স্বদেশ ভাবনা
কুরবানির পশু উৎপাদনে স্বনির্ভর হয়ে ওঠার গল্প
আবদুল লতিফ মন্ডল
প্রকাশ: ২৮ জুন ২০২৩, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
আগামীকাল বাংলাদেশে উদযাপিত হবে মুসলমানদের দুটি প্রধান ধর্মীয় উৎসবের একটি পবিত্র ঈদুল আজহা। ঈদুল আজহার অন্যতম অনুষঙ্গ হচ্ছে আর্থিকভাবে সামর্থ্যবানদের পক্ষ থেকে আল্লাহর নামে পশু কুরবানি। কয়েক বছর আগেও চাহিদা অনুযায়ী বাংলাদেশে কুরবানির পশু, বিশেষ করে গরুর উৎপাদন না থাকায় ঈদুল আজহার সময় ভারত থেকে আসা গরুর ওপর অনেকটা নির্ভর করতে হতো। ভারতীয় গরু বাংলাদেশে আসা একটা নিয়মে পরিণত হয়েছিল।
ঈদুল আজহাসহ বছরের অন্য সময়েও দেশে মাংস সরবরাহে ভারতীয় গরু গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখে আসছিল। ২০১৫ সালে ভারতের বিজেপি সরকার বাংলাদেশে গরু প্রবেশ সম্পূর্ণভাবে বন্ধ করে দেয়। এতে সে বছর এবং পরবর্তী দু-তিন বছর দেশে ঈদুল আজহার সময় গরুর চাহিদার বিপরীতে সরবরাহে স্বল্পতা দেখা দেয়। বাজারে মাংসের দাম বৃদ্ধি পায়। ভারতের নিষেধাজ্ঞাকে চ্যালেঞ্জ হিসাবে নিয়ে দেশের খামারি ও কৃষকরা দেশে গরু উৎপাদনে অনেকটা বিপ্লব ঘটিয়েছে। অবশ্য সরকারি সহায়তা তাদের এ বিপ্লব ঘটানোয় সহায়তা করেছে।
পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, দেশে এ বছর কুরবানির পশুর সম্ভাব্য চাহিদা আছে ১ কোটি ৩ লাখ ৯৪ হাজার ৭৩৯টি। এর বিপরীতে কুরবানিযোগ্য পশু আছে ১ কোটি ২৫ লাখ ৩৬ হাজার ৩৩৩টি। এর মধ্যে ৪৮ লাখ ৪৩ হাজার ৭৫২টি গরু-মহিষ, ৭৬ লাখ ৯০ হাজার ছাগল-ভেড়া এবং বাকিটা অন্যান্য গবাদিপশু। এ সংখ্যা গতবারের চেয়ে ৪ লাখ ১১ হাজার বেশি। চাহিদার হিসাবে এবার ঈদুল আজহায় উদ্বৃত্ত পশুর সংখ্যা ২১ লাখ ৪১ হাজার ৫৯৪।
সরকারি হিসাবে এবার ঈদুল আজহায় পর্যাপ্তসংখ্যক কুরবানির পশুর সরবরাহ হবে। পত্রপত্রিকার রিপোর্ট অনুযায়ী, সরবরাহে পর্যাপ্ততা সত্ত্বেও গরু ও অন্যান্য পশুর দাম এবার অন্য যে কোনো বছরের চেয়ে বেশি হবে। প্রায় দুই ডিজিটের মূল্যস্ফীতি হার (মে মাসে ৯.৯৪ শতাংশ) খাদ্য খাত ও খাদ্যবহির্ভূত খাতে মূল্য বৃদ্ধি ঘটিয়েছে। এতে মূল্যবৃদ্ধি ঘটেছে পশুপালন খাতেও। খামারিদের ভাষ্য অনুযায়ী, গো-খাদ্য, মজুরি ও ট্রাক ভাড়া বৃদ্ধির কারণে এবার পশুর দাম কিছুটা বেশি। তারা বলছেন, বর্তমানে এক বস্তা ভালো মানের গমের ভুসি বিক্রি হচ্ছে ১ হাজার ২০০ থেকে ১ হাজার ২৫০ টাকায়, যা কয়েক মাস আগে বিক্রি হতো ৯৫০ থেকে ১ হাজার টাকায়। একইভাবে মাষকলাইয়ের ভুসির বস্তা বিক্রি হচ্ছে ১ হাজার ৪০০ থেকে ১ হাজার ৪৫০ টাকায়, যা দুই