নেওয়া হয়। অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা (২০২০-২০২৫) এবং জাতীয় নারী উন্নয়ন নীতি, ২০১১-এ নারীর রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক ক্ষমতায়নকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। ২০২৩-২৪ অর্থবছরের মোট জাতীয় বাজেট ৭ লাখ ৬১ হাজার ৭৮৫ কোটি টাকার মধ্যে নারী উন্নয়নে বরাদ্দ রাখা হয়েছে ২ লাখ ৬১ হাজার ৭৮৭ কোটি টাকা, যা মোট বাজেটের ৩৪ দশমিক ৩৭ শতাংশ এবং আগের অর্থবছরের (২০২২-২৩) চেয়ে ৩২ হাজার ১১০ কোটি টাকা বেশি। স্বাস্থ্য খাতে এবারও বেশ গুরুত্ব দিয়েছে সরকার। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে এ খাতে বরাদ্দ রাখা হয়েছে ৩৮ হাজার ৫২ কোটি টাকা, যা আগের অর্থবছরে ছিল ৩৬ হাজার ৮৬৩ কোটি টাকা।
নারী উন্নয়নের জন্য ফি বছর জাতীয় বাজেটে হাজার হাজার কোটি টাকার বরাদ্দ বাড়ানো হয়, কিন্তু মেয়েরা কি স্বাস্থ্যগত সুরক্ষা সঠিকভাবে পাচ্ছে? ঘরের বাইরে স্বাস্থ্যগতভাবে কি নারী নিরাপদ? সভ্যতার আলো ছড়িয়ে পড়েছে গ্রাম থেকে শহরে তথ্যপ্রযুক্তির কল্যাণে, সে কথা অস্বীকার করছি না। কিন্তু স্বাস্থ্যগতভাবে ঘরের বাইরে নারী যে নিরাপদ নন, তা জোর দিতেই বলতে পারি। আমাদের নারীরা যারা নগরে বাস করছেন; যাতায়াতে স্বাস্থ্য সুরক্ষায় তারা মোটেও নিরাপদ নন। জলপথের যানবাহনে শুধু মেয়েদের জন্য আলাদা ‘ওয়াশ রুম’ রয়েছে। কিন্তু বিশাল এ মহানগরীতে মাত্র কয়েকটি স্থান ছাড়া মেয়েদের জন্য আলাদা এ ব্যবস্থা থাকলেও মোটেও তা জীবাণুমক্ত নয়। দুর্গন্ধে অধিকাংশ মেয়ে সিটি করপোরেশনের শৌচাগারে যেতে পারে না। অথচ সিটি করপোরেশনের বাজেটে বরাদ্দ প্রতিবছরই বাড়ে। গ্রামীণ ও নগর জনপদে চলাচলে নারীদের সমস্যার শেষ নেই। অধিকাংশ নারীর কাছে তা এক অন্যতম প্রধান সমস্যা।
তিলোত্তমা রাজধানীতে আকাশচুম্বী দালানের সারি। অপরিকল্পিত ঘনবসতির এ মহানগরীতে সড়কের প্রান্তে প্রান্তে সরকারিভাবে উন্নতমানের ‘পাবলিক টয়লেট’ নেই। নেই ‘রিফ্রেশমেন্ট রুম’ বা স্নানাগার! ঘরের বাইরে যাতায়াত বা চলাচলে মেয়েদের সুরক্ষা নেই। ৩০৫ দশমিক ৪৭১ বর্গকিলোমিটার আয়তনের ১ কোটি ২ লাখ ৭৮ হাজার ৮৮২ লোকের জন্য শুধু ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন এলাকায় রয়েছে মাত্র ৭০টি শৌচাগার। অপরিচ্ছন্ন এসব শৌচাগারের বেশিরভাগই নারীদের ব্যবহারের অনুপযোগী। নারীদের জন্য তা ঝুঁকিপূর্ণও বটে। কর্মজীবী নারী ও শিক্ষার্থী ঋতুমতী মেয়েরা ঘরের বাইরে অনিরাপদ-এ বিষয়টি নতুন নয়। ঘরের বাইরে এ ব্যাপারে নিজেকে সুরক্ষায় প্রতিনিয়তই বিড়ম্বনার শিকার হতে হয় তাদের।
পুরুষও নারীর জঠর থেকে আসা মানুষ। তাই নারীর এ সমস্যাটি আমাকেও স্পর্শ করে। ভাবনাটা বেশ তাড়িয়ে বেড়ায় আমাকে। ঘরের বাইরে নারীর স্বাস্থ্যগত সমাধানে নিচের পদক্ষেপগুলো দেশের পৌরসভা ও সিটি করপোরেশনগুলোর গ্রহণ করা উচিত। নারী কর্মীদের দিয়ে পরিচালিত নারীদের জন্য বিনামূল্যে স্বাস্থ্যসম্মত শৌচাগার ও পোশাক পরিবর্তনে আলাদা আলাদা একাধিক কক্ষ স্থাপন করতে হবে পৌরসভা ও সিটি করপোরেশনগুলোয়। এক কিলোমিটার সড়কের মধ্যে কমপক্ষে পাঁচটি স্থানে এ স্থাপনা তৈরি করতে হবে। রজঃস্বলা নারীদের বিনামূল্যে জীবাণুমুক্ত প্যাড (ন্যাপকিন) সরবরাহ করতে হবে। স্বাস্থ্য সুরক্ষার এ উদ্যোগ পৌরসভা ও সিটি করপোরেশনগুলোকেই নিতে হবে।
২০২২ সালের জনশুমারি অনুযায়ী দেশের জনসংখ্যা ১৬ কোটি ৫১ লাখ ৫৮ হাজার ৬১৬। এর মধ্যে নারীর সংখ্যা ৮ কোটি ৩৩ লাখ ৪৭ হাজার ২০৬ এবং পুরুষের সংখ্যা ৮ কোটি ১৭ লাখ ১২ হাজার ৮২৪। আর তৃতীয় লিঙ্গের সংখ্যা ১২ হাজার ৬২৯। তার মানে মোট জনগোষ্ঠীর মধ্যে নারীই সংখ্যাগরিষ্ঠ। বৃহৎ এ জনগোষ্ঠীর উন্নয়নও দেশের প্রবৃদ্ধির শামিল। স্বাস্থ্য ঠিক না থাকলে কর্ম শ্লথ হয়ে যায়। নারীর প্রতি বৈষম্যমূলক আচরণ রোধ করতে হবে। কর্ম বাজারে নারীর শ্রমমূল্যে এখনো বৈষম্য বিদ্যমান। নারী সুরক্ষিত থাকলেই নর সুন্দর হয়। নারী-পুরুষের সমঅধিকার নিশ্চিত করে সার্বিক উন্নয়নে এগিয়ে যাবে স্মার্ট বাংলাদেশ, এমনটাই প্রত্যাশা করি।
প্রণব মজুমদার : প্রাবন্ধিক, কবি ও অর্থকাগজ সম্পাদক
reporterpranab@gmail.com