থেকে তিন মাস আগেও ১ হাজার ১০০ থেকে ১ হাজার ২০০ টাকায় বিক্রি হতো। এক বস্তা খৈল বিক্রি হচ্ছে ৩ হাজার থেকে ৩ হাজার ২০০ টাকায়, যা কয়েক মাস আগে ২ হাজার ৫০০ থেকে ২ হাজার ৬০০ টাকায় বিক্রি হতো। দাম বেড়েছে শুকনা খড়েরও। বর্তমানে এক মণ খড় বিক্রি হচ্ছে ৪০০ থেকে ৪৫০ টাকায়। বেড়েছে গরু পরিবহণে ট্রাক ভাড়া। উদাহরণস্বরূপ, সাধারণ মৌসুমে আরিচা থেকে ঢাকায় গরুবাহী প্রতিটি ট্রাকের ভাড়া ৫ হাজার টাকা। কিন্তু কুরবানির জন্য ৮ থেকে ১০ হাজার টাকা করে নেওয়া হচ্ছে। তাছাড়া বেড়েছে শ্রমিকের মজুরি। ক্রেতাদের ভাষ্য, গতবারের চেয়ে এবার ৩০ শতাংশ বাড়তি দাম চাওয়া হচ্ছে। তাই গরু ও অন্যান্য কুরবানির পশুর দাম বৃদ্ধি মধ্যবিত্ত ও নিম্নমধ্যবিত্ত কুরবানি দাতাদের ওপর কিছুটা আর্থিক চাপ সৃষ্টি করবে।
সরকারি তথ্যানুযায়ী, ২০১৩-১৪ অর্থবছরে গরু, মহিষ, ছাগল ও ভেড়া মিলে দেশে গবাদিপশুর সংখ্যা ছিল ৫ কোটি ৩৫ লাখ ৯০ হাজার। এগুলোর মধ্যে গরুর সংখ্যা ছিল ২ কোটি ৩৪ লাখ ৮৮ হাজার, মহিষ ১৪ লাখ ৫৭ হাজার, ছাগল ২ কোটি ৫৪ লাখ ৩৯ হাজার এবং ভেড়া ৩২ লাখ ৬ হাজার। ২০২০-২১ অর্থবছরে এসব গবাদিপশুর সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়ে দাঁড়ায় ৫ কোটি ৬৩ লাখ ৩০ হাজারে। ২০২০-২১ অর্থবছরে গরু, মহিষ, ছাগল ও ভেড়ার সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়ে দাঁড়ায় যথাক্রমে ২ কোটি ৪৫ লাখ ৫০ হাজার, ১৫ লাখ ১ হাজার, ২ কোটি ৬৬ লাখ, ৩৬ লাখ ৮০ হাজারে। বৃদ্ধির হার ৫ শতাংশের সামান্য বেশি। ২০১৫-১৬ অর্থবছরের বাজেট বক্তৃতায় তৎকালীন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত এ উপখাতের অগ্রগতিতে অসন্তোষ প্রকাশ করে বলেছিলেন, মাছের ক্ষেত্রে যে উন্নয়ন সম্ভব হচ্ছে, গবাদিপশুর ক্ষেত্রে তা মোটেই লক্ষণীয় নয়। মুরগি ও হাঁস পালনে কিছুটা অগ্রগতি হলেও চতুষ্পদ প্রাণীর মানোন্নয়ন ও সরবরাহে কোনো অগ্রগতি নেই। এমনকি তাদের খাদ্য সরবরাহ ব্যবস্থাও দুর্বল। দেশের জনগণের পুষ্টি চাহিদা বিবেচনায় চতুষ্পদ প্রাণিসম্পদ উন্নয়নে বিশেষ নজর প্রদান এবং বিভিন্ন পাইলট প্রকল্প গ্রহণের ওপর তিনি জোর দেন।
জনাব মুহিতের মন্তব্যের পর গবাদিপশুর উন্নয়নে সরকারের বিভিন্ন উদ্যোগ পরিলক্ষিত হয়। বাংলাদেশ অর্থনৈতিক সমীক্ষা ২০১৯ অনুযায়ী, গৃহীত কার্যক্রমের মধ্যে ছিল গবাদি প্রাণীর কৃত্রিম প্রজনন জোরদারকরণ, প্রতিরোধক টিকা ও চিকিৎসা প্রদান কার্যক্রম জোরদারকরণ এবং অবকাঠামোগত উন্নয়ন। আবুল মাল আবদুল মুহিত অর্থমন্ত্রী হিসাবে ১৯১৯-২০ অর্থবছরের বাজেট উপস্থাপনকালে তার শেষ বক্তৃতায় বলেছিলেন, প্রাণিসম্পদ, বিশেষত গরু ও ছাগল পালনে বাংলাদেশ এখন প্রায় স্বয়ংসম্পূর্ণ। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার ২০১৭ সালের প্রতিবেদন অনুযায়ী, বাংলাদেশ ছাগলের মাংস উৎপাদনে বিশ্বে চতুর্থ। বাংলাদেশ অর্থনৈতিক সমীক্ষা ২০২০ অনুযায়ী, প্রাণিসম্পদের উন্নয়নে গৃহীত সরকারি কর্মসূচিগুলোর মধ্যে ছিল জাত উন্নয়নের জন্য উৎপাদিত তরল ও হিমায়িত সিমেন দ্বারা কৃত্রিম প্রজনন কার্যক্রম সম্প্রসারণ, রোগ প্রতিরোধের জন্য টিকা উৎপাদন ও বিতরণ, গবাদিপশু ও হাঁস-মুরগির চিকিৎসাসেবা প্রদান, খামারিদের প্রশিক্ষণ প্রদান। ২০২০-২১ অর্থবছরের বাজেট বক্তৃতায় অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল বলেছিলেন, দেশ প্রাণিসম্পদ, বিশেষ করে গরু, ছাগল, হাঁস, মুরগি ইত্যাদি পালনে সাম্প্রতিক সময়ে অভূতপূর্ব অগ্রগতি সাধন করেছে। এ খাতে চলমান গবেষণা কার্যক্রম এই উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি অর্জনে অবদান রেখেছে। বাংলাদেশ অর্থনৈতিক সমীক্ষা ২০২৩-এ বলা হয়েছে, গত কয়েক বছরে গবাদিপশুর অবৈধ বাণিজ্য রোধের প্রত্যক্ষ প্রভাবে গবাদিপশু হৃষ্টপুষ্টকরণের বাণিজ্যিক উদ্যোগ ব্যাপকভাবে সম্প্রসারিত হয়েছে। ফলস্বরূপ, বাংলাদেশ মাংস উৎপাদনে স্বনির্ভরতা অর্জন করেছে।
কাঙ্ক্ষিত সাফল্য অর্জনে প্রাণিসম্পদ উপখাতকে কতিপয় চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হতে হচ্ছে। অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা (জুলাই ২০২০-জুন ২০২৫) অনুযায়ী চ্যালেঞ্জগুলো হলো-ক. কম উৎপাদনশীলতা : বাংলাদেশের প্রধান তিন ধরনের প্রাণিসম্পদের যথা-গরু, মহিষ, ছাগলের উৎপাদনশীলতা ভুটান, ভারত, নেপাল ও পাকিস্তানের মতো প্রতিবেশী দেশগুলোর তুলনায় উল্লেখযোগ্য পরিমাণে কম। খ. মানসম্মত ফিড ও তৃণজাতীয় খাদ্যের অপর্যাপ্ততা : প্রাকৃতিক পশু খাদ্যের ঘাটতি এবং প্রক্রিয়াজাত পশুখাদ্যের উচ্চমূল্য ছোট খামারিদের প্রাণিসম্পদ পালনের ক্ষেত্রে বড় প্রতিবন্ধকতা। প্রাকৃতিক তৃণজাতীয় খাদ্য উৎপাদনের জন্য জমির ঘাটতি, ফিড প্রাকৃতিক তৃণজাতীয় খাদ্য সরবরাহে মৌসুমি ওঠানামা, নিম্নমানের পশুখাদ্য এবং পশুপালনে দক্ষতার অভাব-এ সবই সমস্যাটিকে আরও প্রকট করে তুলছে। এ ছাড়া খাদ্যে ভেজাল ও বাণিজ্যিক পর্যায়ে অপর্যাপ্ত বা মান নিয়ন্ত্রণে কার্যকর তদারকির অভাব প্রক্রিয়াজাত পশুখাদ্যের বড় প্রতিবন্ধকতা, যার কারণে জনস্বাস্থ্য ও প্রাণিস্বাস্থ্য এবং পুষ্টি পরিস্থিতি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। গ. নতুন রোগের প্রাদুর্ভাব ও পুরোনো রোগের পুনঃসংক্রমণ : গবাদিপশু যেসব প্রধান রোগের শিকার হচ্ছে সেগুলো হলো অ্যানথ্রাক্স, হেমারজিক সেপ্টিসিমিয়া, ব্লাক কোয়াটার, খুরা রোগ ও মুখের রোগ। তাছাড়া গবাদিপশু বিভিন্ন প্রটোজোয়ান রোগ যেমন টক্সোপ্লাজমোসিস, অ্যামিবিয়াসিস এবং পরজীবী পোকামাকড়ের আক্রমণের শিকার হচ্ছে। ঘ. অপর্যাপ্ত ভেটেরিনারি সেবা ও প্রাণিস্বাস্থ্য : তৃণমূল পর্যায়ে, যেখানে মূলত গবাদিপশু লালনপালন করা হয়ে থাকে সেখানে কার্যকর ভেটেরিনারি সেবার অভাব রয়েছে। উদ্বেগ রয়েছে টিকার অপর্যাপ্ততা ও মান নিয়ে। রোগ নির্ণয়ের সুবিধা সীমিত ও এর জন্য দক্ষ জনবলের ঘাটতি রয়েছে। ঙ. সীমিত ঋণ সুবিধা : ক্ষুদ্র ও মাঝারি খামারগুলোর বিকাশের জন্য উল্লেখযোগ্য পরিমাণের বিনিয়োগ প্রয়োজন। কিন্তু গবাদিপশু পালনে নিয়োজিত ক্ষুদ্র চাষিদের ঋণ সুবিধা সীমিত, যা এসব উদ্যোক্তার ব্যবসা সম্প্রসারণে বড় বাধা।
প্রাণিসম্পদ উপখাতের কাঙ্ক্ষিত উন্নয়নে অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় কিছু কৌশল নির্ধারণ করা হয়েছে। এগুলোর মধ্যে রয়েছে-গবেষণার মাধ্যমে উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি; স্থানীয় জাতের সঙ্গে উপযুক্ত বিদেশি জাতের সংকরায়নের মাধ্যমে জাতের উন্নয়ন; ভেটেরিনারি সেবা সম্প্রসারণ; প্রণোদনার মাধ্যমে খামারিদের পশুসম্পদের উৎপাদন বৃদ্ধিতে উৎসাহিত করা। তাছাড়া সরকারের মধ্যমেয়াদি সামষ্টিক অর্থনৈতিক নীতি বিবৃতিতে (২০২২-২৩ থেকে ২০২৪-২৫) বলা হয়েছে, মধ্যমেয়াদে প্রাণিসম্পদের নতুন জাত উদ্ভাবন, উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি ও দক্ষ ব্যবস্থাপনায় অগ্রাধিকার দেওয়া হবে।
প্রাপ্ত তথ্য মোতাবেক, গরু-ছাগল-মহিষ-ভেড়া মিলে গবাদিপশু উৎপাদনে বর্তমানে বাংলাদেশের অবস্থান বিশ্বে ১২তম। এ প্রসঙ্গে বলতে চাই, ভারতীয় গরুর বাংলাদেশে প্রবেশে কড়াকড়ি আরোপ আমাদের জন্য আশীর্বাদে পরিণত হয়েছে। দেশ আজ শুধু ঈদুল আজহায় পশুর চাহিদা মেটাতে সক্ষম নয়, বরং বছরের অন্য সময়েও মাংসের চাহিদা মেটাতে সক্ষম। সরকারি তথ্য মোতাবেক, দেশ এখন মাংস উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণ। প্রাণিসম্পদের অধিকতর উন্নয়নে অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা এবং সরকারের মধ্যমেয়াদি সামষ্টিক অর্থনৈতিক নীতি বিবৃতিতে যেসব কৌশল নির্ধারণ করা হয়েছে, সেগুলোর পূর্ণ বাস্তবায়নের মধ্য দিয়ে গবাদিপশু উৎপাদনে বৈশ্বিক তালিকায় বাংলাদেশের অবস্থানের উন্নতি হোক-এটাই দেশবাসীর প্রত্যাশা।
আবদুল লতিফ মন্ডল : সাবেক সচিব, কলাম লেখক
latifm43@gmail.com